আরিফ বিয়ে করেছে আজ দশ বছর। পরিচিত জনদের নানা শংকার মাঝেও টিকে যায় আরিফ ও সাথীর বিয়েটি। এক সময় আভিজাত্যের দেয়াল ভেঙ্গে শুধু ভালোবাসাকে পুঁজি করেই ঘর থেকে সাথী বেড়িয়ে আসে আরিফের হাত ধরে। আর ফেরা হয়নি তার চিরচেনা বাবার বাড়িতে।ছোট্ট একটি মেয়ে আর চলার মতো আরিফের গার্মেন্ট ব্যবসা- সব মিলিয়ে তাদের সুখের সংসার চলছিল মোহাম্মদপুরের একটি ভাড়া বাড়ীতে।বাড়ীওয়ালা সঠিক সময়ে ভাড়া পেলেও আরিফরা পানি পায়না সঠিক নিয়মে।তার ওপর দিনের বেলায় থাকে গ্যাসের স্বল্পতা আর রাতে লাগামহীন লোডসেডিং। বিদ্যুৎহীন ঢাকাতে আছে বাতাসহীন গরম।এরই মাঝে সাথীকে প্রতিদিন সাড়তে হয় রান্নাসহ ঘরের নানা কাজ।
বারান্দায় দাড়িয়ে বিল্ডিংয়ের ফাঁক দিয়ে এক খন্ড আকাশ দেখছে আরিফ।তার মনটা ভাল নেই আজ।বিশ্বমন্দার ছিটেফোটা প্রভাব পড়েছে তার ব্যবসায়।দুঃচিন্তা করবে ভেবে সাথীকেও বলেনা কিছু।এর মধ্যেই একদিন আরিফ মাসের কেনাকাটা করতে বাজারে আসে।সাশ্রয়ের কথা ভেবে কিনে ৭কেজি ওজনের রুই মাছ। মাছ কিনে বাড়ী ফেরার সময় হঠ্যাৎ আরিফের খেয়াল হয়, মটর নষ্ট হওয়ায় আজ দুদিন ধরে পানি নেই তার বাড়িতে।মাছ নিয়ে ঘরে যখন সে ঢুকছে তখন বিদ্যুৎ নেই।দরজা খুলে আরিফের হাতে বড় রুই মাছ দেখে সাথীর খুশি হতে পারেনা। তার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। রাগে মোমবাতির আলোতেই ছোট বটি নিয়ে মাছ কাটতে বসে সে।মাছ তো কাটেইনা বরং কেটে রক্তাক্ত হয় সাথীর হাতটি। সে আর ঠিক থাকতে পারেনা।প্রচন্ড রেগে যায় আরিফের ওপর।সারাদিন খেটে আসা আরিফও সহজভাবে নেয়না সাথীর আচরণ। কেউ কাউকে বুঝে উঠতে পারেনা।দুজনের সারারাত কেটে যায় ফেলে আসা দিনগুলিতে না পাওয়ার বেদনার স্মৃতিতে।ভোর হতেই মেয়েকে নিয়ে সাথী চলে যায় বাবার বাড়ীতে। আরিফ থামাতে পারেনি সাথীকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আরিফ তাই ভাবে খুব কি দোষ ছিলো তার।
আরিফের ঘটনাটিই ঘটতে পারে এই ব্যস্ত নগরের যে কোন বাসিন্দার জীবনে। ঘটনাটি শুনে অনেকেই হয়তো বাজার করা বন্ধ করে দিতে পারেন। কিšত্ত সত্যিকারভাবে আরিফ বা সাথীর করোই কি দোষ ছিল এতে। নাগরিক সুবিধার লেশ মাত্র নেই এ শহরে। দিন দিন জীবন হয়ে উঠছে জটিল থেকে জটিলতর। জীবনকে সহজ করতে আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে আধুনিক বাজাররূপী শত শত শপিংমল।মায়ের মাছ কাটার দৃশ্য দেখার স্মৃতি অধিকাংশ বাঙালিকেই আন্দোলিত করে। একসময় বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য কেনা মাছও কাটানো হতো উৎসাহ নিয়ে। নানা কারণে নগর থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে ৫১বর্তী পরিবারগুলো। ফলে নগরবাসীর ব্যস্ত সময়ে মাছ কাটা এখন কোন আনন্দের বিষয় নয় বরং খুবই ঝামেলাযুক্ত সামান্য একটি কাজ মাত্র। আগে কোন বড় মাছ কিনলে বিনা পারিশ্রমিকে মাছ কেটে দিত বিক্রেতা নিজেই।কিন্ত এখন বর্জ্র ফেলার সমস্যা,বটির সমস্যা, কাটতে না জানা,পরিস্কার করার ঝামেলা আর সময় সাপেক্ষ্য হওয়ায় মাছ কাটা অধিকাংশ গৃহকত্রীর নিকট রীতিমত আতংকের বিষয়। তবে সুখের খবর হচ্ছে এ সকল কারণেই ঢাকার বাজার গুলোতে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে একটি পেশাজীবি শ্রেণী। কারা এরা। এদের বলা হয় ‘মাছ কাটাইয়া’।
বিভিন্ন বাজারে মাছ কাটাইয়া থাকলেও এই পেশার লোক সবচেয়ে বেশী গড়ে উঠেছে মিরপুর শাহ আলী মার্কেটের মাছ বাজারে। বিশাল বাজারের মধ্যের সারিতে সারিবদ্ধভাবে বসে থাকে মাছ কাটাইয়ারা। দুপুরে খানিকটা বিরতী থাকলেও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ বাজারে চলে মাছ কাটার কাজ। মজার বিষয় হচ্ছে মাত্র দুইহাত জায়গার মধ্যে একটি বড় বটি আর একজন হেলপার নিয়ে বসে মাছ কাটে কাটাইয়ারা। সকালে একদিকে চলে মাছ বিক্রির পালা, আরেকদিকে দেখা যায় মাছ কাটানোর অন্য রকম দৃশ্য। কেউ কাটছে বড় মাছ কেউবা বেছে দিচ্ছে ছোট মাছ। কথা হলো যুবক বয়সী আলী আহম্মদের সাথে। নয় বছর যাবত সে এই বাজারে মাছ কাটে। বাবার মৃত্যুর পর রাজবাড়ী থেকে বেঁচে থাকার আশা নিয়ে চলে আসে ঢাকায়।পেটের দায়ে প্রথম প্রথম মাছ কুড়াতো সে। এক সময় স্থানীয় ফটিক বাবুর সুনজরে পরেন। তারই হাত ধরে শুরু করেন মাছ কাটার কাজ। মাছ কাটতে কেমন লাগে,প্রশ্ন করতেই বলে ‘পয়সা পাইলে তো ভালই লাগে’। মাছ কেটে সংসার চলে কিনা জানতে চাইলে বলে, ‘যথেষ্ট চলে’। জানা যায়, কাটাইয়াদের বসার মাত্র দুইহাত জায়গার ভাড়া দিতে হয় মাসে ৯,০০০ টাকা। তার ওপর প্রতিদিন আছে হেলপার খরচ ২০০ টাকা। আছে বাজার কমিটির খাজনা, মালিকের খাজনা, পানি কেনার খরচ, সুইপারের খরচ, জেনারেটর ও বিদ্যুৎ বিল প্রভৃতি। লাভ কেমন হয় জানতে চাইলে, আলী আহম্মদের ভাষায়, ‘সব কিছু বাদ দিলেও আল্লাহর রহমতে দিনে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা লাভ থাকে’।
ঝিনুকের খোসা দিয়ে তেলাপিয়া মাছের আশ ছাড়াচ্ছে জুগেস। মনে হচ্ছে যেন অন্যরকম শিল্প কর্মের কাজ চলছে।গোবিন্দের হেলপার সে। মাজার রোডের সজিব হোটেলের মালিক আঃ রশিদ তার হোটেলের জন্য কেনা ৫কেজি তেলাপিয়া আর ৫টি রুই মাছ কাটাচ্ছেন গোবিন্দকে দিয়ে। হোটেলে বুয়া থাকতে এখানে কেন মাছ কাটাচ্ছেন, জানতে চাইলে বলেন, ‘ওরা যে ভাবে তাড়াতাড়ি পারে বুয়ারা সেভাবে পারে না। বরং মহিলারা মাছ নষ্ট করে ফেলে। এছাড়াও বটির ব্যাপার আছে’। গোবিন্দ রুই মাছের কাটা কাটছে বিশেষ কায়দায় বটির উপর ছোট কাঠের টুকরার আঘাতে । মাছ কাটাইয়াদের বাসায় এটি ‘খুটা’। মাছ কাটতে কাটতে হঠ্যাৎ গোবিন্দ বলে ওঠে ‘কি পিছ করমু বাংলা নাকি চাইনিজ’। প্রথম বেশ অবাক হলেও পরে জানা গেল কাটাইয়ারা মাছের মাঝ বরাবর ছোট আকৃতির কাটাকে ‘বাংলা পিছ’ আর চ্যাপ্টা করে বড় আকৃতির কাটাকে ‘চাইনিজ পিছ, বলে। সময় বেশী লাগায় বড় মাছের তুলনায় ছোট মাছ কাটাতে কাটাইয়ারা বেশী পারিশ্রমিক নিয়ে থাকে।শাহ আলী মার্কেটের মাছ বাজারে এক কেজি টেংরা কাটতে কাটাইয়ারা নেয় ২০টাকা, বাইম ১০ টাকা, টাটকিনি ১০ টাকা আর কই মাছ প্রতি পিছ ১ টাকা। মাছ কাটতে গিয়ে হাত কেটে গেলে কি করেন, জানতে চাইলে, গোবিন্দ বলে,‘পানিই ওষুধ’।
রফিকুল সাহেব থাকেন মিরপুর দিয়াবাড়ী পেশায় ব্যবসায়ী। মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্য ৩৮০০ টাকা দিয়ে কিনেছেন ৮ কেজি ওজনের বোয়াল মাছ। খোকন রাজ বংশী মাছটি কাটছে ২০ টাকা পারিশ্রমিকে। রফিকুল সাহেব গত দুই বছর যাবৎ প্রায় সকল মাছই বাজার থেকে কেটে নিয়ে যান। তিনি মনে করেন,ব্যস্ত এই নগরে সময়ের চাহিদায় মাছ কাটাইয়ের সংখ্যা প্রতি বাজারেই বৃদ্ধি পাবে। বাড়িতে নিয়ে মাছ কাটলে ফ্ল্যাট বাড়িতে সবচেয়ে বড় সমস্যা তাৎক্ষনিকভাবে ময়লা ফেলা। মুচকি হেসে তিনি বলেন, মাছ কেটে নিলে ঘরের মানুষের কাছে (স্ত্রী) বাড়তি কদর থাকে।
মাছ কাটাইয়া ছাত্তারের বটির কাছে দেখা গেল আনুমানিক দুই কেজি ওজনের বেশ কিছু মাছের নাড়িবুড়ি একত্রে করা। কি ঐ গুলো, জানতে চাইলে সে বলে, ‘এগুলি গরিবের খাবার’। জানা যায়,অধিকাংশ ক্রেতারা আইর,বোয়াল,রুই ও রিটা মাছের পেটের সব কিছুই রেখে যান। আর ঐ গুলোই ‘ঠিকা’ দরে বিক্রি করা হয় গরিবদের কাছে। বড় মাছ কাটলে খেতে ইচ্ছে করে কিনা জানতে চাইলে সাত্তার বলে, ‘কাটতে কাটতে মাছের প্রতি সব রুচি নষ্ট হয়ে গেছে’।
মৌমিতা সরকার বাজার করতে এসেছেন মোহাম্মদপুর থেকে। তিনি ৫ কেজি তেলা পিয়া কাটাচ্ছেন ১৫টাকা দিয়ে।পরিবারে দুই জনই চাকুরীজীবি হওয়ায় তাদের হাতে সময় খুবই কম থাকে। সামান্য টাকাতে মাছ কাটানোর সুবিধা অন্য বাজার গুলোতে না থাকায় তিনি বাজার করতে আসেন এখানে। তিনি জানান এ বাজার ছাড়াও নগরের কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল ও নিউ মার্কেট বাজারেও মাছ কাটাইয়ারা রয়েছে।
বাজার ঘুরে কথা হলো এই বাজারের মৎসজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিনের সাথে। তার থেকে জানা গেল বর্তমানে এই শাহ আলী মার্কেটের মাছ বাজারে ১৬টি বটি অথ্যাৎ ১৬জন মাছ কাটাইয়া থাকলেও প্রতি বছরই এর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।মাছ কাটাইয়ারা যেন পারিশ্রমিকের ব্যাপারে ক্রেতাদেরকে বাধ্য না করতে পারেন সে দিকে সমিতি থেকে বিশেষ নজর রাখা হয়। এছাড়া কোন কাটাইয়া যদি কারো মাছ কেটে কৌশলে কিছু মাছ রেখে দেন তবে সমিতি ঐ মাছ কাটাইয়াকে ৫০০০ টাকা জরিমানা করে।
সুতরাং নানা অব্যবস্থার এই শহরে শত ব্যস্ততার মাঝেও নিশ্চিন্তে যেতে পারেন মাছ বাজারে। কিনতে পারেন বড় কিংবা ছোট মাছ। যাই কিনুন না কেন, মাছ কাটাতে আপনার পাশে আছে ‘মাছ কাটাইয়া’রা।
-সালেক খোকন
মন্তব্য
ব্লগরব্লগর ট্যাগ হলেও প্রথম দিকে পড়ে মনে হচ্ছিল কোন গল্প হবে হয়তো। শেষ পর্যন্ত এসে নামকরণের সার্থকতা পেলাম। লেখা সুন্দর, ঝরঝরে।
বেশ ভালো লাগলো আপনার লেখা।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
বাস্তব দৃশ্যপট। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ লেখার জন্য।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
অন্যরকম বিষয়ের লেখাটি ভাল লাগল।
প্রথমে ভাবছিলাম আমার কথা কইতেছেন।
লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে কোন পত্রিকার ফিচার বিভাগের জন্য লেখা।
আরিফ ভাই,
আমিও ভাবছিলাম যে আপনার কথা কইতেছেন লেখক।
সুন্দর ঝরঝরে লেখা। ভালো লেগেছে।
--------------------------------------
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
খোকন ভাই, পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলি সচলে ডাম্প করা বেশ জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করা হয় সচলায়তনে। আপনার কাছ থেকে সুখপাঠ্য অপ্রকাশিত লেখার আশায় থাকবো।
এই বানান গুলো চোখে কড়কড় করে লাগছে।
সাড়তে হয়
দুঃচিন্তা
বর্জ্র
বিরতী
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন