ঘাড় লম্বা করে মাথাটা ঝাঁকালো কয়েকবার। হাত দুয়েক পিছিয়ে গেল, হঠাৎ সামনে এগিয়ে এসে দুম করে গুঁতো লাগিয়ে দিলো বয়স্ক মানুষটার গায়ে। আহ! করে কাতরিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক, বয়স হয়েছে অনেক; একটা রাগী ষাঁড় সামলানোর ধৈর্য বা শক্তি কোনটাই নেই এখন তাঁর। একটা দড়ি ধরা ছিলো হাতে, ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে এসে লম্বা ছুরিটা হাতে তুলে নিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের লোকটার উপর রাগ ঝাড়লেন কিছুক্ষন, ছুরিতে ধার ঠিকমত দেয় নাই কেন......সব অকম্মার ধাড়ি......ইত্যাদি ইত্যাদি। এদিকে তখনও ষাঁড়টা প্রচন্ড রাগে দাবড়াচ্ছে, হাঁপিয়ে উঠছে দড়ি ধরা লোকজন।
বাবা একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আর এইসব দেখছে। আর আমি ক্ষুধার্ত ফুসফুসে বিরক্ত হচ্ছি বারবার; এইমুহূর্তে সিগারেট খাওয়া খুবই দরকার। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“যাও হাত লাগাও। এত বড় ছেলে দাঁড়িয়ে আছ কেন??” আমি পাঞ্জাবির পকেটে সিগারেটের প্যাকেটটায় হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম। ব্যাপারটা এতক্ষণে ধস্তাঃধস্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে প্রায়। ষাঁড়টাও হাঁপিয়ে উঠেছে, চকচক করছে খয়েরী রংয়ের শরীরটা। খানিক শংকা নিয়েই মাটিতে পড়ে থাকা দড়িটা তুলে হাতে নিলাম। কতখানি শক্তি খরচ করে টানাহেঁচড়া করা লাগবে ভাবছি, ষাঁড়টা মাথা নিচু করে দাপাদাপি থামিয়ে দিলো। এরপর এগিয়ে এসে শুঁকতে লাগলো আমার পাঞ্জাবীর হাতা। ব্যাপার কি? ব্যাটা গোল্ডলিফের গন্ধ পেয়েছে নাকি! ব্যাপার খেয়াল করে বয়স্ক লোকটা বলে উঠলেন,
“ভাইস্তা, দাঁড়ায়ে থাকো ত চুপচাপ। তোমারে দেখে শালা ক্ষ্যাপে না দেখি! ...........ওই তাড়াতাড়ি কর তোরা...সারাদিন দাঁড়ায়ে থাকবি নাকি??”।
আমি মোটামুটি বোকা বনে দাঁড়িয়ে থাকলাম; এতগুলো কুরবানীর ঈদ পার করলাম, এইরকম কিছু হয়নি কখনও। এদিকে উপস্থিতদের কয়েকজন ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবার; ষাঁড়টার পেটের উপর দিয়ে দড়ি ছুঁড়ে দিলো; অদ্ভুত কায়দায় দড়িটা পেঁচিয়ে আনলো পায়ের চারপাশ দিয়ে। তারপর গায়ের জোরে টান দিলো সবাই। কাজ হল এতে। মাটি কাঁপিয়ে সশব্দে কাত হয়ে পড়ল প্রাণীটা। দ্রুত তার পেটের উপর চেপে বসল কয়েকজন। বয়স্ক লোকটা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন, দ্রুত দোয়া পড়ে নিলেন। এরপর সর্বশক্তিতে দুহাতে চালালেন লম্বা ছুরিটা ষাঁড়ের গলার উপর দিয়ে। থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো প্রাণীটার পুরো শরীর, রক্ত ছিটে এসে লাগলো আমার পাঞ্জাবীটায়। আর আমি বিরক্তমুখে মাথা নাড়লাম; শালার দিনটাই মাটি আমার। ৮০০ টাকায় আড়ংয়ের পাঞ্জাবী আর পাওয়া যায় না। এক বছর হল কিনেছি, পরাই হয় নাই। আর এই কুরবানী, মাত্র তিন মিনিটের ব্যাপার পুরোটাই; তাও আমারে নামিয়ে ছাড়ল।
ঠিক তখনই আমার দৃষ্টি আটকে গেলো মৃত ষাঁড়টার চোখে। দৃষ্টি এখনও মরে নি, কি এক ব্যাকুলতায় উজ্জ্বল হয়ে এখনও। আমাকে দেখে দাপাদাপি থামানোর পর থেকে যেন ওই দৃষ্টি ছিলো বড় বড় চোখগুলোয়। তাই এইটা দেখে মারাত্মক অশান্তিতে পড়লাম আমি এবং ঠা ঠা রোদে আমার মাথায় চেপে বসল নান্দনিকতার ভুত। গদ্যকবিতায় হিসেব মেলানো শুরু করে দিলাম তখনই আর............
চিন্তায় ছেদ পড়ল কারো গলা শুনে।
“ছুরি কি এইটায় হবে, না আরো ছোট লাগবে?”
“নাহ, ঠিক আছে এইটা।” ছুরিটা হাতে নিয়ে খানিক স্বস্তি বোধ করলাম আমি। ভুতটা গায়েব হয়ে গেছে মাথা থেকে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম চামড়া ছিলতে; মাংস আর চর্বির উষ্ণতায় ভুলে গেলাম সময়ের হিসেব।
ঘন্টাখানেক পরে খেয়াল হল আমার। প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, ভেতর প্রায় শুকিয়ে গেছে।
“আব্বা, আমি আসতেছি একটু।” বাবা মাথা নাড়ল। ন্যাকড়াতে হাত কোনমতে মুছে বেরিয়ে আসলাম। তাড়াহুড়োয় ধরাতে গেলাম সিগারেট, তিনটে কাঠি খরচ করতে হল এতে। ভেতর থেকে বয়স্ক গলার আওয়াজ এলো,
“ছেলে তো দেখি বাপের মতই সিগারেট খায়।”
“কি আর করব ভাই বলেন! বড় হয়ে গেছে না এখন!” বাবার হাসি মেশানো গলা শুনি। সরে আসি ওখান থেকে। হাতে লেগে থাকা চর্বির তীব্র পিচ্ছিল গন্ধ উপেক্ষা করে তেতো ধোঁয়া টেনে নেই বুকে। থুতু ফেলি রাস্তার পাশে।
রোদের তীব্রতা বাড়ে। মাথার ভেতর মুচকি হাসে পুরনো ভুত; জেগে উঠেছে সে সিয়ারেটের ধোঁয়ায়। আমি নতুন করে হিসেব মেলাই......
---------------------------------------------------------------------------------------
ইকারুসের আকাশ
মন্তব্য
সুন্দর গল্প। টানা লেখা। জড়তা নেই। ভালো লাগলো।
মর্ম
বহুদিন পরে গল্প লেখার চেষ্টা করলাম। আন্দাজ ছিলো ফালতু হবে।
ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ।
-ইকারুসের আকাশ
ভীষণ ভালো একটা গল্প।
একটা চিনচিনে কষ্ট মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে কোথায় যেন।
আমরা কত নিস্পৃহ !
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
কারো মন খারাপ করে দিতে চাই নি। মনে পড়ায় লিখে ফেললাম।
আর আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুবই খুশি হলাম।
-ইকারুসের আকাশ
ভালো লাগলো
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ছোট কিন্তু খুশি করে দেয়ার মত কমেন্ট!!!!
-ইকারুসের আকাশ
খুব ভালো লাগলো। নির্মোহ বয়ানে একজন কবির শব্দচাষ। বেশ কঠিন!
______________
বিধিবদ্ধ পংকিলতা।
জীবন বাবু,তাঁর কবিতা।
তৃপ্তিদায়ী আত্মশ্লাঘা।
এবং এ রাতজাগা।
______________
ভাল লেগেছে।
আরও লিখুন। স্মৃতিচারন হলে তা-ই লিখুন না, গল্পই যে বানাতে হবে তেমনতো কথা নেই।
ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ। আর আপনার পরামর্শ মেনে নিলাম। তবে শুধু স্মৃতিচারণ করতে গেলে বেশি আত্মবিশ্বাস পাই না, তাই গল্পের ট্যাগটা লাগিয়ে দিয়েছিলাম।
-ইকারুসের আকাশ
ভাল্লাগলো ।
ধন্যবাদ আপনাকে।
খুব ভাল লাগল গল্পটা। ছবিগুলো স্পষ্ট কল্পনা করা যাচ্ছিল- ষাঁড়টার ধস্তাধস্তিতে ক্লান্ত মানুষগুলোর ঘাম, মৃত প্রাণিটার চোখ... নির্মোহ, নিস্তেজ নয় লেখকের বয়ান। তবে ষাড়টা কেন ওরকম আচরণ করল সে সম্বন্ধে হাল্কা ধারণা পেলে গল্পে একটা অন্য মাত্রা যোগ হতে পারত।
গল্পটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুবই খুশি হলাম। ষাঁড়ের ওইরকম আচরণের কারণটা এভাবে বললে কেমন হয়?
... চারপাশে ব্যাপহারে কুরবানী চলছে, অন্য গরুগুলোর আর্তনাদ, জবাই দেবার পর দু'ভাগ শ্বাসনালীর তীব্র ঘড়ঘড় আওয়াজ, ছুরি হাতে দাঁড়ানো লোকজন, টানাহেঁচড়া............প্রাণীটার ভয় পাবার জন্য যথেষ্ট তো নাকি!
-ইকারুসের আকাশ
ষাড়টা কেন ওরকম আচরণ করল তা আমিও জানিনা।
ভালোলাগার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ভাল্লাগছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনাকে ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন