ভালবাসার ক্যান্সার - ২

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: শনি, ১৩/০২/২০১০ - ৯:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যারা ইতিমধ্যে কষ্ট করে ভালবাসার ক্যান্সার - ১ পড়েছেন তাঁদের প্রতি আমার বিনম্র কৃতজ্ঞতা । যদি না পড়ে থাকেন, তাতেও ভালবাসার ক্যান্সার - ২ পড়তে কোন সমস্যা হবে না ।

ক্যান্সারের কড়া গণ্ডা শতকিয়া

তিরিশ বছরে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা কত বেড়েছে তার কোন সঠিক হিসেব আমার জানা নেই । তবে জনসংখ্যার বিপুল বিস্ফোরণ, শিল্পায়ন, নগরায়ন, পরিবেশ দূষণ, ইত্যাকার হাজারো কারণে এই রোগের বিস্তার যে নিম্নগামী না হয়ে, ক্রমশঃই ঊর্ধ্বগামী হয়েছে তা কোন রকম হিসেব নিকেশ ছাড়াই বলে দেয়া যায় । তারপরেও, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সিটিউটের (National Institute of Cancer Research and Hospital, NICRH, Bangladesh) ২০০৫ সালের বার্ষিক (ড্রাফট) রিপোর্টমতে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ৮০০,০০০ । প্রতি বছর ২০০,০০০ নতুন ক্যান্সার রোগী যোগ হচ্ছে এই কাফেলায় । প্রতি বছর ১৫০,০০০ জন রোগী মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেয়, যার মানে হচ্ছে মৃত্যুর হার প্রতি ১০০০ জনে ১.৩ জন । এর বিপ্রতীপে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা সেবার পরিমাণ ও মান কি হারে বেড়েছে বাংলাদেশে ?

খুব বিস্তারিত তথ্য নেই আমার কাছে । মোটা দাগে ওই একই রিপোর্ট থেকে বলতে পারি, দেশে বর্তমানে সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে বছরে সর্বমোট ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ জন রোগীর চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব । সমগ্র বাংলাদেশে রেডিওথেরাপীর সুবিধা আছে ১৬ টি ও ঢাকায় মাত্র দু’টি হাসপাতালে । মোট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (অনকোলজিস্ট) আছেন সাকুল্যে ৯৮ জন । অনুমান করা হচ্ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ২০০৫ সালের ৮০০,০০০ থেকে বেড়ে ইতিমধ্যে দশ লাখ (পশ্চিমা হিসেবে, এক মিলিয়ন) ছাড়িয়ে গিয়েছে । সম্ভাব্য বিশাল এই ক্যান্সার রোগীর বিপরীতে চিকিৎসা সেবার সুবিধাটিকে মনে হচ্ছে না “ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার”?

বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার ও মহিলাদের মধ্যে জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সারের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি । আশঙ্কাজনকভাবে, শিশুদের মধ্যে রক্তের ক্যান্সারের হার অত্যন্ত উচু । প্রতি বছর পাঁচ থেকে ছয় হাজার শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয় । বাংলাদেশ ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেণ্ট অধ্যাপক তালুকদারের মতে সঠিক চিকিৎসায় জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সারের ৯০ শতাংশই সারিয়ে তোলা সম্ভব । মহিলা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. সাইফুল ইসলামের মতে প্রায় সত্তর শতাংশ রক্তের ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুকে সনাক্ত করা সম্ভব স্বল্প খরচের রক্ত পরীক্ষা বা আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে । একইসঙ্গে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন যে, ৪৪ শতাংশ ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু অকালে মারা যায় শুধুমাত্র সঠিক চিকিৎসার অভাবে ।

ক্যান্সার রোগে দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরী । এই রোগ দেহের মধ্যে এত দ্রুত ছড়ায় যে কোনভাবে কালক্ষেপন করা মৃত্যুর দিকে অসহায় হেঁটে যাওয়ারই নামান্তর । যারা কাছ থেকে এই রকম অকাল মৃত্যুকে দেখেছেন তারা সবাই জানেন এই রকম প্রতিটি শবযাত্রার সঙ্গে শেষ হয়ে যায় কত শত তখনও অস্ফুটিত স্বপ্ন । দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এই রকম অকাল যাত্রার স্মৃতি নেই এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর । উন্নত দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত গবেষণা ও দ্রুত চিকিৎসার কারণে এখনও পর্যন্ত ক্যান্সারের “কিওর” আবিষ্কৃত না হলেও, সারভাইভালের হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য গতিতে । তাই, বাংলাদেশে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে, তার পরিবারের সকলের মাথায় সবচেয়ে আগে যে চিন্তাটি আসে তা’হল রোগীকে কিভাবে বিদেশে নিয়ে যাওয়া যায় । সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, ভারত যেখানেই হোক উন্নত ও দ্রুত চিকিৎসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন আপনজনরা । সবার যে সামর্থ্য থাকে তা কিন্তু নয় । অনেক ক্ষেত্রেই দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার জন্যই বাধ্য হয়ে নিঃস্ব হয়েও মানুষকে পাড়ি জমাতে হয় বিদেশে । হাতে গোনা কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে প্রবেশাধিকার কেনা বাংলাদেশের কতজনের পক্ষে সম্ভব তা খুব সহজেই বোধগম্য । তাই সরকারী হাসপাতালে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়, সূচিকিৎসা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সহৃদয় পরামর্শ, সময়মতো ঔষধ এর সব কিছুই সোনার হরিণের মত রূপকথা হলেও আপামর জনসাধারণকে এখনও সরকারী হাসপাতালের ওপরেই ভরসা করে থাকত হয়।

ক্যান্সার রোগের চিকিৎসার একটি বড় অর্থনীতি আছে । একদিকে যেমন এই রোগের ডায়াগনোসিস এক মুহূর্তে একটি পরিবারের ওপর নিয়ে আসে অকাল সন্ধ্যা, তেমনি দীর্ঘ সময় ধরে চলা চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক হাজারো বিষয় একবারে সামনে এসে দাঁড়ায় । কঠিন ও দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় পরিবারের সঙ্গে থাকাটাও রোগীর জন্য জরুরী । কিন্তু দেশে চিকিৎসা সেবার নিদারুণ দৈন্য দশার জন্য বাধ্য হতে হয় রোগীকে সপরিবারে দীর্ঘ সময় বিদেশে চিকিৎসা নিতে । শুরুতে লিবরার বাবার কথা বলেছিলাম । এই মধ্যবিত্ত পরিবারটি দেশেই চিকিৎসা করাতে চেয়েছিল । কিন্তু এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে রোগী ও তার সঙ্গে পরিবারের আরো পাঁচ সদস্যসহ ব্যাংককে পাড়ি জমিয়েছেন । ডি এম সিতে থাকা কালীন সময়ে কেমন সেবা পেয়েছেন তা বিস্তারিত না বলে শুধু লিবরার মায়ের একটি কথা এখানে উদ্ধৃতি করতে চাই, “হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের একজন নেতা আমাদের আত্মীয় । তার খোঁজ পাওয়ার পর থেকে অনেক উপকার হয়েছে ।” আমার পরিচিত আরেকজনের নিকট আত্মীয়ের শিশু কন্যার রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হয়েছিল পুরাতন পি.জি. (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু) হাসপাতালে । স্কুল শিক্ষক মা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবার সামর্থ্য ছিল না অন্য চিন্তা করার । তাছাড়া, দেশের ঐ হাসপাতালটিতেই শুধুমাত্র শিশুদের রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা আছে । ডাক্তারদের মতে শিশুটির চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ধাপে মোট পাঁচ বছর সময় লাগবে । প্রাথমিকভাবে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি কিমোথেরাপির সময় পাঁচ বছর বয়সী ওই শিশুটিকে সার্বক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে । কারণ, ইনফেকশনসহ নানা কারণে ওর জীবন সংশয়ের ঝুঁকি আছে । দেশের একমাত্র শিশুদের রক্তের ক্যান্সার চিকিৎসার ঐ ওয়ার্ডটিতে তিরিশ জন রোগী ও তার এটেনডেণ্টদের জন্য আছে একটি মাত্র বাথরুম । সঙ্গত কারণেই রোগীর সঙ্গে একজনের বেশী এটেনডেণ্ট থাকতে দেয়া হয় না । অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়েরাই থাকেন রোগীদের সঙ্গে । অহর্নিশি সন্তানের ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কায় ম্রিয়মাণ মা অনেক সময় নামাজ পড়ার জন্য অজু করার সুযোগও পান না । যাদের ঢাকায় বাসা আছে, তারা কয়েকদিন পরে হলেও গোসল করতে পারেন, অন্যরা কি করেন তা আমার জানা নেই । আমার চেনা সেই পরিবারটিও কিন্তু এক সময় শুধুমাত্র এই অমানবিক পরিবেশের কারনে বাধ্য হয়ে আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে ভারতে গিয়েছে শিশুকন্যার চিকিৎসার জন্য । অথচ, ভারতের চিকিৎসকেরাও একমত হয়েছেন ঢাকায় শিশুটিকে দেয়া ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে । শুধুমাত্র একটু ভাল পরিবেশের জন্য স্বল্প আয়ের এই চার সদস্যের পরিবারটিকে দীর্ঘ চিকিৎসার জন্য বছরে কয়েকবার করে ভারতে যেতে হচ্ছে ।

দেশের দু’টি সবচেয়ে বড় হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার মানের করুন চিত্র তুলে ধরায় কেউ যেন ভাববেন না আমি সরকারী হাসপাতালগুলোর সীমাবদ্ধতার পেছনের যৌক্তিক কারণগুলোকে অস্বীকার করছি । বরংচ, খুব সহজ সমীকরণেই আমি জানি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতাও যথেষ্ট নয় বর্তমান ক্যান্সার রোগের এই বিশাল সমস্যার সমাধানে । ক্যান্সার নির্দয়ভাবে অকালে কেড়ে নিচ্ছে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে, যারা বেঁচে থাকলে পরিবার ও দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারতো । নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যারা ডায়াগনোসড হচ্ছেন তাদের একটি বড় অংশকে চিকিৎসার জন্য চলে যেতে হচ্ছে বিদেশে, খরচ করতে হচ্ছে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা । দেশে বাড়ির কাছে চিকিৎসার সুব্যবস্থা থাকলে যাদের অধিকাংশই যেতেন না । যারা ডায়াগনোসড হন, অথচ সামর্থ্য নেই বিদেশে যাওয়ার তাদের মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশকে যেমনই হোক চিকিৎসা সেবা দেয়া যাচ্ছে । আর যারা এই সুযোগটিও পাচ্ছেন না কিংবা আদৌ ডায়াগনোসড্ই হচ্ছেন না তাদের কথা কি বলা যেতে পারে আমার জানা নেই । এই বিংশ শতকেও শুধুমাত্র ভাগ্য ছাড়া তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই....

চলবে...

জোহরা ফেরদৌসী


মন্তব্য

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আপনার আগের লেখাটি পড়ে এই পর্বটি যেমন আশা করেছিলাম তেমন পাইনি। সেই অতৃপ্তিটুকু বাদ দিলে লেখা ভাল লেগেছে। আরো লিখুন। ভাল থাকুন।

(আপনার লেখাটি পড়ে ক্যান্সারের উপর একটা লেখা লিখতে ইচ্ছে হল হাসি )
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

সময় করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ । ক্যান্সারের ওপর আপনার লেখাটির অপেক্ষায় থাকলাম ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

অতিথি লেখক এর ছবি

ওরে বাপ্পস!!
এইটা তো প্রায় পি.এইচ.ডি থিসিস-এর "বাস্তবিক চিত্র" অংশটা!!!
বাকিটুকুর অপেক্ষায়।

- মুক্ত বয়ান।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

মনে হয়েছিল বাস্তব চিত্রটি দেখা দরকার । সে যাক পড়ার জন্য ধন্যবাদ ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

নাশতারান এর ছবি

পোস্টের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। চলুক।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ ।
.......................................
তোমারই ইচ্ছা কর হে পূর্ণ ....

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।