কুলদা রায়
পা দুখানি লাল। পদ্মের মতো নয়--শিমুল ফুলের মতো গাঢ়। জলের মধ্যে যতবার পা দুটি উঠছে—জলের সঙ্গে গলে গলে যাচ্ছে রঙ। টকটকে। কাঁচা।
পুরনো পুকুর। বড় বড় গাছের ডাল আর পাতা ভেদ করে যতটুকু আলো রোদ পড়ে—তাতে শান্ত ছায়া নুয়ে থাকে জলের উপর। সিঁড়িতে শ্যাওলা। ছায়াদিদি এই শ্যাওলাটুকু নেড়ে চেড়ে দেখতে দেখতে জলের বর্ণে অবাক বনে গেছে। গোল গোল মৃদু ঢেউ তৈরি হচ্ছে-- ছড়িয়ে যাচ্ছে দূরে দূরে। তার মধ্যে পা থেকে ধুয়ে ধুয়ে পাদুখানি জলের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে শির শির করে ওঠে। একটি পাখি ডেকে ওঠে, টুব। টুব।
সিঁড়িটির পাশে একটি স্নানঘর ছিল। দেয়ালটি ধসে গেছে। তার ভিতরে অশ্বত্থ গাছের শেকড়। আর দুটুকরো পাখিদের ডিম। এর পাশ দিয়ে ভিতর বাড়ির পথ। ঘর দেখা যায় না। এইটুকু আড়াল যে কোন দুপুরকে পাল্টে দেয়। পায়ের ভিতর থেকে আরেকটি পা এসে জলে নামে। জলে গলে।
কাল ছায়াদির বিয়ে। কাল এসময়ে বাড়ির উঠোনে স্নান। পিঁড়িখানি বারান্দায় খাড়া করে রাখা। মনুবালা লতাপাতা এঁকে গেছে। মাঝখানে একটি পাপড়ি ছড়ানো পদ্ম। এই পদ্ম মেখে কাল স্নান হবে। আজ একা একা এই পুকুরে শেষবার স্নান। আয়োজন করে ঝিঁ ঝিঁ পোকা তাই থেমে আছে। টুব টুব পাখিটি আবার ডেকে ওঠার আগেই বিন্তি ডেকে উঠল, দি..দি…!
জলের মধ্যে ততক্ষণে হারিয়ে গেছে ছায়াদির পাদুখানি। একেবারে। কাল তার পদবল্লভ আসবে। বুকের মধ্যে একবার ধরবে এই উষ্ণ পদ্ম। এই জলে হারানো পাদুখানি ছাড়া সে কিভাবে হেঁটে যাবে পদবল্লবের কাছে? বসবে পদ্মপাতার উপরে? হয়ে উঠবে জলের ভিতর থেকে উঠে আসা অন্য রকম এক জলদেবী? ছায়ার উপরে । গাছের উপরে। আর টুব টুব পাখিটির নিঃসঙ্গ করুণ ডাকটির উপরে কিভাবে হেটে যাবে ছায়াদিদি?
--দিদি, ও দিদি। দেরী করছিস ক্যান। জ্যোস্নাবু বসে আছে।
বিন্তি বলছে ফিসফিস করে। কিন্তু স্বরে তাড়া আছে। আর তক্ষুণি জলের ভিতরে পাদুখানি সম্পূর্ণ গলে গেছে। কিচ্ছুটি নেই। কোমর থেকে কোরকতুল্য বুকখানি, মৃণালের মত হাতদুখানি আর জলজ্যান্ত একমাথা চুল জলের মধ্যে গলে গলে ছড়িয়ে পড়েছে। জলের চারিদিকে মিশে গেছে। ছায়াদিদি কোথাও নেই। গোলাকার সবুজ চিহ্ণ পড়ে আছে। ধীরে ধীরে। এইখানে।
--ছায়াদিদি--ও ছায়াদিদি, আমার একা একা ভয় করে।
ভেঙেচুরে পড়ে পুরনো স্নানঘর। দুএকটি ইট। আর শুকনো চুন আর সুরকি।
এইটুকু লিখে মনে হল বিন্তি কাঁদছে। তার চোখে আতঙ্ক আর বিস্ময়। জ্যোস্নাবু, একা বসে অপেক্ষা করছে। আর ছায়াদিদিটি কোত্থাও নেই। জলের মধ্যে জলের ছায়ার মতো উবে গেছে।
এই পুকুরটি আমি দেখেছিলাম রহমতপুরে, নারিকেলবাগানে। কেউ কোথাও নেই। দুপুর গড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যা নেমেছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি, পুকুরটি আছে। আছে আধভাঙা শেকড় আর গাছগুলো নেই। নেই স্নানঘর অথবা অনতিদূরের বসতবাড়ি। একটি তুলসী তলার চিহ্ন যেন পড়ে আছে। তার পরে বন পিপ্পলের ঝাড়। সোনালী সোনালী মঞ্জুরী বেরিয়েছে। তার মধ্যে গৃহবাজ পায়রার ভাঙা দুটো ডিম।
এই ভাঙা ডিমটি দেখে মনে হয়, এখানে কবে কোনো এক গুপ্ত ঘাতক এসেছিল। অথবা হলুদ তস্কর! এ যেন কবরের নিস্তব্ধতা অথবা বিস্তির্ণ হিম ক্রোধ।
ক্রোধে এই সুপ্ত বাড়িটি লুপ্ত হয়েছে। লুপ্ত হয়েছে স্নান ঘর, ছায়াদিদি, অপেক্ষামান জ্যোৎস্নাবু অথবা ভয় পাওয়া কিশোরী বিন্তি মেয়েটির মুখ। একাত্তরে? পঁচাত্তরে? দুই হাজার এক-এ?
সময় নিয়ে প্রশ্ন নেই। কারণ গুপ্ত ঘাতক প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে মুছে দিচ্ছে এইসব ছবিগুলি প্রতিদিন। গল্পটি এই রকমই। নির্মম।
এবং মনে হল এখন গল্প থাক। কবিতা পড়ি। এই ভাঙা ডিমের ভেতরের গুপ্ত রাজনীতিটা --যে রিকয়েললেস রাইফেল অথবা রগকাটা কিরিচের লকলকা ধার যা-ই হোক না কেন তা সমকালে লিখিত রক্তবীজের মতো কবিতাগুলোকে আড়াল করছে। এই বুকের ভেতরের গুপ্তঘাতককে কিন্তু চিনতে অসুবিধা হয় না মোটেই। বুঝতে অসুবিধা হয় না-- কেন এই ঘাতকের আঘাতে এই পুকুর, ছায়াদিদি, জ্যোৎস্নাবু আর বিন্তি নামের মেয়েটি আর জলরঙের মতো অনতিদূরের বসতবাড়িটি আজ বনপিপ্পলের ঝোপ! এই ভয়ংকর সত্যকে শিল্পীতভাবে আমাদের কানের কাছে প্রকৃত কবি ছাড়া কে আর উচ্চারণ করবে? এই ভয়ংকর গুপ্তঘাতকের বিরুদ্ধে মারণমন্ত্র হয়ে ওঠে বলেই ঘাতকের জন্মক্রোধ আমাদের হাজার বছরের লালিত আবহমান বাঙালি ঐতিহ্য আর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির উপর। প্রতিরোধের আর বিজয়ের কবিতাগুলোর জন্য ওদের এত ক্ষোভ আর খোলামকুচি ছুঁড়ে মারা।
এরকম কবিতার খোঁজ পেয়ে যাই এই রক্তঝরানো মার্চে—আমাদের কবি বন্ধু তুষার গায়েনের কাছে। তিনি নব্বই দশকের কবি। দুটো বই বেরিয়েছে—নীলভবহ্রদ আর বৃষ্টির অন্তর ত্রাস। জীবন, রূপকথা, লোককাহিনী ও বাঙালি আর্কিটাইপগুলোর বিনির্মিত অবয়বের পাশাপাশি সন্ত্র্রস্ত শব্দে জলবিগলিত, অনাবৃত আমাদের ত্রাসিত স্বদেশ ও পীড়ন প্রভাবিত প্রকৃতির শ্বাসরোধী সূত্রাবলী একে একে উন্মোচিত হয়েছে অমোঘ সংকেতে এই কবিতা অষ্টকে। জাগ্রত মার্চে কবি তুষার গায়েনের কবিতাঅষ্টক তুলে দিচ্ছি।
কবি তুষার গায়েনের কবিতাঅষ্টক
...............................................................
একাত্তরের খনি
(উৎসর্গ: রৌদ্র ঝলসিত পথে সময়ের সাহসী সহিস, আবুল বাশার খান বন্ধুবরেষু)
জোনাক হয়ে জ্বলছে আকাশ আখের বনে
নদীর জলে দগ্ধ হাড়ের ফস্ফরাসে
স্তব্ধ ছায়া ডুমুর গাছের ফিস্ফিসানি
কলার পাতা কাঁপছে ভোরের তারার রাতে।
আমার যাবার কথা ছিলো অনেক সে দূর
পথের পরে পা বাড়াতেই আর্জিনাপুর
পথের পাশে জবাপুকুর, ভয়াল কালীর
পূজার ফুল — লাল জিহ্বার দলচক্র
মেলে আছে মৃত্যুমুখ … বুক ধুক্পুক্
ধুক্পুক্ বুক, উঠোন ছেড়ে অশ্বত্থছায়া
পা যে দুটোই কাদায় মাখা, ভাবছি জলে
পা ধুয়ে যাই, হাঁটতে হবে অনেক দূর…
একটু থেমে ঘোরের মাঝে টিপকলে চাপ
দিতেই জল, গলগলিয়ে উঠে এলো
জল সে নয় রক্তঢল! আঁতকে উঠে
তফাৎ যাই, রক্তে ভাসা শাদা শাঁখা
ভাঙা চূড়ি দেখতে পাই ... ‘কার এ শাঁখা
ভাঙা চুড়ি? — কেঁদে ওঠেন কাজলদিদি
‘একাত্তরে মাঠ পেরোতে, খানসেনারা
আমায় ধরে!’…স্তব্ধ আমি, পা সরে না
জনমানুষ রাও করে না। এক পা দু’পা
এগিয়ে যাই, জলের কলে হাত লাগাই
ঘররঘর শব্দ তুলে সফেন ঘিলু
বেরিয়ে আসে, ভাঙা কাঁচের চশমাখানা
বিদ্ধ আছে স্নায়ুর জালে — আঁতকে উঠে
শুনতে পাই …‘গুরুমশায়, আমি যে তোর
একাত্তরে পাঠশালায়!!’ হায় রে হায়
কি যে করি কাকের ছায়া মাথার পরে
জনমানুষে হুমড়ি খেয়ে জলের কলে
ভিড় করে … গলগলিয়ে উঠতে থাকে
মগজ এবং মাথার খুলি, উৎপাটিত
চক্ষু এবং পেটের কাটা নাড়িভুঁড়ি
ক’জন তারা ক’শতজন বুটের লাথি
বেয়নেটে গুলি খাওয়া ঝাঁঝরা বুকে
মাটির তলে সেঁধিয়ে আছে? মাথার পরে
সূর্য বাড়ে, অবরুদ্ধ পথের পরে
ত্রিশটি সাল উধাও হয়ে কোন্ অতীতের
প্রদোষকালে, রক্তঘন দৃশ্যগুলো
একের পর এক নাচছে ঘুরে … নিথর ছায়া
গাছের তলে, সাক্ষী থাকে জনমানুষে
এগুতে যাই চেতন হারাই ভয়াল কালীর
পায়ের তলে!
ঢাকা, ২০০২
এই নয়া রাক্ষসী বেলায়
নদীজলে ভেসে আসে ডাবের খোলস নাকি মানুষের মাথা
ভেতরে শিংমাছ, সাপ, বালি, কাদা — কি ভেদ, কে বোঝে আজ
সম্বিতহীন বর্ষার জলধারা অবিরাম আচ্ছন্ন করে নামে
রক্তবর্ণ মেঘের ইশারা… …
সবকিছু হয় ইশারায় — পলকেই গ্রামটি উধাও:
মৃতা অথবা ধর্ষিতা কিংবা ‘ক্রাচে হাঁটো ভর করে’…
ব’লে দন্ত বিকশিত করে হাসে দশানন
হু হু হাওয়ার গর্জন টেনে আরে শতাব্দীর প্রেতছায়া
ইংরেজ, পাঠান, পাক, শক, হুন, মোগল, তাতার
মুছে ফেলে কপালের সব ভাঁজ সাজে দেশী ভূত যেন
যুগ যুগ টিকে যেতে পারে, ভয়ে ত্রাসে হিম করে এই জনপদ
খেয়েছে আমার স্বামী, খাবো আমি, খা রে পেটের ছা
কালনাগিনীর পেটের তলায় মারণ ডিমের
তা … না না না, আছেন ভগ্নি আছে ভ্রাতা, তারা
বড়ো তারা ত্রাতা — খাবেন তারাও মহাসুখে, আর
সকলে নিদ্রা যাবে, কিছু দেখবে না ...
হি হি হা হা হা ... ... হি হি হা হা হা
সন্ধ্যা নামে দ্রুত — আলখেল্লা আজানুলম্বিত
মায়াবী মুখশ্রী ঢেকে চোখের উপর শুধু মিহিজাল নড়ে
বহুবর্গে ভাগ করে পৃথিবী দেখার, গরাদ কারার
কি হবে ধরণী দেখে, বাড়ো শুধু চক্রবৃদ্ধি হারে
গ্রীষ্মশাসিত গুহার অন্ধকারে করো গর্ভধারণ —
গিজ গিজ কালোমাথা ছেয়ে ফেলো দাঁড়াবার স্থান
চুমুকে সাবাড় করো নদী, আকাশ নামাও টেনে
মাটির উপর, আর শেকড় উপড়ে আনো গাছ যেন হয়
রাক্ষস দাঁতের ফাঁকে নিমের মাজন!
থু থু থুক্কারে যা কিছু মানবীয় আছে
ভাসাও পঙ্কের স্রোতে — আমরা পূণ্য করি
নতুন রাক্ষসজন্ম রক্তসম্ভোগে!!
-ঢাকা, ২০০১
কৃষ্ণগহ্বর
আমাদের স্নায়ুমণ্ডলী এখন সর্বগ্রাসী কৃষ্ণগহ্বর। যে কোন বিস্ফোরণের আলো ও শব্দকে দ্রুত শুষে নিতে পারে। তাই মুহুর্মুহু বোমা বিস্ফোরণে সহসাই ফেটে পড়া মিছিল-প্লাবিত-মন দ্রুত ধাতস্থ হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন দেহাংশ চিনে নিতে যতটা সময়, তারো আগে ক্রোধ জল হয়ে আসে। অনন্তর মৃতদের স্বজনেরা বাষ্পরুদ্ধ চা’র কেটলির মত প্রতিকারহীন পথে বসা — দেখে, মানুষের আন্দোলিত তরঙ্গকে অনেক উঁচুতে নেবার মতো কেউ নেই। বহু ব্যবহৃত শব্দবন্ধ ভূত আগুনের স্মৃতিবাহী, নিতান্তই অঙ্গার এখন। তাই খুরে খুরে ধুলো ওড়ানো ইতিহাসের দুরন্ত ঘোড়াগুলোকে এক এক করে গিলে খায় অদৃশ্য অজগর। দূরে বনের কিনারে ডাইনীর ঘর, রক্তে সারে প্রসাধন আর হাসে খলখল।
-ঢাকা, ২০০৫
জতুগৃহ
(সূত্র: বাঁশখালীতে অগ্নিপ্রয়োগে নিহত গৃহবন্দী একই পরিবারের এগারো জন)
জতুগৃহ জ্বলছে আগুনে
গলিত তরঙ্গে তার কত সহস্র বছর
উন্মুক্ত হিংসায় প্রকাশিত হয়ে আছে —
ধাতুর দাহ্যগুণের থেকে বিনাশী বৈমাত্রেয় ক্রোধ
পালিয়ে বেঁচেছে একবার কুশলী পাণ্ডব
কুণ্ডলিত আগুণের জিহ্বা থেকে যদি মাটি
গর্ভ হয়ে রক্ষা করে — এবার নিশ্ছিদ্র ফাঁদ
পাউডারে প্রসাধিত মৃত্যু — বিগলিত লাশ
ভাবমূর্তি রক্ষা ক’রে পরিপূর্ণ বিজয় আস্বাদ
পেতে গেলে এই পূণ্যমাসে, দখলের স্পৃহা
দাহ্যগুণে আরও বিনাশী ক’রে নিতে লাগে
আরও বীভৎস মন — হাড়ির ভেতর চাপা
ইতিহাস বিকলাঙ্গ যখন, তখন অবধ্য কে ?
মেয়েটির আর্তনাদ যেন দাউ দাউ আগুনের মাঝে
কম্পিত হয়ে বাজে সঙ্গীতের মত — যেন কোনো গান
আর না সাধে ঐ কণ্ঠ কোনদিন, দগ্ধীভূত
কড়িবর্গা খসে খসে নামে লানতের মত
অবশেষ সমাধিত পরিবার ছাইচাপা বাড়ির ভেতর :
আশ্চর্য দগ্ধশিল্প সুনিপুন ফুটে ওঠে লোভের, ক্রোধের কারুকাজ!
-ঢাকা ২০০৪
রক্তের চুম্বক ডাকে স্বজন লোহাকে
(উৎসর্গ: মৌলবাদী ঘাতকদের হাতে আক্রান্ত ও পরে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুপ্রাপ্ত কবি হুমায়ুন আজাদ)
রাস্তার দু’পাশে ফুটপাথ — কালো পিচের রাস্তাকে রেখে মাঝে লাঞ্ছিত পায়ের ধুলো-ধূসরতা সমান্তরাল উড়ে যেতে জানে —কতদূর, কে জানে : উন্নয়নের দেঁতোহাসি যতদূর নিয়ন্ত্রিত নিয়ন আলোয় এসে থামে — আপাতত ঐ পাশে যতটা নির্জনতা শ্রীহীন পার্কের অধিকার আছে, তাকে বাহুলগ্ন করে বুক ভরে শ্বাস টেনে একবার ছেড়ে দিতে দিতে মাথাটা দারুণ হাল্কা হতে থাকে এই ঘনীভূত ফাল্গুনের রাতে — আজ অফুরাণ অটোগ্রাফে তার ক্লান্ত আঙুলগুলো গুনগুন ভাজে গান — একটা দীর্ঘ সুখটান সিগারেটে — জ্বলজ্বল চেতনার খরস্রোতে কানে ভাসে : সাবধান! হুমায়ূন!সাবধান! একা একা বাড়ি যান? সাবধান!!
কেন সাবধান বলো? আমি তো দলের নই কোনো! যা কিছু সত্য বলে জানি, চলি সেই মতো। নিঃসঙ্গ, নিঃশঙ্ক আমি — আমার শিরোপা আমি নিজেকেই বলে মানি! খাপখোলা কলমের ধারে কেটে নেব অন্ধ সাপের তড়পানি!!
আর তখনি ছোবল সকল প্রত্যয়ে এসে নামে — দু’গালের আশ্রয়ে যে-সব উচ্চারণ অগ্নিসত্য হয়ে যেত — বিভক্ত বামগাল চাপাতির কোপে দরদর নামে রক্তপ্রস্রবণ — আরো কোপ উপর্যুপরি করোটির পরে যেন অবিশ্বাসী ছিন্নমস্তক নিশ্চুপ হতে জানে! মূ-র-তা-দ!!
রক্তের ভাষা! রক্তের ভাষা!! তুমি কি জানো না, কার রক্ত কাকে ডেকে আনে? — রক্তে ভিজে পথের কংক্রীট সহসা চেতন হয়ে বলে! তবে কি সে হ’য়ে ওঠে রক্তের চুম্বক — পরম চেতনা পরিবাহী — টুকরো টুকরো লোহাকে যেভাবে টানে চুম্বকাবেশ, সেইভাবে শত শত হাজারে হাজারে আজ জড়ো হ’তে থাকে — খণ্ডিত ‘আমি’র ভারে ‘আমরা’কে যারা এতদিন
ফেলেছি হারিয়ে, আজ সেই অখণ্ডিত চেতনার ‘আমি’ ও ‘আমরা’ একাকার — বিশ্রুত যুদ্ধের অভিজ্ঞান আরো একবার সংঘটিত হতে ডাকে।
ঢাকা ২০০৪
সজ্জন ঈশ্বর
(সূত্র: ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সংখ্যালঘু নিধনের কালোপর্ব)
সহসাই সিংহাসন চেয়েছিল তারা
করোটি উপুড় করে ভরেছিল বারুদের
ধোঁয়া আর অরণ্যের সাপ
যেসব প্রবৃত্তিগুলো আমরা সম্মতিক্রমে
রেখেছি রাষ্ট্রীয় নিষেধের সীমানায় পুঁতে
তারা ফের শুনেছে বাজায় বাঁশি খল যাদুকর
অস্ত্র মাত্র যদি হয়, বাজেয়াপ্ত করা যাবে
অস্ত্র কেড়ে নিলে অস্ত্রহীন হবে সশস্ত্র উন্মাদ
তবু তার প্রবৃত্তির ভার নেবে সে কোন্ ঈশ্বর?
আভূমি আনত জলে, যে বৃদ্ধ সমুদ্র
থেকে গোটা কয় লোনামাছ দাঁতে ধরে
বাজারে এনেছে প্রতিদিন — সেখানে বাজার
নেই, আগুনপ্রপাত! ‘বিধর্মী দগ্ধ হোক’
ব’লে পড়শী পোড়ায় কারো হাড়
প্রবৃত্তি পোড়ায় সকলই
আমাদের এতগুলো ধর্ম আছে, তবু
নেই কোনো ধর্মনিরপেক্ষ সজ্জ্ন ঈশ্বর!
--মুম্বাই, ১৯৯২
ত্র্যহস্পর্শ
দাউ দাউ চৈত্রের বাতাসে চেপে অনন্ত ত্রিচক্রযান
শহরময় ঘুরে বেড়ালো পাড়া আমাদের হাওয়া হয়ে
যাওয়া মন বাতাসে উড়ে যেতে চায় এমন বাতাস
কোমর থেকে ফুলে ওঠা জামার পিপাসা যেন
ঘনকেশ গাছের মাথায় দোলমান মেঘমুখ
ধুলোজব্দ পাতারা প্রবল মাটিগন্ধে আসে ভেসে
দিগ্বিদিক চোখ জ্বালা করা টায়ার পোড়ানো ধোঁয়া
তোপখানা রোড ধপ্ করে যাবে ধসে
রুদ্ধশ্বাসে উত্তেজিত জনরোষে ফেটে যায়
থেমে থেমে ওই জলাভূমি থেকে বাতাস এসেছে ধেয়ে
চৈত্রগুপ্ত গেরুয়া বসন তার, ভূমিগুলো ছিল
রাস্তার পাশে পাশে আধানগরী মর্ম বোঝেনি তার
টায়ার পুড়েছে দিকে দিকে নগরীর, ঝন্ ঝন্ করা
হরতাল ভাঙা কাঁচ — ত্র্যহস্পর্শে এই বুঝি উড়ে যাবে
পরান পাখির দেহঘর অভিলাষ …
লাশ…লাশ…লাশ…লাশ…লাশ…
আমাদের দেহ থেকে সারি সারি লাশ
শীতের সঞ্চয়ে চলে যায় পিঁপড়ের মত
যানবন্ধ গানবন্ধ কা-কা-খাঁ-খাঁ পথে
জলপাই যম এসে দ্রুত ট্রাকে তুলে নেয়
আকাশ অবধি বলয়িত সিঁড়িপথে নামে সন্ধ্যা
বিস্ফোরিত বোমার প্রণয়; নাভিচাপে বয়ে আসে
নিরুত্তর বেগ, ঘাস, শীর্ষ উত্তেজনা
উস্কোখুস্কো বাতাসের চিরচেনা পাতা
‘…কি নাম লিখেছ তুমি কোন পরিচয় আমরা মৃত যারা…’
নীল নীল রক্তস্রোত, খণ্ড খণ্ড ভয়
বৃত্তপথে ইতিহাস অভিনীত হয়ে যায়!
ঢাকা, ১৯৯৫
আগ্নেয় উচ্চারণমালা
(উৎসর্গ: বাঙালির দ্বিতীয় বিজয় দিবস, ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮)
জলমগ্ন তলদেশ থেকে আগ্নেয়বলয় উঠে আসে
এই অগ্নি বাঙালির মন, নিমজ্জিত হতে হতে
সহসা সরোষ উদ্গীরণ দগ্ধ, আলোকিত করে
দিতে জানে চারিদিক! বিস্ফোরিত হয়ে গেলে একবার
তাতে যে সৃজনচক্র পাকে পাকে খুলে যেতে থাকে
সেখানেই স্মৃতি, শস্য, যূথতার গান, বিগত যুদ্ধের অভিজ্ঞান
দমকা হাওয়ায় আসে ভেসে, বলে :
আমি অগ্নি সর্বকালে জ্বলিতেছি শিখা
প্রকাশ্য তখনই যখন সজ্ঞানে ধরো তুমি থরথর
প্রসারিত করতলে, অথবা তোমার অজ্ঞানতা টেনে নেয় সব
শ্বাসরোধী অন্ধকার বিস্মৃতির গাঢ়ঘুমে
আবার উঠেছ যদি এই পাহাড় চূড়ায়
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ধীরে ছেড়ে দাও
অতল খাঁদের নিচে, দেখো, বয়ে যায় জল
কঙ্কাল সেখানে আর করোটির মালা
খড়ি সাদা সাদা, যারা হত বহুকাল
আর কিছু লাল, যারা নিহত হয়েছে গতকাল
বাতাস আসছে ভেসে পূর্বাপর বধ্যভূমি হতে
বাতাস আসছে ভেসে ঘাতক বিনাশী শিস্ দিতে দিতে
বাতাস আসছে ভেসে হৃতস্বদেশ উদ্ধারগাথা গীত হতে হতে
বাতাস আসছে ভেসে অতীত বিজয় গান আজকের করে নিতে
বাতাস আসছে ভেসে, থেমে থেমে, বিস্মিত বিহ্বল
ইতিহাসের নির্জ্ঞান স্তর থেকে সজ্ঞান প্রান্তর
একবার এসে গেলে বহুকাল পর
দিগন্ত কাঁপানো হাসি তরঙ্গিত বয়ে যায়
আনন্দিত অশ্রুজল — কোটি কোটি শিশির উজ্জ্বল
ফসলের ক্ষেত, প্রান্তরের ওপারে প্রান্তর
একবার বুনে যাকে হারিয়েছি সুনামিতে
বিধ্বংসী কীটের প্রতি প্রশ্রয়ের চোরাস্রোতে
আত্মঘাতী ক্ষমা আর মহত্বের বিপণন
হয়েছে অনেক দেখা, এবার দাঁড়াও ঘুরে
শানিত অস্ত্রের ধারে ছিন্ন করো তমসার মাথা
ফিন্কি দিয়ে বের হোক শত সহস্র আলোর স্রোত
সোনালী রূপালী কারুকাজ মাখা!
টরন্টো, ২০০৯
মন্তব্য
আপনাকে সচলায়তনে দেখে ভালো লাগলো দাদা।
*************************************************************************
ভবিষ্যতে কি হবে তা ভেবে বর্তমানকে উপেক্ষা করবো কেনো?
____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
কুলদা রায়, সাধুবাদ জানাই এরকম কিছু রাজনৈতিক কবিতার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য । কবিকেও শুভেচ্ছা । তবে শেষ কবিতাটির সাথে আমি এতোটা আশাবাদি নই । নির্বাচিত সরকারের "শানিত অস্ত্রের ধারে ছিন্ন করো তমসার মাথা" এখনও যে পুরো হয়নি ।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
কুলদা রায়, সচলে নিয়মিত লিখুন।
তুষার গায়েন যদি সচলে কবিতা লিখতে চান, তিনি নিজেই এসে লিখতে পারেন। কুলদা রায়ের কাছ থেকে কুলদা রায়ের লেখাই পড়তে চাই।
আপনার যেকোন লেখাই কেন যেন চিত্রগল্প মনে হয়। শুরুর অংশটা তো অসাধারণ।
তুষার গায়েনের কবিতাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যও ধন্যবাদ।
- মুক্ত বয়ান
আপনার প্রতিটা গল্প বিষন্ন করে, মুগ্ধ করে। এই গল্পটিও।
তবে বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা থাকলেও গল্পের পোষ্টে এতগুলো কবিতা জুড়ে দেয়াটা ভালো দেখালো না। তুষার গায়েনের কবিতা নিয়ে আলাদা বিশ্লেষনধর্মী পোষ্ট দিলেই ভালো হতো, এখন এটাকে বিজ্ঞাপন বলে মনে হয়। তাছাড়া একসাথে এতগুলো কবিতা পোষ্টের সাইজকে পাঠকের অগম্য করে দেয়। আশা করি বুঝবেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নতুন মন্তব্য করুন