তারপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল - ঠিক এখান থেকেই গল্পটা শুরু হয়। কারণ তাহাদের মধ্যে একটা ছোট্ট খটকা ছিল। তবে যেমনটা হয়ে থাকে একটা দুটো খটকাকে কেউ পাত্তা দেয়না। খোদ ডারউইন সাহেবই বলে গেছেন - টিকিয়া থাকিতে হইলে তাল মিলাইয়া চলিতে হইবে। অগত্যা, সবাই চেষ্টা করে তাল মিলিয়ে চলতে। কিন্তু ছন্দপতন ঠিকই কানে বাজে।
সুখ ও শান্তির সংজ্ঞা তাহাদের কাছে আলাদা ছিল। তাতো হবেই। কারণ প্রত্যেকেই এক ও অদ্বিতীয়। সকলেই নিজের মতের প্রতিষ্ঠা চায়। কেবল সে হোক মানুষ, বাকিরা টিয়াপাখি। আর যে তা পারেনা সে একটি শব্দের উপর্যুপরি প্রয়োগে নিজেকে খুশি রাখার চেষ্টা করে - শব্দটা হইলো গিয়া মহত্ব।
যাই হোক একটা গল্প বলার কথা ছিল - তাহাদের গল্প। তারপর একদিন মেয়েটার মাথায় একটা ইচ্ছা জলের মত ঘুরে ঘুরে কথা বলতে শুরু করলো। "তোমার সঙ্গে আগে দেখা হলে আমি তোমার প্রেমে পড়ে যেতাম"। এই কথাটাই ছিল বোধহয়। ঠিক মনে নেই । ছেলেটার চোখ ছিল তীক্ষ।বাঙ্ময় কিন্তু গোপন। মেয়েটাকে খেলায় পেয়ে বসলো। আচ্ছা নামের অভাব বোধ করছেন কি? নামে কিবা আসে যায়। অথবা হয়তো আসে যায়!!
খেলারাম খেলে যা। খেলা তো সবাই খেলে। আমি আপনার সঙ্গে খেলি, আপনি আমার সঙ্গে খেলেন। নিয়মগুলো বেঁধে দেয়া যদিও। আন্দাজের বাইরে নয়। তারপরও সবসময় একটা ছোট্ট ফাঁক ধাকে। সেই ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারলেই আপনি মানুষ আর বাকিরা টিয়াপাখি।
তারপর একদিন ছেলেটা মেয়েটাকে বললো "তোমার মত তো আর কাউকে দেখি নাই"। মেয়েটা এক সংখ্যাটা পেল। এক একটা অদ্ভূত সংখ্যা। আমিত্বকে ধারণকারী। পশ্চিমা কুশিক্ষার ফল, বুঝলেন। আধুনিক ব্যাক্তির অস্তিত্বের সংকট। স্রষ্টা তার কাছে মৃত। গজদন্ত মিনারে একা থাকে সে। বস্তাপঁচা বুলি আওড়ায় আর জীবনের মানে খোঁজে। আরে জীবনের আবার মানে কিরে ব্যাটা। জন্মিলে মরিতে হইবে। তো মৃত্যুর আগে রেখে যেতে হবে চিহ্ন। কিন্তু চিহ্ন না রাখলে ক্ষতি কি? আসলে কোনো ক্ষতি নাই। জীবনকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করার আরেক প্রয়াস। মানবজনমের কোনো কোনো সার্থকতা উৎপন্ন করতে না পারলে খালি খালি লাগবেনা? শূন্যতার ঘোড়ারোগ যদি একবার ঘাড়ে চাপে তবে কিন্তু মুশকিল। কেন্দ্র হারিয়ে যাবে।
আসলে আমি একটু বাঁচাল প্রকৃতির। নিজগুণে মার্জনা করবেন। প্রসঙ্গ থেকে বার বার দূরে সরে যাচ্ছি। তারপর মেয়েটা অবচেতন মনের তলকুঠুরী ঘাঁটতে শুরু করলো। কী? কী? কী? প্রতিধ্বনি শুনতে পেল। কী চায় সে? পরিতৃপ্তি জোটেনা কেন তার? সৃষ্টিশীলতা কি মানুষকে দেয় অপরিসীম ক্ষমতা নাকি সৌন্দর্য? নাকি সবই বানিয়ে তোলা কথা? প্রশ্নবোধক চিহ্ন কি বেশি হয়ে যাচ্ছে? আমিও মেয়েটাকে তাই বলেছিলাম।
প্রেম মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রেম শূন্যতাকে ফাঁকি দিতে সাহায্য করে। ফুলতোলা বাহারী চাদর যেমন পায়াভাঙ্গা টেবিলটাকেও সুন্দর করে ঠিক তেমনি। তাই প্রেমের নানা কঠিন, তরল ও বায়বীয় সংজ্ঞা এবং সমীকরণ আছে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে। তো মেয়েটা ছেলেটার প্রেমে পড়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। তবে বামপক্ষ = ডানপক্ষ না হলে তো আর প্রমাণিত হয়না। কাজেই নতুন নতুন সূত্রের আবির্ভাব। ছেলেটা তার বাঙ্ময় ও গোপন চোখে হাসে। দ্বন্দ্ব যেকোনো গতির জন্য জরুরী।
প্রেম বিষয়ে আরো কিছুক্ষণ কথা বলা যাক। ইতোমধ্যে মেয়েটাও চক্রাকার সময়ের গতিপ্রকৃতি বোঝার সুযোগ পাবে। প্রেম পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রভাবশালী হাতিয়ার বলে দাবী করেছেন এক গুণীজন। কারণ এটি তৈরি করে একটি খরচের নেটওয়ার্ক। যুক্তিটি অকাট তবে অকাট্য নয়। কারণ বিষয়টি এতো সাদা-কালো নয়। সাদা বা কালো কোনোটাই কিন্তু রং নয়। তারপরও আমরা এই উপমাটি ব্যবহার করি, কারণ আমাদের গোড়াতেই গলদ রয়েছে। মেয়েটাও এক সন্ধায় ভাবলো – বেশ তো ভাল লাগছে। সব মিথ্যে। সেটা ছিল এক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াই। কিন্তু সময়ের সাপ নিজের লেজ কামড়ে পড়ে থাকলে সব কিছু যে অনন্তের চক্রে বাঁধা পড়ে।
বোধ হচ্ছে সেই ধূসর অংশ যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র আর ভাষার ঠগী তার গলায় ফাঁস দিতে পারেনা। যদি আপনার সত্ত্বার ওপর থাকে নানা সুচিন্তিত মতের পলিমাটি, তবে ক্ষমতাসীন পক্ষের সাজিয়ে দেয়া বাগানে বাস করেন আপনি। অতএব, এরপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল – গল্পটা এখানেই শেষ হয়। কিন্তু যদি একটা “কিন্তু” থাকে সেখানে? বেহুলার সাজানো বাসরে সাপ ঢুকবেই। এবং তাকে ভাসতেই হবে অনন্তের স্রোতে। মেয়েটা ঠিক করলো তার উত্তর চাই।
ছেলেটা ছায়ার মত মধ্যাহ্নে দীর্ঘ, অপরাহ্নে খর্ব। শীতল ও অস্পষ্ট। আরামদায়ক কিন্তু রহস্যময়। সত্যের সূর্যের দিকে ওড়ার চেষ্টা করলেই ইকারাসের মোমের পাখা গলে যায়। মানুষ তুমি ওড়ো – বলা আছে পুরাণে। তবে তোমার গণ্ডি সীমিত। আর উড়ে কি লাভ তাহলে? আত্মা বিক্রি করে হলেও পরিপূর্ণ মুক্তি চেয়েছিল ফাউস্ট। মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কি পাপ?
পাপের সংজ্ঞা যুগে যুগে বদলায়। পাপ টিকে থাকে ডারউইন সাহেবের পরামর্শমত – পরিবর্তনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। হার মানায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীকেও। অতি পুরাতন পাপের বোঝা টানতে হয় উত্তর-আধুনিক মানুষকেও। “দ্য ওরিজিনাল সিন” – ইবলিশ শয়তানের আশা পুরাইয়া আদম – হাওয়া গন্ধম ফল খাইলেন। আল্লায় বানাইলো দুনিয়া। সৃষ্টি কি পাপ হতে পারে? আদি ও অকৃত্রিম পাপ তবে সৃষ্টির ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা। এখানেই দ্বন্দের শুরু।
ছেলেটা বললো – “আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার মতো” মেয়েটা বললো – “আমি জানি তুমি আমার মত নও।” স্বকীয় ও স্বতন্ত্র দুই অস্তিত্ব সংঘাতবিহীন এক গোলকের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে গেল। এরকমটা হওয়ার কথা নয়। কারণ তাদের কেন্দ্র পৃথক ছিল।
পৃথিবীর কেন্দ্র সূর্য। তাই পৃথিবীর উপর বসবাসকারী মানুষের ঘূর্ণনের জন্যও কেন্দ্রের প্রয়োজন। সাধারণত স্রষ্টা কেন্দ্রের অভাবটি পূরণ করে থাকেন। সুযোগভেদে সেই জায়গাটি নিতে পারে আদর্শ, তত্ত্ব কিংবা ক্ষমতা। তবে বাউল, ফকির ও সুফীরা বলে থাকেন মানুষের কেন্দ্র মানুষ। মানুষ ভজরে মন। সেটাই সবচেয়ে কঠিন – কারণ মানুষ দৃশ্যমান ও স্পর্শসীমার বাইরে নয়।
ছেলেটা অনেক প্রশ্ন করে? বিশ্বাসের শরীর প্রশ্ন দিয়ে গড়া। মেয়েটা উত্তর দিয়ে উত্তর খোঁজে। বিস্ময়বোধক চিহ্নটাই চোখে পড়ে বেশি। তর্ক ও তত্ত্বের বাইরে আছে কি কোন অনুভূতির অবস্থান? সোনারকাঠি-রূপোরকাঠির মত অবাস্তব? রূপকথার মত অলীক? সে সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা। কারণ সময়কে বাক্সবন্দী করতে পেরেছিল তারা – তাহারা হওয়ার পর। প্রবহমাণ সময়ের কয়েকটি মুহূর্ত ছুঁয়ে ফেলল তাহারা। মুহূতর্গুলো চেঁচালো, হুমকী দিল, ভয় দেখালো – কিন্তু হাতের ফাঁক গলে বেরুতে পারলোনা। অপরিসীম ক্ষমতাধর সময়ের কিছূ মুহূর্ত দুটো নচ্ছার মানুষের কাছে বন্দী হয়ে গেল।
ছেলেটা বললো - আমি তোমাকে ভালবাসতে চাইনা। মেয়েটা বললো : চিহ্নগুলো যে মুছে দিলেও রয়ে যায়।
- ধুলো দিয়ে ঢেকে দিলে কেমন হয়?
: মুহূর্তগুলোর তো বয়স বাড়েনা
- ভালোই মুশকিল তো
: তুমি চাঁদের মত মুক্তি চাও?
- আমি নৈ:শব্দ চাই
: সত্যকে দেখতে চাওনা?
- আমার সত্য সিন্দুকে তোলা আছে
: তবে তাই হোক
মেয়েটা প্রজাপতি হয়ে গেল।
হাজার বছর পরও নদীর জলে মানুষের ছায়া পড়বে। মানুষ ভালবাসবে নিজের ছায়াকে। কৌতুহলউদ্দীপক প্রজাপতি উড়ে যাবে। মানুষ দেখবে রং এর খেলা। তারপর ফিরে যাবে গতানুগতিক জীবনের স্থিতিতে। কারণ প্রজাপতিরা কখোনো বিপ্লব করে না।
---
মনামী
n.afrin[অ্যাট]live.com
মন্তব্য
বেশ মজা পেলুম!
অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নঃ আপনার বয়স কী ২০ নাকী ৩০ এর ঘরে? দৃশ্যপট কত আগের? ব্যাপ্তি কত সময়ের ছিলো?
(যদি দাবী করেন এটা গল্প তাহলে নিজেকে গুলি করবো!)
বয়স - ২০ ও ৩০ এর মাঝামাঝি। দৃশ্যপট - যে কোন সময়। ব্যাপ্তি - যে কোন সময়।
নিজেকে গুলি করুন - এটা একটা প্যাচাইল্লা গল্প।
ভিন্নস্বাদের। লিখে যান
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
কোন সন্দেহ নেই।
অসাধারণ লাগলো। আপনার লেখার স্টাইলটা দারুণ ভালো লাগলো... আমি আপনার নিয়মিত পাঠক হয়ে গেলাম...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
উদ্ধৃতি
সকলেই নিজের মতের প্রতিষ্ঠা চায়। কেবল সে হোক মানুষ, বাকিরা টিয়াপাখি।
তাই কি? একমত নই।
আপনি টিয়াপাখি নন, জেনে ভালো লাগলো।
গল্পের সূচনা আর স্টাইল আমাকে মুগ্ধ করেছিলো- কিন্তু এতো প্যাঁচিয়ে ফেললেন শেষে...
আমি আবার সহজ গদ্য ছাড়া বুঝি না কিছুই !!
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!
গল্প ভালো। ভাল গল্প কি না জানি না।
: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: ::: :
'Cinema is over' - Master Godard
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ভালো লাগলো।
- বিরাট কঠিন লেখারে ভাই। আরেকটু সহজ করে লেখা যায় না! এইটা একটা প্লিজ আরকি!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নতুনত্ব আছে। সচলে স্বাগতম।
**************************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
আপনার তো নিজের অ্যাকাউন্টই আছে মনে হচ্ছে। অতিথি লেখকের অ্যাকাউন্ট আর ব্যবহারের প্রয়োজন নেই তাহলে।
লেখা চলুক।
বাঃ, লেখাটা তো বেশ!
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সবাইকে ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন