আমাদের মা - আমাদের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক - ২
জোহরা ফেরদৌসী
আমার মাকে যদি কেউ জীবনে একদিনও দেখে থাকেন সেই জানেন তাঁর বই প্রীতির কথা। আক্ষরিক অর্থেই একজন “বইয়ের পোকা” ছিলেন। শৈশবে এতো বইয়ের যোগান তাঁকে কে দেবে ? তখনকার দিনে বাজার থেকে কাগজের ঠোঙ্গায় করে জিনিষ আনা হোত। মা সেই ঠোঙ্গাগুলো সযত্নে রেখে পড়তেন। কোথাও খূঁজে না পাওয়া গেলে সবাই জানতেন যে মা ঘরের পেছনের নির্জনতায় বই পড়ছেন। তাঁর বাবার বইয়ের আলমারীর চাবি কাউকে দেয়া হতো না। তিনি লুকিয়ে বাবার আলমারী থেকে নিয়ে বন্কিম চন্দ্রের রচনাবলী পড়তে গিয়ে এক সময় ধরা পড়ে যান। সেদিন থেকে তাঁর বাবা চাবিটি তাঁকে দিয়ে দিয়েছিলেন। একবার বড় বোনের স্বামী তাঁকে কি উপহার চায় জানতে চাইলে বলেছিলেন, “ভাই সাহেব, আমাকে বই পাঠাবেন”। তাঁর সেই ভাই সাহেব (কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজের অধ্যক্ষ প্রয়াত ওয়াসিমুদ্দীন) সব সময় এই বিদ্যানুরাগী শ্যালিকাকে বইয়ের যোগান দিয়েছেন।
জীবন শুরু করেছিলেন প্রত্যন্ত গ্রামে। কৈশোরেই বিয়ে হয়ে চলে গিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ী। দিনের নানা কাজের ব্যস্ততায় বই হাতে নিতে পারতেন না। এখনকার মত বিজলী বাতির আলো ছিল না। সন্ধ্যা হলেই আলো নিভিয়ে সবাই ঘুমিয়ে গেলেও মা ঘুমাতেন না। কত রাত তাঁর কেটেছে বই পড়ে। বলতেন, “পড়তে শুরু করলে শেষটা না জানা পর্যন্ত ভালো লাগে না।” শুধু যে তাৎক্ষনিক পড়ার আনন্দের জন্য পড়তেন, তাই না। উন্নত সাহিত্যের প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন। তাঁদের আনন্দ, বেদনাকে নিজের মধ্যে ধারন করতেন। যে কারনে অনেকদিন আগের পড়া বইও এমন নির্ভুলভাবে উদ্ধৃতি দিতেন যে মনে হতো মা সেই বইটির ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন। রাত জেগে কেরোসিনের আলোতে বই পড়া নিয়ে আমাদের বাবা মাকে রাগানোর জন্য বলতেন, “জীবনে কেরোসিনের পেছনে কত টাকা খরচ করেছো তার কোন হিসাব করেছো কখনো ?” মা বলতেন, “তবুতো আমি হারিকেনের আলোতে পড়ছি, বিদ্যাসাগর তো সারা রাত ল্যাম্প পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থেকে বই পড়তেন।”
আমাদের বাবার কর্মস্থল লাকসামে কেটেছে তাঁদের জীবনের দীর্ঘ সময়। রেলওয়ের কলোনীতে দূ’টো বাসার মাঝখানে একটি করে পানির কল ছিল। সেখানে থেকে চেপে চেপে পানি এনে বাসার চৌবাচ্চায় সংগ্রহ করে রাখতে হতো ঘরকন্নার সব কাজের জন্য। নিজের হাতে ঘরদোর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে রান্না, কাপড় ধোয়া, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার দেখানো, সামাজিকতা, সেলাই ফোড়াই, উলের কাজের মত শৌখিনতার পরেও মা ঠিকই বই পড়ার সময় করতে পারতেন। রেলওয়ের কলোনীতে তখন ভ্রাম্যমান পাঠাগার ছিল। বাড়ী বাড়ী এসে বই দিয়ে যেতো, দূ’এক সপ্তাহ পরে আবার এসে সংগ্রহ করা হতো। পাঠাগারের কর্মী আশ্চর্য্য হতেন যে মাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক বই দেয়া হলেও সবই তিনি শেষ করে ফেলতেন এবং আরো বেশী করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করতেন।
মা সব ধরনের বই পড়তেন। এক কথায় বলা চলে বইয়ের প্রতি তাঁর ছিল সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। শিশু সাহিত্য থেকে শুরু করে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, দিনলিপি, ভ্রমন কাহিনী, গোয়েন্দা গল্প, কার্টুন, রম্য রচনা, অনুবাদ, আধ্যাত্মবাদ, জীবনী, ধর্মীয় কোন বিষয়ে তাঁর অরুচি ছিল না। প্রিয় লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বন্কিমচন্দ্র, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, মনোজ মিত্র, শরদিন্দূ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অচিন্ত্যকুমার সেন, প্রমথনাথ বিশী, মীর মোশাররফ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, কামিনী রায়, বেগম রোকেয়া, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়, বিমল মিত্র, নিহাররঞ্জন গুপ্ত, শংকর, আশাপুর্না দেবী, আশুতোষ মুখোপাধ্যয়, সৈয়দ মুজতবা আলী, বিভূতিভুষন বন্দোপাধ্যয়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যয়, মাইকেল মধূসুদন দত্ত, রাজশেখর বসু, বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যয়, প্রতিভা বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবুল মনসূর আহমেদ, মানিক বন্দোপাধ্যয়, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম প্রমুখ। বই সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি ছিল, “বই এমন এক বন্ধু যে কখনো আঘাত করে না।” বই একাধারে বন্ধু, শিক্ষক ও আশ্রয়।
এমন অনেক বই আছে যা আমরা পড়িনি কিন্তু মার মুখে তাঁর বর্ননা শুনেই তা মনে গেঁথে গিয়েছে। তারাশংকর বন্দোপাধ্যয়ের “আরোগ্য নিকেতন” কখনো পড়া হয়নি আমার। কিন্তু মার মুখের বর্ননায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে নিদান হাকা (মৃত্যুর ক্ষণ বলে দেয়া) জীবন কবিরাজের সঙ্গে তার স্ত্রীর অন্তঃসলীলা গভীর ভালবাসার সম্পর্ক। দৃশ্যতঃ স্বামীর প্রতি সতত বৈরাগ্য প্রকাশ করলেও আতর বৌ যে অন্তরের বাঁধনে বাঁধা তা কবিরাজ মশাই জানতেন তাই কখনো প্রত্যূত্তর করতেন না। নিজের মৃত্যুর কত দেরী জানার জন্য রোগ শয্যায় নিজের নাড়ী ধরে বলেছিলেন, “ঠাকুর একটু বিশ্রামের জন্য গাঁয়ের ঐ মাথার বট গাছটায় থেমেছেন। বেশী দেরী আর নেই।” সত্যিই যখন নাড়ী ধরা অবস্থায় জীবন কবিরাজ শেষ যাত্রায় চলে গেলেন তখন আতর বৌয়ের মর্মস্পর্শী কান্নার প্রতিধ্বনি (“নাড়ী ধরা সাঙ্গ হলো এবার ? আমায় কি করে গেলে?”) আমি মার মুখেই শুনেছি।
রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের পূরো সাহিত্য কর্মের প্রতি তাঁর ছিল অসীম ভালবাসা। বলতেন, “শুধুমাত্র কলমের কালি দিয়ে যে কি অপরূপ ছবি এঁকে দেয়া যায়, তা রবীন্দ্রনাথের মত সফলভাবে আর কেউ বাংলা সাহিত্যে করতে পারেননি”। “জল পড়ে, পাতা নড়ে”র দৃশ্যকল্প মার দূ’চোখে শৈশবে যে মায়ার অঞ্জন এঁকে দিয়েছিল তা মা আমৃত্যু বুকের মধ্যে রেখেছিলেন। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতার ভীষন অনুরাগী ছিলেন। গীতাঞ্জলীর অসংখ্য কবিতা তাঁর হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে ছিল। “যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই/ যা দেখেছি, যা পেয়েছি তুলনা তার নাই..”, “বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা..”, “চিত্ত যেথা ভয় শুন্য ..”, “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরনধুলার ’পরে ..”, “বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয় ..”, “একলা আমি বাহির হলেম তোমার অভিসারে/ সাথে সাথে কে চলে মোর নীরব অন্ধকারে..”, “মরন যেদিন দিনের শেষে আসবে তোমার দুয়ারে..” এইরকম অসংখ্য কবিতা তিনি আবৃত্তি করতেন। জীবনের আনন্দ, বেদনায় সমানভাবে তিনি রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতার মধ্যে শান্তি খুঁজতেন, বলতেন, “রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সুর ও দর্শনের যে সম্মিলন তা অতূলনীয়। সাধারনতঃ কবির কাছে সুর থাকে আর দার্শনিকের কাছে দর্শন থাকে। রবীন্দ্রনাথের কাছেই শুধু সুর ও দর্শন একাকার হয়ে গিয়েছে। তাই তাঁর গান, কবিতা পরশমনির মতো গভীরভাবে হৃদয়কে স্পর্শ করে।”
গোয়েন্দা গল্প
বইয়ের ব্যাপারে সর্বভূক মা সবধরনের বইয়ের অনুরাগী ছিলেন। কথা সাহিত্যিকদের মধ্যে শরৎচন্দ্রের বিলাসী, হৈমন্তী, রাম, শ্রীকান্ত, রমা, নরেন, দেবদাস, পার্বতী, ললিতা, মেজ দিদি, বিরাজ বৌ প্রভৃতি অসংখ্য চরিত্রের জীবনালেখ্যের মধ্যে মা তাঁর চারিদিকের মানুষদের খুঁজে পেতেন। শরৎচন্দ্রের অসাম্প্রদায়িকতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। “পল্লী সমাজ” উপন্যাসের এক জায়গায় জমিদার জেঠীমা মুসলমান প্রজাদের সম্পর্কে বলেন, “ওদের সজীব ধর্মই ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে”। মা এই জায়গাটির কথা অনেকবার বলেছেন।
শুধু যে সিরিয়াস বইয়েরই পাঠক ছিলেন তাই নয়। মা গোয়েন্দা গল্পের ভীষন একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। শরদিন্দূর “বোমক্যাশ বক্সী” থেকে শুরু করে আর্থার কোনান ডয়েলের “শার্লক হোমস”, নিহার রঞ্জন গুপ্তের “কিরীটি”, সত্যজিৎ রায়ের “ফেলূদা” হয়ে সেবা প্রকাশনীর “কূয়াশা”, “মাসুদ রানা”, ও “তিন গোয়েন্দা” সিরিজের সমস্ত বই মাকে বিমল আনন্দ দিতো। অপরাধের ক্লূ বিশ্লেষন করে রহস্যের কিনারায় পৌছানোর জন্য গোয়েন্দাকে যে মানসিক শ্রম করতে হয় তা মা খুব মূল্যায়ন করতেন। সবশেষে গোয়েন্দা যখন সফলতা অর্জন করে, তখন মা তা রীতিমত উপভোগ করতেন। গোয়েন্দা গল্প বিশেষ করে মাসুদ রানা সিরিজটি তাঁর প্রিয় হওয়ার আরো একটি কারন ছিল নানান দেশের মানুষ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও জীবনাচারের বর্ননার জন্য। ঐ একই কারনে সৈয়দ মুজতবা আলীও ছিলো তাঁর ভীষন প্রিয় লেখক। বলতেন, “বইয়ের পাতায় কত অজানাকে জানা হয়ে যায়। এ যেন বিনা খরচে বিশ্ব ভ্রমণ।”
আমাদের মার জীবনে এমন কোন দিন ছিল না যেদিন তিনি পবিত্র কোরান শরীফ ও কোন বই না পড়েছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোরান শরীফ, নবীজীর জীবন চরিত, মোহাম্মদীয়া পঞ্জিকা, গল্প, কবিতা, ও উপন্যাসের বই তাঁর বিছানার শিয়রের কাছে থাকতো। দিনের শুরু করতেন নামাজ, ও কোরান পাঠের মধ্য দিয়ে। সারাদিন যখনই অবসর পেয়েছেন তখনই বই হাতে নিয়েছেন। ঘুমানোর সময় কোরান পাঠ আর প্রার্থনা দিয়ে দিন শেষ করেছেন।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন