এতক্ষন পর্যন্ত আধো ঘুম, আধো জাগরনে প্রায় আচ্ছন্ন অবস্থাতেই শুয়েছিল জয়িতা। হঠাৎ ডোরবেলের একটানা চিঁ-হি-ই-ই আওয়াজটা যেন তার সমস্ত আচ্ছন্নতাকে খান খান করে দিল। সারা সপ্তাহ একটানা ঘড়ি ধরে সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে ওঠা; আর তারপর থেকেই তার প্রাত্যহিক বাঁধা গতের রুটিন লাইফ। ঘর-দোর পরিষ্কার, রান্নাবান্না ইত্যাদি সারতে সারতেই একমাত্র মেয়ে রুম্পির স্কুলের সময় হয়ে যায়। তারপর তাকে তৈরী করে টিফিন দিয়ে স্কুল বাসে তুলে দেওয়া, নিজের অফিসের প্রস্তুতি, অফিসের দশটা-পাঁচটা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি; অফিস থেকে ফিরেও আবার রান্নাবান্না, রুম্পিকে নিয়ে পড়াতে বসা ইত্যাদি চলতেই থাকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত। একটা ফ্রিজ-ও রাখতে পারেনি যে সকালে রান্নাটা করে রাখতে পারে। আর এই সমস্ত কিছুর ওপর আছে অসুস্থ স্বামী রোহিতের সেবা।
রোহিত। তার স্বামী। চার বছর আগেও যে ছিল আঠাশ বছর বয়সের এক তরতাজা যুবক, বিষাক্ত পক্ষাঘাতের নিশ্বাসে আজ সে পুরোপুরি শয্যাশায়ী। এখনকার এই দিনগুলোকে মাঝে মাঝে তার কেমন যেন দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়। এখনো চোখের সামনে ভাসে রোহিতের সেই ঝলমলে মুখ; আয়ত সুন্দর সেই দৃষ্টি। এই সেই মানুষ যে একদিন তার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “জানো জয়ী, আমার মনে হয়, ভালোবাসার সেখানেই শেষ, যেখানে প্রেমিক বা প্রেমিকাকে মুখ ফুটে অপর জনকে বলতে হয় ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’”। বরাবরই একটু অন্য ধরনের ছিল রোহিত। সবার সাথে থাকলেও যেমন তাকে কোনদিন আত্মকেন্দ্রিক বলে মনে হতনা, তেমনি আবার একটা অদৃশ্য দূরত্বও তাকে সবসময় আলাদা করে রাখত। ইউনিভার্সিটিতে রূপসী, বিদুষী জয়িতার স্তাবকবৃন্দের সংখ্যা কম ছিল না, কিন্তু সবার অলক্ষ্যেই অদ্ভূতভাবে এই দুটি মন পরস্পরের কাছে চলে এসেছিল; যার ফলশ্রুতি – আজ সে মিসেস রোহিত রায়।
সপ্তাহের এই একটিমাত্র ছুটির দিনে ঘড়িতে কোন এলার্ম দেয় না জয়িতা। এখন ডোরবেলের আওয়াজে চোখ খুলে দেখল তাদের ফ্ল্যাটের পুবদিকের জানালার দুটি পর্দার ফাঁক দিয়ে একচিলতে রোদ্দুরের ফলা সোজা তাদের মুখের ওপর এসে পড়েছে। রুম্পি এখনও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। তার ছোট্ট ছোট্ট পালকের মত হাতদুটি দুদিকে ছড়ানো। তারই মধ্যে একটি এসে পড়েছে তার গলার ওপর। রুম্পিকে দেখলেই মাঝে মাঝে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায় জয়িতার। তার শৈশবের সমস্ত স্মৃতি জুড়ে আছেন – তার বাবা, প্রফেসর বিপ্রদাস গাঙ্গুলী। খুব ছেলেবেলায় মাকে হারানোর পর থেকে তিনিই ছিলেন একাধারে তার বাবা, অন্যদিকে মা। মেয়েকে তিনি নিজের মত করেই মানুষ করেছেন। জয়িতাও তাই স্বভাবগত ভাবেই ধীর, স্থির, শান্ত। মনে পড়ে ছোটবেলায় রুম্পির মত এইভাবেই সে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকত। তবে দুজনের মধ্যে তফাৎ একটাই, তার যেমন মা ছিল না, রুম্পি তার মাকে পেয়েছে কিন্তু তার বাবা থেকেও নেই। নিজের অজান্তেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস তার পাঁজর ঠেলে বেরিয়ে আসে।
