আমাদের মা - আমাদের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক - ১

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: রবি, ০৮/১১/২০০৯ - ১২:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের মা - আমাদের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক - ১
জোহরা ফেরদৌসী


গত একুশে অক্টোবর, ২০০৯ (বুধবার) আমাদের নয় ভাই বোনের মা নুরজাহান বেগম ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। আমার মা ছিলেন পৃথিবীর সকল মায়ের মতন একজন মা। মা শব্দটি এমন যার অর্থ কোন ভাষার কোন বর্নমালা ধারন করতে পারে বলে আমার জানা নেই। মা ডাকটি এমন এক ডাক যা উঠে আসে শুধু বুকের অতল গভীর থেকে। উঠে আসে আনন্দে, বেদনায়, দুঃখে, হতাশায়, জরা-ব্যধিতে, শোকে, উল্লাসে। আমার মায়ের মৃত্যুতে আমি আজ শোকাচ্ছন্য, চারিদিক আঁধারে ঢেকে আসে। কিন্তু আমার যে মা জীবনে সব সময় সকল মানুষের একজন হতে চেয়েছেন, সাধারন একজন মানুষ হতে চেয়েছেন, সকলের কথা বলেছেন আমি সেই মায়ের জীবনকে আজ উদযাপন করতে চাই। আমার যে মা সকল সময় অন্যের কথা ভেবেছেন, সেই মায়ের মৃত্যুতে আমি পৃথিবীর সকল মায়েদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে চাই, জানি আমার মা তাঁদের সবার সঙ্গেই আছেন।


“প্রতিটি মানুষ একটি আলোর শিখা। নিজের মধ্যে এই আলোক শিখাটি জ্বালিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতে হবে। কারন, তুমি নিভে গেলে তোমার জায়গাটিই অন্ধকার হয়ে যাবে।”
- নূরজাহান বেগম (আমাদের মা)

জন্ম ও শৈশব

আমাদের মা জন্মেছিলেন কোন এক জৈষ্ঠ্য মাসে। বাংলা কত সন ছিল তা সঠিকভাবে জানা নেই। তবে আন্দাজ করা যায় ইংরেজী ১৯২৮-২৯ সালে মা জন্মেছিলেন নানার বাড়ী তৎকালীন কূমিল্লা জেলার মতলব থানার ইছাখালী গ্রামে। বাবা একই থানার গজরা নিবাসী স্কুল শিক্ষক ইয়াকুব আলী মূন্সী, মা আক্রমন্নেসার তৃতীয় সন্তান ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী এক নারী, গায়ের রং ছিল ঘিয়ে রংয়ের। আমার মা পেয়েছিলেন বাবার মত গায়ের রং, কালো। শিশু কন্যার জন্মের সংবাদ পেয়ে তাঁর বাবা শ্বশুর বাড়িতে গেলেন। শিশু কন্যাকে কোলে নিয়ে নাম রাখলেন “নূরজাহান” আর দোয়া করলেন “জগতের আলো হোক আমার এই মেয়ে”।

শৈশবে বাবা ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। বাবার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তিনি। পরপর কয়েকটি ছেলে সন্তান অকালে হারিয়ে তাঁর বাবা তাকেই পূত্র সন্তানের মত মানুষ করেছিলেন। প্রচণ্ড মেধাবী মা আমাদের খুব ছোট বেলা থেকেই পড়াশুনার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। স্কুল শিক্ষক বাবার সংস্পর্শ তাকে পড়াশুনার প্রতি আরো আগ্রহী করে তোলে। তখনকার দিনে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে পড়ালেখার সুযোগ ছিল খুবই কম। মা তাঁর বাবা যে স্কুলে (মতলব থানাধীন ছেঙ্গারচর স্কুল) শিক্ষকতা করতেন সেখানেই শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে থাকতে পারার আনন্দটুকুও তাঁর কম ছিল না। বর্ষায় নৌকা চড়ে আর অন্য সময়ে বাবার হাত ধরে গ্রামের ধান ক্ষেতের আল বেয়ে হেঁটে যাওয়ার কথা তিনি অনেকবার বলেছেন। ছেঙ্গারচর স্কুলে তিনি একমাত্র মুসলিম ছাত্রী ছিলেন। ভীষন মেধাবী মা দূ’বার ডবল প্রমোশন পেয়েছিলেন।

