এমনই হয়...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২০/০২/২০১০ - ৫:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের ঘরের পাশেই 'মিষ্টি' আম গাছটা ছিল। পাশে না, পাশে না। ঘরের ভিতর। ঘরের ভিতরই তো! না হলে বারান্দাটা ঐ কোণে এসে বেঁকে গেল কেন? আমাদের বারান্দাটা গাছটাকে একদম দেখতে পারত না, আর আমাদের সবার প্রতি ভীষণ ক্ষোভ তার। গাছটার প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্বের কারণে বাড়ির ডিজাইনের মাঝে গাছটা এসে পড়লেও তা আর কাটা হয়নি, বরং ছেঁটে দেয়া হয়েছে হতভাগা বারান্দাকে। আর আমরা গাছটার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হবোই না কেন? যা মিষ্টি ছিল আমগুলো! আহা, এখনো জিবে স্বাদ পাই! সে কারণেই তো তার নাম আমরা দিয়েছিলাম - 'মিষ্টি'।

আমাদের বাড়িতে যে পাঁচটা আম গাছ ছিল প্রত্যেকেরই একটা করে নাম ছিল - মিষ্টি, সিঁদুরে, চ্যাপ্টা, টুইরা আর জর্ণা। সিঁদুরে গাছের আম একটু বড় হলেই সিঁদুরে লাল রংয়ের হত। কী সুন্দর যে রং! কী আর বলব। আমি ঐ গাছের আম না খেয়ে রেখে দিতাম। আগে বন্ধুদের দেখাতাম, পরে খেতাম। চ্যাপ্টা গাছটা ভীষণ লম্বা হলেও আমগুলো ছিল চ্যাপ্টা। আঁটিও ছিল ছোট। আর স্বাদের দিক দিয়ে মিষ্টির পরেই সে। তবে ফলন অন্যদের চেয়ে বেশি হওয়ায় চ্যাপ্টাই ছিল আমাদের আমক্ষুধা মেটানোর প্রধান অবলম্বন। টুইরা গাছটা ছিল ছোটখাট গড়নের। কাচা থাকে অবস্থায় অসম্ভব টক থাকত আমগুলো। কিন্তু পাকলে সেগুলোই কেমনে করে যেন মিষ্টি হয়ে যেত! তখন পোকার জ্বালায় আম খেতে বড়ই কষ্ট লাগত। জর্ণা গাছটার আমগুলো দেখতে সুন্দর। হলদে রং-এর উপর ছোপছোপ লাল ফোঁটার আমগুলোতে এক ধরনের গন্ধ থাকত। ঐ গন্ধকে নাকি 'জর্ণা' গন্ধ বলে। আমি আজ পর্যন্ত এই আম গাছ ছাড়া আর কোথাও 'জর্ণা' শব্দটার প্রয়োগ দেখিনি, এমনকি জানিওনা আসলেই শব্দটা প্রমিত বাংলা ভাষায় আছে কি না। জর্ণা গন্ধের কারণেই বাড়িতে অন্য কোন আম থাকলে জর্ণার দিকে আমরা হাত দিতাম না একেবারেই।

সম্ভবত ১৯৯১ সালের কথা। প্রচন্ড ঝড়ে 'মিষ্টি' আম গাছের একটা বড় অংশ ভেঙ্গে পড়ল আমাদের ঘরের চালে। যা ভয় পেয়েছিলাম সেদিন! ভেবেছিলাম ঘরটা বুঝি ভেঙ্গেই গেল। না ঘর ভাঙ্গেনি, তবে চালের টিন একেবারে বসে গিয়েছিল। মিস্ত্রি ডেকে চাল ঠিক করাতে হয়েছিল। একেতো ঝড়ে আমগাছটা ছোট হয়ে গেছে, আবার একই সাথে আমাদের ঘরের জন্য সেটা হুমকিস্বরূপ - এই দুই কারণে আমাদের পক্ষপাতিত্বও গাছটাকে কেটে ফেলা থেকে রক্ষা করতে পারল না। গাছের মৃত্যুতে বারান্দাও কষ্ট পেয়েছিল ভীষণ। 'মিষ্টি'-র অনুপস্থিতি বারান্দার অপূর্ণতাটুকুকে তুলে ধরল নগ্নভাবে।

সিঁদুরে আর টুইরা দুটোই মরেছিল বয়সের কারণে। আর চ্যাপ্টা, মিষ্টির মৃত্যুর পর যে ছিল সবচেয়ে সুস্বাদু, তার মৃত্যু ছিল সবচেয়ে করুণ। আমাদের বাড়ির সামনের খালি জমিটা দিয়ে আমরা মূল রাস্তায় উঠতাম। সেটি যখন বিক্রি হয়ে গেল, তখন নতুন মালিক সে জমির চারপাশে দেয়াল দিতে চাইলে রাস্তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল চরমভাবে। আর রাস্তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে আত্মত্যাগ করতে হল চ্যাপ্টাকেই। চ্যাপ্টার এক সন্তান এখন আমাদের বাড়িতে আছে। মায়ের গুণটুকু পনের আনাই ধরে রেখেছে; তবে আকারে লম্বা নয় মোটেও, ছোটখাট।

আর জর্ণা গাছটা, যে গাছটার আম আমরা পারতপক্ষে খেতে চাইতাম না, সেটা টিকে আছে এখনও। টিকে আছে সদম্ভে।

এমনই হয়। ছাত্ররাজনীতির যে অংশ নিয়ে আমাদের গর্ব ছিল তার মৃত্যু হয়েছে অনেকদিন আগেই। আর সদর্পে টিকে আছে লেজুরবৃত্তিকারী অংশটুকু! আর বকররা প্রাণ হারায় অকালে...

---------------
আলোর ছটা
---------------


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

চলুক
সচলে স্বাগতম!

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।
এখানে ইংরেজি Thank You, Welcome -এর সিক্যুয়েন্সটা কেমন উল্টো হয়ে গেল দেঁতো হাসি

---------------
আলোর ছটা
---------------

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আপনার বর্ণনার শক্তি তো চমৎকার।
কিন্তু যে মেসেজটা দিতে চাইছিলেন, সেটা আরো ভালোমতো আনা যেত।
যাই হোক, সচলে স্বাগতম।
আপাতত বর্ণনাশক্তির জন্যই, আর আমগাছকে ভালোবাসার মতো মন আছে বলেই পাঁচতারা।
লিখে চলুন।
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

অতিথি লেখক এর ছবি

সামান্য হলেও ভাল কিছু আছে জেনে খুশি হলাম। হাসি হ্যাঁ, আরো ভালভাবে বার্তাখানি আনা যেত, যা করতে পারিনি বলে দুঃখিত। সমালোচনার জন্য ধন্যবাদ।

---------------
আলোর ছটা
---------------

নাশতারান এর ছবি

সচলে স্বাগতম।

লেখাটা ভালো লাগলো খুব। দারুণ মায়ামাখানো। গাছগুলোর অনুভূতির প্রকাশ খুব ভালো লাগলো। তবে শেষাংশে ছাত্ররাজনীতির সাথে একে একাত্ম করার প্রয়াস একটু কেমন যেন মনে হলো।

"মিষ্টি", "সিঁদুরে", "চ্যাপ্টা", "টুইরা" - কেউই তো আত্মত্যাগ করেনি। তাদের কেউ বয়সের ভারে মারা গেছে আর কেউ নিহত হয়েছে প্রায়োরিটি লিস্টে পিছিয়ে পরার কারণে। জর্ণা বেঁচে গেছে সবার নজর এড়িয়ে। সে কাউকে স্বাদে তুষ্ট করতে পারেনি বলে ভালবাসা পায়নি। আবার কপালগুণে ঝড়ে আহত হয়নি সে, শরীর কেটে কারুর জন্য পথও করে দিতে হয়নি। সে টিকে গেছে দুধভাত হিসেবে। যাকে কেউ হিসেবে আনে না।

জর্ণাকে লেজুরবৃত্তিকারী রাজনৈতিকদের সাথে তুলনা করাটা আমার কাছে বেচারা জর্ণার উপর অন্যায় বলে মনে হয়েছে।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি আসলে শেষের বার্তাটুকু জানাতে লিখতে বসিনি, লিখছিলাম স্মৃতিচারণ থেকে। শেষের দিকে কেন যেন বার্তাখানি সামনে চলে এল, মুহুর্তের ভাবনায় মনে হল ঠিকই আছে। যদিও আমি লেখক হিসেবে নিয়মিত/পরিপক্ক নই, তাও পরবর্তীতে চেষ্টা করব মুহুর্তের ভাবনাকে স্থান না দিয়ে ভালভাবে চিন্তা করে লিখার।

সমালোচনার জন্য ধন্যবাদ।

---------------
আলোর ছটা
---------------

অতিথি লেখক এর ছবি

শেষ অংশটা পড়ে মনে হল, আপনার লেখার ম্যাসেজ ছিল ওটাই, কিন্তু ৩ নম্বরে আপনার মন্তব্যের উত্তর দেখে কনফিউজড হয়ে গেলাম!!
যাই হোক, শুরুর অংশটা বেশ চমৎকার। হাসি

- মু্ক্ত বয়ান

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পের শেষে সেই ম্যাসেজটাই দেয়ার চেষ্টা করেছি, তবে শুরু থেকেই সে চিন্তা ছিলনা।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

---------------
আলোর ছটা
---------------

অভিষেক [অতিথি] এর ছবি

হুম... জর্ণার জন্য আমারও একটা সফট কর্নার তৈরী হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

জর্ণা আম এখনও খাই আমি চোখ টিপি
কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

---------------
আলোর ছটা
---------------

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- শেষের অংশটাই যদি লেখার মূখ্য অংশ হয়ে থাকে, তাহলে বলবো বড্ড তাড়াহুড়ো করলেন!

শিল্পী তুলির আঁচড়ে আস্তে আস্তে একটা ছবিতে প্রাণ সঞ্চার করেন। যার মধ্যে সব শেষের ছোঁয়াটুকুই বদলে দেয় সব ধারণা। আপনার আঁকা ছবি ভালো হয়েছে, কিন্তু শেষের ছোঁয়াটাই দেয়া হয়নি ভালো করে!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর মন্তব্য। হাসি
সমালোচনা ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

---------------
আলোর ছটা
---------------

নীলঘূড়ি এর ছবি

. দাদা লিখে যাও. লিখতে লিখতেই একদিন লেখক হবে.. ভালো লাগলো . আমের কিন্তু মুকুল আসছে.. না খাইয়ে থেকোনা এবার হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

তোর ব্লগের কথা তো আগে জানতাম না, দেখে ভাল লাগল।

---------------
আলোর ছটা
---------------

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

সুন্দর লেখা, সচলে স্বাগতম।
==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটুকু পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

---------------
আলোর ছটা
---------------

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগছে। হাসি

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

---------------
আলোর ছটা
---------------

আনাম এর ছবি

চলুক

আশীষদা নাকি !! হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ, আমিই হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।