আমি বাঙ্গালি, এই একুশের সকালে আমার মাথা নত! --- লীসা গাজী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ২২/০২/২০১০ - ১১:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

থাকি প্রবাসে, দেশের বিশেষ দিনগুলি নিয়ে উৎসাহ তাই একটু বেশিই। বিলাতের হীম হাওয়ায় বসে দেশের পয়লা ফাল্গুন নিয়ে বসন্তের গান গাই, হলুদ শাড়ি পড়ি। ২১ ফেব্রুয়ারি-তে মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জিবিত হই, চার শহীদের নামে ঢোকে ঢোকে পানি খাই, সুর করে গাই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’ আরে ভোলা কী সম্ভব, ‘একুশের চেতনা’ বলে কথা!

কিন্তু যখন বাঙ্গালি নিজেই অন্যায় রক্ত ঝরায় সেটা কোন চেতনার ফসল? আমরা নিজেদের উপর অত্যাচারের হিসাব খুব কষতে পারি। সেই বিষয়ে আমাদের জ্ঞান বড়ই টনটনা। অথচ এই টনটনা জ্ঞান নিয়েই আমরা কিন্তু গত তিরিশ বছর ধরে পাহাড়ি নিধনে মেতেছি। বাঙ্গালি আমরা যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের আদরে-আপ্যায়নে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি তারা দিনের পর দিন আর্মির মদদ এবং শক্তিপুষ্ট হয়ে পাহাড়িদের বসতভিটা ছাড়া করছি, জমির পর জমি দখল করছি, পাহাড়ি মেয়েদের খোলামকুচির মতো ব্যবহার করছি --- আমরা এতোই মহান এবং আমাদের চেতনা এতোই পোক্ত যে বৌদ্ধ মন্দির গুঁড়িয়ে দিলেও, ২০০ বাড়ি পুড়িয়ে দিলেও, ২০ জন পাহাড়ি নিখোঁজ হলেও, ৫ জনের লাশে ফেব্রুয়ারির সকাল রঞ্জিত হলেও আমাদের চেতনায় কোনো চোট পড়ে না! বরং আমরা আমোদ করে বলতে পারি ‘কী চমৎকার দেখা গেলো! বায়ান্ন’র পর দু’হাজার দশের একুশও রক্তে রাঙ্গানো হলো’! কারণ এই রক্তের চেহারা আলাদা, রাজনীতি আলাদা! এই রক্ত আমার ভাইয়ের না। এই রক্ত তুচ্ছ পাহাড়িদের। এই রক্তপাতে আমরা মোটেই বিচলিত হই না কারণ এর সাথে দেশের শান্তির প্রশ্ন জড়িত, সংহতির প্রশ্ন জড়িত! আমাদের অকুতোভয় সেনাবাহিনীর উপর দেশ রক্ষার দায় পড়েছে যে! এ দায় কী যে সে দায়! তার জন্য শ’ দু’শ পাহাড়ি বাড়ি যদি ভস্মিভূত হয় হোক; দু/পাঁচটা পাহাড়ির রক্ত যদি ঝরে তো ঝরুক, এতে এতোটা উতলা হবার কী আছে!

আজই একজন ব্রিটিশ বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতার সাথে কথা হচ্ছিলো, তিনি পাহাড়িদের পক্ষে যথেষ্ট সহানুভূতি (!) দেখিয়ে বললেন, ‘পাহাড়িদের সাথে পরিকল্পিতভাবে যে অন্যায়, অত্যাচার করা হচ্ছে তার প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু এমনভাবে করতে হবে যাতে দেশের ভাবমূর্তি কোনোভাবেই নষ্ট না হয়।‘ ভাববার কথা বটে! আর যাই করি বিদেশের মাটিতে বসে স্বদেশের বদনাম তো আর করতে পারি না – তাহলে ভাবমূর্তির কী হবে! আমি বলি কী হবে, লবডঙ্কা হবে! যত বেশি আমরা ভাবমূর্তির পূজা করতে গিয়ে সত্য চাপা দেবো তত বেশি এর গলিত পচা গন্ধ আমাদের নিজেদের গায়ে লেপ্টে থাকবে।

পাহাড়িদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে আর আজকে ২০১০, এর মধ্যে ১৩ বছরের ফারাক। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো ফারাক নাই। এখনও প্রায় ৫৪০-টার মতো সেনা ঘাঁটি পার্বত্য চট্টগ্রাম গেঁড়ে বসে আছে। এখনও যত্র তত্র পাহাড়ি মানুষ গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে, আর্মির বুলেটে ঝাঁজরা হচ্ছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ(?)। ২০ ফেব্রুয়ারি আরও পাঁচজন পাহাড়ি মানুষ নিহত হলেন আর্মির গুলিতে। আমরা এই হত্যার বিচার দাবি করছি। আমরা দাবি করছি খুনি আর্মি অফিসার/জোয়ানদের চিহ্ণিত করা হোক এবং তাদের আইনানুগ শাস্তি দেয়া হোক! আসলে সেনাবাহিনীর এই চুক্তি যতদিন বাস্তবায়িত না হবে ততদিন পাহাড়ি মানুষের সম্পদে, সম্ভ্রমে, রক্তে বাঙ্গালি মায়ের সিপাই পুত্ররা উৎসব করবেই!

বাবা সুর করে শেখাতেন, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। কিন্তু এই একুশের সকালে আমার মাথা নত!

http://www.sachalayatan.com/user/658


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এখনও প্রায় ৫৪০-টার মতো সেনা ঘাঁটি পার্বত্য চট্টগ্রাম গেঁড়ে বসে আছে। এখনও যত্র তত্র পাহাড়ি মানুষ গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে, আর্মির বুলেটে ঝাঁজরা হচ্ছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ(?)। ২০ ফেব্রুয়ারি আরও পাঁচজন পাহাড়ি মানুষ নিহত হলেন আর্মির গুলিতে। আমরা এই হত্যার বিচার দাবি করছি। আমরা দাবি করছি খুনি আর্মি অফিসার/জোয়ানদের চিহ্ণিত করা হোক এবং তাদের আইনানুগ শাস্তি দেয়া হোক! আসলে সেনাবাহিনীর এই চুক্তি যতদিন বাস্তবায়িত না হবে ততদিন পাহাড়ি মানুষের সম্পদে, সম্ভ্রমে, রক্তে বাঙ্গালি মায়ের সিপাই পুত্ররা উৎসব করবেই!

সহানুভুতি আছে। এর তদন্ত হবে এমনটা আশা করতে পারি আমরা। অপরাধী যেই হোক তাদের বিচার হতেই হবে।

কিন্তু আপনি যেভাবে বলেছেন তার সবগুলো কি ফ্যাক্ট না আবেগ? বিশেষ করে যত্রতত্র পাহাড়ি মানুষের গুম হওয়া আর খুন হওয়া? এর সাথে আর্মি জড়িত সেটা আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কিভাবে? সেনাবাহিনী সরিয়ে নিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে হয়? আমার তো তা মনে হয়না। বরং যাদের ওখানে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করতে দেয়া হয়েছে তাদেরকে আগে সরিয়ে নিতে হবে। আর এসব করতে হবে রাজনৈতিক সরকারকে।

ঐদিন যা হয়েছে তার জন্য অ-পাহাড়ি হিসেবে আমি লজ্জিত। এটি খুবই লজ্জার ঘটনা। আপনাদের জন্য আমার প্রাণের অন্তস্থল থেকে সমবেদনা রইল। আমিও চাই এর তদন্ত হোক ও অপরাধীদের বিচার হোক।

অতিথি লেখক এর ছবি

একজন বাঙালি হিসেবে আমি লজ্জিত।

---------------
আলোর ছটা
---------------

নাশতারান এর ছবি

বাঙ্গালী বোধহয় নিজের মাথা নত করে দুনিয়া কাঁপাতে বদ্ধপরিকর এখন।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। কিন্তু এই একুশের সকালে আমার মাথা নত!
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
তুলিরেখা এর ছবি

মাঝে মাঝে অসহায় লাগে!
এত রক্তধারা কেন?
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

রক্তপাত থামে, আবারো রক্তপাত হয়... পাহাড়িদের প্রতি এ বর্বরতায় আবারো মাথা নত, আর রইলো তীব্র নিন্দা...
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

অতিথি লেখক এর ছবি

সমস্যাটা হচ্ছে আমরা গোড়া থেকেই পাহাড়িদের নিজেদের মতন সাধারণ নাগরিক ভাবছি না --- আমি আপনি যা পাহাড়িরাও ঠিক তাই, বাংলাদেশের নাগরিক। আমার দরজার গোড়ায় যদি কোন সেনাবাহিন‌ী বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার এখতিয়ার না রাখে, আপনার সম্পত্তি যদি আমি বেদখল করার জোর না রাখি --- তাহলে আমাদেরই মতোন একই দেশের নাগরিক হয়েও এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কেন দশকের পর দশক মৃত্যু হাতে নিয়ে বেঁচে থাকবে?
আমরা বাঙ্গালি যারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক তাদের উপর দায়িত্ব বর্তায় সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পদ, সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমরা যদি একাট্টা হয়ে এই অন্যায়ের বিপক্ষে আওয়াজ তুলি তাহলে কার সাধ্য আছে এই হানাহানি চালিয়ে যাওয়ার।
জনগনের শক্তি অপার! এখনই সময় এসেছে বলার, 'আর না!'
-- লীসা গাজী

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

"কিন্তু এই একুশের সকালে আমার মাথা নত!" -- সহমত।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

একুশ মানে মাথা নত না করা’। কিন্তু এই একুশের সকালে আমার মাথা নত!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।