(২)
রুম্পির হাতটা আলতো করে সরিয়ে রেখে পরনের শাড়ীটা একটু গুছিয়ে নিয়ে একটা হাতখোঁপা বাঁধতে বাঁধতে দরজার দিকে এগোল জয়িতা। দুধওয়ালা। অন্যান্য দিন ভোরে দিলেও আজ রবিবার ওকে বলাই আছে একটু দেরী করে আসতে। দুধটা নিয়ে আনমনে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েই নজর পড়ে যায় দোতলায় নামার সিঁড়িটার মুখে টবের পাশে পড়ে থাকা গোলাপটির দিকে। কাল সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বিকাশের পায়ে লেগে খসে পড়েছিল গোলাপটা। বিকাশ! বিকাশ!... নামটা মনে আসামাত্রই কেমন একটা অদ্ভূত ধরনের অস্বস্তি অনুভব করে সে। সকালের এই চিন্তার সুতোটা যেন হঠাৎ করেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, একটা অশান্ত এলোমেলো দমকা হাওয়া মনের মধ্যে বইতে শুরু করে।
বিকাশ তার কলেজজীবনের বন্ধু। শুধু তারই নয়, রোহিতেরও খুব ভাল বন্ধু ছিল বিকাশ এবং সেই সূত্রেই তার সাথে জয়িতার পরিচয়। পড়াশুনায় দুজনেই ভাল ছিল... বরং রোহিতের রেজাল্ট ছিল বিকাশের চেয়েও উজ্জ্বল। কিন্তু দুজনের আর্থিক অবস্থার বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মত। বিকাশের যেখানে বনেদী অভিজাত পরিবার, রোহিত সেখানে ছোটবেলা থেকেই মামার বাড়ীতে মানুষ। অপরের অন্নে প্রতিপালিত হলে স্বভাবত যা যা অসুবিধা বা অপমান ভাগ্যে জোটার কথা তার থেকে বরং কিছু বেশিই অনুভব করেছে রোহিত। তাই এম. এস. সি.-র পর যখন বিকাশ বিদেশে পড়তে গেল, পরিস্থিতিই তখন রোহিত-কে চাকরী খুঁজতে বাধ্য করেছিল। রোহিতের স্বভাবের যে বিশেষ দিকটি জয়িতাকে তার প্রতি বিশেষ করে আকৃষ্ট করেছিল তা হল তার সরলতা আর বাস্তববোধ। সে কোনদিনই নিজেকে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় করে দেখাতে চায়নি জয়িতার কাছে;- জয়িতাও তাই পরম বিশ্বাসেই তার কাছে আত্মসমর্পন করেছিল, অনুমতি দিয়েছিল তাদের দুজনের জীবনকে একই সুতোয় গাঁথতে।
দুধ নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকার আগে অভ্যাসবশতই একবার পর্দাটা সরিয়ে রোহিতের ঘরে উঁকি মারে জয়িতা। নতুন কিছুই লক্ষ্যে পড়ে না; জানে পড়ার কথাও নয়। ডাক্তার তো একরকম নাই বলে দিয়েছেন। এরকম অ্যাকিউট স্টেজ থেকে আরোগ্যলাভ – খুব খুব কম সম্ভাবনা। একটাই মাত্র উপায় আছে, সুইডেনে নাকি একজন ডাক্তার এই রোগের উপরই রিসার্চ করছেন; উনি এরকম কয়েকজন রোগীকে আশার আলো দেখিয়েছেন। ওনাকে দিয়ে অপারেশন করালে হয়তো রোহিত সুস্থ হলেও হতে পারে। কিন্তু সুদূর সুইডেনে গিয়ে চিকিৎসা করানো তো দূর অস্ত, একবার দেখানোর কথাই কল্পনা করতে পারে না জয়িতা। বিকাশের জোগাড় করে দেওয়া এই চাকরীটা না থাকলে হয়তো এতদিন আত্মীয়-স্বজনদের কাছে গিয়ে হাত পাতা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকত না জয়িতার।
(৩)
বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজের জন্য এককাপ লিকার চা করে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল জয়িতা। রুম্পি এখনও ঘুমোচ্ছে। চা টা খেয়ে ওকেও তুলে দেবে, রোহিতকেও তুলে পরিষ্কার করাতে হবে এবার। ঘড়ির দিকে দেখল একবার – সাতটা কুড়ি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের বড় ইউক্যালিপ্টাস গাছটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই তার মনে পড়ল তাদের পুরনো বাড়ীর কথা। তাদেরও বাড়ীর সামনেই উঠোনে এরকম একটি বকুলগাছ ছিল। গাছটি নাকি তার মার বসানো। বাবা প্রতিদিন গাছটিতে দুবেলা জল দিতেন। গাছটিতে বেশ কয়েকরকম লতাপাতা জড়িয়ে ধরে উঠেছিল। জয়িতা একবার সেগুলি ছিঁড়তে গেলে উনি বারন করেছিলেন; বলেছিলেন, “গাছটা ঠিক তোর মায়ের মত। তোর মাও সবাইকে নিয়ে থাকতে খুব ভালোবাসত। আমিই জোর করে ওকে বের করে এনেছিলাম, সেই অভিমানেই হয়তো ও চলে গেল”।
জয়িতা তারপর ঐ গাছটির ডাল থেকে আর একটি চারা বসিয়েছিল এবং গাছটি বড় হতে স্বাভাবিক নিয়মেই ফুল ফুটেছিল। কিন্তু এই ব্যাপারটিই জয়িতার মনে তখন অদ্ভুত একটা চিন্তার জন্ম দেয়। তার খুব আশ্চর্য লাগে, কিছুদিন আগেও যে গাছটা ছিল শিশু – আজ সেই পরিপূর্ণ হয়ে দায়িত্ব পালনে রত। এই দায়িত্ব পালনে তার না আছে কোন ক্লান্তি, না কোন অভিযোগ। এই মৌনমুখর স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ যদি সব মানুষের থাকত! গাছটির বিকাশ...
‘বিকাশ’! নামটি মনে আসামাত্রই আবার ফিরে এল সেই চিন্তার অস্থিরতা। রোহিতের যখন প্রথম রোগাক্রমণ, তখন জয়িতার তো তথৈবচ অবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে নার্সিংহোম, ডাক্তার, দুবেলা বিভিন্নরকম পরীক্ষা, ছোটাছুটিতে প্রায় জেরবার; তবুও কোনরকম গাফিলতি করেনি সে। বেশ কয়েক মাস ধরে জলের মত খরচ হয়ে প্রায় সমস্ত সঞ্চিত অর্থ নিঃশেষ হয়ে যখন সে প্রায় উদ্ভ্রান্ত তখনই ডাক্তারদের সেই নেতিবাচক স্বীকারোক্তি। বেসরকারী অফিসের রোহিতের চাকরীটা তো গেলই, ঘরের বেশ কয়েকটি আসবাবও চলে গেল ঋণ পরিশোধে। বিয়ের পরের কয়েকটা বছর যেন স্বপ্ন; ফানুসের মতই তার পরিসমাপ্তি। এই প্রচন্ড অসহায় অবস্থায় দুবছরের রুম্পিকে নিয়ে যখন সে দিশাহারা তখনই নিজে থেকে বিকাশ এসেছিল ওদের ঠিকানা খুঁজে।
তারপরের অধ্যায়টা তো আবার এক ইতিহাস। বিকাশ নিজে থেকেই সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল; কিন্তু বন্ধুত্বের মোড়কে হলেও কোনরকম আর্থিক সাহায্য নিতে সে রাজী হয়নি। বিকাশ অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়িতার জেদের কাছে তাকে হার স্বীকার করতে হয়েছিল। সেই তারপর তাদের অফিসে জয়িতার এই চাকরীটি করে দেয়।
এরপর থেকে প্রতিদিনই অফিস যাবার পথে জয়িতাকে লিফট দিতে থাকে বিকাশ। প্রথম প্রথম জয়িতা আপত্তি করলেও পরে বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে আর না বলতে পারেনি। তারপর কেমন করে যেন নিজের অজান্তেই তারা ধীরে ধীরে পরস্পরের অনেকটা কাছাকাছি এসে গিয়েছিল। বিকাশও প্রায়ই আসত তাদের ফ্ল্যাটে – রুম্পিকে আদর করত, রোহিতের সাথে বসে অনেক মজার মজার কথা বলত; - সব মিলিয়ে মানুষটাকে মন্দ লাগত না জয়িতার। রোহিত তো কথা বলতে পারত না, তবে সবই বুঝতে পারত। অনুভূতি বোধহয় তাকে আরো স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
খুবই স্বাভাবিকভাবে এরপর জয়িতাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় বিকাশ। রুম্পি এবং রোহিতের ভারও সে নিতে চায়। কিন্তু কি একটা অজ্ঞাত কারনে এরপর থেকেই জয়িতা যেন ভেতর থেকে কোনও উৎসাহ পায়না। বিকাশের প্রতি তার ভালোলাগা সত্ত্বেও এই ক’বছরের অভিজ্ঞতা তাকে জীবন সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবতে শেখাচ্ছিল। বিকাশ জানত না সে এরমধ্যে বেশ কয়েক জায়গায় দরখাস্ত করেছে এবং এরমধ্যে একটি ইন্টারভিউ সম্পর্কে সে যথেষ্ট আশাবাদী।
তবে তার মনের সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে যায় পরশুদিনের একটি ঘটনায়। পরশুদিন অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত পায়ে নিজের ঘরে ঢোকার সময় হঠাৎই তার নজর পড়ে রোহিতের ঘরের দিকে। দেখে ঐ ঘরে আলো জ্বলছে এবং রুম্পির গলা ভেসে আসছে। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল কিন্তু রুম্পির গলাটা ধরা ধরা দেখে তার কেমন যেন লাগে, আস্তে আস্তে সে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে। দেখল রোহিত ফ্যালফ্যাল করে অপলক চোখে রুম্পির দিকে তাকিয়ে আছে, দুচোখ দিয়ে অঝোরে নেমে আসছে জলের ধারা। রুম্পি কান্নাভেজা গলায় কেবল বলে চলেছে, “বাপি, তুমি কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমারও যে কান্না পায়”। ... এরপর আর কিছু দেখতে পারেনি জয়িতা, ছুটে এসে নিজের ঘরে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রোহিতের দৃষ্টির সেই অসহায়তা, বিবর্ণতা যেন তীরের ফলার মত বিঁধছিল তাকে।
কালকেই বিকাশকে সে জানিয়ে দিয়েছে তার সিদ্ধান্তের কথা। এখন অনেক বেশি তরতাজা মনে হচ্ছে তার নিজেকে। নতুন উদ্যমের একটা উৎসদ্বার যেন এতদিন রুদ্ধ ছিল। হঠাৎ আঁচলে একটা টান পড়তে পিছন ফিরে দেখে রুম্পি কখন ঘুম ভেঙ্গে উঠে এসে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। নীচু হয়ে রুম্পিকে জড়িয়ে তার বাসী মুখে একটা চুমু খায় জয়িতা। তারপর তাকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে নিচে নামে। আসার পথে আর একবার পর্দার ফাঁক দিয়ে রোহিতকে দেখে নেয় সে – একইভাবে মাথাটা একপাশে কাত করে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখে সিঁড়ির মুখে টবের গোলাপগাছটায় আজ অনেক নতুন ফুল ফুটেছে।
-প্রসূন ঘোষাল (prasung@gmail.com)
মন্তব্য
সুন্দর গল্প। ভালো লাগলো। আরো লিখুন ।
অনেক ধন্যবাদ। আমি সচলায়তনের নতুন অতিথি। আপনাদের অনুপ্রেরণা পেয়ে ভালো লাগলো।
বেশ ভালোই লাগল দাদা। চালিয়ে যান।
অজস্র ধন্যবাদ, দাদা।
ভালো লাগলো। অন্যরকম কাহিনী।
অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন