লিফটে দরজার সামনে ওদের দেখা। দুজনের চোখেই কিছুটা কৌ্তুহল।কোন রকম ইতস্তত না করেই তরুন দু পা এগিয়ে যুবতীকে পরিস্কার ইংরেজীতে জানতে চায়, তুমি কোন দেশী?
আমি বাংলাদেশী, তুমি? মৃদু হেসে যুবতীও ইংরেজীতেই উত্তর দেয়।
তরুন এবার বাংলায় বলে, আপনি বাংলাদেশী!সিঙ্গেল স্টুডেন্টসদের এই হাউজেই থাকেন! এখানে আর কোন বাংলাদেশী আছে বলে তো জানি না!
-আমিও তো জানতাম না। কাল চাবি নেয়ার সময় প্রভোষ্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে তো তাই বলল! অবশ্য আমি ভুলও বুঝতে পারি। এদের যা ইংলিশ! বলেই হাসতে শুরু করে যুবতী।
-না সেনসেই ভুল বলে নি। আমি আজই এসেছি। আমি আসলে বাংলাদেশ থেকে আসিনি। আমি এসেছি টোকিও থেকে।গত বছর সরকারী স্কলারশীপে আন্ডার গ্রাড করার জন্য জাপান আসি।প্রথম বছর টোকিও ইউনিভার্সিটিতে ল্যাঙ্গোয়েজ করলাম। তারপর এডমিশন টেষ্টে এখানে চান্স পেলাম।আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পড়বো বলে চলে এলাম।তাই ওরা জানে আমি টোকিও থেকে এসছি।তবে বাংলাদেশে থেকে এসছি জানলেও হয়ত আপনাকে জানাতে পারতো না। বলে হো হো করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে, আপনি?
-আমি গত কালই দেশ থেকে এসেছি।সরকারী স্কলারশীপে সরাসরি পি এইচ ডি প্রোগ্রামে। দেশে কিছুদিন একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছি।
তরুন স্বভাব সু্লভ চাঞ্চল্যে বলে, ওহ! আপনি তাহলে ম্যাডাম। ম্যাডাম বলতে হবে নাকি আবার? বলে হাসে।
লিফটের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে যুবতী বলে, না না, আমি তো আর আপনাকে পড়াই নি। আপনি ম্যাডাম বলবেন কেন! আপা বললেই চলবে।
লিফটে ষষ্ঠ তলার বাটন টিপে তরুন যুবতির দিকে তাকায়।
-এইটথ ফ্লোর।
লিফট ৬ তলায় পৌছালে তরুন বের হওয়ার মুখে বলে, এসে গেছি। এবার যাই তাহলে। ওহ হ্যা, আমার রুম ৬০১। আপনার?
-৮০১।
-ওকে বাই, আবার দেখা হবে।
-বাই।
লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
২
টেলিফোন বাজতেই যুবতী রিসিভার হাতে তুলে নেয়।
-আপা আপনার বাসায় খাবার আছে? বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠ তরুনের
-হ্যা, আছে। কেন?
