দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়ে শিপনের রুমে সবাই বসেছে আগামী কালের প্ল্যান নিয়ে। সবার চোখেই ঘুমের দৌড়াদৌড়ি। তারপরও বসেছে কোথায় যাবে সেটা ঠিক করার অভিপ্রায়ে বা বলতে পারি পরবর্তী দিনের লক্ষ্য স্থির করতে। তমাল প্লেয়িং কার্ড নিয়ে বসেছে। সে এই সফরের দলনেতা, শিপন অলিখিত কোচ। শিপনের পরামর্শ বা কথা ছাড়া তমাল কিছুই করে না। তার কথা কিছুক্ষণ কার্ড খেলে তারপর ঘুমাবে। ঘুম কাতুর জাকির কার্ড খেলতে নারাজ। সাজ্জাদ কার্ডই ভালো করে চিনে না।
"একটা দামড়া হইয়া গেছে কার্ড চিনে না, আরেকটা ঘুরতে আইসাও ঘুমায়, এই গুলির লগে আমি আর কোনোদিন বাইর হুমু না।" রেগে মেগে বলল তমাল। কার্ড গুলি ছুঁড়ে দিল।
"বাদ দে কার্ড খেলা, কাল কোথায় যাবি সেটা বল?" শিপন তমালকে ঠাণ্ডা করে বলল।
"প্রথম দিন চল মহেশখালী ঘুরে আসি, তারপর সেন্টমার্টিন যাওয়া যাবে।" মিঠু বলল। জাকির অলরেডি কুঁকড়ে খাটে শুয়ে আছে, সাজ্জাদ জাকিরের পাশে শুয়ে ঢুলুঢুলু চোখে তাকায় আছে, দেখলেই মনে হয় জোড় করে চেয়ে আছে। সিদ্ধান্ত হলো কাল মহেশখালী। সকাল আটটায় নাস্তা সেরে, মহেশাখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। সবাই যার যার রুমে চলে গেল।
সকালে রেস্টুরেন্টে বসে আছে সবাই, নাস্তা করা শেষ, চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। পাশের টেবিলেই বসে আছে একটা সুন্দরী মেয়ে।
"দেখ্ মাইয়াটা হ্যাভি না?" বলল শিপন।
"হুম, দারুণ----" আরো কিছু বলতে চাইছিল সাজ্জাদ, তমাল থামিয়ে দিয়ে বলল -"তুই সুন্দরের কী বুঝস? জীবনে কোন মেয়ের হাত ধরছস?" সবাই একসাথে একটু হেসে নিল।
"যাবো নাকি কথা বলতে?" বলল মিঠু।
"মামু এখানে কেউ একা আসে না, দেখবা একটু পর মেঘের ফালি সরিয়ে একটা চাঁদ টুপ্ কইরা হাজির হইব।- জ্ঞানীর মত কথাটা বলল জাকির।
জাকিরের কথা শেষ হতে না হতেই একটা কাউল্ল্যা, চান্দি ছোলা, পেট মোটা মার্কা পোলা মেয়েটার পাশে এসে বলল। সবাই তো হতাশ। একজন আরেক জনের দিকে তাকাইল। “জাকির এইতোর চাঁদ!”-তমাল বলল।
"শালায় বুঝি না সুন্দর সুন্দর মাইয়া গুলি কেমনে এমন বদসুরুৎ মার্কা পোলার লগে জীবন কাটায়।" বলল মিঠু।
"দোস্ত পকেটে মালকড়ি থাকলে এমনি হয়। দেখ আমি কী শিপনের চেয়ে দেখতে খারাপ, আমি করলাম সর্বসাকল্যে তিনটা, আর শিপন ২০/২২টাতো আমাদেরই জানা মতে, অজানা যে আরো কত আছে?" বলল তমাল। শিপন মুচকি একটা হাসি দিল। কিছু বলল না। চা এলো, সবাই যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি চা পান করে উঠল। বের হওয়ার মুখে আরেকটা সুন্দরী মেয়ে দেখে সবার পা থেমে গেল, শিপন একটু দূরে ছিল।
'মামা মেয়েটা চেনা চেনা লাগল মনে হয়?" তমালের দিকে তাকিয়ে মিঠু বলল।
"হ, আমার কাছেও তাই মনে হলো, দাঁড়া দেখি শিপন কী করে।" বলল তমাল।
সবাই শিপনের জন্য অপেক্ষা করছে। শিপন ওদের দিকে আসতে গিয়ে থেমে গেলো, মেয়েটার দিকে তাকাল। একবার এগিয়ে যেতে চেয়ে আবার পিছিয়ে গেল, মেয়েটার সাথে একটা হ্যান্ডসাম ছেলেকে দেখে। শিপনের হাসি মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কোন কিছু বলল না। সোজা বেড় হয়ে এল। তমাল আর মিঠু চোখ চাওয়া চাওয়ি করল। কিছু বুঝল না, শিপনকে অনুসরণ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এল।
মহেশখালী ঘুরে আসার পরও সকালে শিপনের মুখে লেগে থাকা বিমর্ষ ভাবটা গেল না। বেশ কয়েকবার সবাই জানতে চাইছিল, কিন্তু শিপন বলে নাই। শিপন অনেক কিছু ওদের আড়ালে করে, যার সব শেয়ার করে না। তবে সবাই আন্দাজ করতে পারল যে এই বিমর্ষ হওয়ার পেছনে সকালের ঐ সুন্দরী মেয়েটার প্রভাব আছে। রাতের খাবারের পর সবাই শিপনের রুমে এল। সবার মনে একটাই প্রশ্ন শিপন নীরব কেন? শিপন হাতে রিমোট নিয়ে টিভি দেখছিল, সেখানেও যে মন বসছিল না সেটা চ্যানেল পরিবর্তনের ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সবাই একটু চুপচাপ, ক্লান্তির সাথে বিষণ্ণতা মিলে গুমট একটা পরিবেশ।
"দোস্ত তুই যদি এমন মুড অফ করে রাখছ, তাইলে যে ঘুরতে আসা আনন্দটাই নিরামিষ হয়ে যাবে।" বলল মিঠু। সবাই যেন কথা বলার সুযোগ পেল। "তোর কী অইছে আমাদের লগে শেয়ার কর, মনটা হালকা লাগব।" বলল সাজ্জাদ। এই প্রথম সাজ্জাদের কথা কেউ ধরল না।
"দোস্ত মেয়েটা কে ছিল? তমাল জানতে চাইল।
"নিভা" নিরুত্তাপ ভাবে উত্তর দিল শিপন।
"ও তাইতো বলি মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগে।" সবাই এক সাথে বলে উঠল।
"তা দোস্ত সাথে ঐটা কে?" তমাল জানতে চাইল।
"ওর জামাই, গত মাসে ওদের বিয়ে হয়েছে।" নীরস বদনে বলল শিপন।
"দোস্ত তুই এই মাইয়ার লেগা পাগল আছিলি, ভাগল কেমনে? জানতে চাইল জাকির।
"দোস্ত এখানেই আমি ব্যর্থ। এই পর্যন্ত যত গুলি প্রেম করেছি, এই একটা মেয়ে আমাকে ছেড়ে গেছে, বাকী গুলিকে আমি ছেড়ে ছিলাম। ওকে আমি অনেক বেশি ভালবাসতাম এবং ভেবেছিলাম এটাই হবে আমার শেষ প্রেম।" অনেক কষ্ট নিয়ে কথা গুলি শিপন বলল।
চোখ টলটল করছে, যেন বর্ষার আকাশ, যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। "ওকে দেখার পর থেকে আমি পা চালাতে পারছি না, মনকে স্বাভাবিক করতে পারছি না, তোদের না নিয়ে এলে আমি তখনি ঢাকা ফিরে যেতাম।" কথা গুলি চোখের জল মুছে বলল শিপন।
সবাই তাজ্জব বনে গেল। শিপন একটা মেয়ের জন্য কাঁদছে! যে শিপন ইচ্ছে করলে দিনে দশটা মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে পারত, নিজে থেকে যে অসংখ্য মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছে, কোনো মেয়ের সাথে টানা ছয়-সাত মাস চুটিয়ে প্রেম করে হাসি মুখে বিদায় দিয়েছে অবলীলায়, আজ সেই শিপন মেয়ের জন্য অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে!হায়-রে, একেই কী তাহলে বলে আসল প্রেম? যার জন্য যার হৃদয় কাঁদে।
"তা দোস্ত কেমন করে কী হইল? তুইতো আমাদের সাথে ওর পরিচয়টা পর্যন্ত করায় দেছ নাই, দিলে আজ কী লজ্জাটা না পাইত?" বলল তমাল।
"লাভ কী হত?" দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শিপন বলল।
"জামাইয়ের সামনে একটা লজ্জা পাইত।" সাজ্জাদ বলল।
"শালা বেকুব চুপ কর, তোরে মনে হয় খুব চিনত? পরিচিত হলেও তোকে না চেনার ভান করে স্বামীর হাত ধরে চলে যেত।" বলল মিঠু।
"তয় মামা মাইয়াটা ঝাক্কাস ছিল।" জাকির বলল।
"চুপ করবি তোরা, শিপনের মনে এমনি অতীত দৌড়াইতাছে আর ওনারা খামোকা পেঁচাল মারতাছে। দোস্ত ঘটনাটা বল'ত শুনি।" তমাল বলল।
"দোস্ত তুই কী মাইয়ার লগে জোড় কইরা কিছু করতে চাইছিলি?" সাজ্জাদ বলল।
"ঐ ক্ষেত, তোর আবাল মার্কা প্রশ্ন বন্ধ করবি, নাকি রুম থেকে বের করে দেব?" তমাল বলল।
রুমের ভেতর সাউন্ডলেস টিভি চলছে। থমথম একটা ভাব। সবাই শিপনের দিকে চেয়ে। ভ্রমণের আনন্দটাই যেন আজ নিরানন্দ মনে হচ্ছে। মহেশখালী ভিজিট যতটা রোমাঞ্চকর হবে ভেবেছিল, ততটা হয়নি শিপনের নীরবতার কারণে।
"দোস্ত কীভাবে কী হইল বল না?" অনুরোধের সুরে বলল জাকির।
"কী শুনবি? " শিপন সবার দিকে চেয়ে বলল।
"দোস্ত এতদিনতো আমরা তুই কীভাবে ছ্যাঁক দিতি সেই কাহিনী শুনেছি, আজ না হয় তোর ব্যর্থতার ইতিহাস শুনলাম?" বলল তমাল। কথাটা বলে গুমট পরিবেশটা একটু শিথিল করার চেষ্টা করল। "হ দোস্ত বল।" বাকী সবাই বলল।
"আমিতো মাঝে মাঝে তোদের রেখে উধাও হয়ে যেতাম।" বলল শিপন।
সবাই কোরাস হুম বলল। "সেই সময় গুলি আমি নিভাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। আমি ভেবেছিলাম নিভাকে বিয়ে করে তোদের একটা সারপ্রাইজ দিমু, কিন্তু তার আগে আমিই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।" শিপন বলে সবার দিকে তাকাল।
"ঘুম পাচ্ছে আসল ঘটনা বল।" হাই তুলে জাকির বলল।
"মিঠু শালারে একটা বাঁ পা দিয়া লাত্থি মারত, ঘুম দৌড় দিব।" তমাল বলল।
"তারপর কী হল? " জানতে চাইল সাজ্জাদ।
"একদিন ইভারে নিয়া গুলশান কেএফসিতে বসে আছি, খাবারের জন্য অপেক্ষা। এমন সময় ওখানে ঢুকল মারিয়া।" "তোর আগের প্রেমিকা" কথা কেড়ে নিয়ে সাজ্জাদ বলল। "নাটকা (বন্ধুরা ক্ষেপে গেলে সাজ্জাদকে এই নামে সম্বোধন করে) চুপ করবি নাকি তু্ইও লাত্থি খাইতে চাস?" তমাল একটা হালকা ঝাড়ি মারল।
"তারপর----" বলল মিঠু।
"আমিতো একটু শঙ্কিত হলাম---" বলে ঢোক গিলল শিপন। "কেন" কথার মাঝে বলল জাকির।
"মারিয়া আমাকে প্রচণ্ড ভালবাসত, আমার জন্য পাগল ছিল, আমি ওকে ওতো ভালবাসতে পারি নাই, আমার কাছে মনে হয়েছিল, আমি যাকে খোঁজতেছি সে মারিয়া না।"
(চলবে)
মন্তব্য
চলুক না দোস্ত, ক্ষতি কি! কিন্তুক অত তাড়াতাড়ি তৃতীয়-পর্বটা শেষ হইয়া যাইব পড়ার মাঝে আইসা ভাবি নাই। আর দাদা, গুলশান কেএফসিতে ইভা নাকি নিভারে নিয়া খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলে ঠিক বুঝে উটতে পারছি না হে।
এস হোসাইন
---------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"
দোস্ত যখন বলেছেন তখন আমিও দোস্ত বলেই বলছি ঐটা টাইপো। দুঃখিত। ক্ষমা করে দিয়েন।
ধন্যবাদ।
দলছুট।
আপনার লেখা পড়তে এখন আগের চেয়ে অনেক আরাম লাগে। চালিয়ে যান।
ধন্যবাদ। আশা করি আরো ভালো হবে। সঙ্গে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন