আমাদের প্রাইমারী স্কুলটা ছিল একটু ইসলামিক মাইন্ডেড। বাধ্যতামূলকভাবে কঠিন কঠিন আরবী শিখতে হত- বাংলা থেকে আরবীতে অনুবাদ টাইপ। যদিও তার অধিকাংশই এখন মনে নেই এবং প্রত্যক্ষভাবে পরবর্তীতে কাজে এসেছে কিনা বলতে পারবো না। মাঝে মাঝে আরব দেশগুলো থেকে আমাদের স্কুলে অতিথি আসতেন। তাঁরা আসার আগে আমাদের পি.টি. তে ট্রেনিং দেয়া হত- কিভাবে তাদের সাথে কথা বলতে হবে বা কী জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দিতে হবে এধরণের। আশ্চর্জজনকভাবে আমাদের কিছু শিক্ষকও দেখতাম চমৎকার আরবীতে কথা বলতে পারতেন! অতিথি আসার সিজন গুলোতে তাই তাদের কদর বেড়ে যেত অনেকখানি। পরে জেনেছিলাম স্কুল ঐসব আরবদেশ থেকে নিয়মিত ফান্ডিং পেত- তাইত তাদের আগমনকে উপলক্ষ্য করে এত আয়জন। উপরের কথাগুলো বললাম আমার লেখার বিষয়ের একটা ভূমিকা দিতে। লেখার বিষয় খুব সাধারণ- ক্লাসে টীচারের সাথে আমাদের সম্পর্ক বা দূরত্ব যেটাই বলি না কেন। স্কুলটার নিয়ম ছিল ক্লাসে টীচার আসা মাত্র সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিবে। মনে আছে একদিন মিজান স্যার ক্লাসে আসলেন। কেন যেন সালামের শব্দ খুব একটা জোরে হলনা। স্যার তো খেপে ফায়ার- ‘ঘটনা কি? সালাম শোনা গেলনা কেন?’ এই বলে সবাইকে নির্বিচারে বেত্রাঘাত। ক্লাসে ছিল আনুমানিক চল্লিশজন। ফার্স্ট বয় (আসলে ফার্স্ট গার্ল) থেকে শুরু করে সবাই মার খেল। প্রথম সারির স্টুডেন্টরা মার খেলে অন্যদের গুলো কিছুটা প্রশমিত হয়ে যায়, খুব একটা লজ্জাবোধ আর হয়না। তো সেই স্যার বললেন, ‘এইবার আমি আবার ক্লাসে ঢুকবো, তোরা আবার সালাম দিবি’। ভোকাল কর্ড ফাটিয়ে সবাই বলে উঠলো- আস্সালামু আলাইকুম। এত জোরে যে স্যার একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন, বুঝতে পারলেন না যে এটা কিছুটা ফান এর পর্যায়ে চলে গেল কিনা। পরবর্তী প্রতি ক্লাসেই মিজান স্যারকে এভাবে অভ্যর্থনা জানানো হত। এরপর হাইস্কুলে গেলাম। ওটা সরকারী স্কুল, ওখানে কেবল দাঁড়ালেই চলত। তারপরও কিছু স্যার সজাগ দৃষ্টি রাখতেন যে কেউ বসে রইল কিনা। তাকে কিভাবে শাস্তি দেয়া যায়, এসব করেই কেটে যেত আরও মিনিট দশেক। একটা ম্যাডামের কথা না বলে পারছি না- রুমি ম্যাডাম। উনার ক্লাসে সবাইকে রোবট হয়ে বসে থাকতে হত। কেউ কোন কাজে দাড়ালেও সোজা হয়ে ক্যাডেটদের মত দাড়াতে হত। ক্লাসের অর্ধেক সময়ই চলে এত উনার ক্লাসে কিভাবে থাকতে হবে তার উপর বয়ান দিয়ে। কলেজে ছিলেন মোজাম্মেল হক স্যার- উনি এই বয়সের ছেলেদেরকেও থাপ্পড় দিতেন। চট্টগ্রাম কলেজে উনি একটা আলোচনার টপিক! ভার্সিটিতে এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি খুব একটা মনে পড়ছে না। তারপরও ক্লাসে লেকচার না শুনে অন্যমনস্ক থাকলে কথা শুনতে দেখেছি অনেককেই। সবচেয়ে অবাক হয়েছি প্রবাসে পড়াশুনা করতে এসে ক্লাসরুমগুলো দেখে। এমনিতেই এখানে আমি নতুন, তার উপর এমন কড়া টাইপের স্কুল কলেজ পার হয়ে এসেছি। আমার সামনের মেয়েটা নিজের চেয়ারে বসেই ক্ষান্ত হয়নি, সামনের চেয়ারটা নিজের দিকে ঘোরালো। তারপর ঐটার উপর তুলে দিল তার পা! বামের চেয়ারটাও ঘোরালো, তার উপর রাখলো বই। আর নিজের চেয়ারে কেবল খাতা আর কলম। পাশে আরেকজন তার মোবাইল নিয়ে খুব ব্যস্ত, খুব সম্ভবত চ্যাট্ করছে। একদম শেষে একজন তার ল্যাপটপ বের করে ব্রাউজ করছে। কেউ কেউ খাচ্ছে, আশে পাশে ড্রিঙ্কস এর ছড়াছড়ি। ওদিকে টীচার তো পড়াচ্ছেনই। উনিও টীচার না- তাকে বলা হয় কোর্স ইন্সট্রাক্টর! হ্যাঁ, অনেকেই অবশ্য মনযোগ দিয়ে লেকচার শুনছে। ছাত্রদের মাঝেও কত রকমভেদ- কারো কারো বয়স নির্ঘাত চল্লিশ ছাড়িয়ে গেছে। দেশে এধরনের স্টুডেন্ট দেখে তো আমি আর অভ্যস্ত না, তাই মনে মনে ভাবি এই বয়সেও তাদের কত খানি তেল- ক্লাস করছে, ক্লাসনোট তুলছে, ক্লাস শেষে এক কোণায় বসে হোমওয়ার্ক সেরে নিচ্ছে।
আমি দেশে যে জাপানি প্রফেসরের সাথে প্রজেক্টে জড়িত ছিলাম, একবার তাকে আর তার স্টুডেন্টদের নিয়ে বেড়াতে গেলাম পদ্মার এক চড়ে। সাদা সাদা বালির মধ্যে কতগুলো মরা কেঁচো পড়েছিল। প্রফেসর তার এক ছাত্রীকে কি প্রসঙ্গে যেন বলছিল যে এই কেঁচোগুলা সে খেতে পছন্দ করে! ছাত্রী মুখ বিকৃত করে ইয়াক্ করে উঠল। প্রফেসর মজা করে একটা কেঁচো হাতে নিয়ে ওই ছাত্রীর দিকে ছুড়ে মারলো। অমনি সে দিল দৌড় আর চিৎকার করে বলতে লাগলো- ‘আই হেইট ইয়ূ, আই হেইট ইয়ূ...’
চিন্তা করে দেখলাম, ওরা যে শিক্ষককে সম্মান করেনা তা না। সেটা অন্যভাবে করে। ভিন্ন কালচারে বড় হওয়ার কারণে আমাদের কাছে সেটা হয়ত কখনই বোধগম্য হবে না...
রিজভী
-------------------------------------
কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-
আমি বহে আনি;
মন্তব্য
স্যার ক্লাসে ঢুকলে বাধ্যতামূলকভাবে দাঁড়াতে হবে ভার্সিটিতে এই ধারনা পোষণ করে মূলত সদ্য যোগ দেয়া লেকচারাররা। অনেক ক্ষেত্রেই এ অপরাধকে মনের ভেতর পুষে রাখতে দেখেছি উনাদের।
লেখা ভালৈছে। তার চেয়ে বড় কথা প্রায় দু'বছর পর আমাকে বাংলা ব্লগের নেশা ধরিয়ে ব্লগ থেকে উধাও হয়ে যাওয়া তোর একটা ব্লগ পড়লাম।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
তোর ডাকাডাকিতেই আবার লেখার অনুপ্রেরণা পাচ্ছি...
খুব ভাল লিখেছিস রিজভী। ভাল লাগছে পড়ে।তবে একটা জিনিস মনে হয় এখনো তোর চোখে পড়েনি। এখানে আসার পর এশিয়ান শিক্ষকদের মানসিকতা কতটুকু পরিবর্তন হয় জানিনা তবে তারা সাদাদের চাটুকারিতা করতে কখনো পিছপা হননা।(যদিও ককেসীয়রা মাঝে মাঝে তাদেরকে নিয়ে ফান করে।) আর বরাবরের মতই এশিয়ান ছাত্রদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম থাকে। এমন একটা ব্যাপার যেন তাদের কে ভয় পেতেই হবে।
হ্যাঁ, আমি প্রত্যক্ষভাবে এখনো দেখিনি। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝি, তারা আসলে অন্যদিকে সুবিধা করতে না পেরে এ ধরণের ব্যবহার করে। ইচ্ছে করেই গ্রুপে প্রচুর এশিয়ান স্টুডেন্ট রাখে যেন মনের মত করে খাটাতে পারে!
রিজভী, সচলে তোমার লেখা দেখে ভাল লাগছে। চমৎকার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ,তবে আমার মনে হয় তুমি লেখাটাকে আরো বেশি দূর নিয়ে যেতে পারতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষকরা তথাকথিত 'ভাব' মেরে থাকেন তাদেরকে ছাত্ররা খুব বেশি পছন্দ করেননা। আমার মতে একজন ভাল শিক্ষক তিনি যাকে ছাত্ররা ভয় পাবেননা বরং ভালবাসবেন আর সেই ভালবাসা আসে মূলত ছাত্রদের সাথে মিশে যাবার মাধ্যমে।
তোমার কাছ থেকে আরো লেখা চাই তাও আবার নিয়মিত।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
স্যার, আপনার মন্তব্য পড়ে ভাল লাগলো। পরে আমারও তাই মনে হয়েছে- খুব সংক্ষেপে লেখাটা শেষ করে দিলাম! আমি বুঝিনা বুয়েটের অধিকাংশ শিক্ষকই তো বাইরে পড়াশুনা করে এসেছেন। উনারা কি ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে এই সহজ সম্পর্কগুলো এখান থেকে দেখে জাননি?
আপনার লেখা ভাল লেগেছে।
একদম সহজ সাবলীল। এরকম আরও লিখুন।
ধন্যবাদ
চেষ্টা করব নিয়মিত লেখার…
ভাল লেগেছে। আরো লিখলেন না কেন!
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধন্যবাদ। এখন আমিও তাই ভাবছি- আরও লিখলাম না কেন? দেখা যাক, পরে ছাত্রজীবনটা ঘুরে ফিরে অনেক লেখাতেই হয়ত আসবে...
রিজভী,
লেখাটা পড়তে পড়তে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল। জানোই তো, আমার ডিপার্টমেন্ট আবার এই ব্যাপারে বুয়েটে বিখ্যাত! কিন্তু লেখা শেষে তোমার নামটা দেখে একখান চিল্লান দিছি... কি যে ভালো লাগতেছে! এই স্বাদটা অনেকদিন পরে পেলাম আবার... চালিয়ে যাও বন্ধু... এভাবেই দেখা হবে বারবার... এখানে সেখানে!
-নীরবতা
নতুন মন্তব্যে তোমার নাম দেখে আমিও একটা চিল্লান দিলাম! এই লেখাটা লিখতে গিয়ে আমার কত যে অতীত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল...ইয়াহু 360- তে কত মজাই না করতাম আমি, তুমি, ইরতেজা ভাই, পল্লব দাদা, জেরীন সহ আরও অনেকে...সবে মাত্র অভ্র বের হয়েছিল...কম্পিউটারে বাংলা লিখতে পেরে এত ভাল লাগতো যে হাত দিয়ে স্ক্রীনে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করত...
হ্যাঁ, এভাবেই আবার ব্লগের মাধ্যমে একেকজনের সাথে দেখা হয়ে যাবে...
ভালো লেখা...
-মুক্তমনা
fibonacci013@yahoo.com
ধন্যবাদ
আমার স্কুলে এক শিক্ষক ছিলেন। উনার পরিষ্কার আদেশ ছিল, উনি ক্লাসে ঢুকলে দাঁড়ানো যাবে না। আপনার লেখা পড়ে তাঁর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলাম।
এটা অবশ্য নটরডেমে সাধারণ ঘটনা ছিল, কয়েকজন ছিলেন চড়-থাপ্পড় দিয়ে অভ্যস্ত। আমাদের সাথে ভর্তি হওয়া এক ছেলে ফার্স্ট ইয়ারেই এক স্যারের হাতে ক'টা সাইজ মতো রামকিল খেয়ে ঢাকা কলেজ চলে গেছিল।
________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা
আপনার সেই শিক্ষকের প্রতি আমারও শ্রদ্ধা রইল। নটরডেমের খুব বাজেভাবে বকাঝকা করা কিছু শিক্ষকের গল্পও শুনেছি বন্ধুদের কাছে...
ভাল লিখেছিস.........। চালিয়ে যা...। ঐ মেয়েটি দেখে তুই বেশ মুগ্ধ মনে হচ্ছে......। হা হাহা...।
ধন্যবাদ। তবে এই ইন্টারনাল খবরটা তুই ক্যাম্নে জানলি!?!
- বেশ ভালো একটা বিষয় তুলে এনেছেন তো!
শিক্ষক ক্লাসে এলে পোলাপানের উঠে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা কি শ্রদ্ধা থেকে হয় নাকি ভীতি থেকে, নাকি এমনি এমনি— এটা জানার ইচ্ছে হচ্ছে খুব।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আমার মনে হই এমনি এমনি...সিস্টেম মনে করে সবাই দাঁড়ায়
নতুন মন্তব্য করুন