-আমি কি আপনার রুমে আসতে পারি? এসে বলি।
তরুনের মন খারাপ বুঝতে পেরে কোন রকম ইতস্তত্ না করেই যুবতী “হ্যা আসো” বলে ফোন রেখে দেয়।
প্রথম পরিচয়ের পর যুবতীর সাথে তরুনের অনেক বার দ্যাখা হয়েছে। লিফটে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাস ষ্ট্যান্ডে, ইন্টারন্যাশনাল হাউজের ওয়েলকাম পার্টিতে। টুকটাক কথার ফাঁকে ফাঁকে কখন যেন তরুন আপনি থেকে তুমি তে নেমে এসেছে। আন্তরিকতা বাড়লেও যুবতী কখনোই তরুনকে নিজ রুমে ডাকে নি কিম্বা নিজেও ওর রুমে যায় নি।এর মধ্য কোন সংস্কারই ছিল না।তবে দেশে স্বামী আর শিশু সন্তান রেখে এসে অকারন মুখোচক গল্পের ঝামেলায় পড়তে চায় নি।কারন বিদেশে বাংলাদেশীদের চরিত্র ও ভাল করেই জানে।বিশেষ করে মহিলারা যদি কোন কাজ না করেন তাহলে অন্য বাসার ড্রয়িং রুম থেকে শুরু করে বাথরুম সব খবরই তারা রাখেন।পুরুষরাও কম যায় না। আর একা কোন মেয়ে পড়তে এলে তো অধিকাংশ বাংলাদেশীর দৃষ্টি তার পাহারায় সদা উদ্গ্রীব থাকে।
বিদেশে বাংলাদেশীদের আর একটা ব্যপার নিয়েও যুবতী প্রায়ই ভাবে।বিদেশে এলে অধিকাংশ বাংলাদেশীই কেন যেন অতি মাত্রায় ধার্মিক হয়ে পড়ে। সদ্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করা তরুনী বউটিও, যে কিনা বিদেশে আসার আগেও ছেলে বন্ধুদের সাথে বিকেল কিম্বা সন্ধ্যায় গরম সিংগারা বা চিনাবাদামের ঠোংগা হাতে আড্ডা দিত-সেই মেয়েটিই বিদেশে এসে স্বামীর কলিগদের সাথে কথা বলতেও মাথায় কাপড় জরায়। যে বউটি দেশে ওড়নাই হয়ত ঠিক মত গায়ে দিত না সে নিয়মিত মাথায় স্কার্ফ বাধে।আর যারা বাধে না তারা কোন জাহান্নামে যাবে তা নিয়ে গবেষনা করে। আর এই সুযোগের কিছু কিছু জামাতী মোড়ল হয়ে যায়!বাংলাদেশী কমিউনিটির সব প্রগ্রামে লিড দেয়ার চেষ্টা করে।
আরো কিছু বিষয় দেখে যুবতী খুব অবাক হয়। কিছু কিছু মানুষ যারা দেশে থাকতে রাজনিতীর নিয়ে তেমন চিন্তাই করতো না তারাই কি ভাবে বিদেশে আসতে না আসতেই অতিরিক্ত রাজনৈতিক সচেতন হয়ে ওঠে! বাংগালী না বাংলাদেশী এই নিয়ে তর্কে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিতে পারে। এমন কি এর রেশ ধরে দুই পরিবারের মহিলাদের মুখ দেখা দেখিও বন্ধ হতে পারে!
তাই “আল্লাহ হাফেজ” না “খোদা হাফেজ” এবং “জয় বাংলা” না “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” এর তর্কে জড়াবে না বলেই কিছুটা একা থাকার সিদ্ধান্ত নেয় যুবতী। দু এক জন বিদেশী ছেলে মেয়েদের সাথে ভালোই বন্ধুত্ব হয়। তবে এদের কাউকেই এ পর্যন্ত সে রুমে ডাকে নি। তাই তরুনকে হ্যা বলার পর কিছুটা দ্বিধায় পড়ে।
৩
দরজায় নক করতেই দ্বিধা ঝেড়ে দরজা খুলে দেয়।রুমে ঢুকতে ঢুকতে তরুন নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। তবুও চোখ মুখ থেকে ক্ষোভ আর কষ্টের ছায়া গোপন করতে পারে না।
স্বভাব সুলভ স্নেহে্র কন্ঠে যুবতী বলে, কি ব্যাপার তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে?
তরুন বলে, আপা আমি খাবার জন্য আসিনি। আমার খুব মন খারাপ। গেল রাতে সমনের ফ্যামিলী বিল্ডিং বি এর আসলাম ভাইয়ের বাসা্য মান্থলি ইসলামিক আলোচনার দাওয়াত খেতে গিয়ে ভাবীকে দুষ্টূমী করে বলেছিলাম আজ খেতে আসবো। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে ভাবীকে ফোন দিলাম। ভাবী খুব বাজে ব্যবহার করে ফোন রেখে দিলেন। আপনিও তো কাল ওখানে ছিলেন, তাই না?
যুবতী তরুনরে ইমোশন বুঝতে পারে। বলে, হ্যা।বাদ দাও ওসব। ভাবী হয়ত ব্যাস্ত ছিলেন।
-না আপা, আপনি জানেন না। রাতে তো আপনারা অন্য রুমে আর আমরা পুরুষরা অন্য রুমে বসে ছিলাম। আমি আলোচনার এক ফাকে আসলাম ভাইয়ের কাছে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী আদায়ের জন্য একটা কিছু করার কথা বলছিলাম। অমনি আসলাম ভাই, শফিক ভাই সহ অনেকে আমার উপর ভীষন ক্ষেপে গেলেন।আমি বুঝলামই না এত খেপার কি হল! পরে বুঝলাম ওগুলো সব জামাতি রাজাকার। এরা আসলে মান্থলি ইসলামিক আলোচনার নামে জামাতি আদর্শ প্রচার করে।যত্তোসব হারামজাদার দল।রাজনিতী করবি কর। তা ধর্মের মত একটা সেন্সিটিভ বিষয় নিয়ে কেন? আর অইগুলারে কিছু বললেই ধর্ম নিয়া টানা টানি শুরু করে। শালরা একেবারে ঘাগু শয়তান। আর দেখেন, এই দিকে এই শালার বি এন পি? তোদের গদির এত লোভ! গদিতে যাওয়ার জন্য তোদের জামাতিদের সাথে জোট বানতে হইলো? ছি তোদের। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে তরুন কিছুটা শান্ত হয়।
যুবতী তরুনের ঘৃনার বর্হিপ্রকাশে অবাক হয়। বড়জোর ১৯/২০ বছরের একটা বাচ্চাছেলে। এত ঘৃ্না পুষে রাখে কি করে? বলে, হুম… হবে, তোমাদের দিয়েই হবে দেশের ভাগ্য পরিবর্তন। তবে দেখো, তুমি কার কথা বলবে। সবারই উদ্দেশ্য এক। গদী দখল।না হলে আওয়ামীলিগ এরশাদের সাথে যেতে পারে! স্বৈরাচার্ এরশাদকে হটানোর জন্য এত করলাম। আমি নিজে রাস্তায় আন্দোলন করেছি। আমাদের বন্ধুরা জেলে গেছে।আর কি হলো! সে এখন সদর্পে সরকারে অবস্থান করছে। মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে।তারা বোঝে কে ভাল আর কে মন্দ।
একটু থেমে বলে, এক একবার সরকার চেইঞ্জ হয় আর আশায় থাকি এবার একটা কিছু ভাল হবে। অথচ দেখো কি হয়।শুধু দলবাজ আর চাঁদাবাজদের চেহারা বদলায়।আর কোন পরিবর্তন হয় না।আসলে সব দলেরই চেহারা এক।
এটা কেমন বলো তো! সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশের সব অফিস আদালত থেকে সেট ধরে কর্মকর্তা কর্মচারী চেইঞ্জ করা। দেখো, ইউনিভার্সিটির মত জায়গাতেও ভাইস চ্যান্সেলর থেকে শুরু করে কেরানীকে পর্যন্ত চেইঞ্জ হয়।কি আর বলবো! আর এখন এমন অবস্থা যে তুমি ইচ্ছে করলেও নিরপেক্ষ কথা বলতে পারবে না। দলবাজরা মনগড়া অর্থ বের করে তোমাকে কোন না কোন দল ভুক্ত করে ছাড়বে।তাই এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে চাই না।
কথার ফাঁকে ফাঁকে যুবতী ঠান্ডা ভাত আর ফ্রাইড চিকেন গরম করে তরুনের হাতে প্লেট দিয়ে বলে, দেখ খেতে পারো কিনা। আমি আবার রান্না বান্না তেমন পারি না! বলে হাসে।
প্লেট থেকে খাবার মুখে তুলতে তুলতে তরুন হেসে বলে, হ্যা আপনাকে দেখেই বোঝা যায় আপনি একটা অকম্মার ঢেকি। যান কালকে আপনাকে রান্না করে খাওয়াবো। আসবেন কিন্তু।
৪
সেই শুরু। তারপর থেকে যুবতী তরুনের রুমে নিঃসংকোচে যায়।দুজন মিলে উইকেন্ডে রান্না করে।এক সাথে খায়।শপিং এ যায়। মাঝে মাঝে বিকেলে হাটতে হাটতে ডর্মের পাশে জাপান সাগরের তীরে বেড়াতে যায়।দেশে নিয়ে, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলে। জাপানীজ কালচার, কি ভাবে জাপান দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এত উন্নতি করলো, জাপানিজদের কঠোর পরিশ্রম, আর দেশ প্রেম নিয়ে আলাপ করে। কি ভাবে জাপানিজরা নিজেদের শ্রদ্ধা বোধ কে জিইয়ে রেখেছে, কোন ধর্ম না থাকার পরও কি ভাবে সংযত আচরন করে তা নিয়ে আলাপ করে।এক কথায় বলা যায় নির্ভেজাল, নিখাদ বন্ধুত্বের সম্পর্ক।মন খারাপ হলে একে অন্যের মন ভাল করার জন্য জোক্স বলে।ইন্টারন্যাশনাল হাউজের সবাই জেনে গেছে ওরা খুব ভাল বন্ধু।
ইন্টারন্যাশনাল হাউজে দেশ বিদেশের ছাত্র ছাত্রী ছাড়াও নিয়মিত আসে জাপানিজ তরুন-তরুনীরা। ওরা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করে। বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করে, বন্ধুত্ব করে।তবে এদের আকর্ষন মুলত আমেরিকানদেরর দিকে।আমেরিকানদের অনুসরন করতে গিয়ে কিছু কিছু দিকে এরা আমেরিকানদের চেয়েও এডান্সড হয়ে পড়ে। লিভ টুগেদার করে বিনা দ্বিধায়। ইন্টার ন্যাশনাল হাউজের জাপানিজ ভলান্টিয়ারদের মধ্যে এশিয়ার রক্ষনশীলতা আর পশ্চিমা কালচারের মিশ্রনে এক জগা খিচুরী অবস্থা দেখা যায়।ওরা কেউ কেউ তরুন আর যুবতীর বন্ধুত্বের মধ্যে অন্য রকম রহস্য খোঁজে। তরুনের পরিচিত কেউ কেউ সরাসরি তরুনকে জিজ্ঞেসো করে যুবতী ওর গার্ল-ফ্রেন্ড কি না কিম্বা ওরা লিভ টুগেদার করে কিনা। সদ্য বড় হয়ে উঠা তরুন এতে বেশ লজ্জা পায়।
৫
জরুরী এক রেফেরেন্স কালেকশনের জন্য যুবতী লাইব্রেরীতে যাওয়া খুব দরকার হয়ে পড়ে। বিকেলে এপ্রোন খুলতে খুলতে ল্যাবের এসিস্ট্যান প্রফেসরে ওনিকি কে বলে, তোমার একটু সময় হবে? চল লাইবেরীতে যাই, আমার খুব জরুরী কিছু রেফান্স দরকার।
এক সাথে কাজ করে বিধায় ওনিকি রাজী হয়ে যায়। প্রায় সমবয়সী দু’জন। ল্যাবের সমস্যা আর রিসার্চের সম্ভাব্য রেজাল্ট কি হতে পারে এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে ল্যাবের উলটো দিকের লাইব্রেরীর কড়িডোরে পৌছে যায় ওরা। এক পর্যায়ের প্রফেসর কি ভাবে সবার আগে ল্যাবে আসে এবং কি ভাবে সবার শেষে যায় এ নিয়ে কথা বলতে বলতে দুজনেই হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই দুজন রেফারেন্স সেকশনের দিকে এগিয়ে যায়।যুবতির হঠাৎ পাশের রিডিং রুমের দিকে চোখ পড়ে। দেখে তরুনটি পড়ার বই খুলে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যুবতী ওনিকির সাথে কথার ফাকে তরুনকে শুধু হাত তুলে হাই বলে রেফারেন্স রুমে ঢুকে পড়ে।
তরুন ক্লাশ শেষ করে ডর্মে না ফিরে লাইব্রেরীতে বসে এসাইমেন্টের কাজ করছিল। পড়তে পড়তে বই থেকে চোখ তুলতেই হঠাত চোখ পড়ে যুবতীর উপর। পাশে ওনিকিকে দেখে ওর বুকের ভিতরে মোচর দিয়ে ওঠে।যুবতীর হাই বলা ওর কষ্টের মাত্রা দ্বিগুন করে দেয়।ওর নিজেকে ভীষন একা মনে হয়। বুক ভেঙ্গে কান্না পায়।গলার কাছে দলা বাধা কষ্টটা চেপে রেখে ব্যাগ নিয়ে ডর্মে ফিরে আসে। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে কষ্টের কারন কোন ভাবেই খুজে না পেয়ে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে।ঘুম থেকে উঠে একাই বাইরে বেড়িয়ে পড়ে। ফিরে আসে অনেক রাতে।
৬
পরদিন সন্ধ্যায় ডর্মে ফিরে ফ্রেস হয়ে তরুনের ইন্টার কমে কল দেয়। কিছুক্ষন পর তরুন ফোন ধরে। তখন ওই রুম থেকে বেশ উচ্চগ্রামে মাইকেল বোল্টনের গান আর ছেলে মেয়েদের হৈ চৈ টেলিফোনের রিসিভার দিয়ে যুবতীর কানে পৌঁছে যায়।
যুবতীর ফোন ধরেই তরুন বলে, কি বলবেন বলেন। আমি বিজি।
যুবতী হেসে বলে, কি নিয়ে বিজি? কাল ল্যাব থেকে ফিরে তোমাকে অনেক বার কল দিয়েছিলাম, কই ছিলে? কখন ফিরেছো?
তরুনের কন্ঠে একধরনের আত্মতৃপ্তির হাসি ফোটে।বলে, এই তো ঘুরে বেড়ালাম। ঘুড়তে ঘুড়তে মিওকো, হানাকো, আমান্ডা, মিচিকোদের সাথে সমুদ্র পাড়ে দেখা হল। ওদের সাথে আড্ডা দিলাম রাত ১ টা পর্যন্ত।
যুবতী হাসতে হাসতে বলে, একদিনেই এত বান্ধবী বানিয়ে ফেলেছো?
তরুন বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে, আজ ওদের নিয়ে আমি পার্টি দিচ্ছি। ওরা সবাই এখন আমার রুমে।
যুবতী হেসে বলে, আমাকে দাওয়াত দিবা না তোমার পার্টিতে?
তরুন বলে, আসতে পারেন।তবে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। আমরা সারা রাত পার্টি করবো আর ড্রিংক করবো ঠিক করেছি।
-ঠিক আছে। দেখি তোমরা কেমন পার্টি দিচ্ছ বলে ফোন রেখে সত্যি সত্যি যুবতী ৬ তলায় তরুনের রুমে যায়।
এক ঝাক জাপানীজ ভলান্টিয়ার তরুনের রুমে কিচেনে ব্যাস্ত। কেউ হাসছে, কেউ রাঁধছে, কেউ ড্রিংক্স গোছাচ্ছে। তরুনীরা যুবতীকে দেখে হৈ চৈ করে ওঠে। ওরা প্রায় সবাই যুবতীর পরিচিত। কারো কারো সাথে টেবিল টেনিসের খেলেছে, কারো কারো সাথে ভল্টিয়ার ওয়ার্ক করেছে। তাই যুবতীও ওদেরকে হাই হ্যালো বলে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কেন যেন একা একা লাগতে থাকে। তরুনের সাথে এত দিনের সহজ সম্পর্ক কেমন যেন দূর দূর মনে হয়। যুবতী নিজের রুমে ফিরে আসে। যুবতি বুঝতে পারে না ওর এমন লাগছে কেন!
৭
পরদিন ল্যাব থেকে ফিরে যুবতী তরুনকে একবার ফোন দেয়।না পেয়ে একাই ঘরে বসে থাকে।জুলাইয়ের লম্বা দিন।প্রচন্ড গরম।একা একা রুমে বসে থাকতে ভাল লাগে না।তার উপর অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে গাছে গাছে হাজার হাজার ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক।এত বড় ঝিঁ ঝিঁ ও বাংলাদেশে দেখে নি।শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজার ঝিঁ ঝিঁ পোকা এক টানা ডাকতে শুরু করলে ঝিঁ ঝিঁ'র শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোন যায় না। কিছুক্ষন শুনলে মাথা ধরে যায়।
যুবতী তাই রুম থেকে বের হয়ে পড়ে। নীচে নামতে গিয়ে লিফটের মুখে প্রফেসর এরন লেভিসের সাথে দেখা।এর আগে অনেক বার প্রফেসরের এরনের সাথে যুবতীর দেখা হয়েছে।মাঝে মাঝে হাই হ্যালো জাতীয় কথাও হয়েছে।তবে সব সময়েই তরুন সাথে থাকত।
তাই আজ যুবতীকে একা দেখে প্রফেসর এরন জিজ্ঞেস করে তোমার ফ্রেন্ড কোথায়?
সে ব্যাস্ত আছে বলে যুবতী এড়িয়ে যায়।
প্রফেসর একটু হেসে বলে, ম্যাম আমার বয়স ৬৫।একটু থেমে বলে তোমার কি আজ খুব মন খারাপ? চল আজ আমরা দুজনে হাঁটি।
তারপরই বলে, আমার সাথে হাঁটতে তোমার আপত্তি নেই তো?
যুবতী বলে, না না আপত্তি থাকবে কেন?
রাস্তায় নেমে যুবতী বলে, তুমি এখানে কি করছ?
-আমি হিব্রু উনিভারসিটি থেকে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ৪ মাসের প্রোগ্রামে এসেছি। আমি বায়ো-ইঞ্জিনীয়ারিং সাইন্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করছি। তিন মাস হয়ে গেছে আর মাত্র ১ মাস। তুমি?
যুবতী নিজের কথা বলে। তারপর জানতে চায় তুমি কি একাই এসেছো?
প্রফেসর এরন বলে, হ্যা। আমি গত ৩০ বছর ধরে একা। আমার বউ মারা যায় ৩০ বছর আগে। তারপর এক ছেলে আর এক মেয়েকে মানুষ করেছি একাই। ছেলে ডাক্তার আর মেয়ে আমার মতই বায়ো-ইঞ্জিনীয়ার।
কথা বলতে বলতে ওরা অনেক দূর চলে আসে।চারিদিকে জাপান সাগরের ঝিরি ঝিরি বাতাস আর সামারের নাম না জানা কোন এক ফুলের মিষ্টি গন্ধে যুবতী খুশী হয়ে ওঠে। বলে দেখো কি মিষ্টি ফুলের গন্ধ! অসাধারন।আমার মাথা ব্যাথা কমে গেছে। ওহ! কি চিতকারই না শুরু করেছিল সিকাডারা বলে হাসে।
প্রফেসর এরন এবার যুবতীর দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বলে হুম সুন্দর।তারপর হেসে বলে, ওদের ওই ডাক কিসের জন্য তুমি জানো?
