আমরা, তথাকথিত সভ্য সমাজের সুবোধ নাগরিকেরা, যা কিছু খারপ তার বীপরিতে মনের মধ্যে কিছু ঘৃণার জন্ম দিয়েছি, আসলে ভালো কে ভালো আর মন্দকে মন্দ শুনতে শুনতেই জন্মে গিয়েছে এটা... নিতান্ত অভ্যাস বশতই। আমরা ঐ টুকুতেই আত্মতৃপ্ত হয়ে যায়... অন্তত জানি আমি, এটা মন্দ আর এটার জন্য আমার মনে কিছু ঋণাত্মক অনুভূতি আছে এবং আমি মন্দ কিছু করছি না। (যদি বা কখনও করেও ফেলি কখনও যা মন্দ বলে জানতাম, তা প্রকাশ করি না, কেউ জানতে পারেনা, মান সম্মান নিয়েও আর টানাটানি পড়ে না... )। হয়ত ওই অনুভূতিটার মাত্রা আমাদের মনস্ত্বত্ত , ঘটনাটার প্রচার আর গুরুত্বের ভিত্তিতে খানিক হেরেফের হয়। কিন্তু সবকিছুর পরেও কেবলই ভদ্র এবং ভালো নাগরিক রয়ে যাই আমরা। এই আমাদের কৃতিত্ব।
এই ঘটনা গুলো আমাদের নিত্যদিনের ব্যাপার, নিত্যদিনের সংস্কার... এই সংস্কারে এতোটাই সংস্কৃতিবান হয়ে গেছি আমরা যে, আমরা আমাদের মানসিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে মাথা ঘামাই না। তাই আবু বকর, সাবেকুন নাহার সনিরা পত্রিকার শিরোনাম হলে আমরা মনে মনে শোকাভিভুত হওয়াই যথেষ্ট ভাবছি... এক দশক আগেও ভেবেছি, আজও ভাবছি, খুব সম্ভবত আরেক দশক পরেও ভাববো... এর পর কি করব জানিনা, কল্পনা করার ক্ষমতা এইখানে হার মানলো।
আজ লিখছি, নিহত আবু বকরের সাথে, যাকে আমি প্রথম দেখেছি পত্রিকার পাতায়, লাশ হবার পর, তার সাথে আমার কোন একটা আত্মার বন্ধন আছে বলেই আর না লিখে পারলাম না। তার মৃত্যুর পর জেনেছি এই ছোট ভাইটার সাথে অন্তত একদিক থেকে আমার কাজের, লক্ষ্যের মিল ছিল। জানার পর হয়ত সেই বন্ধনের জন্যই কষ্টের মাত্রাটা একটু বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি এটাও জানি, আজকের এই লেখাটা কালই অতীত হয়ে যাবে, যেমন করে আবু বকর আমাদের কাছে অতীত হয়ে গেছে। ত্রিশ দিন পর আর কেউ তার কথা মনে করবে কিনা সন্দেহ আছে, খুব কাছের কিছু মানুষ ছাড়া। আসলে এমন কতই তো ঘটে, ঘটেছে এবং ঘটবে। আমরা কেউই জোর গলায় বলি না, না আর ঘটবে না, আমরা ঘটতে দেব না। গলার জোরে যদি আমাদের ভালোত্বে দাগ পড়ে যায়!
২০০৪ সালে যখন ছাত্রী হলের ২২১ নম্বর কক্ষে প্রথম ঊঠি, তখন আমার রুমমেট পেয়েছিলাম সাবেকুন নাহার সনির সহপাঠিনীকে। উনার কাছেই শুনেছিলাম, “সনি খুব ভালো মেয়ে ছিল”। আর ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেখেছি, ৮ই জুনে গলায় কিছু পোষ্টার ঝুলিয়ে বুয়েটের ছাত্ররা হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে যায়, “সনি হত্যার বিচার চাই”। এইটুকুই। কোন কোন পত্রিকার এককোনে একটু খানি খবর আসে, আজ সনির মৃত্যুবার্ষিকী অথবা আজো সনি হত্যার বিচার হয়নি। আমরা ভদ্র নাগরিকেরা সন্তুষ্ট এতেই। যখন সনি আপু ঝরে যায়, তখন কিন্তু এভাবেই খুব আফসোস করেছিলাম, মেধাবী মেয়েটা এভাবে মরে গেল! আজ যেমন করে আবু বকরের জন্য করছি! ইতিমধ্যে বলে ফেলেছে, তাকে যারা চিনত, তাদেরই অনেকে, “ও খুব ভালো ছেলে ছিল”।
এটা নিশ্চিত, আবু বকর ও আমাদের কাছে এমনি করেই একটা দিন হয়ে গেলো। শুধু একটা দিন। একজন সম্ভাবনাময় তরুণ আর রইলো না। তবে যার বা যাদের অস্ত্রের আঘাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকর অতীত হয়ে গেল, তারা কিন্তু এখনো সম্ভাবনাময়। হয়তো একদিন তাদেরই কোন একজনকে রাজনীতি বা সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য সম্মান জানাতে স্কুলের বাচ্চারা শ্রেনীকক্ষ ছেড়ে রাস্তার দুপাশে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। ভদ্র নাগরিকদের চোখের অন্তরালে সেই মানুষটা কিন্তু মনে মনে হাসবে।
একটা ছোট্ট গল্প বলি। আমার এক সহপাঠিনীর নাম ছিল সনি। ডিপার্টমেন্ট এ আমাদের পরিচিতি অনুষ্ঠানের দিন, সেই সনি বলেছিল, তার এক বান্ধবী নাকি তাকে বলেছে, “বুয়েটে তো সনি ইতিহাস হয়ে গেছে। তুই আবার ওই রকম ইতিহাস হয়ে যাবি না না তো!” না, আমার সহপাঠিনী ইতিহাস হয়ে যায় নি। সে এখন সম্ভাবনাময় একজন প্রকৌশলী। কিন্তু, আবুবকরের ঘটনার পর যদি আর কাউকে বিকশিত হয়ে ওঠার আগেই ঝরে যাওয়ার ভয় পেতে হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই আসলে।
হয়ত এরপর বাবা মায়েরা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর সময় বলবে, “বাবা, বেঁচে ফিরবি তো?”
-নীরবতা
ফেব্রুয়ারী ৬, ২০১০।
মন্তব্য
এইসব মৃত্যু আসলেই অনেক মর্মবেদনার জন্ম দেয়। আরো খারাপ লাগে যখন দায়িত্বশীল লোকেদের কাছ থেকেই শুনতে হয় একেবারেই গাঁজাখুরি প্রতিক্রিয়া।
পোস্টের শুরুতেই বানান ভুল বা টাইপো রয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে অবশ্য, লিখতে লিখতে। লিখুন আরো।
----------------------------------------------
আমার যত অগোছালো চিন্তাগুলি,
রয়ে যাবে এইখানে অযতনে ।।
----------------------------------------------
আমার যত অগোছালো চিন্তাগুলি,
রয়ে যাবে এইখানে অযতনে ।।
ক্যাম্পাসে যাই, ক্লাস করি, কলাভবনের সামনে দিয়ে মিছিল যায়, আমরা সচকিত হই, স্যার ক্ষনিকের জন্য লেকচার দেয়া বন্ধ করে, যেন নীরবতা পালন করছেন। বাসায় আম্মুকে দেখি পত্রিকার পাতার নিরীহ ছেলেটি আর টিভির পর্দায় দেখা শোকাচ্ছন্ন পরিবারটির জন্য কষ্টে পুড়ে।কিন্ত প্রশাসন যথারীতি নির্বিকার! কিছু করতে না পারাটা নিয়ত কুরে কুরে খায় আমার বিবেককে। আর এই মৃত্যু আমাকে কাঁদায়!
@রেশনুভাঃ আমি ভুল বানানের ভান্ডার! বাংলা বা ইংরেজী যাই লিখি না কেন, বানান ভুল করার ক্ষেত্রে আমার তুলনা নেই। এমনই অবস্থা, মাঝে মাঝে ঠিক বানান লিখলেও মনে হয়, ভুলই লিখেছি... এতো আত্মবিশ্বাস!
কে জানে, এইখানেও কয়টা বানান ভুল করলাম...
-নীরবতা
নতুন মন্তব্য করুন