১.
মেজাজটাই চড়ে গেল পল্লবের। কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপকের মুখে এমন কথা শুনলে মেজাজের আর দোষ কি? বলে কি না- "দুয়েকটা কঠিক অংক মুখস্থ করলে কিচ্ছু হয় না"। পল্লবকে দেখে কিন্তু বুঝা যাচ্ছে না যে সে এত ক্ষেপে আছে। সে নড়েচড়ে ঘাড় সোজা করে সোফায় হালকা হেলান দিয়ে বসে। হাত দুটো একসাথে মুঠো করে শক্ত করে ধরে রাখে। পল্লবের ভিতরে যত রাগ তার সবটুকু উত্তাপ বয়ে যায় দুই হাতের ঐ শক্ত মুঠোর উপর দিয়ে। মুহুর্তের জন্য চুপ থেকে, গলার স্বর স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নামিয়ে, অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ ভাষায় ধীর লয়ে বলতে থাকে - "মুখস্থ করলে তোমার ছেলে নম্বর ঠিকই পাবে, কিন্তু অংক শিখবে না কোনদিন।"
বুয়েটে পড়া পল্লবের এমন গুরুগম্ভীর কথা ফেলে দিতে পারে না তার মেসো (খালু) সহকারী অধ্যাপক অনীল দত্ত। চুপ থেকে পল্লবকে তার কথা শেষ করতে দেয়- "অংক মুখস্থ করে তোমার ছেলে ক্লাস সেভেন-এইট পর্যন্ত হয়তো হাইয়েস্ট নম্বরও পাবে, তবে এরপর আর না। আমি এ কথা খাতা-কলমে লিখে দিতে পারি।"
আস্তে আস্তে গলা উঁচুতে উঠতে থাকে পল্লবের, ভাষার শুদ্ধতাও কমতে থাকে। তর্জনী উঁচিয়ে ক্লাশ ফোরে পড়া পলককে উদ্দেশ্য করে বলে- "শোন্, তোর বাপে যতই অংক মুখস্থ করতে কউক, তুই জীবনে অংক মুখস্থ করবি না। নাম্বার কম পাইলে পা, তাও মুখস্থ করবি না। নাম্বার দিয়ে গাডা খাবি নাকি?"
পলুদাকে দারুণ পছন্দ পলকের। মায়ের কাছে পলুদার গল্প শুনতে শুনতে তাকেই পড়ালেখার আদর্শ ধরে নিয়েছে মনে মনে। তাই রাগী আর বদমেজাজী বাবার কথাকেও এখন সে পাত্তা দেয় না। পলুদার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলে-"আইচ্ছা"।
ঘটনা হয়েছে- ২য় সাময়িক পরীক্ষায় পলক অংকে ৮০ এর মধ্যে পেয়েছে মাত্র ৫২। ক্লাস টেস্টের বাকি ২০ এর মধ্যে পেয়েছিল ১৫। ক্লাসে তাই তার অবস্থান এখন ৩ থেকে ৮ এ চলে গেছে। অনীল দত্তের বিশেষ উৎকন্ঠা সে কারণেই। ছুটিতে বেড়াতে এলে তাই পল্লবকে ডেকে মাসি বীণা দত্ত চুপি চুপি বলেন- "ভাইডারে ইট্টু বুঝাইয়া দে না, বাবা। কেমনে পড়তে অইব দেহাইয়া দিয়া যা। ইট্টুও পড়ে না রে...। তুই কইয়া দিয়া যা, তর কথা শুনব।"
পল্লব চুপ করে শোনে। সে জানে পলক তাকে ভীষণ পছন্দ করে। সে নিজেও একটু বেশিই আদর করে এই ভাইটাকে, একটু বেশিই প্রশ্রয় দেয়।
২.
বিকেলে পলককে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে পল্লব। মূল উদ্দেশ্য পলককে কিছুটা জ্ঞান দেয়া। কিন্তু খালি খালি উপদেশ সে শুনবে কেন? তাই পল্লব ঠিক করেছে আগে তাকে খাওয়াবে, তার সাথে গল্প করবে, তারপর কোন এক কথার সূত্র ধরে পড়ালেখার কথা নিয়ে আসবে। বাজারের কাছাকাছি আসতেই পল্লব বলে- "আজকা তোরে খাওয়ামু। কী খাবি ক।"
পলক বলার মত বিশেষ কথা খুঁজে পায়- "জান পলুদা... আঙ্গ লগের বাইত বিশুদা আছে না... হেয় না বাজারঅ দোহান দিছে।" [জান পলুদা, আমাদের বাড়ির পাশে যে বিশুদা আছে সে বাজারে দোকান দিয়েছে।] "পুরি-সিংগারার দোহান, যদি খাইতা... ক-ঠি-ন টেস্ট"।
পল্লব মুচকি মচকি হাসে- পিচ্চিটা এরই মধ্যে তার কাছ থেকে 'কঠিন' শব্দটা শিখে নিয়েছে। বলে- "চল্ তাইলে বিশুর দোহানেই"।
দুই ভাই মিলে বিশুর দোকানে যায়। পল্লবকে দেখে বিশু বিশেষ খাতির করে খাওয়ায়। সত্যিই বেশ মজাদার খাবার, বিশেষ করে আলুর চপটা- ভিতরে খানিকটা মুরগির মাংস দেয়া। মাংসের ঝোল দিয়ে খেতে আসলেই ক-ঠি-ন টেস্ট!
খেয়ে দেয়ে রেললাইনের দিকে হাঁটতে থাকে দুজনে। নীরবতা ভাঙ্গে পলকের আগ্রহে - "আইচ্ছা পলুদা, তুমি বলে ছুডবেলায় বান্দর আছিলা?"
পল্লব বুঝতে পারে- বীণা মাসি তার গল্প বেশ ভালভাবেই করেছে। হাসতে হাসতে বলে- "হ, আছিলাম তো, তোরে কইল কেডা?"
উত্তর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না পলক। আবার জিজ্ঞেস করে- "তুমি বলে বান্দরামি কইরাও ঠিকমত পড়াশুনা করতা?"
"আমি পড়াশুনা করতাম কম, তয় যতটুকু পড়তাম মন দিয়া পড়তাম, বুইঝা পড়তাম, আর নিয়মিত পড়তাম।" আসল উদ্দেশ্য কিছুটা সফল করতে পেরে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পল্লব।
পলকের কৌতুহল বাড়ে - "এত কম পইড়াও অংকে এত ভালা করতা কেমনে?"
এবার পল্লব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে থাকে- "অংক হইল একটা সোজা জিনিস। এইটা মুখস্থ করতে যাবি- মনে হইব বি-শা-ল কঠিন জিনিস। কিন্তু বুইঝা করবি- দেখবি কত্ত সোজা।" পল্লব খেয়াল করে পলক ঠিক বিশ্বাস করছে না কথাগুলো, কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তাকে তার আশেপাশের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে।
-ধর, তুই এক ধরনের অংক শিখলি আজকা। এহন তুই আশেপাশে খুঁজবি- এই অংকটা কামে লাগে কই? তুই যোগ অংক পারস না?
- হ, পারি।
- আইচ্ছা ক তো বিশুর দোহান দিতে কত টেয়া (টাকা) লাগছে?
- আমি কেমনে কমু? জিগাইছি নি কোনদিন?
- ল (চল), আমরা আন্দাজ করি। ধর- টেবিল গুলার দাম ১০ হাজার টেয়া, চেয়ার গুলা ৫ হাজার। দুইডা মিল্লা কত অইল?
- ১৫ হাজার।
- আর মনে কর চুলাডার দাম ৩ হাজার। পেলেট-টেলেট আরো ৩ হাজার। কড়াইডা দেড় হাজার।
ইচ্ছে করেই পল্লব হিসাবের মধ্যে 'দেড়' ঢুকিয়ে দেয়। পলক হিসাব কষতে থাকে - "পনের আর তিন মিল্লা আঠার। আঠার আর তিনে একুশ। একুশ আর দেড়... বাইশ... সাড়ে বাইশ।"
হিসাবের স্বচ্ছতা দেখে পল্লব খুশি হয়। বুঝতে পারে- এই পিচ্চির বেসিক ভালই। এবার গুণ অংক ধরিয়ে দেয়-
- সাথে ধর ঘর ভাড়া প্রত্যেক মাসে ২ হাজার কইরা ৬ মাসের অগ্রিম। ৬ মাসের ভাড়া কত হয় রে?
ফিসফিস করে গুণের নামতে পড়তে থাকে পলক- "দুই একে দুই, দুই দুগুনে চাইর, তিন দুগুনে ছয়, চাইর দুগুনে আট, পাচ দুগুনে দশ, ছয় দুগুনে বার... বার হাজার!"
- মোট কত হইল?
এবার একটু ঝামেলায় পড়ে বেচারা, আমতা আমতা করতে থাকে। সহজ করে দেয় পল্লব- "আগে সাড়ে ২২ আছিল না? অইডার অর্ধেক হাতে রাইখা দে। বাকি ২২ এর লগে এই ১২ যোগ কর। কত হয়?"
আঙ্গুলে গুণতে থাকে ক্ষুদে গণিতবিদ।
- বাইশ আর বার। তেইশ, চব্বিশ, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪... চৌত্রিশ।
- এইবার হাতের অর্ধেক যোগ কর।
- সাড়ে চৌত্রিশ।
- তাইলে নতুন দোহান দিতে বিশুর কয় টেয়া লাগছে?
- সাড়ে চৌত্রিশ হাজার!
- এইতো হইছে! সাব্বাস! যাহ্! তোরে একটা মিমি চকলেট দিমুনে।
পল্লব জ্ঞান দিয়ে যেতে থাকে- "ইমুন কইরা তোর আশেপাশের জিনিস দেইখা তুই নিজে নিজেই অংক বানাবি, নিজেই করবি। তাইলেই দেখবি অংক তোর কাছে সহজ হইয়া যাইব।"
পল্লবের কথায় বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে পলকের।
[চলবে...]
---------------
আলোর ছটা
---------------
মন্তব্য
বরাবরের মতো আমি গণিতে অনেক কাচা...
ব্যাপার না, আমি যতটুকু শিখাব সেটুকু আপনি নিশচয়ই পারেন
---------------
আলোর ছটা
---------------
- না, এখন গণিত শিখুম না। আগে ব্লগাইয়া লই। আগে হাদুমপাদুম তারপর গণিত শেখা!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নিশ্চয়ই নিশ্চয়। ব্লগানো আর হাদুমপাদুম দুটোই যেন ভাল হয়
---------------
আলোর ছটা
---------------
খালু নাকি?
---------------
আলোর ছটা
---------------
আমি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে অনেক অঙ্ক শিখেছি। তাই এখন ১, ২, ৪, ৬ যোগ করি ফটাফট। আবার রান রেট হিসাব করে করে গড় করাও শিখেছি...শুধু ৯ এর সাথে কোন কিছু যোগ করা এখনো শিখলাম না। আমার গণিত শিক্ষার সুবিধার্থে ছক্কা বদলে নক্কা করে দেওয়া হোক।
মুদি দোকান থেকে সদাই করতে গিয়ে অবাক হই- এত তাড়াতাড়ি হিসাব করে কিভাবে??
ট্রাই করে দেখবেন নাকি?
---------------
আলোর ছটা
---------------
আমার কমেন্টের উত্তর কই?
অই বেটা, উত্তর দিছি তো!
---------------
আলোরছটা
---------------
পলক কে ভাল মত অংক শেখানো হোক.......সামান্য যোগ গুণ করতেই যে ভাবে কষ্ট করতে হল বেচারাকে.....৮ম হল কিভাবে ? ৪র্থ শ্রেণীর বইয়ে দেখলাম অংক এরচেয়ে অনেক কঠিন!!
হা হা... মফস্বলের ইস্কুল তো ভাই! বাকিগুলোতে ফাটাইয়া নম্বর পাইছিল
আর হ্যাঁ, ক্লাশ ফোরে সম্ভবতঃ লসাগু-গসাগু-ভাজ্য-ভাজকের মতো কঠিন-কঠিন অংক আছে। কিন্তু অংক শেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়, এটা স্রেফ একটা গল্প। তাই যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগেই সীমাবদ্ধ থাকবে গণিত শিক্ষার ক্লাস।
---------------
আলোর ছটা
---------------
চলুক ।
আমিও এইভাবে বাস্তব জীবন এর সাথে মিলিয়েই হিসেব নিকেশ করা শিখছি।
সব কিছুর ফিজিক্যাল ইন্টারপ্রিটেশন দেখার একটা চিন্তা থাকত, এই কারণে কম পড়েও মোটামুটি ভাবে জিনিস গুলা মাথায় রাখতে পারতাম।
আমার ভাগ্নে ভাগ্নির মাথায় এই ভাবে জিনিস গুলা ঢুকানোর প্ল্যান করছি ।
দেখা যাক কি হয়!
__________________________
হৃদয় আমার সুকান্তময়
আচরণে নাজরুলিক !
নাম বলি বোহেমিয়ান
অদ্ভুতুড়ে ভাবগতিক !
_________________________________________
ওরে! কত কথা বলে রে!
আপনার প্ল্যান সফল হোক। আমি কিন্তু এরই মধ্যে আমার ভাগ্নিকে দিয়ে শুরু করে দিয়েছি, এখন কাউন্টিং চলছে।
---------------
আলোর ছটা
---------------
লেখাটা বেশি বাচ্চাদের জন্য হয়ে গেল না? বিশেষত উদাহরণ গুলো? যারা ব্লগ পড়েন তাদের কথা ভেবে আরেকটু "বড়তোষ" ভাবে পরের পর্বগুলো লিখলে ভাল লাগবে। এমনিতে আপনার লেখা ভাল লেগেছে।
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধন্যবাদ এত সুন্দর লেখার জন্য। এই ধরনের কিছু লেখার জন্য চালু হয়ে গেছে গণিত পাঠশালা.কম। একবার কি কষ্ট করে সাইট টায় ঘুরে আসবেন। মনে হয় ভালোই লাগবে
নতুন মন্তব্য করুন