সে দিন বরাবরের মতো বিকালে টিউশনিতে গেছি। রাত প্রায় ৯টা বেজে গেছে। হঠাৎ করে আমার ছাত্রের আব্বা এসে বলল, "স্যার, তাড়াতাড়ি হল এ চলে যান। ঢাকা ভার্সিটিতে নাকি গোলমাল চলছে।" বললাম কেন এবং কিভাবে? উনি আমাকে তেমন কিছু বলতে পারল না। আমিও মনে করলাম আরে এটা আর কি? তখন দেশের যা অবস্থা তাতে কিছু গোলমাল হতেই পারে। পরে হলে এসে শুনলাম, যে সেনাবাহিনীর লোকজন এর সাথে ছাত্রদের কি যেন খেলার মাঠে সমস্যা হয়েছে।
পরের দিন সেই স্বাভাবিক ক্লাসে গেলাম। তখন আমরা শেষ টার্মের ছাত্র। এদিকে আমাদের র্যাগের খেলা চলছে। দুপুরে হলে এসে শুনলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালকের রাতের ঘটনার জন্য নাকি ছাত্র বিক্ষোভ চলছে। সাথে নাকি শিক্ষকদের ও সমর্থন আছে। রাতে শুনলাম সেনাবাহিনীর লোকজন নাকি ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাবে। এদিকে সেনাবাহিনীর সেই লোকজনের শাস্তির দাবিতে, ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। সেইসাথে পুরো দেশে বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা প্রতিবাদ শুরু করেছে।
পরের দিনও ক্লাসে গেলাম। সারা দেশে যে এমন অবস্থা, বুয়েটে তেমন কিছু টের পেলাম না। কিন্তু দুপুরের দিকে কি এক কাজে নীলক্ষেত গিয়ে আসলে টের পেলাম। পুলিশ এবং ছাত্র মুখোমুখি। মাঝে খবর শুনলাম, আজিজ সুপারের সামনে নাকি সেনাবাহিনীর গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। দেশের এমন কোন ভার্সিটি নেই, যেখানে বিক্ষোভ হচ্ছে না। সেই রাতে বুয়েটেও বিক্ষোভ হলো। টিভির রুম এতো ছেলে নাকি খবর শুনার জন্য। বুয়েটের হল এটা সচরাচর দেখা যায় না। পরের দিন যে এমন একটা দিন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, কেউ কি আসলেই টের পাচ্ছিল।
এদিকে র্যাগের খেলা নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দলের জন্য মরণপন খেলা। আজকে জিতেই হবে। বিকেল তিনটা কি সাড়ে তিনটা বাজে। আমরা বুয়েট ক্যাফে স্টেডিয়ামে খেলা নিয়ে ব্যস্ত। দেশে যে কি হয়ে যাচ্ছে বিন্ধু মাত্র টের পাচ্ছিলাম না। খেলা শেষে অনেক মন খারাপ (হেঁরে) করে হল ফিরছি আমি আর আমার বন্ধু জ়োহা। শহীদ মিনারের সামনে এসে চা খাবো। রাস্তায় দেখি অনেক মানুষ। ঠিক বুজে উঠতে পারছিলাম না। সামনে আগাতেই টের পেলাম খুব খারাপ কিছু হয়েছে। জোহাকে বললাম চল তো সামনে এগিয়ে দেখে আসি কি হচ্ছে। অতি উৎসাহি জোহা রাজি হয়ে গেল। সামনে এগিয়ে জেতেই দেখলাম, ছাত্র পুলিশ ধাওয়া পালটা ধাওয়া চলছে। আর সামনে যাওয়ার সাহস পেলাম না। হলের দিকে হাটা দিলাম। সাথেসাথেই আমার রুমমেট এর ফোন, "ওই হাউয়া, কৌ তুই?" আমি বললাম, হলে আসছি। সেই প্রথম জানাল, সাড়াদেশে জরুরী অবস্থা জারি হয়েছে। তাড়াতাড়ি হলে আয় কিছুক্ষনের মধ্যেই হল ছাড়তে হবে। ঠিক বুজতে পারছিলাম না কি করব।
আমার ছোট ভাইকে ফোন করলাম। সে তখন ঢাকায় খুব নুতন। ফোন করে বলে দিলাম রুম থেকে বের না হতে। হলে এসে পৌছে দেখলাম সবাই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পরছে। আমরা কয়েক জন গেলাম প্রোভোস্ট স্যার এর সাথে দেখা করতে।কারন তখন হঠাৎ করে কোথায় যাবো ঠিক বুজে উঠতে পারছিলাম না। স্যারকে বলে আমরা কিছু ছাত্র হলেই রাত থাকব, বলে ঠিক করলাম। স্যার বলল, "দেখ সেনাবাহিনীর লোকজন এলে কিন্তু সমস্যা। যদিও আমি তোমাদের কথা বলব যে, এদের ঢাকায় থাকার তেমন কোন জায়গা নাই, তাই আছে। কালকে সকালেই চলে যাবে।" স্যারের এই কথাটাতে যদিও তেমন ভরসা পেলাম না, কিন্তু আর যেহেতু কোন উপায়ও নাই তাই রাতে হলে থেকেই গেলাম। সাড়া হলে আমরা কয়েকটা ছেলে, পুরা শুনশান নিরবতা। এর আগে এমন পরিবেশে আগে কখনো হলে থাকি নাই। সবাই খুব তারাতারি খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। তখন হলের ম্যাস ম্যানেজার হওয়ার সুবিদ্ধার্থে, রাতের খাবারের তেমন কোন সমস্যা হলো না। রাতে রুমের আলো বন্ধ করে শুয়ে পরলাম। ঠিকমতো যে খবর শুনব এমন উপায়ও নাই, টিভি চ্যানেল সব বন্ধ। রাতটা অনেক ভয়ে কাটালাম। বারবার যখন পুলিশ গাড়ীর সাইরেন শুনছিলাম, কেমন জানি অজানা এক ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠছিল। এই বুঝি পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে।
রাতটা কোনমতে কাটালাম। সকালে একটু তাড়াতাড়িই উঠলাম। কোথায় যাবো, ঠিক করতে পারছিলাম না। কিছু বন্ধু থাকে মোহাম্মদপুরে। কিন্তু এতোটা রাস্তা যাবো কিভাবে? এদিকে হলের কিছু কর্মচারি খবর দিল, সেনাবাহীনি আর র্যাবের লোকজন নাকি পলাশীর দিকে চলে এসেছে। যেকোন সময় হলে চলে আসতে পারে। না আর রিস্ক নেয়া যাই না। এদিকে হঠাৎ খবর পেলাম, হলের ফোন নাকি কাজ করছে না। কিন্তু প্রোভোষ্ট স্যারকে বলে যাওয়াও দরকার, যেহেতু ম্যাস ম্যানেজার। একজন কর্মচারীকে ম্যাসের জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরলাম। সবাই মিলে ডিসিনশ নিলাম, সবাই একসাথে দল বেঁধে যাবো না। এক দল গেলে হলের পেছন দিক দিয়ে, আমরা দুই জন রওনা হলাম পলাশীর দিক দিয়ে। হলে সামনে এক পরিচিত রিক্সায়ালা পেলাম। বললাম মোহাম্মদপুর যাবো। কিন্তু সে বলল, ঢাকা কলেজের সামনে নাকি রিক্সা যেতে দিচ্ছে না। বলাম যতোদূর যাওয়া যায় চলেন।
সামনে এগিয়ে যেতেই, পলাশী মোড়ে র্যাবের এক লোক রিক্সা দেখে থামাল। কাছে যেতেই বলল, কোথায় যান, কি করেন? এইসব বলার আগেই আই,ডি, কার্ড বের করে দিলাম। আচ্ছা ঠিক আছে যান, কিন্তু হেটে যান। রিক্সা ছেড়ে দিতে বলল। এদিকে বুক দুরুদুরু কাঁপছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে রিক্সা ভাড়া দিতে ভুলে গেলাম। কিন্তু আবার ঝাড়ি, ভাড়া দেন। রিক্সায়ালাকে পকেটে যা আছে বের করে দিলাম। মনে মনে বললাম, হেটেই যাবো। হেঁটে হেঁটে আজিমপুর মোড় হয়ে ঢাকা কলেজ এর দিকে আগালাম। রাস্তায় বেশ ভালোই লোকজন আছে। সবাই কেমন জানি একটা অজানা ভয়ে হাঁটছে। নীলক্ষত মোড়ে অনেক পুলিশ। নিউমার্টেরের সামনে যেতেই কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলাম পুলিশ লাঠি নিয়ে তেড়ে আসছে আমাদের দিকে। প্রাণপনে দৌঁড়াছি, কিন্তু কিছুদূর যেতেই, যখন সামনের দিক থেকে আরো কিছু পুলিশ তেরে আসলো, তখন আর আসলে কিছুই করার ছিল না।অনেক লোকজন যে যেদিকে পারছে দৌঁড়াচ্ছে। হঠাৎ টের পেলাম, প্রচন্ড বেগে আমার ডান পায়ে পুলিশের লাঠির আঘাত। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি পরে যাব। পা থেকে বুঝি প্রচন্ড রক্ত ঝরছে। তবুও প্রাণপনে হাতের ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে দৌঁড়াচ্ছি। একদৌঁড়ে সাইন্সল্যাব মোড়ে এসে পৌছালাম। কিন্তু পড়বি তো পড়, মালীর ঘাঁড়ে। এবার পরলাম, সেনবাহিনীর লোকজন এর হাতে। আবার দৌঁড়। আমার পায়ে যে ব্যাথা তখন বিন্ধু মাত্র টের পাচ্ছিলাম না। এভাবে প্রায় পুরাটা রাস্তা কি যে ভয়ে আসলাম, মনে পড়লে আজোও বুকটা ভয়ে কেমন জানি আঁতকে উঠে। পরে অবশ্য পায়ের ব্যাথাটা আমাকে অনেক দিন ভুগিয়েছে। যদিও পাঁ টা কেটে যাই নাই।
__________
শুভ্রসাদা
মন্তব্য
সত্যিই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা
খুবই মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা। খারাপ লাগল আপনার সেদিনের অবস্থার কথা ভেবে।
কয়েকটা বানান দয়া করে খেয়াল করবেন একটু-
মরণপন -> মরণপণ
বিক্ষুদ্ধ -> বিক্ষুব্ধ
হেঁরে -> হেরে
সাড়াদেশে -> সারাদেশে
বুজতে -> বুঝতে
পরছে -> পড়ছে
কারন -> কারণ
তারাতারি -> তাড়াতাড়ি
সুবিদ্ধার্থে -> সুবিধার্থে
সেনাবাহীনি -> সেনাবাহিনী
এই বুঝি পরে যাব -> পড়ে
প্রাণপনে -> প্রাণপণে
পরলাম -> পড়লাম
যদিও পাঁ টা -> পা টা
তবে বানান নিয়ে ভীতসাব্যস্ত হবেন না, লিখতে লিখতেই ঠিক হয়ে যাবে। হাত খুলে লিখতে থাকুন।
কৌস্তুভ
- পুরো বইয়ে পড়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনুভূতি এনে দিলো।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
বানান শুদ্ধ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। কেন জানি মনে হয়, হাতে লিখলে বানান গুলো ভুল হতো না।
______________
শুভ্রসাদা
লাঠিটা হাত বদলায় শুধু। আমরা যারা মার খাওয়ার, তারা আর বদলাই না।
আপনার অভিজ্ঞতা শুনে খারাপ লাগলো।
...
ধুসর গোধূলিকে উনার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি, এ ঘটনার সাথে ৭১ কে মেলানো যায়না কোনভাবেই, এমনকি এরশাদের সময় যারা ছাত্র ছিলো কমবেশী সবার অভিজ্ঞতা এর চাইতেও খারাপ।
অমিত ভাই, আপনি ঠিকই বলেছেন। যারা মাইর খাওয়ার তারা এখনো মাইর খেয়েই যাচ্ছে। এখন পাহাড়ী এলাকাতে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন, কেমন মাইর খেয়ে যাচ্ছে, আমাদের মতো মানুষগুলোর হাতেই।
__________
শুভ্রসাদা
এরশাদ খেদান আন্দোলনের সময় সামনে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা। প্রাইভেট পড়তে যাওয়া দরকার কিন্তু চারদিকের পরিবেশ থমথমে। পাব্লিক মারার নানারকম হাতিয়ার সাজান। পুলিশ, জল কামান, কাদানে গ্যাস কিছুই বাকি নেই। স্যারের বাসায় একদিন বারান্দায় টিয়ার গ্যাস চলে এসেছিল। তখন প্রথম এই জিনিসের স্বাদ পাই। তারপর একদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছি আমি আরেক সহপাঠীর সাথে। হঠাৎ কি হল দেখলাম পুলিশে দৌড়ে আসছে লাঠি হাতে। চোখ বুঝে দৌড়!! কোন রকমে বাসায় ফিরলাম। সাথের বন্ধুটিও নিজের মত রাস্তা দিয়ে বাসায় ফিরেছিল। হায়রে দেশ। কিছুকি পাল্টেছে? আমিত ভাইয়ের পর্যবেক্ষনের সাথে সহমত।
নতুন মন্তব্য করুন