নীল টিপ নৌকোর পাটাতনে বসে জল ছুঁয়ে খেলছে। ঘাসফড়িং এর কাছ থেকে সবুজ ধার করেছে ওর মন। সাদা শার্ট এতোটা দক্ষভাবে নৌকা বাইতে পারবে জানা ছিলনা ওর।
নীল টিপ - তোমায় বেশ লাগছে। জ্যোৎস্না মিশে গেছে তোমার শরীরে, শার্টের বুননে।
সাদা শার্ট - নদীটা ভীষণ প্রিয়। ওর সাথে আমার অনেকদিনের প্রেম। ওকে তুমি ঈর্ষা করছোনাতো?
নীল টিপের অধরে মাতাল হাসি ভর করে। বৈঠা ছেড়ে নীল টিপের কোলে মাথা রাখে সাদা শার্ট। শান্ত নদীতে দুরন্ত নৌকো ভাসতে থাকে; জল আর নৌকো গড়াগড়ি খায় একে অপরকে স্পর্শ করে।
নদী ‘সীমানা’র অর্থ বোঝেনি কোন কালে। কোন শতবর্ষী গাছের ঝরা পাতা, দুরন্ত বালিকা-হাতের ভাঙা চুড়ি অথবা দস্যিছেলের ভাসানো কাগজের নৌকা ঢেউয়ে ডেউয়ে ভ্রমণ করে শ্বাশতকাল ধরে। নদীপাড়ের বালকেরা শৈশব-কৈশোর-যৌবনের আবর্তনে ঘুরপাক খায় নদীর মোহে আচ্ছন্ন সময়ের সমষ্টিতে।
নদী খেলার সাথী, নদী ষোড়শীর উচ্ছ্বলতা আর পরিণতকালে সেই নদী কামুক নারীরূপে ধরা দেয় কাব্যে-গদ্যে নিঃসঙ্গ প্রহরে। নদী স্বাক্ষী থাকে ধীবরের ছেঁড়া জালের কষ্টের, ‘নাইওর’ যাওয়ার পথে মায়াবী বধূটির গভীর আনন্দের। ফিরতি পথে স্কুলপড়ুয়া মেয়েটি যখন কাচাহাতের, অসংখ্য ভুল বানানের চিঠিটি পড়াশেষে, লাজুক চুমু মিশিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়, তখন শুধু নদী জানে কতখানি কদর পেল চিঠিটি।
নদী ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে গ্রামগুলো কিংবা বলা চলে বেশ কিছু কর্ষণযোগ্য জমিন। ভূ-খন্ডের গাছ-ঘাস-পলিমাখা কাদামাটির উপর কাঁটাতারে আঁকা থাকে মানচিত্রের সীমারেখা। মাঝে থাকে চল্ ছুট্ ছুট্ নদী। এই যেমন এটি - ইছামতী। জল নদীর এপাড় ছুঁয়ে ওপাড়ে যায়, বটপাতায় ভাসতে থাকা একদল পিঁপড়ে পাসপোর্ট ছাড়াই পাড়ি জমায় বাংলাদেশ টু ভারত।
‘জানো, লাল-সবুজ আর তিনরঙা পতাকার চিহ্ন বুকে গেঁথে অনেক নৌকো ভিড়ে এখানে ভাসানের কালে।’ - সাদাশার্ট চোখ বুজে নরম গলায় কথা বলে।
দূর্গো পূজোর ‘ভাসান’ ছেলেটির চোখে ভাসে। মানুষের ঢল নামে দু’পাড়জুড়ে। সীমানা বিলীন হয় কর্তৃপক্ষের আদেশে। বিসর্জনের পর নদীতে ভেসে যাওয়া প্রতিমায় চোখ পড়লে বলা ভার - কোন্ প্রতিমাখানি কোন্ বাংলার।
নীল টিপ আলগোছে হাত রাখে সাদাশার্টের কপালে আর শোনে কথার ঝুনঝুনি। এখানে আজ প্রথম আসা হলো নীল টিপের। দুজনে একসাথে নৌকোতে ভাসবে কোন এক রাতে, আরও অনেক ছেলেমানুষী স্বপ্নের মতো এটাও একটি স্বপ্ন ছিল ওদের। এই নদী জানে শৈশবের দুরন্ত ছেলেটিকে, কৈশোরের প্রথম কবিতায় ছিল এই নদী।
‘ মা’কে দেখানোর আগে নীল টিপকে তোমায় দেখালাম নদী’- মনে মনে ভাবে সাদা শার্ট।
মাঝিহীন নৌকা দোলে, ভাসে, ধীরে, অতি ধীরে। রাত গভীর হয় ক্রমশ আর নৌকো দোলে তার আপন তালে, হয়ত ভাসে দূরে, বহুদূরে। জ্যোৎস্না অগ্রাহ্য করে অকস্মাৎ এক তীব্র তীক্ষ্ণ আলোর ঝলকানিতে চমকে ওঠে নীল টিপ। আর ভয়ার্ত এক কর্কশ শব্দে রাতের পবিত্র নীরবতা ধর্ষিত হলে সীমান্তবাসীদের ইন্দ্রিয় ঘুমকেই অধিক প্রশ্রয় দেয়। দু’একজন জেগে উঠলেও স্বাভাবিকতার কাছে দমে যায় কৌতূহল। শুধু সাদা শার্ট ওর কপালের উপর ঢলে পড়া নীল টিপের মুখখানি তুলে ধরতে চেষ্টা করে বেশ ক’বার। কপালজোড়া নীল টিপ বুঝি একবার দেখার সাধ ছিল তার?
