আমাদের মা - আমাদের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক - ৫
জোহরা ফেরদৌসী
মা ছিলেন আমাদের পরিবারের চলন্তিকা। যে কোন কিছু না বুঝলেই মার কাছে যেতাম। শুধু যে আমরাই গিয়েছি তাঁর কাছে তাই নয়, আশেপাশের গুরুজনদেরকেও দেখেছি পরম শ্রদ্ধায় তাঁর কাছেই আসতেন। অনেক সময় আমরা বাবার কাছে অনুমতি চাইতাম। কারন, মার চেয়ে বাবার কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী ছিল। কিন্তু আমাদের বাবাও প্রথমেই জানতে চাইতেন মা কি বলেন।
বাবার বাড়ীর তাঁর প্রজন্মের সকলের কাছে ছিলেন প্রিয় “ছোট আপা”। সকল আত্মীয়, স্বজনের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন সব সময়। সেকারনে সবাই বলতো যে কারুর খোঁজ খবর জানতে হলে ছোট আপার কাছে গেলেই জানা যাবে। এখনকার মত টেলিফোনে খোঁজ নেয়া নয়, মা স্বশরীরেই যেতেন সবার কাছে। তাঁর স্নেহধন্য সকল ভাইজী, ভাগ্নীদের সকলের কাছেই আছে তাঁর স্মৃতি। আর আছে তাঁর দেয়া উপহার বইয়ের পাতায় স্নেহাশীষসহ স্বাক্ষর। তাঁর এক চাচীর সঙ্গে বন্ধূত্বের কথা না বললে অসম্পুর্ন থেকে যাবে। আমাদের সেই নানী আটটি সন্তান নিয়ে খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। মা সব সময় তাঁর খোঁজ খবর নিতেন। আমাদের ভাই বোনদের সকলের বিয়েতে সেই নানীকে নিয়ে আসতেন। ঈদের আগে তাঁকে একটি শাড়ী কিনে দিতেন, যদিও নানীর তখন আর সেই দূর্দশা ছিল না। প্রতিবার বিদায়ের সময়ে এই দূই অসমবয়সী বন্ধূ এমন আকূল হয়ে কাঁদতেন যে বোঝা যেত তাঁদের মধ্যে কি গভীর ভালবাসা ছিল।
বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ীতেও তিনি গুরুজনদের স্নেহধন্য ছিলেন। আমাদের দাদী খুব দৃঢ়চেতা, বিচক্ষন মানুষ ছিলেন বলে মার কাছে শুনেছি। দাদা বাংলার পাশাপাশি ফার্সী ভাষায় কিতাব পড়তে জানতেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও যে মানুষ উদার, উন্নত, বিচক্ষন, ন্যায়পরায়ন হতে পারে তা মা বলতেন তাঁর আশে পাশের মানুষদের স্মৃতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। আমাদের নিভৃতচারী বাবার আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গেও মারই যোগাযোগ ছিলো বেশী। আমাদের কাকা, জেঠা, ফুপু, চাচীরা আমাদের বাসায় এলে সবার আগে মার সঙ্গে দেখা করতেন। আমাদের বাসায় মার ঘরটি সবসময় মুখরিত থাকতো। ছূটির দিনে ভাইবোনরা সবাই এসে আমরা সবাই মার ঘরেই গল্পে মেতে উঠতাম। মার নাতি-নাতনীরাতো দাদীকেই ঘিরে থাকতো তাঁর গল্প, কবিতা, গানের জন্য। অদ্ভুতভাবে মার বিছানায় একে একে সব ক’টি নাতি-নাতনী, ছেলের বৌ, মেয়েরা জায়গা হয়ে যেতো।
জীবনের বড় একটা সময় তিনি আর্থিক দৈন্যদশায় ভুগেছেন। সেই অক্ষমতা এতোই তীব্র ছিল যে আমার বড় ভাইয়ের ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট বের হওয়ার পরে তাকে পাঁচটি টাকা দিতে পারেন নি। আমার বড় ভাই খবরটি টেলিগ্রাম করে নানীকে জানাতে চেয়েছিলেন। বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ছেলের হাতে সেই টাকাটি না দিতে পারার বেদনা তাঁর অনেকদিন ছিল। কিন্তু এতো দূর্দশার মধ্যেও ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ চালিয়েছেন। তাঁর বিয়ের স্মৃতিচিন্থ গয়না বিক্রির কথা কেউ বললে বলতেন, “মানুষেরতো দূ’এক সেট গয়না থাকে। আমার আছে নয় সেট।” দারিদ্রের কারনে তাঁর সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ হয়নি এই অর্জনই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ। আত্মীয় স্বজনরা কেউ কখনো তাঁকে “রত্নগর্ভা” বলে ডাকলে সবচেয়ে খূশী হতেন। আমাদের এই মাকেও যে আমরা দূঃখ দেইনি, তা কিন্তু নয়। দিয়েছি। জীবনে যখন যার কাছ থেকে যে আঘাতটুকুই পেয়েছেন, আহত হয়েছেন। তারপরে এক সময় নিজেই তা অতিক্রম করে উঠেছেন। শুধু “ক্ষমা মহৎ ধর্ম” বলে ক্ষান্ত থাকেননি, যে আঘাত দিয়েছে তার কাছে আগ বাড়িয়ে গিয়েছেন, কথা বলেছেন। আমাদের সেই মা সন্তানদের কাছে আঘাত পেয়েও বলেছেন, “কূপূত্র যদিও হয়, কূমাতা কখনো নয়”।