যুবতী বলে, হ্যা এটা ওদের রিপ্রোডাক্টিভ সিজন। তাই মেইল সিকাডা গুলো ফিমেইল গুলোর দৃষ্টি আকর্ষন জন্য ডাকে।
প্রফেসর হেসে বলে, নাহ এটা ওদের প্রেমের আকুতি।
যুবতী হেসে বলে, বাহ! বেশ ভাল বলেছো তো। এমন করে তো আগে ভেবে দেখিনি। তাহলে তো বেচারাদের উপর বিরক্তি প্রকাশ ঠিক হয় নি।ওদেরো তো ভালবাসা প্রকাশের অধিকার আছে তাই না বলেই হি হি করে হেসে ওঠে।হাসি থামিয়ে হঠাৎ করে যুবতী এরনকে প্রশ্ন করে, প্রফেসর তুমি বলতে পারো ভালবাসার মানে কি?
প্রফেসর যুবতির দিকে তাকিয়ে বলে দেখ ৩০ বছর আগের কথা আর মনে নেই। এর উত্তর তোমাকে ক’দিন পরে দেবো।
এরপর প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় প্রফেসর এরন যুবতীর রুমে ফোন দেয়। ওরা এক সাথে হাটতে যায়। মাঝে মাঝে ইস্রাইলের কালচার, ফিলিস্তনীদের সাথে যুদ্ধ, ইহুদী ধর্ম নিয়ে আলাপ করে। যুবতী দেশে স্বামী, সন্তান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। বাংলাদেশর প্রাকৃতিক সম্পদ, সুন্দরবন, পাট, কুয়াকাটা সৈকতের কথা বলে।প্রফেসরকে বাংলাদেশে বেড়ানোর দাওয়াত দেয়।কখনো প্রফেসর বলে যুবতী শোনে আবার কখনো যুবতী বলে প্রফেসর শোনে।প্রায় দ্বিগুন বয়সী প্রফেসর এরানের সাথে এ ভাবেই চমৎকার বন্ধুত্ব হয় যুবতীর।
৮
কোর্স শেষ করে দেশে ফিরে যাওয়ার আগের রাতে প্রফেসর এরন যুবতীকে ফোন করে বলে, আজ আর হাটতে যাব না। আজকে রাতটা আমি তোমার সাথে রুমে কাটাতে চাই। নিশ্চয় তোমার কোন আপত্তি থাকবে না।
হঠাৎ এ প্রস্তাবে যুবতী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।কিন্তু প্রফেসরকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বলে, আজ রাতে আমি আমার স্বামী আর বাচ্চার সাথে কথা বলবো।সরি, আমি তোমার রুমে আসতে পারবো না প্রফেসর।
প্রফেসর বলে, ঠিক আছে তোমার এখনি আসতে হবে না। আমি অপেক্ষায় আছি তুমি তোরার স্বামী বাচ্চার সাথে কথা শেষ করেই আসো।
যুবতী বলে নাহ আজ আমি বেশ টায়ার্ড।আগামী কাল তোমাকে এয়ারপোর্টে সিই অফ করতে যাবো।
প্রফেসর বলে, সে কাল দেখা যাবে। আজ আমি নিজ হাতে তোমার জন্য রান্না করেছি। আর সে দিনের সেই বাতাসে গন্ধ ছড়ানো ফুলও খুজে এনেছি।তুমি এলেই পরিপুর্ন হয়। শুধু একবার এসে দেখে যাও।
যুবতী কি করবে বুঝতে পারে না।ওর কথায় প্রফেসর কষ্ট পাক তাও চায় না আবার রাতের বেলায় প্রফেসরের রুমে একা যাবে তাও ভাবতে পারে না।তাই দুষ্টুমীর ছলে বলে তুমি তো ড্রিঙ্ক করবে। আমি তো আর ওসব খাই না তুমি অন্য কাউকে ডাকো।
এবার প্রফেসর গম্ভীর ভাবে বলে অন্য কাউকে আমি ডাকলে তো আর তোমাকে ডাকতাম না।
প্রফেসরের কন্ঠের গভীরতায় যুবতী বুক কেপে ওঠে। যুবতী প্রায় নিরুপায় হয়ে বলে সরি আমি রাতে তোমার ওখানে আসতে পারব না প্রফেসর।আজ আমার ম্যারেজ এনিভ্যারসারী। আজকে রাতটা আমি একাই উপভোগ করতে চাই।
প্রফেসর এরান এবার ধীরে ধীরে বলে অহ তাই! যদি নাই আসতে পারবে তাহলে ভালবাসার মানে কেন জানতে চেয়েছিলে সেদিন? আমি তো একা একা এসব ভুলে ৩০ বছর ভালোই ছিলাম।
যুবতী চুপ হয়ে যায়।কোন উত্তর দিতে পারে না। প্রফেসর ফোন রেখে দেয়ার পরও অনেক্ষন রিসিভার হাতে বসে থাকে। তারপর উঠে ৮ তলার ব্যালকনী থেকে রাতের আকাশের দিকে চেয়ে থাকে একাই…।
নাসরীন
মন্তব্য
ভালো লেগেছে নাসরীন।
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ধন্যবাদ তানবীরা।ভাল লেগেছে জেনে খুশী হয়েছি। শুভেচ্ছা।
লেখা ভালো লেগেছে। সব মিলিয়ে ওদের সবার কষ্ট নিজের বুকে ঢুকে গেলো কিছুটা।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ধন্যবাদ গৌতম।হুম কষ্টই...।ভাল থাকুন।
ভাল হয়েছে লেখাটা*নক্ষ্ত্র
নক্ষত্র! তাহলে যাত্রা কি এক সাথেই শুরু হল? ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। ভাল থাকুন।
সচলে স্বাগতম...
ভালো লাগলো লেখাটা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ নজরুল ইসলাম।ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আপনার স্বগতমতে এক একটু ভয় কাটতে শুরু করেছে। ভাল থাকুন।
ভাল লেগেছে
ধন্যবাদ। নিয়মটা জানতাম না। আপনার কথা মনে থাকবে। অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ভাল থাকুন।
সচলের নীতিমাল খুব সম্ভবত অন্য কমিউনিটি ব্লগে প্রকাশিত লেখা সচলে পুন:প্রকাশে নিরুৎসাহিত করে, একটু খেয়াল রাখবেন।
সখি ভাবনা কাহারে বলে
সখি যাতনা কাহারে বলে
তোমরা যে বল দিবস রজনী ভালবাসা ভালবাসা
সখি ভালবাসা কারে কয়, সেকি কেবলই যাতনাময়?
________________________________________________
হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে
________________________________________________
হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে
প্রবাসিনী, হা হা হা...। তাই তো মনে হচ্ছে। শুভেচ্ছা।
খুব সুন্দর লেখা, বর্ণনা, ঘটনা, যোগসূত্র। আরো লিখুন।
আপ্নার কমেন্ট অনেক ভাল লেগেছে। উতসাহ পেয়ে সাহস বেড়ে যাচ্ছে। ভাল থাকুন অনেক অনেক...।
- লেখাটা ভালো লেগেছে। কী কী জানি লিখতে নিছিলাম, লেখা হয়নি আর।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
হুম...।মনে করে লিখে ফেলুন।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আরে ,এতো সুন্দর গল্পটা মিস করে গিয়েছিলাম!!!! আপ্পি; নিয়মিত লেখো কিন্তু.... --------------------------------------------------
"সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে..."
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
"সব শেষ হয়েও যা শেষ নয়, যা অবিনশ্বর...সেই তো বিশ্বাস; সেই তো ভালবাসা!!" --------------------------------------------------
"সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে..."
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন