মাসুম

মহাস্থবির জাতক এর ছবি
লিখেছেন মহাস্থবির জাতক (তারিখ: বুধ, ৩১/০৩/২০১০ - ৮:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“তোর জঙ্গলে একটা বুনো জানোয়ার আছে”, বললো ছবি-আঁকিয়ে জিহান করিম, তাকে তখন স্টেশনে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পুরো রাস্তাটা জুড়ে এই একটা বাক্যই সে উচ্চারণ করলো, কিন্তু যেহেতু অরণ্য অবিরাম বকবক করেই যাচ্ছিলো, তাই তার সঙ্গীর নীরবতা তেমন একটা নজরে পড়ে নি।

“ছুটকো দু’একটা শেয়াল আর গন্ডাখানেক ভাড়াটে বেজি, এর চেয়ে বেশি হিংস্র আর কিছু নেই,” অরণ্য বললো। আঁকিয়ে বললো না কিছুই।

“বুনো জানোয়ার বলতে কী মিন করছিস রে?”

“কিছু না। আমার কল্পনা। ওই যে ট্রেন চলে এলো,” জিহান বললো।

ওই বিকেলে অরণ্য তার বনের সম্পত্তিতে লাগামহীন ঘোরাঘুরিতে বেরুলো। তার পড়ার ঘরে একটা স্টাফড পিউ-কাঁহা, আর বেশ ক’টা বনফুলের নামও জানে সে, তাই তার ফুফু যে তাকে বিশাল প্রকৃতিবিদ মনে করেন এবং বলে বেড়ান তার কিছুটা সত্যতা তো আছে। আর যাই হোক, সে হাঁটতে পারে বেশ। চলতিপথে যা চোখে পড়ে সব কিছু মনে মনে টুকে-নেওয়া তার স্বভাব, যতটা না আধুনিক বিজ্ঞানের প্রসারের ইচ্ছেয়, তার চে’ অনেক বেশি ভবিষ্যতে কথা-বলার বিষয় খুঁজে পেতে। যখন নীল অপরাজিতার ঝাড়ে ফুল এলো সে সবাইকে ব্যাপারটা জানিয়েই ছাড়লো; তার শ্রোতাদের হয়তো মওসুম ঘটনাটার ব্যাপারে আগেই সতর্ক করেছিলো, কিন্তু সবাই বুঝলো যে সে খুব দিল খুলে কথা বলতে ভালোবাসে।

সেই বিকেলে অবশ্য অরণ্য এমন কিছু দেখলো যা তার এতাবৎকালের অভিজ্ঞতা থেকে বেশ অন্যরকমের। একটা ছোট জলাশয়ের ওপর ঝুলে থাকা একসারি মসৃণ পাথরের ওপরকার একটা শালগাছের কোটরে বছর ষোল-এর একটা ছেলে শোয়া, রোদে আরামসে শুকিয়ে নিচ্ছে তার ভেজা বাদামি হাত-পাগুলো। অল্প কিছু আগেই সে জল ছেড়ে উঠেছে, চুলগুলো এখনো পাট-করা আর তার হাল্কা বাদামি চোখ, এতোই লঘু যেন একটা বাঘসুলভ ঝিলিক চোখে পড়ে, অরণ্যের দিকে সতর্কতার সাথে তাক-করা। অপ্রত্যাশিত এই আবির্ভাব, আর অরণ্যের মনে হলো তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করছে সে এখন, ভাবছে কথা বলার আগে। কোন গ্রহ থেকে এই বুনো ছেলেটার উদয় হলো? মাস দু'য়েক আগে ধোপার বৌয়ের একটা বাচ্চা খোয়া গেছে বটে, ধরে নেওয়া হয় জলে ভেসে গেছে, কিন্তু ওটা নেহাৎ ছোট্টো ছিলো, এমন প্রায়-পূর্ণবয়েসি ছিলো না।

“কী করছো এখানে?” অরণ্যের ডাক।

“দেখছেন তো, রোদ পোহাচ্ছি,” ছেলেটার জবাব।

“থাকো কোথায়?”

