আমার পরিবর্তিত জীবন। বেকার জীবন। সপ্তাহ দুয়েক আগেও ছাত্রই ছিলাম বলা যায়। কোত্থেকে কি হয়ে গেলো, মাত্রতো সেদিন ট্রেনে করে ঢাকা আসলাম, ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে কয়টা ক্লাস করলাম, বন্ধুদের সাথে চা টা খেয়ে আড্ডা দিলাম, কয়দিন বাদে বাদে কয়টা পরীক্ষা দিলাম, শুনি যে পাশ করে গেছি, হাসিনা এসে সার্টিফিকেট দিয়ে গেলো আর আমি কিনা হয়ে গেলাম এক বেকার যুবক! চার চারটা বছর লাগলো ইঞ্জিনিয়ার হতে আর বেকার হতে কিনা লাগলো একদিন! একদম ফ্রেশ গ্রাজুয়েট প্লাস একদম ফ্রেশ বেকার।
বেকার জীবনের নানান অভিজ্ঞতা কমবেশি সবারই আছে। আমার স্বল্প বেকার জীবনও সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করা শুরু করেছে। বেকার জ়ীবনের শুরুতেই যেই ব্যাপারটা আমাকে বিব্রত করছে তা হলো...একই ছাদের নিচে ২৪ ঘন্টা বাপ-বেটার সহবস্থান। আমি বেকার, উনি অবসরপ্রাপ্ত। সারাদিন কামকাজ না পেয়ে এমনিতেই উনার মেজাজ সবসময় খিটমিটে হয়ে থাকে, আমিও কম কিসের? আমারও কামকাজ নাই। তাই উনার সাথে সমানতালে আমিও খিটমিটিয়ে যাই। বাপ সরাসরি কিছু বলেন না। তবে উনার চাহুনি দেখলে আমি মনোবিজ্ঞানী হয়ে যাই। খুব সুন্দর পড়ে ফেলি, উনি বলছেন...হারামজাদা তোকে দক্ষিণখানের জমি বিক্রি করে পড়ালেখা করাইছি আর তুই কিনা এখনো আমার ঘাড়ের উপর বসেই খাচ্ছিস। আমি মার কাছে যাই। অভিযোগ জানাই। মা উল্টা আমারে সতর্ক করেন, ‘চাকরি বাকরি কিছু একটা জোগাড় কর, তোর বাপ এমন করবেই, তোর দাদাও তোর বাপেরে এমন বেকারত্বের খোটা মারতো, কথা শুনতে শুনতে না পেরে তোর বাপই একদিন ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেছিলো’। আমি মনে মনে হাসি। আব্বায় তো ম্যালা বোকা আছিলো, আমি কিন্তু আব্বার মতো বোকামী করুম না।
চার বছরে কত কত সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট পড়লাম। স্টুডেন্ট, টিচার, ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরী, হোস্টেল আরো বহুত কিসিমের ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের অ্যানালাইসিস করতে হইছে। তবে ‘মানি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ এর ইমপ্লিমেন্টেশনটা মনে হয় বেকার জীবনে এসেই করতে হলো। আরে কয়দিন আগে প্যাকেট প্যাকেট বেনসনের হিসাবও কোন ফাঁক গলে বেরিয়ে যেত আর এখন একখান বিড়ি খাইতেও কত কি চিন্তা করতে হয়। ইদানিং ৫/৬ টাকার রিক্সা-পথ হেঁটেই পাড় করি। মাঝারী সাইজের দূরত্বও লোকাল বাসেই সেরে নেই। তাও ভাড়া নিয়ে প্রায়ই ক্যাঁচাল লাগায় দেই। সবসময় ধান্ধায় থাকি কিভাবে চললে গাঁটের পয়সা কিছুটা বাচঁবে। বড় ভাইদের সাথে মিশি, ছোট ভাইদের এড়িয়ে চলি। আম্মা মাঝে মাঝে বাজারে পাঠান টুকটাক কেনাকাটা করতে, বাকী টাকা আর ফেরত দেই না। এভাবেই চলছে অভাব অনটনের বেকার জীবন।
আরে আরে ভাইজানেরা এই প্যারা পড়ে ইমোশনাল হয়ে পড়বেন না। লেখাগুলা আসলে আমিই বেকারদের প্রতি কিছুটা ইমোশনাল হয়ে বাংলা সিনেমা স্টাইলে লিখে ফেলেছি। আপনাদের দোয়ায় আল্লাহর রহমতে অভাব অনটন এখনো আকঁড়ে ধরে নাই। পুরা ৫০০০ টাকার টিউশনি করছি, বহাল তবিয়তে ডাইরেক্ট বাসে করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছি, বড়ভাই ছোটভাই যাদের সাথেই আড্ডায় বসি না কেন বিড়ি ঠিকই শেয়ারে ফুঁকে যাচ্ছি, বাজারের বাকী টাকা আগেও কখনো ফেরত দিতাম না আর এখন তো দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। আছি ভালো, বেশ আছি।
মিরপুর থেকে উত্তরা টিউশনিতে যাই। আগে বাসা থেকে টিউশনিতে গেলে সবসময় সেখান থেকে বোর্ডবাজার যাওয়ার তালে থাকতাম, আর ফোন করে আম্মাকে বলতাম, ‘আম্মা আইইউটি গেলাম গা’। যেখানেই থাকি না কেন লাল দেয়ালগুলো যে কি অদ্ভুত আকর্ষণে টানতো তা বুঝাতে পারবো না। এখনও টিউশনিতে যাই উত্তরা কিন্তু গাজীপুরের বাসে আর চড়া হয় না। চার বছর আইইউটিতেই পড়ে থেকেছি। যেই ঢাকা-গাজীপুর ভ্রমণ ক্লান্তি আর বিরক্তিতে খুব বেশি করা হতো না, সেই ঢাকা-গাজীপুর ভ্রমণ এখন মনে হয় প্রতিদিন করি। হায়রে কি ছিল জীবন আর এখন চলছে কি জীবন!
আগে পকেটে সবসময় একটা চাবির গোছা থাকতো। আইইউটির রুম আর লকারের চাবি। চাবির রিং এ লেখা ছিল ‘hell to live, heaven to leave’। আইইউটিতে যখন ঢুঁকি বড়ভাইরা আমাদের সবাইকে উপহার দিয়েছিল চাবির রিংটা। বড়ভাইরা অবশ্য পড়ালেখার চাপজর্জরিত আইইউটি জীবনকে hell আর আইইউটি ছাড়ার পর উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে heaven বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু আমার জীবনতো চারবছর heaven এ পার করে এসে এখন বের হয়ে পুরা hell হয়ে গেছে।
বেকার জীবনে এসে সবকিছুর সাথেই মানিয়ে নিচ্ছি ধীরে ধীরে। শুধু সময় লাগছে আইইউটিকে বাদ দিয়ে জীবনটা চিন্তা করতে। জানিনা কি অদৃশ্য বন্ধনে এখানে আটঁকা পড়েছি। আইইউটি, আইইউটি জীবন, আইইউটির দোস্তরা সবকটাকেই সমানতালে মিস করছি। কেন এত অল্প বয়সেই ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলাম? কেন এত তাড়াতাড়িই আমি বেকার হয়ে গেলাম? তাও বেকার হয়েছি ভালো কথা। বেকারের দুঃখ কষ্টের কারনে থাকবে অর্থের টানাটানি, পারিবারিক কলহ, বেকারত্বের গ্লানি। কিন্তু আমার কষ্ট, আমার দুঃখ কেন শুধু ঐ লাল দালানগুলোকে কাছ থেকে না পাবার কারনে। জানি লাল বরাবরই আমার অপ্রিয় রঙ, তবুও কেন সারাজীবন আমায় কাঁদাবে ঐ লাল ইটের দেয়ালগুলি?
/
ভণ্ড_মানব
মন্তব্য
হমমম। পড়লাম।
পাস করার পর ১ মাস ২৩ দিন বেকার ছিলাম। ঐ জীবনের কথা মনে পড়ছে এখন। টিউশনি করাতাম। ১ জন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার; ২ জন ফার্স্ট ইয়ার। ১ জন হলিক্রস; ২ জন ভিকারুননিসা । কোচিং এ ক্লাস নিতাম। টাকার কষ্ট তেমন হয়নি। এর মধ্যে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম ২ টা প্রাইভেট ইউনিতে। আইইউটিতে যেদিন জয়েন করি সেদিনই অন্য একটা প্রাইভেট ইউনি থেকেও জয়েন করতে বলেছিল।
সময়গুলো বড্ড দ্রুত চলে যায়। আর কান্নার জন্যও আরো অনেক উপলক্ষ পাবে বোধকরি। হতে পারে তা আনন্দ অশ্রু।
----------------------------------------------
আমার যত অগোছালো চিন্তাগুলি,
রয়ে যাবে এইখানে অযতনে ।।
পড়লেনই খালি? ভালো মন্দ কিছু লাগলো না?
আর আপনে তো দেখি সেই আমল থেকেই মাইয়া লইয়া আছেন।
আপনে মিয়া হাই-প্রোফাইল পুলা...আমরা নিম্নমানের বেকার...তবুও দোয়া রাইখেন যেন একদিন এ চোখে আনন্দ অশ্রু ঝরে।
বেকার কথন মজাদার হৈছে। আপনের লাল রঙ অপ্রিয় হৈলেও মিয়া আপনের রঙের সংজ্ঞায় কিঞ্চিৎ ঘাপলা আছে। আইইউটি লাল রঙের না, বারগেন্ডি রঙের। বারগেন্ডি রঙ না চিনলে কাছে ধারের কোনো ঠোঁটপালিশের দোকানের সামনে গিয়া আমার নাম নিয়া খাড়ায়া যান, আর কোনো আফা ভেতরে ঢুকতে নিলেই জিগান, "আফা বারগেন্ডি রঙ কোন্টা?" আফায়, আমার ওয়াস্তে চিনায়া দিবে। না চিনাইলে আমার নাম কইয়েন।
ধন্যবাদ ধুগোদা।
আর আইইউটি তো আমার কাছে লাল রঙেরই লাগে...ধুসর লাগে না।
এই ধরনের লেখা পরলেই মনটা আজ কাল অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়।মনে হয়,আর মাত্র ২ বছর????
ভণ্ড ভাই,লেখা ভাল লাগল।১৭ তারিখের জন্য শুভকামনা থাকল।
কেউ_না
দোয়া করিস ভাই। তোদের দোয়াতেই বেঁচে আছি।
লেখা ভালো হইছে। পাঁচ তারা। এইবার আমাকে একটা টিউশনি দে। সিরিয়াস্লী!
পুচ্ছে বেঁধেছি গুচ্ছ রজনীগন্ধা
থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু।
বেকারের সম্বল একটা মাত্র টিউশনি...আইচ্ছা তোকেও কিউতে রেখে দিচ্ছি আপাতত।
এই বেকার জীবনের ভয়ে আমি এখনো পড়াশোনা করছি। আর তোমরা যে সবাই মিলে লাল দেয়াল লাল দেয়াল শুরু করলা, আমার তো খালি জেলখানার কথা মনে পড়ে।
________________________________________________
হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে
________________________________________________
হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে
হুম জেলখানাই...তবে এই জেলখানায় সারাজীবন কাটিয়ে দিলেও কোন আফসোস থাকবে না।
সুন্দর লাগলো লেখা। চাবির রিং এর লাইন দুটি চমৎকার ছিলো! সুন্দর একটি স্মৃতি হয়ে থাকলো সেটা।
অনেক ধন্যবাদ মৃত্তিকা আপু। চাবির রিং এর লাইন দুটি আসলেই অনেক চমৎকার।
এদের সমস্যাটা কি? মাস পার হয় নাই এখনও, প্যানপ্যান শুরু করেছে!!! আরে আমিতো যুগ যুগ ধরে বেকার। বাপ, মা, ভাই, বউ হয়ে এখন ছেলের ঘাড়ে চাপার অপেক্ষায়।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আপনে তো বিশাল সৌভাগ্যবান দেখছি!
বাইর হয়ে বুঝা যাইতেছে কি হেভেনে আছিলাম। তুই তো বাসায় থাকস, মেসে থাকলে বুঝতি টাকা সব ক্যাম্নে কাম্নে বাইর হইয়া যায়।
স্পার্টাকাস
হুম তোদের দুঃখ বুঝতে পারতাছি। তয় বাপের মুখোমুখি হইতে আমার বিশাল পেইন লাগতাছে।
পইরা খুবেই ভাল লাগল একই সাথে খারাপ ও লাগল। জাই হউক অতি সুন্দর লিখা চালাই জা
কিরে তুই ব্যস্ত জীবন থেকে কিছু সময় বের করে আমার লেখা পড়েছিস...ভাবতেই আনন্দ লাগতাছে।
মন খারাপ করিস না...বিদেশ গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বেকার জীবনটাও এনজয় কইরা নাও। নয়টা-পাঁচটা অফিস করলে তখন এইটারেও মিস করবা। আসলে, মজার লাইফ শেষ কইরা ফেলছো, এখন শুধু পিছনে তাকায়া বলার সময় - "আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম"!
লেখাটা খুবই ভালো হইছে। চালায় যাও।
"Life happens while we are busy planning it"
থ্যাঙ্কু রাফি ভাই।
হাঁড়ে হাঁড়ে উপলব্ধি করতাছি...'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!'
বেকার জীবন উপভোগের চেষ্টায় আছি...দোয়া রাখবেন।
অনেক শুভ কামনা রইল। বেকার হয়ার দুঃখে পাশ করার কৃতিত্বটা ভুলে যাবেন না কিন্তু।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
-----------------------------------------------------
আর কিছু না চাই
যেন আকাশখানা পাই
আর পালিয়ে যাবার মাঠ।
অনেক ধন্যবাদ আহির ভাই। ভালো কথা মনে করায় দিসেন। বেকার হতে পারি...সেই সাথে ইঞ্জিনিয়ারও বটে।
চাকৃবাকৃকর্তেভাল্লাগেনারে।
তোর্টিউশনিটা আমারে দিয়া দে। একটা বেনসন দিমু নে।
(কানে কানে) শুনলাম, অস্ট্রেলিয়া যাইতাছস বলে?
*******************************
আমার শরীর জুড়ে বৃষ্টি নামে, অভিমানের নদীর তীরে
শুধু তোমায় বলতে ভালবাসি, আমি বারেবার আসব ফিরে
*******************************
আমার শরীর জুড়ে বৃষ্টি নামে, অভিমানের নদীর তীরে
শুধু তোমায় বলতে ভালবাসি, আমি বারেবার আসব ফিরে
অন্ধের লাঠিটাও নিয়ে যেতে চাস?
(জনসম্মুখে) আমি আর অস্ট্রেলিয়া?
নিশ্চই আকতার/আদনানের জায়গায় ভুলক্রমে আরমান শুইনা ফালাইসোস।
লেখা ভাল লাগল। জীবন ভালই কাটতেছে, তবে আইইউটি মিস করি... পড়ার পর আরও নস্টালজিক হয়ে গেলাম, যদিও মাত্র ১ সপ্তাহ আগের ব্যাপার
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
থ্যাঙ্কু দোস্ত
যুগ যুগ পার হয়ে গেলেও মনে হয় আইইউটিকে এখনকার মতোই মিস করবো। ভালো থাকিস।
বাড়ির রং পাল্টায়া লাল রং করেন... আমারো চাকরি নাই... বেকার কি না জানি না
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নতুন মন্তব্য করুন