‘লইয়া যাইন মাই।
ডাইন আতঅ (হাতে) বান্-বা, গলাত্ বান্-বা।
আর কুনু জা’গাত্ বান্ধইন না-জান।
ড্যাগঅ ছুয়াইয়া পিন্-বা।
লইন বইন, লইন বাই (ভাই), আশা ফুরন(পুরণ) অইবো, বরকত পাইবা........’ -
মাথায় সাদা টুপি, প্যান্ট আর পাঞ্জাবী পরনে। গলার সুর আকৃষ্ট করে মানুষগুলোকে। ওদের মন তখন সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুর মতোন নড়বড়ে কিংবা পদ্মপাতার টলটলে জলকণা। আঁকড়ে ধরতে চায় বিশ্বাসের খুঁটি, গহীন অতল হাঁতড়ে খুঁজে ফিরে দৃঢ় প্রত্যয়। সফিউল্লাহ জানে সেকথা। এ সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে কেটে গেছে তার ত্রিশটি বছর।
এরা কেউ হয়ত এসেছে জীবনে এই প্রথমবার, কেউ কেউ দ্বিতীয়বার, শহরে যাদের বাস তাদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ‘চার/পাঁচ বার’ এ গিয়ে ঠেকবে। কিন্তু সফিউল্লাহ এখানে আসে প্রত্যহ। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা এখানেই কাটে ওর; সিঁড়ির নীচে দাঁড়িযে লাল-হলুদ সুতোয় পাকানো বিশ্বাস ফেরী করে করে। যত বেশি আহাজারী, তত বেশি দূর্বলতা, তত বেশি সুবিধে। কেউ কেউ চোখের পানি মুছতে মুছতে সিঁড়ি ভাঙে, তখন সফিউল্লাহ জানে সুতো তার বিক্রি হবেই। অনেকে অবশ্য কর্ণপাতও করেনা ওর কথায়। তবে এদের সংখ্যা কম।
কেউ কেউ শুধু একঝলক দেখতে আসে বাবা শাহপরান’র মাজার, এসব মানুষ এহেন জিনিস নেই যা একবার চেখে দেখেনা। ওইযে কমিরুদ্দিনের মা- গুটিকতক ডালপালা, শেকড়-বাকড় নিয়ে বসেছে, জমির বসেছে রত্ন-পাথর আংটিতে লাগিয়ে দিতে- ওসবও নিয়ে যায় এরা। কাজে লাগুক বা না লাগুক।
নেকাবপরা তরূণী যেমন ভয় আর শ্রদ্ধায় সেজদাহ্ দিতে আসে; ঠিক তেমনি সিঁদুররাঙা কোন বধূও মাথা ঠেকিয়ে যায় একবার। গুটিকতক সিঁড়ি পেরিয়ে নামাজ আর প্রণতির স্থান একই জায়গায় এসে মিশেছে। আরও কিছু সিঁড়ি ডিঙিয়ে পৌঁছুতে হয় মূল কবরস্থলে। একটা প্রস্তরখন্ড প্রশান্তির আধার হয়ে ধরা দেয় মনস্তাত্বিক কারনে। যুগ-যুগান্তরের বিশ্বাসের বীজ ধারণ করে কিছু মানবসন্তান।
মূল কবরের কাছে যাওয়ার অধিকার মেয়েদের দেওয়া হয়নি, ভক্তি-শ্রদ্ধা পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম না থাকা সত্ত্বেও ওটুকু নিষিদ্ধ। তাই নামাজ-ঘর এর দেয়ালে ঝুলন্ত মূল কবরের প্রতিচ্ছবিতে পরম ভক্তিতে মাথা ঠেকিয়ে কেউ কেউ গ্রিলে বেঁধে দেয় লাল-হলুদ মোটা সুতো। কেউ বাঁধে হাতে কিংবা গলায়।
এই এখানটায় সফিউল্লাহকে আসতে হয় কিছুক্ষণ পর পর। গ্রিলে আবদ্ধ বিশ্বাসের গিটবন্ধন খুলতে, হাতে থাকে পুরনো জংধরা এন্টিকাটার, তারপর হাত ঘুরে সে সুতোয় আবার ভরে ওঠে গ্রিলের খাপগুলো। অভ্যস্ত হাতে ঝটপট সুতো খুলতে খুলতে চোখে পড়ে কারও বিষাদগ্রস্ত মলিন চোখদুটো, কারও আনন্দাশ্রু। কোন নবজাতককে দুহাতে তুলে মা ছুঁইয়ে দেন ওর তুলতুলে মুখখানি প্রস্তরখন্ডের ছবিটায়, হয়ত ‘মানত’ কোল আলো করে এসেছে তার। আশির্দ্ধো বৃদ্ধার ন্যুজ্ব দেহ আরও বেঁকে যায় প্রবল কান্নার ঢল সামলাতে, এক জীবনের চাওয়াগুলো ক্রান্তিলগ্নেও হাতছানি দেয় বুঝি।
সফিউল্লাহর জীবনে এমন কোন মানত পূরণের ইতিহাস নেই। প্রতিটা জীবন ইতিহাস, একেকটা জীবন শেষে রচিত হয় নতুন নতুন ইতিকথা। একেক ইতিকথা ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় ভাস্বর। কবিগান, মদ, আড্ডায়- বাবার ইতিহাস ভরপুর। ঠিক তেমনি মা’র ইতিহাসের পাতাগুলো দৈন্যতা, সংসারের চুলো জ্বালানোর চিন্তা আর বাবাকে গৃহী করার মানত-এ মানত-এ পরিপূর্ণ। কতজনের দুয়ারে গিয়েছিলেন, সংখ্যাটা মা নিজে জানতেন কি? ৩৬০ জনের ঠিক কতজনের কাছে ছন্নছাড়া-ভবঘুরে বাবাকে পাওয়ার বাসনার কথা জানিয়েছিলেন মা? সফিউল্লাহর জানা হয়না। কত শক্তি ‘মানত’এ- তাও জানা হয়নি কোনদিন।
যেদিন অন্য কারও ঘর করে বাবা, আর মা যেদিন কুষ্ঠরোগের পচনে ভনভন করতে থাকা মাছি তাড়াতে তাড়াতে মৃত্যুকামনা করে - সেদিনও সফিউল্লাহর কোন মানত ছিলনা কারও কাছে, কারও দ্বারে। শুধু জানার ছিল কি করে বেঁচে থাকা যাবে, সম্বল কি হবে। মাজার সম্বল দিল- প্রথমে কয়েক প্যাকেট মোমবাতি, ওটার প্রাপ্তিস্থান প্রচুর। তাই এখন এই লাল-হলুদ সুতো।
আযানের সুর ভেসে আসে। নামাযের তাড়া, পুণ্য অর্জনের ব্যাকুলতায় হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকে দল-দল মানুষেরা। সফিউল্লাহর সে তাড়া নেই। আরও কয়েকজনের নেই, এই যেমন কলিমুদ্দিনের মা’র। কিংবা সফরের - যে সাদা থানে নিজেকে আবৃত করে হাতে লোটা নিয়ে ঘুরে। আর হুটহাট পথরোধ করে গুরুগম্ভীর গলায় কোন এক ভবিষ্যৎবাণী শোনায় ‘বাবা’র ভক্তদের। লাল-থান চোখ-রক্তবর্ণ হরিপদও তাই করে। ওদের লক্ষ্যবস্তু ষোড়শী তরুণীরা, আতঙ্কিত ললনাদের ভ্যানিটিব্যাগ থেকে ভাল পয়সা খসানোর সুনাম আছে ওদের। আর কলিমুদ্দিনের মা’র চোখ বয়স্ক-মধ্যবয়স্কদের প্রতি; বাতের ব্যাথা, হৃদযন্ত্রের শ্লথক্রিয়া কাবু করেছে যাদের।
সফিউল্লাহ বিষন্ন চোখে তাকায় ‘দড়ি পাগলী’র দিকে। কোন এক কালে ওর একটা নাম ছিল। এখন শুধু দড়ি-পাগলী। ‘শাহ পরান’র পাশেই ‘কদ্রিছ শাহ/কন্যা শাহ’ মাজার। ওখান থেকে হাসতে হাসতে এলোমেলো কথার খই ফুটিয়ে বেরিয়ে আসছে দড়ি-পাগলী। ওর দিকে তাকালেই আবেদনময় নারীখোপার বদলে রাজ্যের দড়ি, রশি, ফিতে-গোঁজা এক দঙ্গল জঞ্জাল চোখে পড়ে।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে ধূপ-ধুনো নিয়ে এই আঙিনায় বসে পড়ে কালিয়া। স্নিগ্ধ গোধূলির আলো ছড়িয়ে যায় পুকুরের শান্ত জলে।
এখন প্রান্তর কিছুটা নীরব, মাগরিবের এই ক্ষণটুকু পেরোলে বেশ জমে উঠবে এই হাট আবার। জীবন ঘিরে হাট, মসজিদ-মন্দির ঘিরে হাট, শুধু দেনা-পাওনা আর হিসেব-নিকেষ।
সফিউল্লাহর মনে পড়ে, আসর শেষে মদে ডুবে বাড়ি ফিরলে মা’র ঝাঁজের উত্তরে বাবা বলতেন- ‘ই আটত্(হাটে) আর থাকতামনায়, অত দায়-দেনা বালালাগেরনা আর।’
তবে কি বাবার কাছে ওই সংসারটা একটা হাট ছিল, নাকি জীবনটা।
আরও অনেক কথার মতন এই কথাটিও জানা হয়নি সফিউল্লাহর......
----------------------------------------------------------------------
মন্তব্য
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
অসংখ্য ধন্যবাদ
গল্পটা কি একটু আগেই শেষ হলো! মনে হচ্ছে, আরো কী কী যেন বলার ছিল।
হুম, জীবনে অনেক প্রশ্নেরই তো উত্তর মেলে না! জীবন এমনই।
................................................................................................
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।
হুম...... জীবন এমনই...........
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, ভালো থাকুন
গল্পটা পড়লাম মউ । আপনার আর সব গদ্যের ( গল্পের ) মতোই এই গল্পেরও ভাষাভঙ্গি, নির্মাণে পরিশ্রমের ছাপ । ভালো লাগলো । ভালো লাগলো এটাও যে, আপনি ঠিকই বুঝে গেছেন, গল্প মানেই আর কিচ্ছা কাহিনী না, অন্যকিছু । কিন্তু তার জন্য আরো আরো বিস্তার ( দৈর্ঘ্য না ) আশা করি পাঠক হিসেবে ।
সব চেয়ে ভালো লাগলো সংলাপে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারে আপনার সাহসিকতা ! কি এক অদ্ভুত কারণে আমাদের অঞ্চলের কথাকর্মীদের ধারণা হয়েছে সিলেটি শব্দ সাহিত্যোপযোগী না !
এমন কি আপনার প্রিয় নিপু আংকেল ও এই বিষয়ে একমত !!!
আপনাকে অভিনন্দন মউ ।
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
এমন কি আপনার প্রিয় নিপু আংকেল ও এই বিষয়ে একমত
মানতে পারলাম না। নিপু ভাইয়ের গল্পে যে সিলেট (আঞ্চলিক) এর ভাষা থাকে না তা তো নয়।
_____________________________________________
তুমি হতে পারো একটি স্বার্থক বিষাদের সংজ্ঞা। স্বার্থক নদী, স্বার্থক ক্লান্তি অথবা স্বার্থক স্বপ্ন।
____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
“তোমরার বীররে দেখছোনি ভাই!”-(ভূমিপুত্র অথবা হাওরপুরাণ, পৃ.৫৯)
নিপু আংকেল এর কিছু গল্পে এরকম অনেক সংলাপ আছে যা সিলেটী উপভাষার কাছাকাছি।
প্রথমেই জানিয়ে রাখি আপনার মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগছে।
সিলেটি উপভাষাকে আমি যথেষ্ট সমৃদ্ধ হিসেবেই বিবেচনা করি ব্যক্তিগতভাবে। সিলেটী আঞ্চলিক শব্দগুলোকে বৈচিত্র্যময় মনে হয় আমার কাছে। আর নিপু আংকেল-এর লেখায় সিলেটি উপভাষিক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করেছি। এই যেমন :
“.... আগে এমন খাড়ি সেচলে ভার দিয়ে মাছ নিতে হইত। কুটুম খেশ কারে না মাছ দিছি....।”(বুড়ি চাঁদ ডুবে যাবার পরে- পৃ ৫০)
এখানে ‘খাড়ি’এবং ‘কুটুম খেশ’ শব্দটি সিলেটী। এই বইয়ে তিনি ‘জিওল মাছ’ শব্দটিও ব্যবহার করেছেন।
পরামর্শ এবং মতামতের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন...
প্রথমেই জানিয়ে রাখি আপনার মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগছে।
সিলেটি উপভাষাকে আমি যথেষ্ট সমৃদ্ধ হিসেবেই বিবেচনা করি ব্যক্তিগতভাবে। সিলেটী আঞ্চলিক শব্দগুলোকে বৈচিত্র্যময় মনে হয় আমার কাছে। আর নিপু আংকেল-এর লেখায় সিলেটি উপভাষিক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করেছি। এই যেমন :
“.... আগে এমন খাড়ি সেচলে ভার দিয়ে মাছ নিতে হইত। কুটুম খেশ কারে না মাছ দিছি....।”(বুড়ি চাঁদ ডুবে যাবার পরে- পৃ ৫০)
এখানে ‘খাড়ি’এবং ‘কুটুম খেশ’ শব্দটি সিলেটী। এই বইয়ে তিনি ‘জিওল মাছ’ শব্দটিও ব্যবহার করেছেন।
পরামর্শ এবং মতামতের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন...
(বি.দ্র: সুপান্থদা, আমি জবাব-এ ক্লিক করেই মন্তব্যটি লিখেছিলাম। কিন্তু নিচে কি করে গেল বুঝলামনা সেজন্য আবার দিলেম।)
মউ, ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে!!! ব্যস্ততার জন্য সব সময় FaceBook এ আসা হয়না. আরো ভালো লিখো দোয়া করি.
ভালো লাগার কথা জেনে ভালো লাগলো
শুভেচ্ছা রইলো।
ভালো লেগেছে। তবে পড়তে পড়তে শেষে এসে মনে হলো একটু হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেলো না ! আরো কিছু কী বলার ছিলো !
আপনার আরো আরো গল্প আসুক সচলায়তনে।
পাঠপ্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
গল্প প্রত্যাশা করছেন জেনে ভালো লাগলো। ভালো থাকুন
দারুণ লাগল
জেনে ভালো লাগলো অতন্দ্র প্রহরী,
ধন্যবাদ, ভালো থাকুন
নতুন মন্তব্য করুন