হাঁটছি বত্রিশ বছর আগের করিডোরে....
জানুয়ারীর ২৩ তারিখ । ঠিক দু’দিন পরে দু’মাসের ছুটি শেষে ফিরে যাব অটোয়ায় । নিজের আবাসে নাকি প্রবাসে ? ঠিক জানি না । যে দেশে আজ এগারোটা বছর কাটিয়ে দিলাম, তাকে আর কতকাল প্রবাস বলব ঠিক জানি না, তবে এখনো নিজের দেশ (পশ্চিমারা যাকে “হোম” বলে) বলতে ভেতরে কোথায় যেন ভীষণ টান লাগে । সে যাক, আমরা দু’বোন হাঁটছি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডোর ধরে । আউটডোরের গেট দিয়ে ঢুকে শীতের সন্ধ্যা নেমে আসা হাসপাতালের টিমটিমে টিউবলাইটের আলো আঁধারির মধ্যে আমরা যাচ্ছি কেবিনের দিকে । টিউবলাইটগুলো আলোর চেয়ে অন্ধকার ছড়ানোর কাজটাই বেশি করছে । দেয়ালে পানের পিকের দাগ, মেঝেতে রক্তের ছাপ.... করিডোরের এখানে ওখানে রোগীর আত্মীয় স্বজনের জটলা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি । পর্দার ফাঁক গলে ওয়ার্ডের ভেতরের পরিবেশ খুব ভাল মনে হয় না । অবশেষে লিবরার বাবার কেবিনের দরজায় কড়া নাড়তেই খালাম্মা এসে খুলে দিলেন (লিবরা অটোয়ায় আমার প্রতিবেশী ও বন্ধু । বাবার চিকিৎসার জন্য ও খুব শিগগিরই দেশে আসবে । আমাকে অনুরোধ করেছে আমি যেন ওর বাবার কিছু মেডিকেল রিপোর্ট সঙ্গে করে নিয়ে যাই ।) গোটা কেবিনের ম্রিয়মাণ আলোতে, নিষ্প্রভ দেয়ালে, অপরিচ্ছন্ন মেঝেতে, শক্ত বিছানার কাঠিন্যে- সবকিছুতে কেমন বিষণ্ণতা ঝুলে আছে । বিষণ্ণতার অবশ্য আরো কারণ আছে, লিবরার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে ।
ওঁকে প্রথমে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল । সেখানে বোর্ড মিটিং করে ডাক্তাররা জানিয়েছেন রেডিওথেরাপী দিতে হবে । ঢাকায় রেডিওথেরাপীর ব্যবস্থা যেহেতু শুধুমাত্র ডিএমসি ও অন্য একটি প্রাইভেট হাসপাতালে আছে, তাই ডাক্তারের পরামর্শ মত ডিএমসিতে ভর্তি করা হয়েছে । কিন্তু এখানে ভর্তি করার পরে ভীষণ দুর্বিপাকে পড়েছে পরিবারটি । নানান অব্যবস্থায় হতাশ হয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ওঁকে ব্যাংকক নিয়ে যাওয়া হবে চিকিৎসার জন্য ।
শীতের রাত নেমে আসা করিডোর ধরে আমরা দু’বোন বের হয়ে আসি হাসপাতাল থেকে । আমরা কেউ কিছু বলি না, চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটি । দু’জনেই জানি আমরা ফিরে গেছি বত্রিশ বছর আগে ফেলে আসা ১৯৭৮ এর আট মাস সময়ে । আমার বয়স তখন সাত বছর । আমার বোনটি, যাকে আমি ছোট’পা ডাকি (কারণ আমাদের একটি বড় আপা ছিল), সে সদ্য কলেজ পাশ করে জাহাঙ্গীর নগরে ভর্তি হয়েছিল । সেই আট মাস এই হাসপাতালটি আমাদের বাড়িঘর হয়ে গিয়েছিল । আমাদের বড় আপা ওভারিয়ান ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে করে আট মাসের মাথায় মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে চলে গেল না ফেরার দেশে । তখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী ছিল । কৈশোরে বিয়ে, স্বামীর কর্মস্থল (তৎকালীন) পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া আবার ফেরা ইত্যাকার নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে পড়াশুনা করার অদম্য আগ্রহ ছিল তাঁর । উনত্রিশ বছর বয়সের জীবনে সে ছিল পরিবারের “বাতিঘর” । অথৈ সমুদ্রে নিকষ অন্ধকারে জাহাজ যেমন করে দূরে বাতিঘরের আলো দেখে লক্ষ্য স্থির করে, বড় আপাকে দেখেও আমরা সবাই জানতাম কতদূর পথ পাড়ি দিতে হবে ।
সেই বয়সে সব কিছু বুঝে উঠিনি, মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনো দেখিওনি, চিরতরে চলে যাওয়া, কখনও আর না ফেরা.....বোধের অধরা সেই সময়েও পরিবারের সবার অসহায়ত্বটুকু কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলাম । হাসপাতালের করিডোরে সবার দীর্ঘ পায়চারি, ঝুলে পড়া কাঁধ, বিষণ্ণ চাহনি, দু’চোখের পাতায় জমে ওঠা তিরতিরানো অশ্রুকণা, কেউ কাউকে কোন “আশা” দিতে না পেরে নির্বাক তাকিয়ে থাকা......এ সবকিছু কেমন করে যেন আমার পাঁজরে লেগে আছে । আজ অনেকদিন পরে সেই করিডোরে হাঁটতে গিয়ে আমি তা টের পেলাম ।
চলবে...
নিবন্ধন-নাম: জোহরা ফেরদৌসী
মন্তব্য
এমন একটা মন খারাপ করা বিষয় নিয়ে লিখলেন যে লেখার ভঙ্গি নিয়ে প্রশংসা, কিংবা সচলে স্বাগতম - এসব কোন কথাই ঠিক বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না ......
মাত্র ঊনত্রিশ বছর!!!
থাক না স্নিগ্ধা, কখনো কখনো না হয় নাই বললাম আমরা সব কথা । কখনো কখনো শুধু নীরবতায় ভরে থাক....
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
আপু , মাস দুয়েক আগে মাকে নিয়ে একটা সিরিজ লিখেছিলেন আপনি... তাই না?
--------------------------------------------------
"আমি তো থাকবোই, শুধু মাঝে মাঝে পাতা থাকবে সাদা/
এই ইচ্ছেমৃত্যু আমি জেনেছি তিথির মতো..."
*সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথীডোর, নামটা দেখে আমারও সেই সন্দেহ হয়েছিলো, কিন্তু তিনি তো ইশতিয়াক রউফের খালা ছিলেন আর ইনি তো আমাদের জেনারেশনের। অবশ্য সেটা তো সম্ভবই। দেখা যাক জোহরা ফেরদৌসী কী বলেন ......
স্নিগ্ধা, নিজের সৌভাগ্য দেখে নিজেরই হিংসে হচ্ছে । আমার মত অভাগার (নাকি অভাগী হবে ?) লেখা কেউ পড়ে মনে রেখেছে !
ঠিকই ধরেছেন, আমি ইসতিয়াক রউফের খালা । আমাকে নিয়ে আপনার সন্দেহটা খুবই যুক্তিযুক্ত । আমি হলাম এক “নিরালম্বু”, নিজের প্রজন্মের লোকজনরা (মানে ভাই বোনরা) পাত্তা দেয় না, তাদের হাটুর বয়সী বলে । আর পরের প্রজন্ম (আমার প্রথম ভাইজির জন্ম আমি যখন সবে ক্লাস ফাইভে পড়ি) পাত্তা দেয় না, মাথায় তাদের খুব কাছাকাছি বলে । আরও একটি কারণ হল, আমি ওদের সব অপকর্মের (ছাদে লুকিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা, শীতকালে আইসক্রিম খাওয়া থেকে হাল আমলে ফেস বুকে একাউন্ট খোলা পর্যন্ত) একনিষ্ঠ সহকর্মী ও উৎসাহ দাতা । বুঝতেই পারেন, পরিবারে আমার প্রাজ্ঞতা, বিজ্ঞতার কোন দাম নেই ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
তিথী, ধন্যবাদ মনে রাখার জন্য । ঠিক ধরেছেন, মাকে নিয়ে লেখাটা আমারই ছিল । মার চলে যাওয়ার সেই সময়টা মাকে নিয়ে লিখে, মার কথা বলে অনেক শান্তি পেয়েছি । মার নামের অর্থ “পৃথিবীর আলো”, মা তাঁর নামকে সার্থক করেছিলেন । সন্তান হিসেবে তাঁর রেখে যাওয়া আলোয় পথ দেখতে চাই ।
শুভ কামনা রইল আপনার জন্য ।
..............................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
আপা আপনার লেখা খুব ভালো লাগলো। অনেক সময় ধরে দেখছিলাম নতুন কোনও লেখা আসছিলোনা, আপনার লেখা সেসময়ে খুব বেশী ভালো লাগলো।
================================================
পরদেশী বঁধু, ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি।
যদি গো নিশিথ জেগে ঘুমাইয়া থাকি,
ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি।।
আপনার প্রতি রইলো আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
দারুণ!
ডিএমসি এর রেডিওথেরাপি ডিপার্টমেন্ট খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাই অনুভব করতে পারছি কিছুটা হলেও।
---------------------
।।সাদাত।।
ধন্যবাদ সাদাত পড়ার জন্য । ভালো থাকুন ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
সচলে স্বাগতম!
এরকম আরো লিখুন।
==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
ধন্যবাদ পড়ার জন্য । ভালো থাকুন ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
আপনার কিছু কথা মন ছুঁয়ে গেছে। বেশ সুন্দর করে লিখেছেন।
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
কাকুল কায়েশ
ধন্যবাদ পড়ার জন্য । আশা করছি পরের পর্বগুলো পড়বেন । শুভ হোক সকলের ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
এমন চমৎকার মন ছুঁয়ে যাওয়া ভাষায় লিখেন আপনি! চলুক তাহলে (চলুক)।
ধন্যবাদ সময় করে পড়ার জন্য । ভালো লেখার চেষ্টার কমতি নেই এটুকু বলতে পারি, তবে তেমন কি আর লিখতে পারি ?
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
মন ছুঁয়ে গেছে। ভালো থাকুন।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
তাসনিম, আপনাকে ধন্যবাদ পড়ার জন্য । আরেকটা কথা বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথের যে গানটি বেছে নিয়েছেন, সেটি আমি দিনের মধ্যে একবার অন্ততঃ নিজেকে মনে করাই ।
কোথা সে অচিন আলোকপুর
কিসের মোহে খ্যাপা তুই আছিস মজে...?
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
এই শীতের সকালটা জমে দলা পাকিয়ে গলায় আটকে গেলো।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কারণ, শেষতক আমরা মানুষ....
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....
জোহরা ফেরদৌসী
অসাধারান
অনেক ভালো লাগলো
জলপুত্র তথাস্থু,
ধন্যবাদ পড়ার জন্য ।
নতুন মন্তব্য করুন