মা প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। জীবনে একবার যে গান শুনেছেন, তা কোনদিন ভোলেন নি। একবার যে ছড়া, কবিতা পড়েছেন তার কথা, সুর, ছন্দ মার মনে গেথে থাকতো সারাজীবন। দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়া ছড়া, কবিতা তিনি অবিকল বলে যেতেন। বাড়ীতে যত বই তাঁর বাবার সংগ্রহে ছিল তা সব শেষ হতে খুব সময় লাগেনি। সে সময়ে গজরা গ্রামে পচাত্তর শতাংশই ছিল হিন্দু অধিবাসী। তাদের পাঠাগার থেকে বই আনিয়ে পড়তেন। একবার ছোট ভাই স্কুল থেকে রবীন্দ্রনাথের “শিশু” বইটি পুরষ্কার পেয়েছিল। ভাইয়ের কাছে সেই বইটি চেয়েছিলেন। স্বভাবতঃই ভাই রাজী হয়নি। একদিন তার ভাই আবিষ্কার করেন তিনি খাতার মধ্যে পূরো বইটি নকল করে লিখে ফেলেছেন। বইটি নিজের সংগ্রহে রাখার ইচ্ছে তিনি এভাবেই পূরন করেছেন।

মার পড়ালেখা করার এই অদম্য স্পৃহা দেখে তাঁর বাবা সলিমুল্লাহ এতিমখানার পলিটেকনিক স্কুলে অংকের শিক্ষকের চাকরী নিয়ে ঢাকায় আসেন। তৎকালীন শিক্ষাভবন বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমানে নবকুমার ইনস্টিটিউট) অষ্টম শ্রেনীতে ভর্তি হন। সে সময়ে স্কুলের ঘোড়া গাড়ী মেয়েদেরকে বাড়ী থেকে নিয়ে যেতো। গাড়ীর চারিদিকে শাড়ী দিয়ে ঘিরে রাখা হতো। গাড়ীর ভেতরে থাকতেন একজন বর্ষিয়সী মহিলা, যিনি মেয়েদের নিরাপত্তার দিকটি দেখতেন। শিক্ষাভবনের গুটি কয়েক মুসলিম ছাত্রীদের মধ্যে মা ছিলেন একজন। মার ক্লাসে তিনিই একমাত্র মুসলিম ছাত্রী ছিলেন। দূঃখজনকভাবে, সেই সময়ে হিন্দু, মুসলিম দাঙ্গা লেগে যাওয়ায় বকশী বাজারস্থিত এই স্কুলটিতে মেয়েদের যাতায়াত নিরাপদ ছিলো না। সে সময় লালবাগ এলাকা ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত আর বকশীবাজার ছিল হিন্দু প্রধান এলাকা। দাঙ্গার তীব্রতা বাড়লে তাঁর বাবা সপরিবারে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হন। মা সফলতার সঙ্গে অষ্টম শ্রেনী পাশ করেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার এখানেই ইতি টানতে হয়, যা ছিল মার সারা জীবনের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা।

বিয়ে

বাংলা তেরশ পঞ্চাশ সনে (ইংরেজী ১৯৪৩) ভীষন দূর্ভিক্ষের সময়, যা অবিভক্ত বাংলার “পঞ্চাশের মণ্বন্তর” নামে পরিচিত, সেই বছর মার বিয়ে হয় কূমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার তূলাতুলি গ্রাম নিবাসী আব্দুল মজিদ সরকার ও সখিনা বেগমের বড় পুত্র আব্দুল হাই সরকারের সঙ্গে। দূর্ভিক্ষের আগে চালের দাম ছিল মনপ্রতি সাড়ে তিন থেকে পাঁচ টাকা। কিন্তু আকালের সময়ে বিয়ের জন্য এক মন চাল কেনা হয়েছিল ষাট টাকা দিয়ে।

মার বিয়ের ঘটনার সঙ্গেও বই পড়ার স্মৃতি জড়িত ছিল। মা খুব ভাল আবৃত্তি ও পাঠ করতে পারতেন। বাড়ীতে বাবা, মা, চাচা, চাচী, খালা, মামারা তাঁর বই পাঠের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। সেই সময়ে মীর মোশাররফ হোসেনের “বিষাদ সিন্ধূ” মুসলিম সাহিত্যিকদের লেখা অন্যতম উপন্যাস ছিল। প্রায়শই মাকে এটি পাঠ করে শোনাতে হতো। উঠোনে পাটি পেতে হারিকেনের আলোতে মা পাঠ করতেন, চারিদিকে ঘিরে সবাই তা শুনতেন। মার পাঠ এমনই হৃদয়গ্রাহী হতো যে শ্রোতার চোখে জল এসে যেতো। বিষাদ সিন্ধূর দূ’টি বিশেষ জায়গা পাঠের সময় মা খুব আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন। প্রথমটি যেখানে সীমার প্রিয় নবীজীর (সাঃ) আদরের ধন ইমাম হোসেনের (রাঃ) গলায় খঞ্জর চালাচ্ছে হত্যার উদ্দেশ্যে, অথচ ব্যর্থ হচ্ছে সেই সময়ে দূ’জনের কথোপকথন। ইমাম হোসেন (রাঃ) সীমারকে অনুরোধ করছেন দ্রুত করতে যেন তিনি কষ্ট কম পান। তিনি নানাজীর শপথ নিয়ে বলছেন কিয়ামতের দিনে সীমারের জন্য সূপারিশ করবেন। পরেরটি ছিল যখন ইমাম হোসেনের (রাঃ) মৃত্যু সংবাদ নিয়ে কাসেদ (বার্তাবাহক) ছূটে চলেছিল মরূর বুকে। তখন প্রকৃতিতে যে বিষাদের মাতম উঠেছিল তার বর্নণা পড়তে পড়তে মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন। মার বিয়ের সঙ্গেও বই পড়ার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একবার মা তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন, সেখানে তাদের অনুরোধে বিষাদ সিন্ধু পাঠ করেছিলেন। গ্রামের বাড়ীতে টিনের বেড়ার অন্যধারে আমার দাদী (তাঁর মেয়ের শ্বশুড়বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন) সেই পাঠ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিয়ের পরে শ্বশুড়বাড়ীতেও মাকে এই পাঠ করে শোনানোর কাজটি করতে হয়েছে।

পড়াশুনার প্রতি অদম্য আগ্রহ

আমার মা জন্মেছিলেন ভুল সময়ে। ইংরেজ শাসন আমলের শেষ দিকে প্রত্যন্ত এক গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। তখনও মুসলিম সমাজে নারীশিক্ষার প্রসার প্রাথমিক স্তরও পার হয়নি। আমার স্থির বিশ্বাস মার যে মেধা, ইচ্ছাশক্তি, স্মরণ শক্তি, সর্বোপরি বিদ্যা অর্জনের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ছিল তা দিয়ে তিনি অনেকদুর যেতেন। সেই দূরত্ব শুধু যে তাঁর একার জন্যই যাওয়া হতো, তা নয়। তিনি আরো অনেকের জন্যই আদর্শ হতেন।

