আমার ছেলেবেলাটা কেটেছিল গ্রামে, শীতের সকালে খেজুরের রস আমার অনেক পছন্দের একটি জিনিস ছিল। দাদু এ ব্যপারটি লক্ষ্য করে আমাদের গ্রামেরই এক বুড়ো গাছিকে রোজ সকালে রস দিয়ে যেতে বলেন। দিনকয়েক যেতে না যেতেই আমার সাথে বেশ ভাব হয়ে যায় গাছি হারুন দাদুর। কোন কোন দিন খুব ভোরে শিশিরভেজা ঘাস বা গ্রামের আলপথে আমাকে তিনি নিয়ে গেছেন কোন একাকী খেজুর গাছের পাশে। গরম কাপড়ে আগাগোড়া আবদ্ধ আমি শুধু অবাক চোখে দেখতাম- এই শীতে একমাত্র প্রতিরোধ গায়ের শালটা খুলে হারুনদাদু কেমন করে কুয়াশার চাদর চিরে তরতর করে উঠে যেতেন গাছে! রসের কলসিটা নামিয়ে এনে আমার জিভে খানিকটা ছুইয়ে আদরমাখা গলায় শুধাতেন- ‘স্বোয়াদ হইসে গো দাদুভাই?’
পাশের বাড়ীর রাজুর সাথে খেলা শেষে এক বিকেলে বিষন্নমনে আমি ফিরে আসি মায়ের কাছে। কান্নাভেজা গলায় অভিমান নিয়ে মাকে বলি- ‘মা আমি আর কখখোন হারুনদাদুর সাথে কথা বলব না’। মা আমার এই আকস্মিক পরিবর্তনে হতভম্ব হয়ে যান। দাদু কতভাবে আমাকে সুধান, আমি কাউকে কিচ্ছু বলি না।
দিনপনেরো টিকেছিলো আমার এই প্রতিজ্ঞা, আবার এক শিশিরপড়া ভোরে বেড়িয়ে পড়ি হারুনদাদুর সাথে, সারাটা পথ হারুনদাদু আমাকে শোনালো এক খোড়া শেয়ালের কিচ্ছা। কিন্তু সেদিন আমি আর আগের মতো প্রশ্ন করি না, পাথরমুখে মাটির দিকে তাকিয়ে আমি হেঁটে যাই পুরোটা পথ।
খেজুর গাছের সামনে এসে হারুনদাদু শালটা আমার হাতে দিয়ে ফিরতেই পিছনথেকে আমি তার জামাটা টেনে ধরি। উনি ভিষণ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন- ‘কী হয়েছে গো দাদুভাই?’
আমি কোন জবাবদেইনা। টের পাই তার মুখেরদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার দৃষ্টি যেন ঝাপসা হয়ে আসে। আমার গালবেয়ে নোনাপানির প্রথম ফোটাটি পড়তেই তিনি আমাকে বুকে টেনে নেন, আবারো ব্যাকুল হয়ে সুধান- ‘কী হইসে গো দাদুভাই?’।
আমি তার কাধে মাথা কাত করে ফুপিয়ে উঠি- ‘দাদু, রাজু সেদিন বল্লো তুমি নাকি রাজাকার ছিলে? তুমি কেন…’ । আমি আর কোন কথা বলতে পারছিলাম না। কান্নার তোড়ে আমার বাকি সব কথা গড়িয়ে পড়লো চোখের কোনা দিয়ে।
আমাকে আলিংগন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হারুনদাদু নিষ্ঠুরভাবে উল্টোফিরে দাঁড়ান। কুয়াশাঢাকা সেই সকালে হারুনদাদুর মুখ থেকে আমি আর কোন কথা শুনতে পাইনি কিন্তু ফিরিয়ে নেয়া মুখের দুপাশদিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতকে আমি দেখেছিলাম ভোরের ম্লান আলোয়।
পরিশিষ্টঃ
সে দিনের পর থেকে হারুনদাদুর সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হয়নি। এর দুদিনই পর স্কুল ভর্তি পরিক্ষা দিতে ঢাকা আসাতে হয়েছিল আমাকে। ফিরে গিয়ে শুনতে পাই হারুনদাদু গ্রাম ছেড়েছেন। দাদুর কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম হারুন দাদু যুদ্ধের সময়টায় সত্যিই শান্তি বাহীনিতে ছিলেন। গ্রামের এক সাধারণ বর্গা চাষী হয়ে মোড়লের কাছথেকে নেয়া ধার পরিশোধ না করতে পারা হারুন দাদুর সামনে জেলে যাওয়া ছাড়া এই একটিই পথ খোলা ছিলো।
এখনো প্রতিবছর একবার করে গ্রামে যাই। সেই খেজুর গাছটি আজো আছে। শুধু আমারই কারো হাত ধরে কুয়াশাঢাকা সকালে রস আনতে যাওয়া হয় না...
------------------- মনজুর এলাহী -----------------------
মন্তব্য
যেসব বর্গাচাষী মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের সামনে কি ঋণমুক্ত হবার পথ অবারিত ছিল?
এই গল্পটা লিখবার উদ্দেশ্য কি "সব রাজাকার খারাপ না" জাতীয় উত্তরাধুনিক ত্যানা প্যাচানি?
বুঝ্লাম্না
অজ্ঞাতবাস
অজ্ঞাতবাস
সুমনদা, ত্যানা প্যাচানো আমার উদ্দেশ্য না। আর পালের গোদা রাজাকারদের শাস্তি আমিও মনেপ্রাণে চাই। রাজাকারদের যে আমি কতটা ঘৃণা করি তা প্রকাশ করতে গেলে তা শালিনতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে।
গল্পটা হুট করে মাথায় এসে যাওয়ায় লেখা। কিন্তু রাজাকারদের মাঝেও যে কিছু মানুষও ছিলো তা অস্বিকার করা কি অপরাধের কাতারে পড়ে?
আমার কাকা মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি বাহিনীর তিনজন সদস্যের কাছ থেকে অনেক ইনফর্মেশন বের করেছিলেন। তারা শান্তি বাহিনির তালিকাভুক্ত ছিলেন ঠিকই কিন্তু পাকিস্তানিদের আর রাজাকারদের হারামিগিরি তাদের কাছেও অসহ্য ছিল। তারা হয়তোবা মুক্তিযোদ্ধাদের মত সাহসী ছিলেন না কিন্তু রাজাকারদের মতো নিমকহারামও ছিলেন না।
গল্প পড়ার জন্য, কমেন্ট করার জন্য এবং গুতানোর জন্য ধন্যবাদ।
সুমনদা, ত্যানা প্যাচানো আমার উদ্দেশ্য না। আর পালের গোদা রাজাকারদের শাস্তি আমিও মনেপ্রাণে চাই। রাজাকারদের যে আমি কতটা ঘৃণা করি তা প্রকাশ করতে গেলে তা শালিনতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে।
গল্পটা হুট করে মাথায় এসে যাওয়ায় লেখা। কিন্তু রাজাকারদের মাঝেও যে কিছু মানুষও ছিলো তা অস্বিকার করা কি অপরাধের কাতারে পড়ে?
আমার কাকা মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি বাহিনীর তিনজন সদস্যের কাছ থেকে অনেক ইনফর্মেশন বের করেছিলেন। তারা শান্তি বাহিনির তালিকাভুক্ত ছিলেন ঠিকই কিন্তু পাকিস্তানিদের আর রাজাকারদের হারামিগিরি তাদের কাছেও অসহ্য ছিল। তারা হয়তোবা মুক্তিযোদ্ধাদের মত সাহসী ছিলেন না কিন্তু রাজাকারদের মতো নিমকহারামও ছিলেন না।
গল্প পড়ার জন্য, কমেন্ট করার জন্য এবং গুতানোর জন্য ধন্যবাদ।
---- মনজুর এলাহী ----
ক্যাটাগরীতে "গল্প" দেখে কমেন্টাচ্ছি...
সচলে প্রথম লেখা হিসেবে একটু বিতর্কিত প্লট বেছে নিয়েছিস। যদিও আমার মনে হচ্ছে না "সব রাজাকার খারাপ না"- এটা বলা তোর উদেশ্য; তারপরেও আমার গল্পটা ভালো লাগে নাই। কোন রাজাকার যদি এই টাইপ যুক্তি দাঁড় করিয়ে সহানুভূতি আদায় করতে চায়- এবং তাতে কারো মন গলে- তাইলে বিপদ।
_________________________________________
সেরিওজা
সত্য কইসস... প্লটটা বিতর্কিত। চরম বিতর্কিত...
মিথ্যা কইসস... প্লটের বিষয়ডা বাদ দে, বাকিটুকুতো সুন্দরই হইসে। গল্প ভালো লাগ্লো না ক্যান?
আর কোন রাজাকারের এই পোস্ট পড়ার সম্ভাবণা কতটুকু? সচলে রাজাকাররা আসে কি??? আর আসলেও হিমুদা, ধুগোদা, লিলেনদা, মুস্তাফিজ ভাই এর লেখা বাদ দিয়া আমার লেখা যেই হালা পড়বো অয় তো...
---- মনজুর এলাহী ----
গল্প ভালো লাগার বিষয়টা আসলে পাঠকের রুচির উপর নির্ভর করে, আমার ভেতরের পাঠকের এই গল্পটা ভালো লাগেনি। সৌন্দর্য্যের প্রয়োজন দেখি না, ভাষা-বর্ণনা-চরিত্র দিয়েই একটা ভালো লাগা গল্প বানিয়ে ফ্যাল দেখি...
কমেন্টে এর পরের অংশটা খাপছাড়া ঠেকছে...
_________________________________________
সেরিওজা
মাফ করবেন। অনেক কিছু প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলেছি।
স্কুলপড়ুয়া বালকের অভিমানের ধাক্কায় রাজাকার বুইড়া গ্রাম ছেড়েছে, মানতে পারছিনা।
প্রিয় একটি মানুষ(!) রাজাকার ছিল, সেটি জানার পর এত কমবয়সী বালকের আবেগও ঠিক মানানসই মনে হচ্ছেনা। (দাদুর পিছে পিছে খেজুরের রস আনতে যাওয়ার বয়স খুব বেশি হবে বলে মনে হয়না। গ্রামের ছেলে হলে তো সেই বয়স দশ বছরের বেশি হওয়ার কথা না।)
মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বাদ দিয়ে এমনকি এদেশের সাধারণ মানুষদেরও পুরো ৭১'এ ছিল মৃত্যুর ভয়। জেলে যাওয়ার ভয়ে রাজাকার হলে মৃত্যুর ভয়ে তো তাদের ফাকিস্তান হাটুরে বাহিনিতে যোগদেয়ার কথা তাদের।
লেখাটায় কি বোঝাতে চেয়েছেন দয়া করে আরেকবার বলুন। (যা বুঝেছি তা সত্যিই বিশ্বাস করতে চাইনা।)
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
যা বুঝেছেন তা বিশ্বাস না করতে চাওয়ার জন্য ধন্যবাদ। লেখাটাও আসলে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা নয়।
বালকের আবেগের পরিমাণের বিষয়টা আসলে আমার অতিকল্পনা মনে হয় না। আমরা বড়রা মনে করি ছোটরা বোঝেনা, কিন্তু সত্যি সত্যি তারা কিন্তু অনেক কিছু বোঝে।
রাজাকারদের নৃশংসতা বুঝতে পারার কিন্তু যথেষ্ট কারণ আছে... অনেক পরিবারেই ছোট বাচচাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান হয়। শিশু মন কিন্তু অনেক কিছু সেখান থেকে অনেক কিছুই মাথায় নিয়ে নেয়। অন্তত রাজাকারদের বর্বরতার স্বরূপ বুঝতে না পারলেও রাজাকাররা যে অনেক খারাপ আর তারা যে দেশের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করেছে তা তারা ঠিকই বুঝে যায়।
প্রসংগক্রমে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল, ক্লাস ফোরে থাকতে আমাদের ড্রইং টিচার 'দিদার স্যার' আমাদের ক্লাসের সবাইকে নিয়ে একটা নাটক করতে চেয়েছিলেন। নাটকের বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। নাটকের গল্পটা আমাদের পড়ে শোনানোর পর তিনি অভিনেতা সিলেকশনের কাজ করতে চেয়েছিলেন। একটা সাদা কাগজ টেবিলের উপর রেখে তিনি সবাইকে নিজের নাম আর পাশে কোন চরিত্রে অভিনয় করতে চায় তা লিখতে বললেন। আমাদের সবার নামের পাশে এক্টাই কথা লেখা ছিলো- 'মুক্তিযোদ্ধা'। দিদার স্যারের সারা মুখজুড়ে একটা হাসি খেলে গিয়েছিল- সে হাসি আমি এখনো মনের চোখে দেখতে পাই...
হুঁ... ঠিকই বলেছেন। বুড়ারে পটল ক্ষেতে সবজি আহরনের কাজে পাঠানো উচিত ছিলো। ভুল হয়ে গেসে... (আফসোসের কোন ইমোটিকন থাকলে সেইটা)
বাকিটুকুর জবাব উপরের মন্তব্যের জবাবে দিয়েছি।
পড়ার জন্য, গুঁতানের জন্য এবং বিশ্বাস রাখার জন্য ধন্যবাদ জানবেন।
---- মনজুর এলাহী ----
গল্পটা ভালো হয়েছে বলতে সংকোচ নেই। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে দুটো কথা মনে পড়লো।
১. শুওর যতই মোটাতাজা আর সুন্দর হোক কোরবানিতে লাগে না।
২, শুওরের কপালে কখনো সিঁদুর লাগে না।
- দুটোই উদাহরণ হিসেবে আমার মা অনেকবার বলেছেন।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
মনজুর এলাহী, আপনার আরো পরিমিতিবোধের দরকার। পরিণত হয়ে উঠুন।
এইটুকু সত্যি হতে পারে কী?
আপনার লেখার হাত ভালো। আরো লিখুন। তবে খিয়াল কইরা।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
মনজুর এলাহী-
উদ্ধৃতি:
"আর কোন রাজাকারের এই পোস্ট পড়ার সম্ভাবণা কতটুকু? সচলে রাজাকাররা আসে কি??? আর আসলেও হিমুদা, ধুগোদা, লিলেনদা, মুস্তাফিজ ভাই এর লেখা বাদ দিয়া আমার লেখা যেই হালা পড়বো অয় তো..."
-ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা হওয়া প্রয়োজন মনে করছি।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
বলছিলাম কি- সচলে রাজাকারদের ঢুঁ মারার সম্ভাবনা আমার কাছে কম বলে মনে হয়। আর যদিবা কেউ ঢুকে পড়ে; উল্লেখিত লেখকদের অনন্যসাধারণ লেখাগুলাও তাদের সামনে দৃশ্যমান হবে। ওঁনাদের লেখা রেখে আমার লেখা হালারা কোন দুঃখে পড়বে? নিতান্ত তুচ্চ একটা লেখা আমার...
ভাল শব্দটা খুবই আপেক্ষিক ....আমার কাছে যে ভালনা...অন্যের কাছে সে ভাল...
আজ যাদের আমি বিদ্রোহী বলব কাল তারা জয়ি হলে নায়ক...
আমি শুধু এটুকু জানি ..যে অন্যায় করে তার শাস্তি হওয়া উচিত...
অন্যায় শব্দটাও তো আপেক্ষিক...!
(জয়িতা)
ভাল শব্দটা খুবই আপেক্ষিক ....আমার কাছে যে ভালনা...অন্যের কাছে সে ভাল...
আজ যাদের আমি বিদ্রোহী বলব কাল তারা জয়ি হলে নায়ক...
আমি শুধু এটুকু জানি ..যে অন্যায় করে তার শাস্তি হওয়া উচিত...
অন্যায় শব্দটাও তো আপেক্ষিক...!
(জয়িতা)
চিন্তার আপেক্ষিকতাই আসলে দ্বন্দ্ব স্মৃষ্টি করে।
পড়ার জন্য, এবং ভাবনা বিনিময়ের জন্য ধন্যবাদ।
প্লট ভাল
স্পার্টাকাস
নতুন মন্তব্য করুন