যারা প্রথম পর্ব পড়েননি আর যারা পড়েছেন, সবার জন্যেই বাক্সে বন্দীঃ প্রথম পর্ব
----------------------------------------------------------------------------------
এতসব ভাবতে ভাবতে সে বাক্সটা তুলে নেয়। ব্যাকপ্যাকের চেইনটা খুলে ভেতরে রাখে। অদ্ভুত রকমের একটা মন খারাপ লাগা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অবশ্য জীবনে ক'টা দিন সে হাসি-আনন্দে কাটাতে পেরেছে, সে গুণে গুণে বলতে পারবে। দিন হিসেবে গুনলে এক হাতের পাঁচটা আঙুলও লাগবেনা।
সে মেইন গেইটটা পার হয়ে ফেন্সে রাখা সাইকেলটা তুলে সোজা করলো।
"মিস্টার শ্যালন, আজও কি আপনি ফ্লায়ারগুলো নেবেননা?", একটু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।
"না হে বাছা। আমার ওসব ফ্লায়ারে কাজ নেই। কোথায় কোন বিউটি শপে ডিসকাউন্ট দিচ্ছে, তা জেনে আমার দরকারটা কি?",হাসতে হাসতে বলেন মিস্টার শ্যালন।
"ঠিক আছে, আজ আসি তবে"।
"ওকে ইয়াংম্যান। এই শনিবারে চলে আসতে ভুলোনা যেন"।
হাতটা নাড়িয়ে বিদায় জানায় দুজন দুজনকে। সে চড়ে বসে তার সাইকেলে। মাথায় তখন তার চিন্তার ঝড় বইছে বাক্সটা নিয়ে। খুব দ্রুত প্যাডেল চেপে সে তার বাসায় যাবার রাস্তাটা ধরে। আজ এত ফাঁকাফাঁকা লাগছে কেন? অন্যদিন তো এ সময় রাস্তায় অনেক বেশি গাড়ি থাকে। তার গ্যারেজে যাবার কথা, সেটাও ভুলে যায়।
পাঁচ মিনিটের মাথায় চলে আসে তার ঠিকানায়। একটা পরিত্যক্ত ইয়ার্ডকে বসবাসের উপযোগী করে তার কাছে ভাড়া দিয়েছেন মিসেস ওনহাইম। ভাড়া যেমন কম, সুযোগ সুবিধে তার চাইতেও কম। এতেই দিব্যি চলে যায় তার। তিন বছর বয়েসে মা বাবাকে হারানোর পর চার্চের পাদ্রির কাছে মানুষ হওয়া একটা মানুষের কোন পিছুটানও থাকেনা, চাওয়া পাওয়াটাও খুব বেশি হয়না।
দড়াম করে সাইকেলটা ফেলে রেখে সে ঘরে ঢোকে। ব্যাকপ্যাকটা থেকে বের করে নেয় ডিএইচএল এর সেই বাক্সটাকে। কিচেন নাইফটা দিয়ে চড়াৎ করে একটানে ছিড়ে ফেলে আটকানো মুখটাকে। বুকে তার ড্রাম পেটানোর শব্দ। একটানে বক্সটার ওপরের মুখটা খুলে ফেললো সে।
একটা অতি সাধারণ কাঠের জিনিস।
চারকোণা।
কালো রঙ।
ভুরু কুঁচকে সে উল্টেপাল্টে দেখে। এই চারকোণা কাঠের জিনিসটি ঠিক কি সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। বেশ ভারি। এর ভেতরে কি কিছু আছে, ভাবছে সে। কিন্তু কোনদিকে খুলবার মত কোন দরজাও নেই, আশ্চর্য! এ জিনিস তার কাছে আসলোই বা কেন? ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে, হঠাৎ একটা জায়গাতে ছোট্ট কিছু একটা লেখা তার চোখে পড়ছে। টেবিল ল্যাম্পটার কাছে নিয়ে যায় এই অদ্ভুত বাক্সটাকে দেখবার জন্যে।
এমন সময় মিসেস ওনহাইমের কাঁচভাঙা গলা শোনা যায়।
"কতবার বলেছি আমার বাগানটাকে নষ্ট কোরোনা। বদ ছেলে, কথা শুনলে তো। সাইকেলটাকে এমন ভাবে রেখে গিয়েছে....আহারে, আমার ম্যাগনোলিয়া গাছগুলো। সেদিন লাগালাম, আহারে, মারা যাবে বেচারা"।
চেঁচামেচি শুনে সে বের হয়ে আসে।
"আমি সরি মিসেস ওনহাইম। আসলে তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে...."
"থামো ছেলে" বলে ওঠেন ওনহাইম, "সবসময় একই কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছি। তোমাকে মনে হয় এখানে থাকতে দেয়া যাবেনা আর"।
"আচ্ছা, আপনার এই পরিত্যক্ত ইয়ার্ডে কে যে থাকতে আসবে, সে আমার জানা আছে", মনে মনে বলে সে।
ওদিকে মিসেস ওনহাইমের গলা চড়ছেই তো চড়ছেই। কিন্তু একটা শব্দও আর তার কানে ঢুকছেনা। অদ্ভুত একটা কালো বাক্স তাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আর হঠাৎ করে মনটাও অদ্ভুতরকম খারাপ হচ্ছে, সে টের পায়।
হঠাৎ করে কী হলো। দুপদাপ করে সে তার সাইকেলটা নিয়ে মিসেস ওনহাইমের সামনে দিয়ে বের হয়ে যায়। সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে রাস্তায় নেমে যাবার সময় সে খেয়ালও করেনা যে পেছনে ওনহাইমের চোয়ালটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত সে সাইকেল চালাতে থাকে। চালাতে চালাতে সেই লিবিগস্ট্রিটে চলে আসে সে, সেই বাড়িটার সামনে, যেখানে ডিএইচএল এর বাক্সটা পড়ে ছিলো।
ক্রিং...ক্রিং। কর্কশ বেলটাতে চেপে ধরে সে। তার ভেতরে তখন যেন অন্য কেউ। অন্য একজন তাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে সব।
"কে?", বলতে বলতেই দরজা খুলে দেন মিসেস এলি। "তুমি আমাদের নিউজপেপার দাও, তাইনা?" জিজ্ঞেস করেন তাকে দেখে।
"না, ফ্লায়ার বিলি করি", জবাব দেয় সে (নাকি অন্য একজন)।
"আচ্ছা, বলো কি করতে পারি" হেসে বলেন মিসেস এলি।
"মিসেস এলি,আমি কি ভেতরে আসতে পারি? খুব জরুরি কিছু কথা ছিলো"।
"জরুরি? আচ্ছা। অবশ্যই, এসো ভেতরে", বলে দরজা ছেড়ে দাঁড়ান মিসেস এলি।
ভেতরে ঢোকে সে। ছিমছাম সাজানো ঘর। পাশের রুম থেকে মিসেস এলির দুই বছরের মেয়ে এলেনার গলা শোনা যাচ্ছে। খেলছে মনে হয়।
দামি একটা সোফাতে বসতে বসতে সে বলে, "আমি অনেক দূর সাইকেল চালিয়ে এসেছি। একটু পানি খাওয়াতে পারেন?" বলেই তার ভেতরেই সে টের পায় কীভাবে এতটা জলজ্যান্ত মিথ্যে সে বলে ফেললো, কিন্তু কিছুই যেন করার নেই তার। তার মোটেও পিপাসা পায়নি। আর তার বাসা তো মোটে পাঁচ-ছ মিনিটের সাইকেল পথ।
"অবশ্যই। আমি নিয়ে আসছি। একটু বোসো", সদা হাস্যময়ী মিসেস এলি এ কথা বলেই কিচেনের দিকে এগুতে থাকেন।
এরপর....
একটা কালো ঝড়। একটা আদিম পশু জেগে ওঠে কোথা থেকে।
আধঘন্টা পর চোখমুখ শক্ত করে যখন সে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন পেছনে বাসার কিচেনে মিসেস এলির নিথর দেহের আঙুলগুলো থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্তের একটা সরু ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছে।
পরের দুই মাসে লিবিগস্ট্রিটে আরো তিনজন মেয়ে খুন হয়ে গেলো, একইভাবে। সবাইকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলবার পর হাতের সব আঙুল থেকে নখগুলো তুলে নিয়েছে খুনি। ছোট্ট সেই শহর এক অজানা সিরিয়াল কিলারের ভয়ে আড়ষ্ট। সবার প্রতিদিনের কাজে ছেদ পড়লো নানান ভাবে। একটা কালো বিমর্ষ আবহাওয়া ছেয়ে ফেললো যেন সবাইকে।
একদিন।
সে পুলিশ স্টেশনে এলো।
"আমাকে বাঁচান সার্জেন্ট কুগার। আমাকে সে মেরে ফেলবে"।
ভুরু কুঁচকে সার্জেন্ট কুগার তার দিকে তাকান। এমনিতেই খুনগুলো নিয়ে সাংবাদিক গোয়েন্দাদের সাথে ঝামেলা, এ সময় এ আবার কোন উৎপাত।
"হুমম কি হয়েছে তাড়াতাড়ি বলো। পানীয় খাওয়ার বয়েস হয়েছে তো তোমার খোকা? নইলে কিন্তু সোজা হাজতে", বলে ওঠেন সার্জেন্ট।
"আমার কথা শুনুন অফিসার", হঠাৎ করে চোখ মুখ শক্ত হয়ে ওঠে তার।
এই হঠাৎ পরিবর্তন দেখে চমকে ওঠেন কুগার।
"আমিই খুনি, আমিই খুনি"।
সার্জেন্ট কুগার এবার নিশ্চিত হলেন যে এই ছোকরাটার পেটে একটু বেশি মাত্রাতেই পড়েছে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফেলেন তিনি।
"সার্জ, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা? আমার ইয়ার্ডে চলুন, সব দেখবেন", বলে ওঠে সে।
একথা শুনে ততোধিক ভুরু কুঁচকে যায় সার্জেন্ট কুগারের। দু' ভুরুর মাঝখানের অংশটা একটা টিলামতন জায়গা তৈরি করে ফেলে। ছেলেটা এতটাই বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠে বলছে, সেটাই বিশ্বাস করতে পারেননা কুগার।
এরপর...
তাকে নিয়ে পুলিশের একটি গাড়ি ইয়ার্ডে যায়। ঘর থেকে বের করে বোতলে জমিয়ে রাখা নখ, কোনটাতে তখনো নেইলপলিশ লেগে রয়েছে। কিন্তু একটাতেও রক্ত লেগে নেই। পরিষ্কার করা হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।
সার্জেন্ট কুগার তাকে নিয়ে জেলের অন্ধকুঠুরিতে রাখার নির্দেশ দেন।
তাকে ওঠানো হলো পুলিশের ভ্যানে। সার্জেন্ট কুগার তার দিকে তাকাতেই একটা ক্রুর হাসি হাসে সে। দুটো আঙুল দিয়ে কুগারের দিকে তাক করে নিজের বুকে ছোঁয়ায় সে।
"বাই বাই সার্জেন্ট কুগার", বলেই একটা অপার্থিব নৃশংস হাসি দু ঠোঁটের মাঝে নিয়ে সে চড়ে বসে পুলিশভ্যানে।
চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সার্জেন্ট কুগার খুনির ঘরে ঢোকেন। আবছা আলো একটা বিষন্নতার সৃষ্টি করেছে পুরো ঘরে। ঘরের বিভিন্ন জিনিস নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে তার চোখ পড়ে যায় একটা বাক্সের দিকে।
একটা ডিএইচএল এর বাক্স।
ওপরে 'ডেলিভার টু'তে লিখা--"সার্জেন্ট কুগার"।
-----------------------------------------------------------------------
~..::সাদাত::..~
মন্তব্য
আমি প্রথম পর্ব পড়ে ভেবেছিলাম কোনও পুরোনো প্রেমিকার পাঠানো উপহার আছে সেই বাক্সে...ওম্মা এখন দেখি নৃশংস খুনাখুনি
রক্তারক্তি ভায়োলেন্স ভালা পাইনা
তবে গল্প ভালো।
================================================
পরদেশী বঁধু, ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি।
যদি গো নিশিথ জেগে ঘুমাইয়া থাকি,
ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি।।
খুব দুঃখিত ভয় দেখানোর জন্যে।
অশেষ ধন্যবাদ পড়ার জন্যে।
-----------------------
।।সাদাত।।
এই রে, বেশ একটু তাড়াহুড়া করা হইসে এই পর্বে!
এই রে, ঠিকই তো ধরা খেয়ে গেলাম।
------------------------------
।।সাদাত।।
গল্প ভালো লাগছে।
লিবিগস্ট্রিটের ধারেকাছেও আমি নাই আর!
"Life happens while we are busy planning it"
আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবে। শনিবার হলেই তো টুকটুক করে ঠিকই লিবিগস্ট্রিটের সামসটাগ মার্কেটে চলে আসা হবে। ইস, মনেই ছিলোনা, নইলে ফোর টাওয়ারসকে নিয়ে আসা যেত, মুহাহা হা।
--------------------------------
।।সাদাত।।
সহমত। প্রথম পর্বের Pace টা যেমন ছিলো এইবার তার পুরাই উলটা।
"Life happens while we are busy planning it"
হুমম। পেছনে তো পরীক্ষা তাড়া করছে, সেজন্যেই তাড়াহুড়ো।
-------------------
।।সাদাত।।
পরীক্ষার ঝামেলা চুকিয়ে ধীরে- সুস্থেই লিখুন না হয়...
তবে খবরদার, পাঠককে ঝুলিয়ে রেখে মাঝপথে চা খেতে ছুটবেন না!
--------------------------------------------------
"আমি তো থাকবোই, শুধু মাঝে মাঝে পাতা থাকবে সাদা/
এই ইচ্ছেমৃত্যু আমি জেনেছি তিথির মতো..."
*সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
এক কথায় দারুন। লেখার স্টাইলটা সেবা প্রকাশনীর অনুবাদের মত লাগলো। একটা কথা- গল্পের শুরুটা কি এই ছেলেটার কারাগার জীবন দিয়ে শুরু করেছিলেন?
হ্যাঁ সাবু ভাই, এই ছেলেটাকে দিয়েই শুরু ছিলো গল্পটা।
খুব খুশি হলাম।
------------------------
।।সাদাত।।
দুই পর্বই পড়লাম। শেষের পর্বটা তাড়াহুড়া করে লিখসেন বুঝা গেলেও সব মিলিয়ে গল্পটা বেশ ভালো লাগলো। আরো লিখুন - ধীরে-সুস্থে।
নতুন মন্তব্য করুন