কার্জন হলের সাদা বিল্ডিংয়ের পাশ থেকে ছয়-সাতটা কুকুরের বাচ্চাকে উঁকি দিতে দেখলাম। প্রত্যেকেই নাদুস নুদুস। বাবা কুকুর আর মা কুকুর তাদের নিয়ে আশপাশটা চেনাতে বের হয়েছে। বাবা কুকুরটা শক্তপোক্ত চেহারার। মা টাকে কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তাদের দুজনকে লাগছে হ্যামিলনের বাশিঁওয়ালার মত। হিমেল আর আমি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে তাদের শোভাযাত্রা উপভোগ করছি আর চানাচুর খাচ্ছি। আমাদের দুই বন্ধুর একটা ব্যাপারে খুব মিল। তেলাপোকা, মাকরশা, ছ্যাঙ্গা, বিছা ইত্যাদি কিছু পোকামাকড় ছাড়া প্রানীজগতের বাকি সদস্যদের প্রতি আমাদের গভীর ভালবাসা কাজ করে। একবার নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে গিয়ে আমরা একবার নীলচোখের একটা বিড়াল ছানা কুড়িয়ে পেলাম। কেউ তাকে নিয়ে খুব একটা চিন্তিত না। কেউ মালিকানাও দাবি করল না। এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম এর বাবা-মাকে কেউ দেখেছে কিনা। সে অত্যন্ত অনিচ্ছাভরে উত্তর দিলো, “মনে কয়, মাও-বাপ ফালায় গ্যাছে গা, আবার মইরাও যাইতে পারে, কিসুই কইতে পারি না”। যদি নাই কইতে পারেন তাহলে দুই দুইটা হাইপোথিসিস দিলেন ক্যান, পিথাগোরাস সাহেব?? যত্তসব! মনে মনে বললাম আর কি কথাগুলি। বিড়ালটাকে সাথে নিয়ে এসছিলাম আমরা। আমার পাড়ার দারোয়ান তাকে খাবার দাবার দিবে এরকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কয়েকদিন পর কাঁটাবনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, দেখি বিড়ালটা কাচুমাচু হয়ে ছোট একটা খাঁচায় বসে আছে। মানুষ কেমন। সব বেচে দিতে চায়। ভারী মন নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম সেদিন।
বাদামী রঙের বাচ্চাটাকে দলছুট হয়ে যেতে দেখলাম। ভয় পাওয়া চেহারা নিয়ে সে রাস্তার পাশের ঢালু জায়গাটায় আশ্রয় নিয়েছে। হুশহাশ করে কয়েকটা গাড়ি চলে গেল। বাচ্চাটা কেঁপে উঠল। রাস্তাঘাটের ব্যস্ততার সাথে সে পরিচিত না। রিকশা বা গাড়ির তলে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যেতে পারে। চিন্তা করে শিউরে উঠলাম। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে। চিন্তাটা হিমেল আর আমার মধ্যে একই সাথে কাজ করল। কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। তাকে কেমন করে ধরব এটা একটা সমস্যা। কামড় দিয়ে দিতে পারে। পোষা বিড়ালের আঁচড় খেয়ে পাঁচটা ইনজেকশন নিয়ে বাঁকা হয়ে পড়ে থাকতে হয়েছে গত বছর। আর কয়েকদিন আগে ল্যাবে ইঁদুরের উপর এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে মারাত্মক কামড় খেয়েছি। সুতরাং কুকুর শিশু উদ্ধারের মহান দায়িত্ব একা হিমেলকে কাঁধে নিতে হবে। হিমেল উবু হয়ে ওড়না হাতে পেঁচিয়ে বাচ্চাটাকে ধরতে গেল এমন সময় কোত্থেকে এক লোক ছুটে এসে বলল, “কাঁটাবনে নিতে পারলে এক্কেরে পাঁশশো”। দারোয়ান কিংবা মালি হবে হয় তো। ব্যাটা কি আশা করে আমরা বাচ্চাটা ধরে তার হাতে দিয়ে দিব আর সে কাঁটাবনে বেচে দিয়ে এসে পাঁচশো টাকার হাওয়া খেতে থাকবে? কিছুটা বেপরোয়া হয়ে ছানাটাকে খপ্ করে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিল হিমেল। তার সাহসিকতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কাঁধের ব্যাগটা আমার বাম কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম। সে একটু নির্ভার থাকুক। কুকুরটার চোখেমুখে এখন নিরাপত্তার ছাপ। তার চিন্তা কেটে গেছে। পশুপাখিদের অনুভূতি আমি কিভাবে যেন বুঝতে পারি। খালি মানুষেরটা পারি না। কারণ তারা জটিল প্রানী। যাইহোক, কোলে নেয়াতে বাচ্চাটা একটুও ট্যাঁ ফোঁ করল না। তাকে একটু আদর করে দিলাম মাথায় হাত বুলিয়ে। মখমলের মতো তুলতুলে। পিটপিট করে আবার তাকাচ্ছেও আমার দিকে। মায়ার চোটে আহা উহু করতে করতে হিমেল আর আমি একেবারে কাত। গুলুগুলু বুলুবুলু কত কি যে বলতে থাকলাম। কার্জন হলের লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। আমাদের তাতে খুব একটা কিছু আসে যায় না। জ্যুলজি ডিপার্টমেন্টের পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া জংলা জায়গাটায় ছেড়ে দিয়ে আসলাম তাকে। সেখানে তার আরো কয়েকজন ভাই-বোনের দেখা পাওয়া গেল। আমরা মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে আসলাম। দুজনের মুখে রীতিমত বিজয়ীর হাসি।
হাসিটা মিলিয়ে যাবারও সময় পেল না। হিমেল একটা কুঁইকুঁই শব্দ শুনতে পেল। আমার কানে কিছুই ধরা পড়ল না। আমি সারাজীবনই কানে কম শুনি। ইদানীং সেটা আরো বেড়েছে। কুকুর পরিবারের আরেক নয়া সদস্য ড্রেনে পড়ে গিয়ে কাদঁছে। বোধহয় ‘এ্যারাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ’ এর মতো ‘এ্যারাউন্ড দ্যা কার্জন হল ইন ওয়ান ডে’ টাইপের কোন অ্যাডভেঞ্চারে নেমেছিল। এখন বিরাট ফাঁপড়ে পড়েছে। জাগতিক সব পশুপাখির প্রতি প্রগাঢ় মমতায় আমরা আরেকবার আপ্লুত হলাম। এক টুকরা কাপড় দিয়ে যোগাড় করা হল। সাবধানে দেখে নিলাম ড্রেনের পানি কতটা ময়লা। অবাক ব্যাপার, পানি টলটলে পরিষ্কার। কাপড়টা হিমেলকে দিতেই সে সেটা দিয়ে পেঁচিয়ে বাচ্চটাকে তুলে আনল। তার ধরন-ধারন দেখে মনে হল, প্রায় প্রতিদিনই তাকে দু-চারটা করে কুকুর-বিড়ালের প্রান বাঁচাতে হয় এবং এই লাইনে সে পুরোপুরি প্রোফেশনাল। মনে মনে একটা বাহবা না দিয়ে পারলাম না! এই ছানাটাকেও তার আগেরজনের মতো একই জায়গায় ছেড়ে রেখে আসলাম। আসার সময় তাদের বাবা-মায়ের মুন্ডুপাত করছিলাম দুজনে। কেমন মা-বাপ? ছানা-পোনাদের দু-একটাকে ফেলে ফুলে মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমরা দুনিয়া ভুলে সেগুলোকে উদ্ধার করে বেড়াচ্ছি। আমাদের কি খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নাই? ভাবেটা কি ওরা?!
আজকে বিকালে ল্যাব থেকে বেড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম পুকুরপাড়ে। উদ্দেশ্য আবার কেউ আবার হারিয়ে গেল না ড্রেনে পড়ে গেল সেটা দেখা। সেরকম কাউকে পাওয়া গেল না। কিন্তু ব্যাপারটাকে আমরা দায়িত্ব হিসেবে নিয়ে নিয়েছি বলা যায়। আমাদের তৃতীয় নয়ন পড়ে থাকবে কার্জন হলের আনাচে কানাচে। আর্ত-পীড়িতের সার্বক্ষনিক সেবায় সাহসিকা হিমেল এবং মমতাময়ী রিম!
--রিম সাবরিনা; ৭।১১।০৯
মন্তব্য
তেলাপোকা, মাকরশা, ছ্যাঙ্গা, বিছা ইত্যাদি কিছু পোকামাকড় ছাড়া প্রানীজগতের বাকি সদস্যদের প্রতি আমাদের গভীর ভালবাসা কাজ করে।
হুম, আমারও একই অবস্থা। একবার একটা বিড়ালের বাচ্চা ছাদ থেকে লাফিয়ে আরেক বাড়ির কানির্শে পড়ে গিয়েছিল। পরে সেটাকে বালতি ট্রিটমেন্ট দিয়ে উদ্ধার করতে হয়।
-------------------------------
শান্ত নদী
কুকুর প্রাণীটাকে কেন জানি আমি ভীষণ ভয় পাই
লেখাটা ভাল লাগছে। সচলে স্বাগতম। আশা করি আর নিয়মিত সচলে আপনার লেখা গুলো দেখা যাবে
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
সৌন্দর্য লেখা হইছে।
কুকুরদের ভালো লাগেনা, কুকুরশাবকদের দেখতে ভালো লাগে।
বেড়ালদের কথা বলবো কিছু?!
মর্ম
প্রানীজগতের প্রতি আপনার মায়া দেখে খুব ভাল লাগলো।আশা করি আপনার আরো লিখা পরতে পারব।
মিতু
রিফাত জাহান মিতু
মন্তব্যগুলি পড়ে মজা পাচ্ছি। ভাল লেগেছে জেনে খুশি।
ধারা বর্ণনা ভালো লাগলো ।
আপনার ত্রিমাত্রিক লেখা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা ।
{পাউরুটি দিয়ে লাঞ্চ করে দেখি কিছুটা দূরে ঠিক অতটুকু
কুকুরছানা এক জায়গায় শুয়ে আছে, দুই-তিনজন ছেলে
যাওয়ার সময় বলছে কুকুরছানাটা বাচবেনা। আমি আর
একটি ৩ টাকার পাউরুটি দাড়িয়ে (কাক যেন না নিতে পারে)
থেকে খাওয়ালাম, দেখি হাটার শক্তিটুকু সে পেয়ে গেছে।
পরের দিন আর দেখা পাইনি ।}
সাহসিকা আর মমতাময়ী আরো উদ্দিপীত থাকুক এই কর্ম যজ্ঞে। নতুনেরে স্বাগতম।
মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....
ধন্যবাদ। ত্রিমাত্রিক লেখা বলতে কি বোঝালেন ঠিক বুঝলাম না। কনফিউজড একটু।
সুপ্রিয় রিম সাবরিনা, এই প্রশ্নটা নেটিকেটের সাথে যায় না, তবু করছি। প্রয়োজনে বোধে উত্তর নাও দিতে পারেন, সে ক্ষেত্রে আগাম ক্ষমাপ্রার্থী।
আপনি কি ঢাকা বিশেবিদ্যালয়ের শিক্ষক ?? আই-ই-আর বিভাগের ?? ...
আপনার পূর্বের এবং এই লেখাটি পড়ে এই ধারণা হচ্ছে দেখে প্রশ্নটি করলাম।
_________________________________________
সেরিওজা
আপনার অনুমান ভুল।
ব্যাপার না মানুষ মাত্রেই ভুল হয়, ম্যান ইজ মরটাল।
আমি এরকম এক ঝাঁক পাপিকে (কুকুরের বাচ্চা বলতে ইচ্ছা করছে না হাহা) বড় হতে দেখেছি। ওদের একটা ছোটবেলায় ড্রেনে পড়ে গিয়েছিল। ওকে তুলে আনার পর দেখা গেল পেছনে ড্রেনের ময়লার একটা ছোপ লেগে গেছে। মজার ব্যাপার হল, ওটা বড় হবার পরও পেছনের ওই ছোপটা দেখে আমরা ওটাকে আলাদা করতে পারতাম! আমার ধারণা ড্রেনে পড়ার পর ওটার স্কিনে কিছু একটা সমস্যা হয়েছিল, যাতে করে ওই জায়গায় যে লোম গজাত সেটার রঙ শরীরের বাকি অংশের চেয়ে আলাদা হত।
- ওড়না পেচিয়ে প্রথম কুকুরছানাটাকে তোলার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত হিমেলকে আমার ছয়ফুটি পোলা মনে হয়েছে। কারণ, এই নামে, ঐ সাইজের এক বন্ধু আছে আমার। তবে তার যদিও কার্জনের আশেপাশে থাকার সম্ভাবনা শূণ্যেরও নিচে, যাইহোক।
বিছা, ছ্যাঙ্গা বাদে বাকি সব প্রাণীর প্রতিই ভালোবাসা টের পান? সর্প বিষয়ে কী মত আপনার?
কুকুর দেখলেই বিশাল ডর করে। এখানে ডিপ্লোমাধারী কুত্তা নিয়ে লোকজন রাস্তায় চলাফেরা করে। উঠতে বলে উঠে, বসতে বললে বসে। এইগুলা দেখেও ডর করে। মানী লোকের মতো রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু বদমাশগুলা এতোই বদ, এগুলা হুঁশ হুঁশ করে নাক শুকতে শুকতে আমার ঠ্যাঙ্গের কাছেই আসে। আর আমার চুপসে যাওয়া দেখে কুত্তাওয়ালিরা বেশ মজা নিয়ে বলে, "আরে ভয় পাও কেনো, ও কামড়াবে না। ও খুব ভালো কুত্তা!"
আমি কাষ্ঠ হাসি দেই, কিন্তু ডর দূর হয় না।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
নতুন মন্তব্য করুন