জালাল মাষ্টরের ছিল তিন মেয়ে এক ছেলে। স্কুল মাঠের এক প্রান্তে, স্কুল কতৃপক্ষেরই বানানো বাড়িটাতে পাঁচ জনের সংসার চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হতো। ছেলে মেয়েরা সবাই স্কুল-কলেজে পড়ে। বড় মেয়েটা ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে, তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছে। বাকিরা এখনও স্কুলে পড়ে। স্বভাবতই শুধু স্কুলের বেতনে সংসার চালানো ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। সবার পড়ার খরচ দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে নিত্য টানাপেড়ন। মাসের শেষে প্রায়ই ধার-কর্য করতে হতো। তাই জালাল উদ্দিন প্রাইভেট পড়ানো শুরু করে, মানে আর পাঁচজন যেমন করে আরকি। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, তার ছাত্র সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নাজুক। কারন পয়সা দিয়ে কেউ বাংলা, ইংরেজি বা সমাজ বিজ্ঞান পড়তে আসে না। সবাই অংক শিখতেই প্রাইভেট মাষ্টার রাখে, সাথে বোনাস হিসেবে পায় ইংরেজী আর বিজ্ঞানের তালিম। তাই জালাল মাষ্টর প্রাইভেটে অংকওপড়ান শুরু করল। আর্টসের শিক্ষক হয়েও জালাল উদ্দিন কিভাবে অঙ্কের মাষ্টার হিসেবে পরিচিত হল সেটা না বললেই নয়।
জালাল মাষ্টর আর্টসের শিক্ষক ছিল বিধায় স্কুলে বাংলা, ইংরেজী, সমাজ অথবা কখনও কখনও ইসলাম ধর্ম পড়াত। কিন্তু একবার স্কুলের একমাত্র বিএসসি শিক্ষক সন্তোশ বাবু বদলি হয়ে যাওয়ায়, তাকে অংকও শেখাতে হয় নিচের ক্লাসে। সেই সুযোগেই জালাল উদ্দিন প্রথম অঙ্কের প্রাইভেট পড়ানোর ঘোষনা দেয়। ব্যাপারটা আসলে এত দ্রুত ঘটেনি। ঠিকাছে খোলাসা করেই বলছি। রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে বিএসসি শিক্ষক ছিলেননা প্রায় এক বছর। এই সুযোগে অনেকেই সন্তোশ বাবুর ছাত্রদের ভাগিয়ে নিতে শুরু করে। স্কুলেরই মধু বাবু, হারাধন বাবু কিংবা পাইলট স্কুলের ইসমাইল মাষ্টর ছিলেন সবার আগে। এর আগে শহরের একমাত্র বিএসসি শিক্ষক হিসেবে সন্তোশ বাবুর ছিল একচেটিয়া আধিপত্য। শহরের দুইটি হাইস্কুল আর একটি পাইলট স্কুলের উপরের ক্লাসের ছাত্রদের অংক-বিজ্ঞান শেখাবার অঘোষিত সৌল এজেন্ট ছিলেন সন্তোশ বাবু। কিন্তু হঠাত উনার ষ্ট্যান্ড রিলিজের ঘটনায় তাঁর কাছে পড়তে আসা ছাত্ররা একটু বেগতিক অবস্থায় পড়ে। তারা তখন ক্লাসে ক্লাসে যে শিক্ষকরা অংক জানে বলে বিজ্ঞাপন দেয় তাদের কাছে ছুটে যেতে বাধ্য হয়। জালাল মাষ্টর প্রথমে একটু ইতস্তত করে, এইসব বিজ্ঞাপনের ঝাঁকের কই হতে লজ্জা পায়। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত তার দৈনিক দশ লিটার দুধ দেয়া গাভীটা সাপের কামড়ে মারা গেলে এবং বাড়ীর পেছনের জমিতে লাগানো ঢেঁড়সের ক্ষেতে পোকা হলে জালাল উদ্দিন মনে মনে বলল, "জান বাঁচানো ফরজ"। সেই থেকেই শুরু।
অবশ্য সেই থেকে আরও একটা জিনিষের শুরু। সেটা হল জালাল মাষ্টর, মধু বাবু আর হারাধন বাবু এই তিন জনের মধ্যে একটা কোল্ড ওয়ার মানে শীতল যুদ্ধ। অন্য স্কুলের হওয়ায় ইসমাইল মাষ্টর এই যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেল। বাকি তিন জন যুদ্ধ চালিয়ে গেল। এ যুদ্ধ সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারার যুদ্ধ, এ যুদ্ধ ছোট্ট এই শহরটাতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ, এ যুদ্ধ নিজের ইজ্জতের যুদ্ধও বটে। একই স্কুলে পড়িয়ে মধু বাবুর যখন সকাল-বিকাল পাঁচ ব্যাচেও ছাত্র সংকুলান হয় না, হারাধন বাবুর এটা মোটেও সহ্য হয় না যে কেন তার মাত্র চার ব্যাচ ছাত্র। ওদিকে জালাল মাষ্টরের অবস্থা তো আরও খারাপ। অন্যরা যখন ছাত্র পড়াতে আলাদা বাসা ভাড়া নিতে হয়, সেখানে তার বসার ঘরটাও ভর্তি হয় না। তার সাকুল্যে দুই ব্যাচ ছাত্র আর রাতের বেলায় ইসহাক সদাগরের মেয়েকে পড়াতে হয় বাসায় গিয়ে।
এভাবেই চলছিল অনেকদিন এবং ভালই চলছিল। কিন্তু বড় মেয়ে লুতফার বিয়ের জন্য জালাল মাষ্টরের আরও টাকার দরকার পড়ে। সে টাকা কিভাবে আসবে তার কোন কূল পাওয়া যায়না। মাসের পর মাস নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়ে, নানা জনের সাথে পরামর্শ করেও যখন কোন কিছু হয় না, তখন জালাল মাষ্টর ঘোষনাটা দেয়। সেই ঘোষনা বোমার মত শহর কাঁপিয়ে দেয়। বাজারের চায়ের দোকানে আর বেকারদের আড্ডায় অবশ্যম্ভাবী টপিকে পরিণত হয়। কেউ ছি ছি করে, কেউ মুক্ত বাজার অর্থনীতির কথা বলে, কেউ কেউ শুধু সমবেদনার কথা বলে। জালাল মাষ্টরের ক্লাসে দেয়া ঘোষনাটা ছিল এরকম, এখন থেকে তার কাছে প্রাইভেট পড়ার মাসিক বেতন অন্য যে কোন মাষ্টারের থেকে পঞ্চাশ টাকা কম! অন্যরা দু'শ নিলে সে নেবে দেড়শ, অন্যরা যদি দেড়শ নেয়, তাহলে তার রেট একশ!
এই ঘোষনা জালাল মাষ্টরের ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি করে কিনা সেটা দেখার সময় আমরা পাই না। কারন তার আগেই জালাল মাষ্টরের রিলিজ অর্ডার চলে আসে স্কুলে। এর কারন কিন্তু সেই ঘোষনাটা নয়, অথবা ক্লাসে এরকম কিছু বলা যে কোন শিক্ষকের জন্য অপরাধ সেটা হয়তো আইনের কোথাও লেখা নেই। কেন জালাল মাষ্টরের আকস্মিক বদলির আদেশ হয়, আসুন সেটা আমরা বিস্তারিত শুনি।
সেদিন ছিল বৃহস্পতি বার, হাফ স্কুল। জালাল উদ্দিন সকালের ব্যাচের ছাত্রদের পড়িয়ে স্কুলে যাবার জন্য তৈরী হয়। পাকের ঘরে মাটির চুলার ধোঁয়াতে নাজেহাল হতে থাকা লুতফার মা সেসময় তাকে জানায়, নতুন কেনা গাভীটা স্কুলের মাঠে বাঁধা আছে। তিনি যেন স্কুল শুরু হবার আগে সেটিকে বাড়িতে রেখে যান। তো জালাল উদ্দিন তখন গাভীটা আনতে গিয়ে মাঠের আরেক প্রান্তে মধু বাবুকে আসতে দেখে। কম করে হলেও একশ বিশ কেজি ওজনের দশাসই শরীরের মধু বাবু হাঁটার সময় থপ থপ শব্দ হয়। তার ইয়া বড় টাক মাথায় সকালের সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করে ওঠে। দুদিন আগে টিচার্স কমনরুমে হয়ে যাওয়া বাক-বিতন্ডার কথা মনে করে জালাল উদ্দিনের মনটা বিষ বিষ লাগে। সেদিন সবার সামনে এই মধু বাবুই তাকে ছোটলোক, শিক্ষক নামের কলঙ্ক এইগুলো বলে অপমান করেছিল, সেটা কি মরে যাবার আগ পর্যন্ত ভুলতে পারবে? জালাল উদ্দিন অবশ্য তেমন কিছুই বলেনি, শুধু রুম থেকে বের হতে হতে চাপা গলায় বলেছিল "মালাউন কোনখানকার"। এখন যদি ঐ মহিষটাকে মাটিতে ফেলে দু'ঘা লাগাতে পারত তাহলে মনের জ্বালা কিছুটা কমত। কিন্তু স্কুল শুরুর ঘন্টা দিয়ে দিলে গরুটাকে হাট হাট বলে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
অর্ধেক পথ আসতেই দেখে মধু বাবু স্কুলের দিকে না গিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। জালাল উদ্দিনের মনে কেমন যেন সন্দেহ হয়। মধু বাবু কি কিছু বলতে আসছে না কোন ক্যাচাল শুরু করতে, সেটা ভেবে কেমন যেন দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জালাল উদ্দিনের উতকন্ঠা বাড়ার কোন সুযোগই পায়না, যখন দেখা যায় মধু বাবু দৌড়ে এসে জালাল উদ্দিনের মুখে একটা ঘুষি মারে। ঘটনার আকষ্মিকতা হোক অথবা এত বিশাল বপুর ধাক্কায় হোক, জালাল উদ্দিন চিত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, নাক দিয়ে তিরতির করে বেরিয়ে আসে রক্ত। এখানেই শেষ নয় মধু বাবু তখন পুরোপুরি উন্মাদ, জালাল উদ্দিনের বুকের উপর বসে মেরেই চলেছে আথালি পাথালি। এসেম্বলির জন্য জড়ো হওয়া স্কুলের ছাত্ররা তখন মাঠের চারদিকে দাঁড়িয়ে একটা কুৎসিত নাটকের মঞ্চায়ন দেখে।
পুরো ঘটনাটা শিক্ষা অধিদপ্তর, বোর্ড, মন্ত্রনালয় সব জায়গায় আলোড়ন ফেলে দেয়। বড় বড় কর্মকর্তারা রামগড় এবং জেলা সদরের বিভিন্ন স্কুল ভিজিট করেন। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর মফস্বল সংবাদে এই ঘটনা গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। এর মাস খানেক পর জালাল উদ্দিন সহ স্কুলের আরও চারজন শিক্ষকের স্ট্যান্ড রিলিজ অর্ডার আসে। কিন্তু কি অদ্ভুত! শহরের মানুষেরা খুব দ্রুতই তাদের কথা ভুলে যায়। কারন উপর-মহলের নির্দেশে স্কুলে তখন নতুন এগার জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। প্রত্যেকেই সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ফ্রেস গ্রেজুয়েট। রামগড়ের মত এরকম ছোট মফস্বল শহরে এতগুলো তরুন শিক্ষকের আগমনের ঘটনা তখন সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সেই ফাঁকে জালাল মাষ্টরের মেয়ের বিয়ে বা অর্থকষ্টের কথা কারও মনে থাকেনা।
(বাউলিয়ানা)
মন্তব্য
গল্পের ভেতরে গল্প আবার তারভেতরে গল্প বেশ ভাল লাগলো।
গল্পের ভেতরের গল্প ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল
চুপচাপ পড়ে গেলাম.....
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
হুমমম ।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
আচ্ছা..
- এরকম গল্পগুলো বুকের গহীনে সূক্ষ্ণ চিনচিনে ব্যথাটা আরও বাড়িয়ে দেয়।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
চিনচিনে ব্যথাটা বাড়িয়ে দেবার জন্য দুঃখিত ধুগো।
আসলে সেদিন কংচাইরীর লেখাটার মন্তব্যগুলো পড়ে মনে হলো- আমাদের স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের চিত্রটাও একটু বিশদভাবে দেখা উচিত। তাই অভিজ্ঞতা থেকে এই লেখা।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
>>ফ্রেশ
লেখায়
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অনেক চেনা এই দৃশ্যগুলো। ভালো লাগলো। অনেক কথা মনে পড়লো।
-ইকথিয়ান্ডার
ভাল লাগল জেনে ভাল লাগল।
মনে পড়া কথাগুলো লিখে ফেলুননা, আমরাও শুনি।
গল্প:-)
গল্পের এই ধরণটা গল্পকে খুব বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। কোন সত্য ঘটনার বর্ণনার মতো।
বিষয়:-)
বিষয়টা এতো পরিচিত, সেটা নিয়ে লেখার চিন্তাই মাথায় আসে নাই। মাশ্টর আমি নিজেও ছিলাম, হয়তো সে কারণেই। শিক্ষক মানেই তো কতোগুলো চাপিয়ে দেয়া আদর্শের বোঝা পিঠে নিয়ে হাটা গাধা।
বাস্তবতা:-)
জাতীয় বাজেটের তিন শতাংশের নীচে থাকে শিক্ষার ব্যায়। মানুষ গড়ার কারিগররা ভাত না খেয়ে হাওয়া বা জ্ঞান খেয়ে পেট চালাতে পারলে আমরা একটা শিক্ষিত জাতি পেতাম।
স্বাগতম:-)
এতো সুন্দর করে গল্পটা বলার জন্য ধন্যবাদ এবং সচলায়তনে স্বাগতম।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
অনেক ধন্যবাদ পুতুল আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের বাজেট, প্রশাসন ব্যাবস্থাপনা সব মিলিয়ে স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের আরেকটু সচ্ছলতার নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত।
সচলে আমার আগের লেখাগুলো- ১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং ৬
আশা করি শিঘ্রই হাচল হয়ে যাবেন। লেখার ব্যপারে বলি, বর্ণনার ভঙ্গিটা খুবই চমৎকার লেগেছে। লেখাটা এতই ঝরঝরে, কোন ফাকে পড়ে ফেললাম টের ই পেলাম না।
লেখা ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
কষ্ট লাগল ভীষণ।
খুব সুন্দর করে গল্পটা বলেছেন আপনি।
এহহে কষ্ট পাইয়ে দিলাম?
আচ্ছা দেখি আরেকটা লেখা দিয়ে আপনার কষ্ট কিছুটা কমাতে পারি কিনা।
নতুন মন্তব্য করুন