ঈশ্বর মঙ্গলময়
মার তাঁর গভীর ধর্মবিশ্বাস আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করার চেষ্টা করেছেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও পবিত্র কোরান শরীফের তাফসীরসহ তর্জমা প্রতিদিন পড়েছেন। নিত্যসঙ্গী কোরানের অধিকাংশই তাঁর মুখস্থ ছিল। কোরানের বঙ্গানুবাদ পড়তে পড়তে অনেকসময়েই আবগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। বিশেষতঃ সুরা আর-রাহমানের “অতএব তোমরা আমার কোন অবদানকে অস্বীকার করবে ?” আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীন যখন এক এক করে মানবজাতির ওপর তাঁর দেয়া করুনাধারার বর্ননা দিচ্ছেন এবং এই প্রশ্ন করছেন তখন তার মর্মবানী মার মরমে গিয়ে পৌছাতো। এছাড়াও, কোরানের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পয়গম্বরদের মোনাজাত মা বিশেষভাবে খাতায় লিখে রাখতেন ও তাঁর নিজের মোনাজাতে উল্লেখ করতেন। তাঁর মোনাজাত হতো দীর্ঘ ও মর্মস্পর্শী।
আমাদেরকে সকল সময় সৃষ্টিকর্তা দয়া, করুনার আঁধার বলে শিখিয়েছেন। জীবনের আনন্দ বেদনায় সমানভাবে মঙ্গলময় আল্লাহর স্মরন করতে বলেছেন। বলতেন, “সূখে নতজানু হও আল্লাহর কাছে যে তিনি তোমাকে এই সূখ দিয়েছেন। দূঃখেও তাঁকে স্মরন করো, কারন তিনিই রক্ষাকর্তা। আরো মনে রেখো তোমার চেয়েও দূঃখে কেউ আছে। অপরের দূঃখ যেনো বুঝতে পারো সেজন্যেই আল্লাহ তোমাকে এই দূঃখ দিয়েছেন। দূঃখও জীবনের অংশ। জীবনের ধন কিছূই যায় না ফেলা।”
মা সবকিছূই গল্প বলে শিখাতেন। “ঈশ্বর মঙ্গলময়” এই শিক্ষাও তিনি একটি গল্প বলেই শিখিয়েছিলেন। এক রাজ্যের মন্ত্রী খুব ধার্মিক ছিলেন, সকল সময় বলতেন “ঈশ্বর মঙ্গলময়”। রাজা একারনে খুব বিরক্ত ছিলেন মন্ত্রীর ওপর। কিন্তু বিচক্ষনতার জন্য তাকে ছাড়া রাজার চলতোও না। একবার রাজা শিকারে গিয়েছেন সদলবলে। যে কোন ভাবেই হোক রাজার আঙ্গূল কাটা গেল। তখনও মন্ত্রী বলে উঠল, “ঈশ্বর মঙ্গলময়”। রাজা তখন প্রচন্ড রেগে গিয়ে মন্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে একটি গর্তে ফেলে দিলেন। এদিকে রাজা তার দলবল নিয়ে বনের আরো গভীরে শিকারের উদ্দেশ্যে ঢুকে গেলেন। এমন সময় প্রচন্ড জোরে দিক বিদিক অন্ধকার করে ঝড় এল। ঝড়ের তান্ডব লীলায় সবাই এদিক ওদিক ছূটে গেল, রাজা একা হয়ে গেলেন। সেই অন্ধকারে একদল জংলী এসে রাজাকে ধরে নিয়ে গেল তাদের পূজার বলী দেয়ার জন্য। রাজা তখন বিচক্ষন ও সূহৃদ মন্ত্রীর কথা মনে করে কাঁদতে লাগলেন। এদিকে বলী দেয়ার আগে রাজার হাতের ক্ষত চিন্থটি জংলীদের দৃষ্টিগোচর হল। তারা তখন খূঁতসহ রাজাকে বলী না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল ও তাকে বনের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে এল। ততক্ষনে ভোরের আলো ফূঁটে উঠেছে। রাজার দলবল সবাই একত্র হয়ে রাজাকে খূঁজে পেল। রাজা সবাইকে নিয়ে মন্ত্রীকে সেই গর্ত থেকে উদ্ধার করলেন ও ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। মন্ত্রী প্রথম কথাই বললেন, “ঈশ্বর মঙ্গলময়”। সব শুনে আরো বললেন, “মহারাজ, আপনি ইশ্বরের ইচ্ছায় আমাকে গর্তে ফেলে দিয়ে ভাল কাজ করেছেন। তা নইলে জংলীরা নিখূঁত আমাকে বলী দিতো। আপনার হাতের আঙ্গূল কাটা যাওয়ার মধ্যেও মঙ্গল আছে। সে কারনেই আপনি প্রানে বেঁচে গিয়েছেন। মহারাজ, ঈশ্বর সদাই মঙ্গলময়, আমরা অবোধ। তাই বুঝি না।”
(ক্রমশ)
মন্তব্য
"প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও যে মানুষ উদার, উন্নত, বিচক্ষন, ন্যায়পরায়ন হতে পারে তা মা বলতেন------------"
আপনার মা সত্যিই বিচক্ষন মেধাবী ছিলেন। ওনার জন্যে শুভ কামনা!!!!!!!!!!!!
এস হোসাইন
---------------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার মত এক অতি সাধারণ সন্তানের মাকে নিয়ে লেখাটি সময় নিয়ে পড়ার জন্য । আপনার মায়ের প্রতিও রইলো আমার শুভ কামনা ।
নতুন মন্তব্য করুন