পাচ গাও এর ইতিহাস.........

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২৮/০৯/২০০৯ - ১২:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাচ গাও এর ইতিহাস.........
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার একটি গ্রাম পাচ গাও। দেশ বিদেশে সব জায়গায় দূর্গা মূর্তির রং একই রকম হলেও এখানকার দূর্গা মূর্তিটি লাল বর্ণের্। এবং এর একটি বিশেষ ইতিহাস আছে। এই পাচ গাও এর ইতিহাসটি লিখেছিলেন স্বর্গীয় হরিনারায়ন ভট্টাচার্য্য। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল শাশ্বতী নামক একটি শারদীয় প্রকাশনায়। এবার বেরিয়েছে এটার ষোড়শ সংখ্যা। স্বর্গীয় হরিনারায়ন ভট্টাচার্য্য-এর লেখা থেকে প্রয়োজনীয় ইতিহাসটুকু আমি এখানে তুলে দিলাম। তথ্যগুলো কতটুকু ঠিক তা এখন আর কেউই মনে হয় বলতে পারবেন না। কিন্তু লোকমুখে এই রকমই শোনা যায়।
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
পাচ গাও
প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গ্রাম পাচ গাও। সেই পাচ গাও গ্রামে সর্বানন্দ দাস নামক একজন সাধকের দুর্গামণ্ডপে মহাদেবী দুর্গার স্থায়ী অধিষ্ঠান হয়েছিল। সর্বত্র ভগবতী দেবী অতসী পুষ্প স্বর্ণাভ কিন্তু পাচগাও এর দুর্গাদেবী লোহিত (লাল) বর্ণা।

প্রায় তিন শত বছর আগে সর্বানন্দ দাস তখনকার সরকারের অধীনে মুন্সি পদবীতে সমাহীন ছিলেন। তার কর্মস্থল ছিল আসামের শিবসাগর জেলায়। সেখানে কর্মতাবস্থায় একবার শারদীয় দুর্গাপূজার সময় তিনি কামাখ্যাধামে কুমারীপূজা করবার মনস্থ করেন এবং নিজের বাড়িতে যথাবিহীত পূজা সম্পন্ন করবার জন্য তার স্ত্রী ও কর্মচারীগণকে নির্দেশ দেন।

বংশ পরাস্পরায় কথিত আছে যে, সর্বানন্দ দাস কামাখ্যাধামে উপস্থিত হয়ে কুমারীপূজা করার অভিলাষ ব্যক্ত করেন। মন্দিরের সেবায়েতের সহায়তায় তিনি পঞ্চবর্ষীয়া কুমারী নির্বাচন করেন। মহাষ্ঠমীদিন কুমারীকে আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে স্বয়ং ভগবতীজ্ঞানে পূজা চলতে লাগলো। প্রায় ছয় ঘন্টা ধরে পূজা অনুষ্ঠিত হলো। পূজা শেষ হবার পর ভগবতীকে প্রণাম করার পর এক অর্ভতপূর্ব দৃশ্য দেখা গেলো। কুমারীর গায়ের বর্ণ পরিবর্তন হয়ে লাল বর্ণ হয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখার পর সর্বানন্দ দাস ভগবতীকে জিজ্ঞেস করলেন- “মা আমার পূজা সুপ্রসন্ন হয়েছে কি?”
উত্তরে ভগবতী বললেন “হ্যা তোর পূজা সিদ্ধ হয়েছে। এই বর্ণে তোর গ্রামে (পাচগাও) আর্বিভূত হয়েছিলাম। এখন থেকে তুই ভগবতীকে লাল বর্ণে পূজা করবে।“
তখন সর্বানন্দ দাস জিজ্ঞেস করলেন্- “তুমি যে এই রূপে আমার বাড়িতে আর্বিভূতা হয়েছিল তার প্রমাণ কী?”
উত্তরে কুমারী দেবী বললেন- “তোর দুর্গামণ্ডপের বেড়ার উপর হাতে ছাপ রেখে এসেছি। তোর পূজায় আমি খুব সন্তুষ্ঠ হয়েছি, তুই বর প্রার্থনা কর।“
তখন সর্বানন্দ দাস বলেলেন- “ভগবতীর শ্রীপাদপদ্ম পাওয়াই আমার একমাত্র কাম্য।“
তবুও ভগবতী বর চাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ী করতে লাগলেন, তখন বাধ্য হয়ে সর্বানন্দ দাস ভগবতীকে বললেন- “মা তুমি যদি একান্তই আমাকে বর দিতে চাও, তবে আমি এই বরই প্রার্থনা করি যে তুমি স্থায়ীভাবে আমার পাচগাও এর দূর্গামণ্ডপে অধিষ্ঠিতা থাকবে।“ ভগবতী “তথাস্তু” বলে তার নিজের মাথার সোনার সিথি খুলে সর্বানন্দ দাস এর হাতে দেন এবং প্রতি বছর মহাস্নানের সময় এই সিথি দ্বারা স্নান করাবার নির্দেশ দেন। তারপর সর্বানন্দ দাস মাকে প্রণাম করে কামাখ্যাধাম থেকে বাড়িতে চলে আসেন। বাড়িতে আসবার পর সর্বানন্দ দাস দূর্গামণ্ডপে খুজে দেখেন যে সত্যই বেড়ার উপর দেবীর হাতের ছাপ দেখা যাচ্ছে।

পরবর্তী বছর নিজ বাড়ি পাচগাও এ সর্বানন্দ দাস শারদীয় পূজার আয়োজন করেন। কামাখ্যাধামে দেবীর আদেশ অনুয়ায়ী মাতৃমূর্তিকে কুমারীর গায়ের সেই লাল বর্ণের সাথে সাদৃশ্য করে লালবর্ণে রঞ্জিত করেন। কিন্তু লালবর্ণের দূর্গা নির্মিত করার জন্য গ্রামবাসীরা ইহা শাস্ত্র বিরোধী বলে সকলে একবাক্যে অভিমত দেন এবং সর্বানন্দ দাসকে অশাস্ত্রীয় কাজ হতে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করেন। তখন সর্বানন্দ তার কামাখ্যাধামে দেখা অভিজ্ঞতার কথা বলেন। কিন্তু এটাকেও নিছক মনগড়া ও পাগলামি বলে সকলে সিদ্ধান্ত নেন। গুরু পুরহিত জ্ঞাতিবর্গ কেউই পূজায় যোগদান করবেন না বলে জানান।

সে বছর ষষ্ঠীদিন রাত পর্যন্ত কেউই পূজামণ্ডপে আসেন নি। পুরোহিতের অভাবে দেবীর বোধন সম্পন্ন হয়নি। সর্বানন্দ পাগলের মতো দেবীকে ডাকতে লাগলেন। রাত শেষ হওয়ার সময় চলে আসছে প্রায়, এমন সময় গুরু পুরোহিত জ্ঞাতিবর্গ ও গ্রামবাসী সকলে পূজামণ্ডপে এসে জানালো যে ভগবতী লালবর্ণে পূজিত হবেন বলে তাহারা স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন এবং সর্বানন্দ দাস এর অন্য জ্ঞাতিবাড়িতেও ভগবতীকে এই লালবর্ণে পূজা করতে হবে বলে স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন। ভোর হওয়ার সময় শঙ্খ, ঢাক, ঢোল, ঘণ্টার আওয়াজে চর্তুদিক মুখরিত। মহাসপ্তমীর পূজা মহাসমারোহে আরম্ভ হলো। এই বছর পূজায় সমারোহের সীমা রইল না। পরবর্তী বছর হতে সর্বানন্দের অপর জ্ঞাতিবাড়িতেও ভগবতী এই লালবর্ণে পূজিত হতে লাগলেন। বর্তমানে একমাত্র সর্বানন্দ দাস এর দূর্গামণ্ডপেই ভগবতী লালবর্ণে পূজিত হচ্ছেন।

দুই তিন বছর পর সর্বানন্দ কামাখ্যাধামে আবার গিয়ে কুমারী পূজা করেন এবং গত দুই তিন বছর তার বাড়িতে পূজা সুষ্ঠুভাবে হয়েছে কি না জানতে চান। উত্তরে কুমারী বলেন গত বছর নবমী দিন যে শাড়িখানা দুর্গাকে দেয়া হয়েছিল তা ছেড়া ছিল এবং পরিবারের গৃহিনীর শাড়ির চেয়ে নিম্নমানের ছিল। তখন সর্বানন্দ দেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরে খবর নিয়ে দেখা যায় সত্যই শাড়িখানা ছেড়া ও নিম্নমানের ছিল।

সর্বানন্দ দাস ১০৮ চণ্ডীপাঠ, দশহাজার হোম ও পূজার অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করার জন্য গুরু, পুরোহিত, প্রতিমা গঠক ও পূজার সামগ্রী প্রস্তুতকারীদের জন্য পৃথক পৃথকভাবে ভূমি প্রদান করেছিলেন। সর্বানন্দ দাস দেবীর সেবা কার্যাদি সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য তার মৃত্যুর পূর্বে তার পূত্র কমলচরণ বাবুকে একটি নির্দেশনামা দিয়ে যান। কমলচরণ বাবু তার পুত্র কালীকিশোর বাবু এবং কালীকিশোর বাবু তার পূত্র কালীপদ বাবুকে অনুরূপ একটি নির্দেশনামা লিপিবদ্ধ করে দেন।

কমলচরণ বাবুর আমলেও যথাবিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। একবার দশমীর দিনে দূর্গা বির্সজনের সময ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষেতের মালিক জনৈক পাল বাবু কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন। কমলচরণ বাবু সদলবলে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তখন মহুকুমা প্রশাসক ছিলেন একজন ইংরেজ সাহেব্। তিনি নিজে পরিদর্শনে আসেন এবং রায় দেন যে উক্ত স্থান ব্যতিত প্রতিমা বিসর্জন করার বিকল্প কোন স্থান নেই। কথিত আছে যে যেগুলো ধান ক্ষতিগ্রস্থ হতো সংগ্রহ করার সময় সেই জায়গায় ফসল বেশিই পাওয়া যেত।

কমলচরণ বাবুর পুত্র কালীচরণ বাবুর আমলে একবার কাঠাম (মূর্তি) ছোট করে আধুনিক ধাচে ঢাকাইয়া কারিগর দ্বারা নির্মান করা হয়েছিল। সে বছরই মহাষ্ঠমীদিনে কালীপদ বাবু হঠাত অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং এমন অবস্থা হয় যে তাহার অন্তিম সময় চলে এসেছে। তখন কুলগুরু রোহিনী ভট্টচার্য্য সবেমাত্র সম্পন্ন মহাস্নান হাতে নিয়ে ভগবতীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং রোগীর কাছে এসে রোগীর মুখে মহাস্নান দেন। এক ঘণ্টার মধ্যে কালীপদ বাবুর জ্ঞান ফিরে আসে এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন। এই ঘটনার পর থেকে সর্বানন্দ দাসের উত্তরাধিকারীরা কাঠামোর পরিমাপ, সনাতনী ভঙ্গী বা রূপ পরিবর্তন করার সাহসী হন নি। প্রতি বছরই ভগবতী আগের বছরের রূপে দৃষ্ট হন। বিন্দুমাত্রও এটার ব্যাতিক্রম হয় না। ইহাও অলৌকিক ব্যাপার।

১৩৬২ বাংলার ১লা বৈশাখ হতে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়, তখন পূজার আড়ম্বর কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সর্বানন্দ দাস মণ্ডপের সামনে একটি গর্ত করে গিয়েছিলেন। প্রতি বছর প্রতিমা নির্মাণের জন্য মালাকাররা এতে অক্ষয়তৃতীয়া দিনে মাটি এনে রাখত। এখনও মাটি এনে রাখা হচ্ছে। প্রতিমা গঠন থেকে আরম্ভ করে পূজার যাবতীয় কার্যাদি আগের সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিগণ বংশাক্রমিকভাবেই পালন করছেন। এ ব্যাপারে কোন প্রকার পারিশ্রমিক গ্রহন করতে তারা অনিচ্ছুক। জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর দূর্গাপূজা ভিতর বাড়িতে সম্পন্ন করবার সিদ্ধান্ত নেযা হয়, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মীরা সমবেত হয়ে জানান যে, তারা যথারীতি পূজার যাবতীয় কার্যাদি আগের মতো চালিয়ে যাবেন।

জমিদারী আয় কমে যাওয়ায় কালিপদ বাবুর বড় ছেলে সুধাময় বাবু মহিষবলি বন্ধ করবার প্রস্তাব দেন। পূজার ২/৩ পূর্বে তার মা শান্তিবাবুকে বলেন যে গতকাল রাতে তার ঘুম হয়নি, খুব অশান্তিতে রাত কেটেছে, কাজেই মহিষবলি বাদ দেয়া যাবে না। এই সময় কৈলাস ঘোষ নামের একজন ধর্মপ্রাণ ব্যাক্তি অযাচিতভাবে দুইশ টাকা মহিষ কেনার জন্য পাঠিয়ে দেন। এই দিকে স্নেহময় বাবুও স্বপ্ন দেখেন যে, মহিষবলি দিচ্ছেন। কাজেই মহিষবলি বন্ধ হলো না। এখনও প্রতিবছর কয়েকশত পাঠা ও একাধিক মহিষবলি হয়। বহু লোক কাপড়, স্বর্ণালঙ্কার ইত্যাদি নানাবিধ উপচার দেবীকে দিতে লাগলো এবং লোকসমাগম দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগলো। ঠিক এই ভাবে ১৩৭৭ বাংলা পর্যন্ত চললো। ১৩৭৭ বাংলার শেষ দিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলো। তখন দেবীর ৮০ ভরি ওজনের রূপার মুকুট, রূপার চরণপদ্ম, সোনার নোলক, আংটি সহ সবই লুণ্ঠিত হয়। কেবলমাত্র কুমারীর মাথার সোনার সিথিটা রক্ষা পায়্। যে লোকটি মুকুট নিয়েছিল, তার পরবর্তী সময় মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে মারা যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শান্তিবাবু সেই সোনার সিথিটি তাদের কুলপুরহিত স্বর্গীয় রাজীব ভট্টাচার্য্যের কাছে রেখে ভারতে চলে যান। রাজীব ভট্টাচার্য্যের অস্থাবর সম্পত্তি সংগ্রামের সময় নষ্ট হয়ে গেলেও তিনি সেই সিথিটা প্রাণের চেয়েও বড় মনে করে রক্ষা করেছেন এবং দেশে ফেরার পর শান্তিবাবুকে তা সমজাইয়া দেন। শান্তিবাবুর বাড়িঘর পাক সৈন্যরা পুড়িয়ে দিলেও বহু চেষ্ঠা করেও দূর্গামণ্ডপটি পুড়াতে পারেনি।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাচগাওয়ে ছিয়াত্তর জনকে হত্যা করা হয়। সমস্ত গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়। সেই বছর পূজা অনুষ্ঠিত হয় নি। তবে ঐ গ্রামের মণ্ডপ সংলগ্ন বাড়ির পরেশ চন্দ্র নাথ মণ্ডপ ঘরে একটি ঘট বসিয়ে ফুল বেলপাতা দিয়ে মাকে অর্চনা করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার ১৩৭৯ বাংলা থেকে মায়ের পূজা আগের মতো অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৩৭৮ বাংলায় পাচগাও ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা স্বেচ্ছাপ্রণেদিতভাবে মিলিত হন এবং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন যে, জনসাধারণের কাছ থেকে চাদা তুলে দূর্গামন্ডপ পাকা করে স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হবে।

দেশের অন্যান্য স্থান ও দেশের বাইরে থেকে পরিবারের সবাই পূজার সময় এসে পূজায় যোগদান করেন। বর্তমানে শান্তিবাবুর পুত্র সঞ্জয় দাশ পূজাদি কার্যের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহন করেছেন। বংশপরাস্পরায় এখনও কুমারীর দেয়া সোনার সিথিটি উনাদের কাছে আছে এবং এটি দিয়ে স্নান করানো হয়। বর্তমানে পুরনো মন্দির ভেঙ্গে নতুন মন্দির স্থাপনা করা হয়েছে।

নীচে পাচ গাও এর দেবীর ১ টা ছবি সংযুক্ত করে দিলাম।

শান্ত


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।