অগোছালো মন আর অগোছালো জীবন, এই হল আমার সম্বল। যেদিন ছোট্ট জুতা পায়ে ছোট্ট আমি আমার চেয়ে বড় একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে প্রথম স্কুলে গিয়েছিলাম, সেদিন থেকেই মনে হয় গোছানোর পাঠ শুরু হয়েছিল আমার। ব্যাগের মধ্যে বইগুলো, লাল রঙের বড় বড় খাতাগুলো, পেন্সিল বক্স, স্কেল, টিফিনবক্স আর পানির ফ্লাক্স এই গুলো সব গুছিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কোনটাই ফেলে যাওয়া চলবে না। তারপর জামা-জুতো পরতে হবে। জুতোর ফিতে বাঁধতে হবে। ছোট চুলে দুইটা ঝুটি করতে হবে। স্কুলে গিয়ে শান্ত হয়ে ছোট ছোট চেয়ার-টেবিলে বসতে হবে। কত্তো কিছু... প্রথমে ক’দিন মা গুছিয়ে দিতো সব। তারপর একটু একটু করে আমাকেই শিখতে হল। ক্লাস টুতে উঠেও জুতার ফিতা বাঁধতে পারতাম না। স্কুলে যদি ফিতে খুলে যেতো, মহা বিপদে পড়ে যেতাম আমি। দৌড়াদৌড়ি বন্ধ! সাবধানে হেঁটে স্কুলের খালার কাছে গিয়ে বলতাম, “খালা, ফিতা খুলে গেছে।” খালা বেঁধে দিলেই হল, আবার দৌড়াতে শুরু করতাম। আম্মুতো দেখতো না, আমি এখন দুষ্টামি করছি। কিন্তু টিচার দেখতো। একদিন আব্বুকে ডেকে বলে দিল, “ছেলেরা না হয় বেশী দুষ্টামি করে, কিন্তু আপনার মেয়ে তো ছেলেদেরও হার মানায়!” বাসায় ফিরে আব্বুর কি হাসি! আর আম্মুর মুখে কপট রাগ! আমার কি দোষ, আমি কি আমার ছেলেবন্ধুদের বলেছিলাম নাকি, এই তোরা কেউ আমার চেয়ে বেশী দুষ্টামি করবি না! আর আম্মুই বা কেমন, আমাকে এভাবে বকছে কেন! যাই হোক, যতই দুষ্টু হই না কেন, কিছুই গুছিয়ে রাখতে না পারলেও, রেললাইনেই রেলগাড়িটাকে চলতে হবে, এই পরাধীনতা ঠিকই ছিল। সবাই মিলে শুধু হতচ্ছাড়া একটা কথা ঢুকিতে দিয়েছিল আমার ছোট্ট মাথায়, গোছাতে শিখতে হবে! এইজন্যই হয়তো শিখতেই পারলাম না কোনদিন। তবে একটা জিনিশ ঠিকই শিখেছি, তর্ক করতে, কি হবে গুছিয়ে?
টেবিলের উপর বইগুলো সাজিয়ে রাখলে আমার কখনো পড়তে ইচ্ছা করতো না, আমি চুপ করে সাজিয়ে রাখা বইগুলো দেখতাম। ওইখান থেকে আর বই বের করতে ইচ্ছা করতো না। ইস, এতো কষ্ট করে গুছালাম, এখন যদি এলোমেলো হয়ে যায়! তাই এদ্দিন পর্যন্ত যতটুকু পড়েছি, পড়তে ইচ্ছা হলে, এলোমেলো বইয়ের মাঝখান থেকে খুঁজে নিয়েই পড়েছি। শুধু শুধু মাঝখান থেকে গুছাতে পারিনা বলে বকা খেয়েছি আর মাঝে মাঝে মন খারাপ করে থেকেছি। এখন আমি খুশি, আমাকে এখন কেউ আর কিছু গোছাতে বলে না। আমার এলোমেলো স্বভাবের সাথেই সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এখন তো আমি পঁচিশের বুড়ি!
একটা সময় ছিলো, গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম। বিতর্কের মঞ্চে গুছিয়ে যুক্তিগুলো উপস্থাপন করতে সময় লাগতো না। এখন আর পারিনা। আসলে আর কোনদিন পারি, সেটাও আর চাই না। এইতো আমি এলোমেলো কথা বলে যাচ্ছি, এতে আমি মজা পাচ্ছি কিনা সেটাই আসল কথা। আমার এক বন্ধু আছে, আগে যখন লিখতো, যা মনে আসতো লিখে ফেলতো, আর আমি তখন লিখতাম অনেক যত্ন করে। তাতে অপরিপক্কতা থাকলেও যতন ছিলো। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “অনেকদিন লেখ না, কবে আসবে লেখা?” উত্তরে বলেছিলাম, “লেখার কথা ভাবছি, ভেবে এখনও শেষ করতে পারিনি আসলে কি লিখতে চাই।”। বন্ধুটা আমার আঁৎকে উঠেছিল, “তুমি ভেবে লিখ?”! এখন যা ইচ্ছা তাই লিখছি... যতদিন যাচ্ছে ততই এমন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছি। আমার কিন্তু ভালোই লাগছে। জীবনটাকে একটু খুশি মত চলতে দেই না কেন? সবাইকে যে সাজিয়ে গুছিয়ে জীবনটাকে আকর্ষনীয় করে তুলতেই হবে এমন কোন কথা নেই। অগোছালো জীবনের আনন্দের মাঝে আমি আকণ্ঠ ডুবে আছি। আমার মুখটা কখনো একটু রাঙ্গা হয়ে উঠুক, এই শখ যদি মনে জাগে কখনও, তাহলে নাহয় আমি প্রসাধনের বাক্স না খুলে শেষ বিকালের আলোর মাঝে দাঁড়িয়ে যাবো।
এই যে, এলোমেলো কত কথা লিখে ফেললাম! লিখতে মনে চাইলে তা যে সুন্দর কিছু হতেই হবে, এমন তো কথা নেই। ভালোলাগার চেয়ে সুন্দর কিছু আর নেই!
-নীরবতা
February 7, 2010.
মন্তব্য
ভালোলাগার চেয়ে সুন্দর কিছু আর নেই!
কত সহজে কত সুন্দর একটা কথা বলে ফেললেন। লেখাটার সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। একটা ছবি দেখতে পেলাম যেন আপনার লেখার মাঝে। ভাল থাকুন।
ভালো লেগেছে। আরো লিখুন।
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
জয় ভালো লাগা ! জয় অগোছালো জীবন !!
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগলো। ধন্যবাদ... ঃ)
-নীরবতা
পানির ফ্লাক্স, ছাতা এইগুলা সবসময় ভুলে ফেলে চলে আসতাম যেগুলা পরে গিয়ে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যেত না...আর বাসায় এসে খেতাম বকুনি!
রিজভী
-------------------------------------
কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-
আমি বহে আনি;
আপনার একটা আকর্ষণীয় অকপট ভঙ্গি আছে। ভালো লাগলো।
________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা
- নজরুলের একটা লাইন আছে না? ঐ যে, 'আমি বনের পাখি, নিজের ইচ্ছেমতো গান গাই। কারো ভালো লাগলেও গাই, না লাগলেও গাই।' (তাঁর মতো করে মনে পড়ছে না, কিন্তু মূলভাব এটাই)
আপনি গাইতে থাকেন। নিজের কাছে ভালো লাগাটাই মুখ্য। বাকি কে, কী মনে করলো তা দিয়ে কি আর ইঞ্জিন চলে!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
তাইতো, কি হবে গুছিয়ে?!!
ভাল লাগল লেখাটা
-------------------------------------------
আকাশে তোর তেমনি আছে ছুটি
অলস যেন না রয় ডানা দুটি
সাবলীল লেখা।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
লেখা ভালো লেগেছে। সহজপাঠ্য এবং অকপট।
ক্লাস টুতে উঠেও জুতার ফিতা বাঁধতে পারতাম না
এই অসুবিধা আমার এখনো আছে, ফিতা বাঁধলে খুলে যায় একটু পরে। ক্লাসে টু এর মধ্যে সমস্যা সমাধান না হলে সারাজীবনে নাও হতে পারে
একদিন আব্বুকে ডেকে বলে দিল, “ছেলেরা না হয় বেশী দুষ্টামি করে, কিন্তু আপনার মেয়ে তো ছেলেদেরও হার মানায়!”
দুষ্ট মেয়েদের বলা হয় "ফ্রী স্পিরিটেড"...আমার নিজেরো একখানি আছে। দুষ্টামি বজায় থাকুক।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
'তুমি দুষ্ট জানতাম, এতো দুষ্ট তা জানতাম না'
ক্লাস ফোরে ম্যাম চশমার ফাঁক দিয়ে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে ঠিক এইভাবে বকুনি লাগিয়েছিলেন... লেখায়
লিখতে থাকুন ইচ্ছেমতোন!
--------------------------------------------------
"আমি তো থাকবোই, শুধু মাঝে মাঝে পাতা থাকবে সাদা/
এই ইচ্ছেমৃত্যু আমি জেনেছি তিথির মতো..."
*সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আমি তো একরকমের চালাক জুতা পেয়েছিলাম, ফিতাটিতা বাঁধতে টাধতে হতো না, শুধু চটির মতন পায়ে গলিয়ে নিলেই চলতো! নইলে ধুলামাখা ফিতা ধরবে কে!!!
ভালো থাকবেন, অনেক লিখবেন হাত খুলে।
প্যারাগ্রাফ ভাগ করে করে লেখাটা দিলে পড়তে চোখে আরাম হয়।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
@রিজভীঃ সে আর বলতে... কিন্তু ঐ বকাগুলো এখন সম্পদ... এইযে বলছি... ছোট্টবেলায় এই এই করেছি... না বকলে মনে হয় মনেই থাকতো না...
@রাহিন হায়দায়ঃ
@ধুসর গোধূলিঃ আমার বুড়িয়ে যাওয়ার রোগ আছে। ইঞ্জিন মাঝে মাঝে ঝালেমা করে। ওটেই আমার ভয় বেশী!
@আনন্দী কল্যাণঃ
@রাফিঃ ধন্যবাদ...
@তাসনীমঃ কেউ আমাকে ছেলে-মেয়ের কথা বললে মনে হয়... বুকটা খালি খালি লাগছে... কি আর করা, ছয় মাসের মামাতো ভাইকে ট্রেনিং দিচ্ছি... প্রথম ডাকটা যেনো বিড়ালের মত ডাকে...
@তিথিডোরঃ স্বগোত্রীয় মানুষ দেখলে খুশি খুশি লাগে...
@তুলিরেখাঃ একটা টাইম মেশিন লাগবে আমার... তাইলে একটু স্মার্ট হওয়ার সুযোগ ছিল...
প্যারাগ্রাফ এর কথা মাথায় রাখার চেষ্টা করব...
-নীরবতা
বাহ! ভালো লাগলো খুব! দুষ্ট মেয়েদের বড় ভালু পাই!
-------------------------
ওলো সুজন আমার ঘরে তবু আইলোনা
এ পোড়া মনের জ্বলন কেন বুঝলোনা!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
কিছু গোছানোর কথা ভাবলেই আমার ম্যাক্সওয়েলের ডেমনের কথা মনে পড়ে। পুরো বিশ্বের এন্ট্রপি যেহেতু বাড়তেই থাকবে। তাই কিছু গুছিয়ে এন্ট্রপি কমাতে যাবার অর্থ হলো নিজের ব্রেইনের মধ্যে তার চেয়ে বেশি এন্ট্রপি বাড়ানো। হয়তো টেবিল গুছিয়ে ফেলব ঠিকই, কিন্তু নিউরণগুলো যাবে সব এলোমেলো হয়ে !!!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ভাইয়া, খুব ভাল লাগলো আপনার কমেন্টটা...মজা পাইলাম
রিজভী
@স্পর্শঃ লিঙ্কটা কাজে লাগবে আমার। আমি আপনার সাথে পুরাই একমত। বেহুদা কাজে এনট্রপি বাড়ানোর কোন মানে নাই...
@দুষ্টু বালিকাঃ আপনি তো দেখি আমার আদরের নাম নিয়ে নিছেন...
-নীরবতা
নতুন মন্তব্য করুন