“এই তো, এই বনেই।”

“বনে তো থাকা যায় না,” অরণ্য বলে।

“বনটা বেশ দারুণ,” ছেলেটা জানায়, গলায় পৃষ্ঠপোষকতার আন্তরিক ছোঁয়া।

“কিন্তু রাতে ঘুমাও কোথায়?”

“রাতে ঘুমাই না তো, তখনই তো সবচাইতে ব্যস্ত থাকি।”

অরণ্যের মাথার ভেতরে একটা সাড়া জাগে, যেন একটা সমস্যা ধরি ধরি করেও এড়িয়ে যাচ্ছে।

“খাও কী?” প্রশ্ন অরণ্যের।

“মাংস,” ছেলেটা জানায়, শব্দটা উচ্চারণ করে ধীরে স্বাদ নেওয়ার ভঙ্গিতে, যেন ওটা খাচ্ছে সে এখনই।

“মাংস! কিসের মাংস?”

“জানতেই যখন চাইছেন, খরগোশ, বন-মোরগ, হাঁস-মুরগি, সময় সুযোগে ছাগল-ভেড়া, যদি পাই তাহলে বাচ্চা-টাচ্চা; অবশ্য রাতে যখন আমি শিকারে বেরুই, তাদের বেশ ভালো করে ঘরে আটকে রাখা হয়। বাচ্চার মাংস শেষ খেয়েছি প্রায় মাস দুয়েক হয়।”

শেষ কথাটার ঠাট্টাটা বাদ দিয়ে অরণ্য ছেলেটাকে সম্ভাব্য চোরাশিকারের প্রসঙ্গে টেনে আনতে চাইলো।

“খরগোশ শিকার করবে তুমি? যতসব বাজে কথা।” (অবশ্য ছেলেটার সুরৎ দেখলে মনে হয় কথাটা ঠিক হলেও হতে পারে) “আমাদের পাহাড়ি খরগোশগুলো এতো সহজে ধরা যায় না।”

“রাতে আমি চারপায়ে শিকার করি,” রহস্যময় উত্তর।

“মানে কুকুর নিয়ে বেরোও?” অরণ্য বিভ্রান্ত।

ছেলেটা পিঠে ভর দিয়ে আন্তে করে কিছুটা ওঠে, হাসে এক অদ্ভুত নিচুগলায় যা ভালোভাবে নিলে বিদ্রূপের আর অপছন্দনীয়ভাবে দাঁত-খিঁচানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।

“মনে হয় না কোনো কুকুর আমার সাথে খুব খুশি হয়ে থাকবে, বিশেষত রাতে।”

অরণ্য অনুভব করতে শুরু করে এই অদ্ভুত-চোখ, অদ্ভুত-ভাষী ছেলেটার ভেতর স্পষ্টত অতিপ্রাকৃত কোনো লক্ষণ রয়েছে।

“তোমায় এই জঙ্গলে আমি থাকতে দিতে পারি না,” অরণ্য কর্তৃত্বসুলভ ঘোষণা দেয়।

“আপনার ঘরের চাইতে আমাকে এখানে থাকতে দিলেই মনে হয় আপনার মঙ্গল”, ছেলেটা বলে।

অরণ্যের ফিটফাট গোছানো ঘরে এই বুনো, নগ্ন জন্তুটার আবির্ভাবের সম্ভাবনাটা তার নিজের কাছেই বেশ বেখাপ্পা ঠেকে।

“যদি না যাও, জোর করে ধরে নিয়ে যাবো,” অরণ্য উবাচ।

বিদ্যুৎ খেলে গেলো ছেলেটার মধ্যে, ঝাঁপ দিলো জলে, এবং পলকেই পাড়ের কাছে যেখানে অরণ্য দাঁড়ানো, ভেজা আর চকচকে শরীরে তার অর্ধেকটা পেরিয়ে এলো সে। ভোঁদড়ের জন্যে ব্যাপারটা মামুলি, কিন্তু একটা ছেলের জন্যে, অরণ্য ভাবে, ঘটনাটা অসাধারণ বলতে হয়। নিজে নিজেই তার পা পিছিয়ে আসে আর পিছুতে গিয়ে পড়ে যায় সে। এবং আবিষ্কার করে পিচ্ছিল আগাছাময় পাড়ে সে প্রায় শুয়ে, সেই বাঘ-হলুদ চোখগুলো তার বেশ কাছেই। অবচেতনার তাড়নাতেই তার হাত গলার প্রায় কাছে চলে আসে। ছেলেটা হেসে ওঠে আবার, এমন হাসি যাতে দাঁত-খিঁচানো বিদ্রূপের ভাবকে প্রায় তাড়িয়েছে, আর তখন, আর এক বিজলি-চমকে, নোয়ানো একঝাড় আগাছা আর ফার্নের মাঝ দিয়ে সে ছুটে হারিয়ে যায়।

“কী অস্বাভাবিক বুনো জানোয়ার!” নিজেকে তুলতে তুলতে অরণ্য বলে, আর তার মনে পড়ে যায় জিহানের কথাটা, “তোর জঙ্গলে একটা বুনো জানোয়ার আছে”।

মন্দপায়ে ঘরমুখো হাঁটতে হাঁটতে অরণ্য আশেপাশের কিছু ঘটনা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে যেগুলো হয়তো এই বিস্ময়কর বন্য কিশোরের অস্তিত্বের সন্ধান দেবে।

ইদানীং বনে জন্তু-জানোয়ার কিছুটা কম কম ঠেকে, খামারগুলো থেকে খোয়া যাচ্ছে হাঁস-মুরগি, খরগোশও কমে আসছে বেশ চোখে পড়ার মতো, অভিযোগ আছে ছাগল পাহাড়ে চড়তে-যাওয়ার পর হারিয়ে যাওয়ার। এ কি সম্ভব যে এই জংলি ছোকরা সত্যিই এই এলাকায় একটা চালাক শিকারি কুকুর নিয়ে চোরাশিকার চালিয়ে যাচ্ছে?

রাতে নাকি সে ‘চার পায়ে’ শিকার করে, কিন্তু সে তো এমন একটা অস্বাভাবিক ইঙ্গিতও করেছে যে কোনো কুকুর 'বিশেষত রাতে' তার কাছে আসতে সাহস পাবে না। ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক।

আবার এদিকে গত দু’এক মাসের দু’একটা ঘটনার কথা মনে পড়ায় থেমে যায়-তার হাঁটা এবং চিন্তা দুটোই। দু’মাস আগে ধোপাবাড়ির যে-বাচ্চাটা খোওয়া গেছে, ধরে নেওয়া হয় ওটা পাশের পাহাড়ি খালে উল্টে পড়ে ভেসে গেছে চিরতরে; কিন্তু তার মা সবসময়ই বলে বেড়ায় যে, তার ঘরের যে-দিকে পাহাড়, সে-দিকে একটা চিৎকার সে শুনেছে। খালটা ওটার ঠিক উল্টো দিকে। ভাবা যায় না, কিন্তু অরণ্য প্রাণপণে তার মন থেকে দু’মাস আগের শিশুমাংস-খাওয়া নিয়ে-করা ছেলেটার গা-ছমছমে মন্তব্যটা মুছে ফেলার চেষ্টা চালায়, মজা করেও এমন ভয়ংকর কথা বলা ঠিক না।

নতুন কিছু দেখলে তা নিয়ে বকবক না করে চুপ করে থাকাটা অরণ্যের স্বভাবের সাথে ঠিক মিললো না। মসজিদের উপদেষ্টা আর স্থানীয় সালিশ কমিটিতে বিচারক হিসেবে তার নাম আছে। এধরনের বিচিত্র একটা জীব তার নিজের জঙ্গলে আছে এটা জানার পর তার নিজের অবস্থা কী দাঁড়াবে? এমন সম্ভাবনাও আছে যে চুরি-যাওয়া ছাগল আর হাঁস-মুরগিগুলোর ক্ষতিপূরণের দায় চাপানো হবে তার ওপর। কাজে কাজেই রাতের খাবারের সময় সে রইলো অস্বাভাবিক চুপচাপ।

“তোর কথাবার্তা শুনছি না তো?” তার ফুফু শুধান। “মনে হয় যেন নেকড়ে দেখেছিস?”

পুরনো প্রবাদটার সাথে অরণ্যের তেমন পরিচয় না থাকায় কথাটা তার নেহাৎ বেকুবি মনে হলো; সত্যিই যদি সে তেমন কিছু দেখতো তবে তার জিভের দারুণ ব্যায়াম হতো সন্দেহ কী!

পরদিন সকালে নাস্তার সময় অরণ্য টের পায় গতদিনের ঘটনায় জন্ম-নেওয়া তার অস্বস্তি পুরোপুরি উবে যায় নি, ভাবলো ট্রেন ধরে যায় কিছুদূরের শহরটায়, খুঁজে বের করে জিহান-কে, জিজ্ঞেস করে ঠিক কী দেখে সে বললো যে তার জঙ্গলে বুনো জন্তু আছে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে কিছুটা, একটা পছন্দের সুরে শিস দিতে দিতে সে সকালের সিগ্রেট-টা ধরাতে ঢোকে ড্রয়িংরুমে। ঘরে ঢুকতেই তার শিসের সুর হঠাৎ থমকে যায়। সোফার ওপর প্রায় শোয়ার ভঙ্গিতে বনের সেই ছেলেটা। অরণ্য তাকে শেষবার যখন দেখে সেসময়ের মতো সে এখন ভেজা নয়, কিন্তু আর কোনো পরিবর্তন অরণ্যের নজরে আসে না।

“এতো বড় সাহস? আমার এখানে এসেছো?” বেশ রেগে ওঠে অরণ্য।

“আপনিই তো জঙ্গলে থাকতে মানা করলেন,” শান্তভাবে ছেলেটা জানায়।

“কিন্তু এখানে আসতে বলি নি। যদি আমার ফুফু দেখে ফেলেন!”

আর আসন্ন দুর্যোগ যতদূর সম্ভব কমাতে অরণ্য দ্রুত হাতে 'ভোরের ডাক' পত্রিকার ভাঁজ খুলে তাকে মোটামুটি ঢেকে দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরে ঢোকেন ফুফু।

“বেচারা ছেলেটা পথ হারিয়ে ফেলেছে; আর ওর কিছু মনেও পড়ছে না। সে যে কে আর কোত্থেকে এসেছে, তাও ওর মনে নেই।” অরণ্য তড়িঘড়ি করে বোঝায়। এক ফাঁকে তাকায় ছেলেটা আবার তার বুনো স্বভাবের কিছু দেখিয়ে ফেললো কি না বুঝতে।

ফুফু খুব আগ্রহ বোধ করেন।

“ওর জামায় হয়তো কোনো কাগজ-টাগজ আছে,” তিনি খুঁজতে চান।

“ওসবও ওর কিছু নেই,” কথার সাথে সাথে চটপট হাত চালিয়ে পত্রিকার কাগজগুলো যথাস্থানে রাখার চেষ্টা চালায় সে।

কোনো ঘরছাড়া বেড়ালছানা কিংবা রাস্তার কুকুরছানা যেমন আদর পেতো তেমনি আন্তরিকতায় ফুফু এই ন্যাংটো উদ্বাস্তুটাকে অভ্যর্থনা জানান।

“ওর জন্যে যা কিছু করা দরকার সবই করবো”, তাঁর সিদ্ধান্ত। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই একটা চাকর নিয়ে আসে এক প্রস্থ কাপড়। শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি সব ধোয়া, শুকানো আর পরিপাটি। অরণ্যের চোখে ছেলেটার অস্বাভাবিকতা কিছুমাত্র কমে না, কিন্তু ফুফুর চোখে সে আদুরে হয়ে ওঠে।

“ওর পরিচয় পুরো না জানা পর্যন্ত কিছু একটা নামে ওকে ডাকা যায়,” তিনি বলেন, “মাসুম রহমান, বেশ ভালো মানায় না নামটা?”

অরণ্য সায় দেয়, কিন্তু মনে তার সন্দেহ, বোধহয় ঠিক নিষ্পাপ আদুরে কোনো বাচ্চা তাদের ঘরে ডেরা গাড়ে নি। তার কুটিল এই সংশয় মোটেও কমে না যখন দেখা যায় ছেলেটার আবির্ভাবের প্রায় সাথে সাথেই তার গোমড়ামুখো বুড়ো স্প্যানিয়েলটা ছিটকে যায় ঘরের বাইরে এবং এই মুহূর্তে বাগানের এককোনায় গুঁজে সে একগুঁয়েভাবে কাঁপছে আর কাতরাচ্ছে। সাধারণত অরণ্যের মতোই ফুর্তিবাজ বকিয়ে টিয়েটা ভয়ার্ত গলায় স্রেফ দু’চারবার কিচিরমিচির করে। আর তার মনে হয় একটা মুহূর্তও নষ্ট না করে জিহানের সাথে দেখা করার এখনই সময়।

সে যখন ছুটছে স্টেশন-মুখো হয়ে তখন তার ফুফু তাঁর স্কুলের বাচ্চাদের বিকেলে বাসায় দাওয়াতের ব্যাপারে মাসুম-কে জড়িয়ে ফেলছেন।

জিহান প্রথমত মুখ খুলতেই চায় না।

“মা মাথার কোনো একটা সমস্যায় মারা যান,” সে ব্যাখ্যা করে, “বুঝছিস তো, এজন্যে আমি খুব অস্বাভাবিক কিছু দেখলে বা দেখেছি বলে ভাবলে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই না।”

“কিন্তু তুই দেখলিটা কী?” অরণ্য চাপ দেয়।

“যা দেখেছি বলে ভেবেছি সেটা এতটাই অস্বাভাবিক যে কোনো সুস্থ মানুষ ঘটনাটা ঘটেছে বলেই বিশ্বাস করবে না। গত সন্ধ্যেয় তোর সাথে যখন ছিলাম তখন বাগানের দরজায় ঝোপঝাড়গুলোর একটু আড়াল থেকে সূর্যাস্তের চুরি-যাওয়া আলোর খেলা দেখছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ন্যাংটো ছেলে, মনে হলো আশেপাশের কোনো একটা ডোবা-টোবা থেকে স্নান করে উঠেছে। দেখি একটা খোলা টিলার ওপরে সে-ও সূর্যাস্ত দেখছে। ওকে দেখে রীতিমত বন্যদেবতার মতো লাগছিলো, তাই ভাবছিলাম ওকে মডেল বানাবো। আর একটু হলেই ওকে ডাকতে যাবো, কিন্তু ঠিক তক্ষুনি সূর্য চোখের আড়ালে চলে গেলো, আর চারদিকের ল্যান্ডস্কেপ থেকে কমলা আর গোলাপি সব রঙ মুছে গেলো, পুরোটা ঠান্ডা আর ধূসর এখন। আর ঠিক তখনই দারুণ একটা অবাক-করা ব্যাপার ঘটলো, উধাও হয়ে গেলো ছেলেটাও!”

“মানে! একবারে গায়েব হয়ে গেলো?” উত্তেজনা-ভরা গলায় অরণ্যের প্রশ্ন।

“না! সবচাইতে ভয়ঙ্কর দিক এটাই,” চিত্রীর জবাব, “এক সেকেন্ড আগে খোলা টিলার ঠিক যে-জায়গাটায় ছেলেটা দাঁড়িয়েছিলো, সেখানে এখন বিরাট একটা নেকড়ে, রঙ কালচে, ঝকঝকে খিঁচানো দাঁত আর হিংস্র, হলুদ চোখ। দেখে তোর মনে হবে...”

কিন্তু অরণ্য কিছু মনে করে আর সময় নষ্ট করতে চায় না। তুমুল বেগে চারপাশ চিরে সে ছুটে চলেছে স্টেশনের দিকে। টেলিগ্রামের চিন্তা বাতিল। “মাসুম একটা নেকড়ে-মানব”-এটা পাঠালে পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর রূপ নেবে, আর ফুফু ভাববেন এটা কোনো গোপন সংকেত যার সমাধানটা দিতে অরণ্য ভুলেছে। একটাই শুধু আশা যে সূর্য ডোবার আগেই সে পৌঁছাচ্ছে। রেলপথের যাত্রা শেষ করে যে-ট্যাক্সিতে করে সে পৌঁছাবে ঘরে, মেঠো রাস্তায় তার গতি যেন বড্ড শ্লথ, আর সে-রাস্তা এখন অস্তগামী সূর্যের আলোয় গোলাপি এবং নীললোহিত। ঘরে পৌঁছে দেখলো রোদ পড়ে আসায় ফুফু কিছু আচারের বোতল তুলে রাখছেন আলমিরায়।

“মাসুম কই?” প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো সে।

“ওই তুপি, রায়হান-দের বাচ্চাটা আর কি, ওকে ঘরে পৌঁছে দিতে গেছে,” ফুফু জানান। “অনেক দেরি হয়ে গেলো তো, তাই ওকে একা ছাড়াটা নিরাপদ ভাবলাম না। সূর্যাস্তটা কী দারুণ, না রে?”

কিন্তু অরণ্য পশ্চিম আকাশের বর্ণচ্ছটা দেখলেও খেয়াল করছিলো না তার সৌন্দর্য। প্রচণ্ড জোরে রায়হান-দের ঘরের সরু পথটায় ছুটলো সে। পথের একদিকে পাহাড়ি খালের তীব্র স্রোত, অন্যদিকে পাহাড়ের নগ্ন খাড়া গা উঠে গেছে আকাশে। লাল সূর্যের ক্ষীণ আলো এখনো দিগন্তরেখায়, আর মোড়টা ঘুরলেই বুঝি চোখে পড়বে ওই শয়তানওয়ালা জুটি যাদের খোঁজে সে ছুটেছে এতদূর। তারপরেই হঠাৎ করে মুছে গেলো সব রঙ আর চারপাশের প্রকৃতিতে আচমকা শিউরে-ওঠা একটা ধূসর আলো এলো নেমে। অরণ্যের কানে এলো ভয়ের একটা তীব্র, তীক্ষ্ম চিৎকার, আর সে থামিয়ে দিলো দৌড়।

এরপর কোনোদিনই আর তুপি কিংবা মাসুমের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। তবে মাসুমের ফেলে-যাওয়া কাপড় পাওয়া গিয়েছিলো রাস্তায়। মনে করা হয় তুপি যখন জলে পড়ে যায় তখন মাসুমও জামা-কাপড় খুলে ঝাঁপ দেয় জলে, বাচ্চাটাকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টায়। অরণ্য এবং আরো ক’জন মজুর-যারা সেসময় ওখানটায় ছিলো-সবাই জানায় যেখানটায় কাপড়গুলো পাওয়া গেছে, তার কাছাকাছিই একটা বাচ্চার চিৎকার তারা শুনেছে। নাজনীন রায়হানের আরো এগারোটা বাচ্চা-কাচ্চা, কাজেই শোক যথাসময়ে অস্তমিত, কিন্তু অরণ্যের ফুফু বড় শোক পেয়েছিলেন তাঁর হারানো পেয়ারের বালকটির কারণে। তাঁর উদ্যোগেই শহরের কমিউনিটি হলের সামনে একটা স্মৃতিফলক স্থাপিত হয়, লেখা ছিলো ওখানেঃ “মাসুম, এক অজানা বালক, অন্যের জন্যে যে নিজের প্রাণ দিয়েছিলো।”

ফুফুর অনেক কাজেই অরণ্য বাধ্য হয়ে সায় দিয়ে যেতো, কিন্তু মাসুম স্মৃতিফলকের জন্যে চাঁদা দিতে সে সরাসরি অস্বীকার করে।

[এইচ. এইচ. মুনরো (সাকি)-র ‘গ্যাব্রিয়েল-এর্নেস্ট’ অবলম্বনে]

---মহাস্থবির জাতক---


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

দারুণ অনুবাদ, এবং এই বাবদ একটা অসাধারণ আগে না পড়া গল্প পড়া হয়ে গেলো, এ জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, আপনাকেও। আমিও মূলত পাঠক, কিন্তু সচলে এসে ঠকে গেলাম আপনার কাছে রে ভাই!!!

সবজান্তা এর ছবি

আরে ! চমৎকার !

চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো। গল্পটা দারুণ। সাকির গল্প আমার কাছে দারুণ লাগে। আপনার অনুবাদটাও বেশ ভালো লাগলো।

আপনার অনুবাদ দেখে মনে পড়লো, অনেকদিন আগে সাকি'র মিসেস প্যাকেল্টাইড'স টাইগার অনুবাদ করেছিলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম সেই গল্পটার কথা হাসি


অলমিতি বিস্তারেণ

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুবাদ ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো।

আপনার অনুবাদটাও দিয়ে দিন না। ওটা আমাদের উচ্চ মাধ্যমিকের ইংরেজি বইটাতে ছিল। শেষ লাইনটার অনুবাদ কী করলেন? (Incidental expenses are heavy) এই রকম ছিল না বাক্যটা?

শিব্রাম সাকির 'ডাস্ক'টা অনুবাদ করেছিলেন, তবে নিজের মতো করে এবং সঙ্গে আরো কিছু জুড়ে দিয়ে। পড়েছিলেন কি?

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

অনুবাদ ভালো লাগ্লো। এই গল্পের অনুবাদ অবশ্য আগে রহস্যপত্রিকায় পড়েছি, সেটার নাম কী ছিলো ,মনে নেই...

_________________________________________

সেরিওজা

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

গল্পটার নাম গ্যাব্রিয়েল আর্নেস্ট-ই ছিলো। খুঁজে পেলাম একটা পুরোনো ভৌতিক বিদেশী গল্পের অনুবাদ সংকলনে...

_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

সম্ভবত আমিও ওই বইতেই অনুবাদটা পড়েছিলাম। বইটা কলকাতা থেকে প্রকাশিত ছিল। সাকি আমার আগে থেকেই পছন্দের গল্পকারদের একজন। বালকবেলায় 'চিল্ড্রেন্স ক্লাসিকস' নামের একটা বইয়ে প্রথম সাকির লেখা পড়ে মুগ্ধ হই। এরপর, অন্যত্রও।
পরে কলকাতা থেকে সাকিসমগ্র (সব ছোট গল্প আর উপন্যাস) আনাই। ওটা থেকেই অনুবাদটা করা।

ভাল লেগেছে জেনে ধন্যবাদ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গল্পটা দারুণ। অনেক ধন্যবাদ। আরো অনুবাদ চাই।
কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে নামগুলোর বাঙ্গালিকরণ বা মসজিদ টেনে না আনলেও চলতো। বিদেশী স্থান কাল পাত্র দিয়ে পড়তেই মনে হয় বেশি আরাম হতো। এখন একটু বেখাপ্পা লাগছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

এই একটু সাবলীল বা চেনা জায়গায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা আর কি।

যেহেতু আপনার কাছে বেখাপ্পা লেগেছে, তাই আরো কষ্ট করতে হবে বুঝতে পারছি।

পড়ার এবং মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।

তিথীডোর এর ছবি

হে কলেজমেট, দূর্দান্ত হইয়াছে...
চলুক
লেখককে শিগগির হাচলত্ব প্রদানের দাবি জানাই!

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

হে অকলেজমেট, 'দুর্দান্ত' বানান ভ্রেম হইয়াছে।

ধন্যবাদ, (একটা দীর্ঘশ্বাসের ইমো), কেউ তো বললো, যদিও ভুল করে (কান্নার ইমো...)

তিথীডোর এর ছবি

অকলেজমেট!
এক্স মহসিন নন তবে? থুক্কু..

"ভ্রেম" ??
চেকার তো দূর্দান্তই দেখাচ্ছে,
ঠিক হ্যায়, আরেকটু খুঁজে দেখি..

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুবাদ পড়ায় বেশ খুঁতখুঁত না করে পারিনা এবং ভালো না লাগলে পড়িও না।
আপনার গল্পটা পড়ে ফেললাম। হাসি

মর্ম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।