আমাদের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় বর্ণমালা দিয়েই, যদিও অক্ষরগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠতা দূরে থাক, পরিচয় হওয়ার অনেক আগেই আমরা শিখে যাই পাগলা ঘোড়ায় চড়ে তেড়ে আসতে আসতে বুবুকে ধমকে দিতে, কিংবা চাঁদকে নিজের কপালে টিপ দিতে অনুরোধ করতে করতে অজ্ঞাতসারেই মামা ডেকে বসা অথবা, শিখে ফেলি Humpty Dumpty জুটির গল্প। তারপরও আমাদের মোটামুটি সবার পড়াশুনাটা বাংলা বর্ণমালা দিয়ে শুরু হয়ে ইংরেজিতে নোঙর ফেলে অংকের বন্দরের দিকে নতুন করে পাল ওঠানোর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম থাকলেও অধিকাংশের গল্পগুলো মনে হয় এরকমই।
যে সময় মা-বাবারা খুঁজে খুঁজে সেই চারপাতা রঙিন প্লাস্টিকের বইগুলো কিনে এনে আমাদের সাগ্রহে “অ” “আ” “ই” “ঈ” পড়িয়ে পন্ডিত বানানোর চেষ্টায় রত, আমরা তখন বইয়ের পাতায় গাছের ডালে ঝুলে থাকা আম পারার জন্যে লাফ দেই কিংবা, পেঁচানো অজগর দেখে আতঙ্কে চিৎকার দেই অথবা এমনও হয় বক পাখি দেখে উড়ে যাবার বাসনা পরিতৃপ্ত করতে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে বোঁ-বোঁ শব্দে ঘরময় ছুটে বেড়াই, পড়াশুনার থোড়া্ই কেয়ার করে।
মা-বাবারা হতাশ হন। বাবা অফিসে চলে যান, অবসর পেলে পত্রিকা পড়ার ফাঁকে একটু-আধটু পড়াতে বসেন। আর মা তো হেঁশেল সামলাতেই ব্যস্ত। তারপরও সবসময় কেমন করে যেন মায়ের অখন্ড অবসর। সবসময়ই মুখে যেন ছন্দে ছন্দে বর্ণমালাগুলোর খেলা চলা। তাতেই অনেকটা সময় নিয়ে একটা একটা করে বর্ণ শেখা, বর্ণগুলোকে আত্মার বাঁধনে বাঁধা, ভবিষ্যতে পেট চলার জন্য এগুলোর উপর ভরসা করতে হবে এই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আরো বেশি করে এগুলোকে ভালোবেসে ফেলা।
ছেলেবেলায়, যখন আমাদের হাফপ্যান্ট পরারও বয়স হয়নি, নিয়ম করে রোজ বিছানা ভিজাই, প্রতিরাতেই মায়ের সাথে ঘুমাবো বলে বায়না ধরি, আর, মা ভাত খেয়ে এসে ঘুম পাড়িয়ে যেতেন ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসিদের ডেকে কিংবা চড়ুই পাখির চুরি করে ধান খেয়ে ফেলার কারণে আক্রমণ করা বর্গীদের ভয় দেখিয়ে অথবা little starগুলোকে যখন twinkle নামে ডাকতেন তখন কেন জানি খুব করে বর্ণমালাগুলোকে নিজের সম্পত্তি বলে মনে হত। কাউকে দেবো না, এমন একটা ভাব।
সাইকেল চালাতে শিখবো বলে বায়না ধরায় মা’র অনুরোধে বাবার ২ বছরের প্রতিরোধ ভাঙে ৩য় শ্রেণীতে এসে। প্রতিজ্ঞা করতে হয়, ১ম-৩য় অবস্থানে থাকার শ্রেণীতে। সবসময় সবকিছুতে বেশি বেশি করে চাওয়া মানুষগুলো অযথাই পরীক্ষার ফলের ব্যাপারে কম হয়েছে শুনলেই বেশি খুশি হয়ে উঠতো। এই ফলাফলে অবস্থানের সংখ্যামানের নিম্নগতির সাথে মানুষের খুশি হওয়ার হারের ব্যস্তানুপাতিকতার কারণ ছোটমাথায় তখনো পরিস্কার না হলেও কখনো ৫ এর কমে আসতে না পারা সেই ছেলেটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ৩য় হয়ে যায়। খুশিতে বাকবাকুম ছেলেটির স্বপ্নজুড়ে সাইকেলের ছবি আঁকা ঘুড়িটা হুট করে ছিঁড়ে যায় “১ম সাময়িক আর বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের মাঝে পার্থক্য আছে” হঠাৎ উদ্ভুত এই তত্ত্বের প্যাঁচে পরে। সাইকেল আর পাওয়া হয় না। শেখা হয় না সাইকেল চালানো, শেখা হয় না সবদিক সামলে নিজের ভারসাম্য রক্ষার প্রথম পাঠ, যা হয়ত পরবর্তীতে খুব সহজে জাত-পাত ভেদাভেদে উদ্বুদ্ধ করে। তবু, যেটা পাওয়া হয়, বার্ষিক পরীক্ষা শেষে একটা লেগো সেট, যেটা বর্ণমালাযুক্ত। শব্দ মেলাতে হয়। সেই থেকে আবার শুরু বর্ণের সাথে বর্ণের মিলনমেলা।
মায়ের হাত ধরে প্রথম যেদিন গুটি গুটি পায়ে আঁকার স্কুলে গেলাম, শিক্ষিকাকে আচমকা প্রথমবারেই ভালো লেগে গেল, কেন যেন খুব আপন বলে মনে হল, মনে হল এনার সাথে আমার বনবে, আমাকে ইনি বুঝতে পারবেন। কে জানে কেন এমন মনে হল? হয়ত, প্রথম দিনই তিনি আমাদের পাখি আঁকতে শিখিয়েছিলেন, “দ” দিয়ে, তাই। এখনো মনে আছে। “দ”এর নিচের অংশটা নৌকার মত আঁকতে হয়, আর উপরের মাত্রাটাকে আরেকটা উল্টানো নৌকার গলুই হিসেবে শুরু করে পুরোটা শেষ করলে আস্ত একটা পাখি হয়ে যায়। কি পাখি, তার নাম জানি না। কখনো জানাও হয় নি। হয়তো ইচ্ছে করেনি। আমার কাছে ওটা এখনো হয়ে আছে “দ পাখি”।
তারপর?
কেমন করে হুড়মুড়িয়ে শৈশবটা কেটে গেল। হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেলাম। এখন আর ঘুম ঘোরে বর্ণমালাগুলো খেলে না, এখন আর বর্ণের পাশে বর্ণ, কিংবা, বর্ণের উপরে বর্ণ চড়ে বসে শব্দশৈলী করে না। এখন শব্দরা কেবল পরীক্ষার খাতায় পর পর বসে পরে বেশি বেশি নম্বরের জন্যে, মুখস্থ করে আসা কথাগুলো লিখে যাই এক এক করে। আর অনেকদিন পর হঠাৎ করে পত্রিকার পাতায় ছবি, টেলিভিশনের পর্দায় বাচ্চাদের বর্ণ নিয়ে উৎসব দেখে নস্টালজিক হয়ে যাই।
- মুক্ত বয়ান
মন্তব্য
- লেখাটা মজার।
কিন্তু হাম্পটি ডাম্পটি কি কোনো জুটি? একটাই চরিত্র না, যে সবসময় একটা দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতো!
অ্যালিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড-এ অবশ্য তার একবার দেয়াল থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো!
আরও লিখুন। জমায়ে পড়ি।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ধূগোদা.. ধইন্যাপাতা। :)
না, এটা জুটি না। একটাই চরিত্র। একটু ভুল হয়ে গেল।
তেমন অসুবিধা করে না, একটা জোড়া হিসেবেই নাহয় আপাতত চলে গেল.. এই যা!! :)
- মুক্ত বয়ান
ভাল লাগল ছোটবেলার গল্প। এইবার আপনার পোলাপানদের বর্ণমালা শিখিয়ে চক্র সম্পূর্ণ করুন...
কৌস্তুভ
আরে আরে বলেন কি!! এখন তো সবেমাত্র বিয়ার বয়সে সরকারি ছাড় পাইলাম, কিন্তু পারিবারিক ছাড় তো পাইলামই না!!
তারপরে তো ভবিষ্যৎ!!
দিল্লী বহুত দূর!! ;)
- মুক্ত বয়ান
হে হে। হবে সব সময়মত, রাই ধৈর্য্যং রহু ধৈর্য্যং...
কৌস্তুভ
হ.. সেটাই.. ধৈর্য্যই ধারণ করে আছি!!!
- মুক্ত বয়ান
মুক্ত ভাই,ভালো লিখসেন ।
শৈশব তার মুগ্ধ হবার ম্যাজিক কাউকে বেশীদিন দেয় না । ম্যাজিকটা যেই আপনি বুঝতে শুরু করবেন ; শৈশব ব্যাটা তার ম্যাজিক হস্তান্তর করবে অন্য কাউকে - অন্য কোনো খানে।
ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ ভাই।
শৈশবের ম্যাজিকের কথাটা হুমায়ূনীয় লাগল। কিন্তু, তারপরও সত্য। যারা এই ম্যাজিক দীর্ঘদিন পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে, তারা অনেক ভাগ্যবান।
- মুক্ত বয়ান
Humpty Dumpty অবশ্যই কোন জুটি নয়, একটা ছড়া। বা, একটা ধাঁধা।
ধাঁধাটার উত্তর জানেন?
অবশ্য, চরিত্রটার কী একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার আছে বলে কোথায় যেন পড়েছিলাম।
তাই নাকি? ঐতিহাসিক ঘটনার কথা তো জানা ছিল না। লিখে ফেলুন। আমরা পড়ি।
ধন্যবাদ।
- মুক্ত বয়ান
মুক্ত বয়ান ভাই, সুন্দর লিখেছেন। বর্ণগুলো ছোটবেলা যে চোখের সামনে কতরকম আকৃতি নিয়ে হাজির হতো মাথায় তার ইয়ত্তা নেই। তবে সবচেয়ে দুষ্টু ছিলো মেঘগুলো। সবগুলো মেঘ যেন যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগীতায় নাম লিখিয়ে সাজতে বসতো আর আমি হুট করে তাদের মেকাপরুমে অনাহুত আগন্তুকের মত ঢুকে পড়ে মুগ্ধ চোখে দেখে নিচ্ছি রুপবদলের প্রক্রিয়া!
লিখুন বেশি করে। আমরা যারা লিখতে পারিনা, তারা কিছু শিখি অন্তত।
---- মনজুর এলাহী ----
হা হা হা হা!!
লিখতে পারা, না পারা কিছু নাই। আমার চাইতে এখানে অনেক ভালো লেখক আছেন এখানে। আমিও আপনার মত, তাদের লেখার মুগ্ধ পাঠক।
মেঘের ব্যাপারটা একটা চমৎকার ঘটনা। আমি মেঘ দেখতাম ট্রেনে চড়ার সময়। জানলার পাশে বসে তাকিয়ে থাকতাম, আর অবাক হয়ে দেখতাম, একটা সিংহ হঠাৎ করে পাখি হয়ে গেল, কিংবা একটা বিছানার হঠাৎ ফুলে রূপান্তর!
এ যেন ঐ বিখ্যাত জাদুকরের গল্পের মত, "ছিল ফুল, হয়ে গেল পাখি"!!
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
- মুক্ত বয়ান
লেখা ভাল্লেগেছে!
শিরোনামও...
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অবশেষে.. !!!
আমার একটা শিরোনাম আপনার পছন্দ হইল। :)
লেখা ভালো লাগবেই.. শৈশবের যেকোন কিছুই আমাদের অনেক প্রিয়।
ধন্যবাদ।
- মুক্ত বয়ান
নতুন মন্তব্য করুন