টলটলে দীঘিতে সূর্যালোক খেলা করলে অনেক মাইক্রোফোন-ক্যামেরা জড়ো হয় নদীপাড়ে। সংবাদপত্র আর ঝকঝকে চ্যানেলের সংবাদে শিরোনাম চোখে পড়ে -
“জলসীমা লঙ্ঘনের দায়ে বি.এস.এফ-এর গুলিতে দুই বাংলাদেশী তরূণ-তরূণী নিহত”
দু’দুটি দেশের কোন্ কোন্ প্রধান যেন আলোচনায় বসেন সাদা পতাকা হাতে। নদী অদৃশ্য কাঁটাতার ডিঙিয়ে বয়ে চলে আর ম্লান হাসে। টিভিস্ক্রীনে বারকয়েক ভেসে ওঠে রক্তাক্ত-কাদাজলে ভেজা সাদা শার্ট। রক্তেভেজা নীল টিপ রোদ রোদ সকালে কালচে হয়ে যাওয়ায় জানা হয়না কারও - এই কপালে নীল টিপ ছিল।
------------------------------------------------------------------------
মন্তব্য
খুব ভালো লাগলো। আপনার প্রতিটা গল্পই এতো মায়াভরা !
ভালোলাগাটুকু জেনে ভীষণ ভালো লাগলো। ধন্যবাদ
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
ধন্যবাদ
পড়লাম।
---------------------------------------------------------------------------
মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক
জানলাম
দূর্দান্ত... এই গল্প বিকালে পড়লে আপনের জন্য এক কাপ কফি বাড়তি থাকতো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পড়লেন জেনে ভাল্লাগলো।
'দূর্দান্ত' র জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আর কফি'টা পাওনা র'লো
চমৎকার...
প্রিয় পোস্টে...
_____________________________________________
তুমি হতে পারো একটি স্বার্থক বিষাদের সংজ্ঞা। স্বার্থক নদী, স্বার্থক ক্লান্তি অথবা স্বার্থক স্বপ্ন।
____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
প্রিয় পোস্টে ?! জেনে ভালো লাগছে.....
অসংখ্য ধন্যবাদ বন্ধু
নদী স্বাক্ষী থাকে ধীবরের ছেঁড়া জালের কষ্টের, ‘নাইওর’ যাওয়ার পথে মায়াবী বধূটির গভীর আনন্দের। ফিরতি পথে স্কুলপড়ুয়া মেয়েটি যখন কাচাহাতের, অসংখ্য ভুল বানানের চিঠিটি পড়াশেষে, লাজুক চুমু মিশিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়, তখন শুধু নদী জানে কতখানি কদর পেল চিঠিটি।
এমন বর্ণনাভঙ্গি যার আয়ত্বে,তার লেখা গল্প ভালো না লেগে যায় না ! ভালো লাগলো । কিন্তু মউ,এই গল্পে একটা কাহিনী বলার জন্য আপনাকে উদ্বিগ্ন মনে হলো ! মনে হলো একটা ক্লাইম্যাক্স তৈরী করতেই চাচ্ছিলেন আপনি । ঘটনার বিন্যাস হতেই পারে , কিন্তু চমকের জন্যই হতে হবে, এমনট কখনো কখনো ক্ষতিকর ! আপনার আর সব গল্পে আপনি এই মোহ এড়াতে পারছিলেন , মনে আছে । বিশেষতঃ ভাতওয়ালী তে ।
কিছু মনে করবেন না আশা করি । ভালো থাকবেন ।
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
কিছু মনে করবো কেন ভাইয়া, এই পরামর্শগুলোর জন্যইতো আপনার মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকি।
প্রায়ই বি.এস.এফ/বি.ডি.আর-এর গুলিতে সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো ছোট্ট একটি 'নিউজ' হিসেবে থেকে যায়। অথচ বুলেটবিদ্ধ হয় কোন স্বপ্ন কিংবা কোন পরিবারের একমাত্র অবলম্বন- এই উপলব্ধি থেকেই গল্পটি লেখা শুরু করেছিলাম। সেজন্যই বিষয়টি উপস্থাপনের তাড়না বেশি ছিল হয়তো।
আপনার কথা মনে থাকবে, সচেতন থাকবো এ ব্যাপারে।
পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন
দৃশ্যের এতো চমৎকার বর্ণনা কেমন করে দেন আপনি!
..................................................................
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।
মন্তব্যটি পেয়ে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ
মউ
এত সুন্দর শান্ত পরিবেশের এমন পরিনতি!!!!সত্যিই কষ্ট দায়ক!!! চমৎকার!!
ভা ল লাগলো । আরো ভালো লিখো দোয়া রইল।
পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো। অসংখ্য ধন্যবাদ
অবাক লাগছে, এই লেখাটা আমি আগে পড়ি নাই!
লেখার মান খুবই ভালো, তবে হর্ষে-বিষাদ।
______________________________________
ভাষা উন্মুক্ত হবেই | লিনলিপি
______________________________________
লীন
পড়া হল জেনে ভালো লাগলো...
ধন্যবাদ
-------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো,
গৃহী হয়ে কে কবে কী পেয়েছে বলো....
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি
নতুন মন্তব্য করুন