তাক্‌ ধি না ধিন্‌

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০২/০৩/২০১০ - ১১:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রঙ-এর আজকের ছুটিটা অন্যরকম।

সেবার ক্লাস নাইনে রঙ স্কুলে যায়নি একদিন। জ্বর এসেছিল কি আসেনি মনে পড়ে না তার। সম্ভবতঃ এসেছিল, না হলে স্কুল ফাঁকি দেয়ার ছেলে সে নয়। তবে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে যে একদমই ছিল না, একেবারে নিঃসন্দেহ। মুরুব্বিদের ভাষ্যমতে পাড়ার ঐ অভদ্র আর বখাটে ছেলেগুলোর সাথে মার্বেল খেলে সেদিনের সকালটা কাটিয়েছিল সে। দুপুরটা পার করেছে ঘুমিয়ে। আর বিকেলে গিয়েছিল পাশের গ্রাম গনেরগাঁয়, ক্রিকেট খেলতে। দু' ম্যাচ করে খেলা হত প্রতিদিন। ১ম ম্যাচের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ছিল না যে রঙকে পাবে। ভাগ্যদেবী সেদিন ১ম ম্যাচের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিল। আনন্দে আনন্দে কাটিয়েছিল দিনটা।

পরদিন ১ম ক্লাসেই কিরণ স্যারের মুখদর্শন। কিরণ স্যারকে চেনে না এমন ছাত্র কিংবা ছাত্রী স্কুলে থাকতে পারে, তবে তাকে ভয় পায়না এমন কেউ বোধ করি ছিল না। যেমন ভাল তিনি পড়াতেন, তেমনি ভাল তিনি পিটাতেন। সবসময় যে তিনি পিটাতেন তা কিন্তু না, বড় জোর ২/৩ মাসে একদিন। কোনদিন তাকে বেত নিয়ে ক্লাসে আসতে দেখলেই সবার মধ্যে হিড়িক পড়ে যেত সেদিনের পড়া শিখার। সেদিনও তাকে আসতে দেখা গিয়েছিল বেত হাতে। যেসব ভাগ্যবান ছাত্র আগেই স্যারকে দেখেছে তারা আস্তে করে পিছনের দরজা দিয়ে চম্পট। ক্লাসে এসে রোল কল করার পরই স্যারকে সেই রূপে দেখা গেল, হাঁটুদ্বয়ের উপর দু' হাতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে চেয়ার হতে উঠে দাঁড়ালেন- "গতকাল কে কে স্কুলে আসনি, দাঁড়াও।" দাঁড়াতে দাঁড়াতে রঙ ভাবছিল- তবে কি তাকে শায়েস্তা করতেই আজকের আয়োজন? এর আগে কোনদিন স্যারের কাছে ধরা খায়নি রঙ। ভাল ছাত্র বলে প্রায় সব শিক্ষকের কাছ থেকে যে অতিরিক্ত সুবিধা পায় সে, আজ কি তার দেখা মিলবে না? প্রস্তুত রঙ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। স্যারও শুরু করলেন ১ম বেঞ্চের কোনা থেকে, রঙকে দিয়েই। চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞেস করলেন- "গতকাল স্কুলে আসনি কেন?" মুখে কিছু বলে না রঙ, দ্রুত হৃদস্পন্দন কথা বলতে দেয় না তাকে। খাতার মধ্য থেকে একখানা দরখাস্ত বের করে স্যারের হাতে দেয়, রঙের বাবার স্বাক্ষর আছে সেখানে। দরখাস্তটা বেঞ্চের উপর রাখেন স্যার। হৃদকম্পন বাড়ে রঙের, ঠোঁট কামড়ে ধরে চেয়ে থাকে স্যারের দিকে। স্যারের চোখের মনি এপাশ-ওপাশ করছে। দরখাস্ত পড়ার সময় বেশ শান্ত দেখায় স্যারকে, কিন্তু ঠিক ভরসা পায়না রঙ। কারণ সে জানে, যেদিন স্যার বেত মারেন, সেদিন ভয়ানক ঠান্ডা থাকে তার প্রকৃতি। একটু পর স্যার চলে এলেন তার নিজের চেয়ারের সামনে, হাতের ইশারায় বসতে বললেন সবাইকে। বেঁচে গেল সবাই। রঙ বুঝতে পারল- সেই ছিল আজকের লক্ষ্য। এ কারণেই কিরণ স্যারকে এত শ্রদ্ধা তার- ভাল ছাত্র বলে অযাচিত সুবিধা তিনি কাউকে দেন না। তবে দরখাস্তের উপযোগিতায় যারপর নাই মুগ্ধ হল রঙ।

তবে আজকের ছুটিটা অন্যরকম, এমনকি বৃষ্টির ছুটির মতোও নয়।

বৃষ্টির দিনে, সকালে তুমোল বৃষ্টি হত এমন দিনে, যেদিন কেউই তেমন স্কুলে যেত না, যেতে পারত না, সেদিন অতি অবশ্যই স্কুলে যেত রঙ। গিয়েই একখানা দরখাস্ত লিখত, দরখাস্ত লেখাকে বাস্তব কাজে লাগানোর দিকে বরাবরই বিশেষ আগ্রহ তার। মুষলধারে বৃষ্টির কারণে অনেকে স্কুলে আসতে পারে নি, যারা এসেছে তাদের কাপড়-চোপড়ও ভিজা, তাই ছুটি চাই ১ম ঘন্টা শেষে। এরপর আরো দুয়েকজনকে নিয়ে ঘুরত ক্লাসে ক্লাসে ক্লাস-ক্যাপ্টেনের স্বাক্ষর নিতে, মেয়েদের ক্লাসগুলোতেও ঢু মারা যেত এই সুযোগে। শিক্ষকরাও খুব করে চাইতেন এমন ছুটি, তাই কোনবারই হতাশ হতে হয়নি রঙদের। সর্বোচ্চ ২য় ঘন্টার পর ছুটি পেয়ে যেত। তাক্‌ ধি না ধিন্‌ করে নাচতে নাচতে বাসায় চলে আসত রঙ। শিখাদি, অপুদি আর চম্পার সাথে লুডু খেলা যেত জম্পেশ করে। রবি দাদুর বাড়ি থেকে গরম গরম ভাজা বাদাম কিনে খেতে খেতে, টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে লুডু খেলা কী মজারই না ছিল!

বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাছুটির ('অটো') চাইতেও আজকের ছুটি ভিন্ন ধরনের।

মনে পড়ে- প্রথমবার যেদিন তারা অটো নেয়, সেদিন ছিল বিশ্বকাপের প্রথম দিন। অটোর পর উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে। কম্পিউটারে হাই ভলিউমে গান চালিয়ে দিয়ে তাস পিটাচ্ছিল রঙ ও তার কয়েকজন বন্ধু। শেষ পর্যন্ত সেই অটো ভাল কাটেনি রঙের। সন্ত্রাসীদের গুলিতে এক আপু মারা গিয়েছিলেন সেদিন। গন্ডগোলে দু' মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও তেমন ছুটি কোনদিন চায় না রঙ।

প্রক্সির চেয়েও স্বতন্ত্র আজকের ছুটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে রঙ প্রায়ই অন্যদের প্রক্সি দিয়ে দিত। একবারতো ফুরিয়ার সিরিজ স্যারের ক্লাসে এক মেয়ের প্রক্সিও দিয়ে দিয়েছিল! রঙ নিজে যেমন অন্যের প্রক্সি দিত, তেমনি অন্যরাও তার প্রক্সি দিয়ে দিত প্রায়ই। বহুদিন বাঙ মেরে ক্যাফেতে তাস খেলেছে সে, কিন্তু ক্লাসের উপস্থিতি খাতায় অনুপস্থিত থাকেনি খুব একটা।

এমনকি চাকরিতে ঢুকার পরে বিনা কারণে অফিস ফাঁকি দিয়েও এত মজা পায়নি রঙ। বরং ছুটির দিনগুলোতে করার মত কিছু না পেয়ে প্রতিবারই বিরক্ত হয়েছে সে। শেষে ভেবেছে- অফিসে গেলেই বরং ভাল হত!

তাইতো আজকের ছুটিটা অন্যরকম।

অফিস থেকে আজ সে ছুটি নিয়েছে বই পড়ার জন্য। বইমেলা থেকে বেশ কিছু বই কিনেছে, পড়া হয়নি। বই পড়ার অভ্যেসটা চলে গেছে বলে প্রায়ই আফসোস করত রঙ, আর ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেত। অভ্যেসটা আজ আবার ফিরে এসেছে। সকালে উঠেই মনে হয়েছে আজ তার বই পড়ার দিন। অফিসের শৃঙ্খল থেকে মনকে মুক্তি দেয়ার দিন। আজ তার জাগরণের দিন। মনটা নেচে উঠেছে কি? তাক্‌ ধি না ধিন্‌ ...

---------------
আলোর ছটা
---------------
alorchhota AT gmail DOT com


মন্তব্য

আসমানী-মডু এর ছবি

আপনার লেখা নিজ ব্লগে আগে প্রকাশ হতে দেখা যায়। নীতিমালা অনুযায়ী:

২. সচলায়তনে প্রকাশিত লেখাগুলি ৭২ ঘন্টার জন্যে অনন্য থাকতে হবে, এবং অন্য কোন কমিউনিটি ব্লগে প্রকাশিত হতে পারবে না। মুদ্রিত মাধ্যম বা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশের ক্ষেত্রে এ নিয়মটি প্রযোজ্য নয়। অন্য কোন কমিউনিটি ব্লগে সম্প্রতি প্রকাশিত লেখা সচলায়তনে প্রকাশিত হবে না।

যদিও আপনার নিজ ব্লগে প্রকাশ করাটা নীতিমালা অনুযায়ী ঠিক আছে, তবু আপনাকে অনুরোধ করব সচলায়তনে অনন্য বা নতুন লেখা প্রকাশ করতে।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সমাধানটাও সহজ।

আপনার ব্লগস্পটে লেখাটা কিউ করে রাখবেন। সচলে প্রকাশ হওয়ার ৩ দিন পরে যেন স্বয়ংক্রিংভাবে প্রকাশিত হয় সেভাবে। ব্লগস্পটের এডিটর উইন্ডোর নীচে বাম দিকে Post Options আছে। সেখানে ক্লিক করলে নতুন প্যানেলের ডানদিকে দেখবেন Post date and time । সেখানে Set date and time এর মধ্যে ভবিষ্যতের একটা তারিখ দিয়ে দিলেই হল।

সম্ভবত সচলায়তনে বেশী পাঠক আগে পড়তে পারবে। সেদিক বিবেচনায় এখানে আগে দেয়াটাই লাভজনক হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ ভালভাবেই পড়া আছে নীতিমালা, ব্যক্তিগত ব্লগে লেখা প্রকাশ নীতিমালাবিরোধী নয় বলেই সেখানে তা প্রকাশ করা হয়েছে। তারপরেও আপনার অনুরোধ রক্ষা করার চেষ্টা করব।

---------------
আলোর ছটা
---------------
alorchhota AT gmail DOT com

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

স্কুলের ঘটনা বলতে বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসাটা একটু দ্রুত হয়ে গিয়েছে মনে হল। আর বৃষ্টির দিনে রঙের স্কুলে যাওয়ার সাথে টিনের চালের শব্দের সাথে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙের বর্ণনা এলে আরো ভালো হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো রঙ মাঝে মাঝে বাঙ মারতোই; বেশ ছন্দবদ্ধ হতো তাহলে চোখ টিপি

(মজা করলাম)

অতিথি লেখক এর ছবি

হুমম... বাঙ মারার অংশটুকু একটু বেশিই ছোট হয়ে গেছে। আর বৃষ্টির দিনে ব্যাঙের ঘ্যানর-ঘ্যানরের কথা বলছেন? এখানে আমি ভিন্নমত প্রকাশ করি। বড় বেশি গৎবাঁধা মনে হয় ব্যাঙকে। ইচ্ছাকৃতভাবেই তাই আনিনি তাকে। তারচেয়ে বরং বাদাম-ভাজাকে আনতে চেয়েছিলাম, যদিও পারিনি এক আনাও। বাস্তব এর চেয়ে হাজার গুণে সুন্দর।

মজা করে দেয়া আপনার বিশ্লেষণ আর মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। হাসি

---------------
আলোর ছটা
---------------
alorchhota AT gmail DOT com

Shizumu Wabishii Tawakemono [অতিথি] এর ছবি

রং এর তাও ছুটি নেওয়ার সুযোগ আছে ...... আর আমাকে ত চুরি করে বই পড়তে হয় । :-< মন খারাপ

আপনার লেখা যে কয়টি পড়েছি তার মাঝে এটি সবচেয়ে ভাল লেগেছে । চালিয়ে যান । হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

তার মানে, আমার বাকি লেখাগুলো এর চেয়েও খারাপ লেগেছে চোখ টিপি খারাপ লাগার পরেও আবারো পড়তে আসার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ। হাসি

---------------
আলোর ছটা
---------------
alorchhota AT gmail DOT com

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।