নিজের জীবনের সেই অপুর্ন সাধকে তিনি কখনো ভূলেন নি। তাই সারাজীবন তাঁর চারিদিকে শিক্ষার আলো জ্বালাতে ব্রতী ছিলেন। নিজে কখনো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াননি কিন্তু নয় সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়া পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছেন। প্রায়শই নবীজীর হাদিস উদ্ধৃতি করতেন, “বিদ্যাশিক্ষা করতে প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে হলেও যাও”। আমাদের পড়ালেখার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার খুব অনায়াসে করেছেন। আমাদের বাবা সামান্য বেতনে অবিভক্ত বাংলার রেলওয়েতে টিকেট চেকারের (টি. টি.) চাকরীতে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু মার অনমনীয় দৃঢ়তার জন্য আমাদের পড়ালেখার খরচের কখনো অভাব হয়নি। মা তাঁর বিয়ের গয়না বিক্রি করেছেন, স্বামীর পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। একবার এক আত্মীয় এজন্য অভিযোগ করলে মা জবাব দিয়েছিলেন, “আব্দুল মজিদ সরকারের বংশধরদের লেখাপড়া না হলে, ধানী জমি দিয়ে কি হবে? আব্দুল মজিদ সরকার বেঁচে থাকলে আজকে আমার সিদ্ধান্তেই খূশী হতেন। পড়াশুনা করে মানুষ হলে অনেক জমি কেনা যাবে।”

শুধু যে নিজের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তাই নয়, আত্মীয় স্বজনদের সকলের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য মা ছিলেন অনূপ্রেরনা। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ীতে সকলের মধ্যেই মা একাধারে স্নেহ ও শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন। বয়োজেষ্ঠ্যরা সকলেই যে কোন সমস্যায় মার কাছে পরামর্শের জন্য আসতেন। মা সর্বাগ্রে লেখাপড়াকে গুরুত্ব দিতেন। বিশেষতঃ যে কোন পরিবারের প্রথম সন্তানটিকে পড়ানোর জন্য গুরুত্ব দিতেন, বলতেন, “বড় ভাই বা বোনটি পড়ালেখা করলে, পরের ভাই বোনগুলো উৎসাহিত হবে”। তাঁর সংস্পর্শে যারাই এসেছেন তারা সবাই স্বীকার করেন শুধুমাত্র তাঁর অনূপ্রেরনাতেই অনেক পরিবারে শিক্ষার আলো জ্বলেছিলো।

অভূতপুর্ব স্মরনশক্তি ছিল তাঁর। ছোট বেলা থেকে পড়া কোন ছড়া, গান, কবিতা, পূঁথি কোনকিছুই তাঁর স্মৃতি থেকে মুছে যায় নি। গ্রামীন জীবনের কত হারিয়ে যাওয়া লোকসাহিত্য আমরা তাঁর কাছেই শুধু শুনেছি। মার মুখে আমরা অসংখ্য খনার বচন শুনেছি। “কলা রুয়ে না কেটো পাত/ তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত”, “যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ ধন্যি রাজার পূন্য দেশ”, “আশ্বিনে রেধে কার্তিকে খায়/যেই বর মাগে কন্যা সেই বর পায়” এমন অগনিত প্রবচন মা হরদম বলতেন। মার মুখে কত হাজারবার যে শুনেছি, “জানলে কাজ শরবত, না জানলে কাজ পর্বত”। তাঁর ধী শক্তি দেখে অনেকেই বলতেন যথার্থ সূযোগ পেলে মা অনেক বড় কিছু হতেন। মার চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য আমরা আড়ালে তাঁকে ডাকতাম “ইন্দিরা গান্ধী”। এক অর্থে মা তাঁর প্রিয় চরিত্র খনাই ছিলেন যে প্রচন্ড মেধা, ধী শক্তি নিয়ে জন্ম নিয়েও শুধুমাত্র পারিপার্শ্বিকতার কারনে সম্পুর্ন সম্ভাবনায় বিকশিত হতে পারেন নি।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।