লুকুন্ডু

মহাস্থবির জাতক এর ছবি
লিখেছেন মহাস্থবির জাতক (তারিখ: বুধ, ০৭/০৪/২০১০ - ৩:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“যুক্তিতে এটাই বলে,” টোম্বলি বলে চলে, “যে নিজের চোখে দেখা প্রমাণ মেনে নিতেই হয়, আর যখন চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়, তখন সেখানে কোনো সন্দেহ থাকা উচিতই না। যা শুনেছে আর দেখেছে মানুষের সেটাই বিশ্বাস করা উচিত।”

“সবসময় না,” সিঙ্গলটন মৃদু গলায় যোগ দেয়।

ঘরের প্রতিটি লোকের মুখ সিঙ্গলটনের দিকে। টোম্বলি দাঁড়িয়ে আছে ফায়ারপ্লেসের সামনে-রাখা পাপোশটার ওপর, আগুনের দিকে তার পিঠ, পা দু'টো ছড়ানো, ঘরের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তারের সচরাচর ভঙ্গি তার। আর সিঙ্গলটন যথারীতি এক কোনায় চুপচাপ। কিন্তু সে যখন মুখ খোলে তখন কিছু সে বলে বটে। আমরা আশাময় নৈঃশব্দের উৎসাহভরা স্বতঃস্ফূর্ততায় তার দিকে তাকালাম, আমরা চাইছি শব্দেরা বেরিয়ে আসুক।

“ভাবছি,” কিছু সময় পর তার কথা, “আফ্রিকায় দেখেছি আর শুনেছি এমন কিছু তোমাদের বলবো।”

ব্যাপার হচ্ছে যে সিঙ্গলটনের কাছ থেকে তার আফ্রিকার অভিজ্ঞতার ব্যাপারে পেটে বোমা মারলেও কিছু বের করতে পারা সম্ভব ছিলো না। সেই যে গল্পে আছে আল্পস পর্বতে উঠেছে এমন একজনকে জিজ্ঞেস করায় যে বলেছিলো সে উঠেছে আর নেমেছে তেমনি সিঙ্গলটনের কাছ থেকে শুধু এটুকুই জানা যেতো যে সে আফ্রিকায় গিয়েছে আর ফিরে এসেছে। তাই তার কথা এখন আমাদের একেবারে গেঁথে ফেললো। টোম্বলি পাপোশের ওপর থেকে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেলো, কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ মনে করতে পারবে না কখন উবে গেলো ও। ঘরটা এখন একেবারে পাল্টে গেছে, সিঙ্গলটনের দিকে সবার মনোযোগ, আর কিছু সিগার জ্বললো, কিছু দ্রুতহাতে এবং কিছু লুকিয়ে লুকিয়ে। সিঙ্গলটনও জ্বালালো একটা, কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই নিভে গেলো ওটা, এবং সে আর ওটা জ্বালায় নি একবারও।


আমরা গহিন অরণ্যে, ব্যস্ত আছি পিগমিদের সন্ধানে। ভ্যান রিটেনের একটা থিওরি ছিলো যে স্ট্যানলি কিংবা অন্যেরা যে বামনদের খুঁজে পেয়েছেন তারা স্রেফ সাধারণ নিগ্রো আর আসল পিগমিদের বর্ণসঙ্কর। তার আশা একটা জাত খুঁজে বের করার যারা সর্বোচ্চ তিন ফুট, কিংবা আরো খাটো। এমন কিছুর অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাই নি।

দেহাতি লোক কম, শিকারও অপর্যাপ্ত; খাবার বলতে শিকার-করা জন্তু ছাড়া আর কিছু নেই; আর চারপাশে প্রচণ্ড ঘন, স্যাঁতসেঁতে, ঠান্ডা আর ভেজা জঙ্গল। সে-মুল্লুকে আমরা নেহাৎ নতুন, এমন কোনো লোক পাই নি যারা এর আগে আর কোনো সাদা-চামড়ার দর্শন পেয়েছে। আচমকাই আমাদের তাঁবুতে উদয় হলো এক ইংরেজের, এবং সে-ও দারুণ বিধ্বস্ত। তার কোনো দূরতম গুজবও শুনি নি; আর সে শুধু আমাদের কথা শোনেই নি, বরং নিদারুণ পাঁচ দিনের একটা মার্চ করে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। তার গাইড আর দু’জন কুলিও তার মতোই হা-ক্লান্ত। যদিও তার কাপড় ছেঁড়া-খোঁড়া আর আর মুখে পাঁচ দিনের না-কামানো দাড়ি, তারপরও দেখেই বোঝা যায় যে সে বেশ ছিমছাম আর ফিটফাট আর প্রতিদিনই দাড়ি কামাতে অভ্যস্ত। ছোটোখাটে সে, কিন্তু গড়ন শক্তপোক্ত। তার মুখে সেধরনের ব্রিটিশ চেহারা যেখান থেকে আবেগ এমন নিখুঁতভাবে মুছে ফেলা হয়েছে যে বাইরের যে-কেউ ভাবতে বাধ্য ওই চেহারার মালিকের আদৌ কোনো অনুভূতি নেই; সেধরনের চেহারা, যদি আদৌ তাতে কোনো ভাব ফোটে, তবে তা হবে পৃথিবীর পথে বিনীতভাবে চলার শপথ, যাতে কারোর কোনো বিঘ্ন বা বিরক্তি না ঘটে।

নাম তার এশাম। বিনয়ের সাথে সে নিজের পরিচয় দিলো, আর এতো স্বাভাবিকভাবে খেলো যে যদি আমাদের কুলিরা তার কুলিদের সাথে আলাপ না করতো তাহলে আমাদের কখনোই সন্দেহ হতো না যে এই পাঁচ দিনে সে খেয়েছে মাত্র তিন বার, আর তা-ও স্বল্প পরিমাণে। খাবার পরে যখন আগুন জ্বালালাম তখন সে জানালো তার আসার কারণ।

“আমার সাহেব খুব অসুস্থ,” দম ফেলতে ফেলতে সে বললো। “এভাবে চললে উনি আর বাঁচবেন না। ভাবছিলাম যদি...”

নরম, একটানা গলায় সে কথা বলে যাচ্ছিলো, কিন্তু দেখছিলাম তার ঠোঁটের ওপর না-কামানো গোঁফের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, তার গলায় একটা যেন চাপা আবেগের ছোঁয়া, চোখে চেপে-রাখা আকুলতা, আর তার পুরো আচরণে এমন এক আন্তরিক স্পন্দিত উদ্বেগ, সব মিলিয়ে ব্যাপারটা তক্ষুনি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। ভ্যান রিটেনের কোনো সহানুভূতি দেখলাম না; যদি তার বুকে কোনো দাগও পড়ে অন্তত মুখে কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু সে শুনছিলো। ব্যাপারটা অবাক করলো আমায়। সে যেরকম মানুষ তাতে মুখের ওপরেই ‘না’ বলে দেওয়ার কথা। কিন্তু সে শুনছে এশামের আধো আধো উচ্চারণে লাজুক, ইঙ্গিতপূর্ণ কথা। এমনকি প্রশ্নও করছে সে।

“তোমার দলনেতা কে?”

“স্টোন,” এশামের উচ্চারণ।

আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম যেন বাজ পড়েছে আমাদের ওপর।

“র‌্যালফ স্টোন?” দু’জনেই একসাথে।

মাথা ঝোঁকালো এশাম।

কয়েক মিনিট ভ্যান রিটেন আর আমি চুপ করে বসে রইলাম। ভ্যান রিটেন তাকে দেখে নি কখনো, কিন্তু স্টোনের সাথে আমি একই ক্লাসে পড়েছি, আর অনেক ক্যাম্পফায়ারে আমি আর ভ্যান রিটেন আলোচনা করেছি তার কথা। দুবছর আগে শেষ তার কথা শুনি, লুয়েবোর দক্ষিণে বালুন্দা-য় সে এক বালুন্দা ওঝার সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে, ফলাফল ওঝার সম্পূর্ণ নাকানিচুবানি আর স্টোনের কাছে তার গোত্রের পরাজয়। তারা ওই ওঝার বাঁশি ভেঙ্গে টুকরোগুলো তুলে দেয় স্টোনের হাতে। বাল নগরীর নবীদের বিপক্ষে হযরত এলাইশার জয়ের সাথে এর মিল বেশ।

স্টোন সম্পর্কে অনেক ভেবেছি, আদৌ সে আফ্রিকায় আছে কি না, আর এখানে সে আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে আর হয়তো থামিয়ে দিয়েছে আমাদের অভিযান।


এশাম যখন স্টোনের নাম নিলো তখন আমাদের সবারই মনে পড়ে গেলো তার অসাধারণ জীবনকাহিনী; তার চমকপ্রদ মা-বাবা, তাঁদের করুণ মৃত্যু; তার কলেজ জীবনে প্রতিভার বিকাশ; তার অর্থের ঝলমলানি; তার যৌবনের প্রতিজ্ঞা; তার বিখ্যাত কুখ্যাতি, আসল খ্যাতির প্রায় কাছাকাছি; ধূমকেতুর মতো যে-লেখিকার উত্থান তার সাথে রোমান্টিক ঘর-ছাড়া, সে-রমণীর লেখালেখি তাকে তুলে দিয়েছিলো খ্যাতির চূড়ায়, যার সৌন্দর্য আর আকর্ষণ নিয়েও কত যে-রটনা; এরপরে তার নামে সেই ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞাভঙ্গের মামলা; তার প্রতি কনের অনুরাগ; সব কিছু মিটে যাওয়ার পরও তাদের হঠাৎ কলহ; তাদের ডিভোর্স; প্রতিজ্ঞাভঙ্গের মামলায় বাদিনীর কাছে তার বহুল বিজ্ঞাপিত আসন্ন বিয়ের উন্মুক্ত ঘোষণা; তার ডিভোর্সড স্ত্রীর সাথে তার পুনর্বিবাহ; তাদের দ্বিতীয় কলহ এবং দ্বিতীয় ডিভোর্স; স্বদেশত্যাগ; অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশে তার পদার্পণ। ঝড়ের মতোই সব স্মৃতি আমার ওপর বয়ে গেলো এবং আমার বিশ্বাস ভ্যান রিটেনেরও একই দশা, যদিও সে বসে আছে মুখ বুজে।

তারপর সে জিজ্ঞেস করে, “ওয়ার্নার কোথায়?”

“মারা গেছে,” এশাম জানায়। “স্টোনের সাথে আমি যোগ দেবার আগেই।”

“লুয়েবোর আগে স্টোনের সাথে তুমি ছিলে না?”

“না,” এশাম বলে, “আমি স্ট্যানলি প্রপাতে ওঁর সাথে জুটে যাই।”

“ওর সাথে কে ছিলো তখন?” ভ্যান রিটেনের প্রশ্ন।

“শুধু ওঁর জাঞ্জিবারের চাকর আর কুলিরা,” এশামের উত্তর।

“কোন জাতের কুলি?” ভ্যান রিটেনের তালাশ।

“মাং-বাট্টুর লোক,” এশাম সংক্ষেপে জানায়।

এবার ভ্যান রিটেন আর আমার দুজনের তাজ্জব বনে যাওয়ার পালা। এতেই বোঝা যায় নেতা হিসেবে স্টোনের ক্ষমতা কেমন ছিলো। সেসময় অব্দি মাং-বাট্টুর লোকদের তাদের নিজের এলাকার বাইরে কুলি হিসেবে কিংবা কোনো লম্বা বা কঠিন অভিযানে কেউ কাজে লাগাতে পারে নি।

“মাং-বাট্টুতে অনেকদিন ছিলে?” ভ্যান রিটেনের দ্বিতীয় প্রশ্ন।

“সপ্তাখানেক,” এশাম বলে। “ওদের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ছিলো, ওদের শব্দ আর বাগধারার বেশ ভালো একটা সংগ্রহ ছিলো তাঁর কাছে। তাঁর একটা থিওরি ছিলো যে ওরা বালুন্দার একটা শাখা এবং ওদের রীতিনীতিতে এর প্রচুর প্রমাণও তিনি সংগ্রহ করেছিলেন।”

“কী খেতে তোমরা?” ভ্যান রিটেনের প্রশ্ন।

“প্রায়ই শিকার করতাম,” এশাম বলে।

“স্টোন ক’দিন ধরে পড়ে আছে?” পরবর্তী অনুসন্ধান ভ্যান রিটেনের।

“মাসখানেকের ওপর হবে,” এশাম জানায়।

“আর ক্যাম্পের জন্যে তোমরা শিকার করতে?” ভ্যান রিটেন জানতে চায়।

এশামের পোড়া আর কর্কশ চামড়া লালচে হয়ে ওঠে।

“কয়েকটা সহজ শিকার মিস করেছি,” দুঃখ তার গলায়। “আমার নিজের শরীরটাও ঠিক ভালো ছিল না।”

“তোমার সাহেবের হয়েছেটা কী?”

“কার্বাঙ্কল জাতীয় কিছু।”

“দু'একটা কার্বাঙ্কলে তো ওর সেরে ওঠার কথা।” ভ্যান রিটেনের মতামত।

“ওগুলো আসলে ঠিক কার্বাঙ্কল না,” এশাম ব্যাখ্যা করে। “আর একটা দুটোও নয়। প্রায় ডজনখানেক হবে, কখনো কখনো একসঙ্গে পাঁচটা। ওগুলো কার্বাঙ্কল হলে অনেকদিন আগেই তিনি মারা যেতেন। কিছু কিছু দিকে ওগুলো অত খারাপ না, আর কিছু কিছু দিকে আরো বাজে।”

“মানে?” ভ্যান রিটেনের কৌতূহল।

“মানে,” এশাম ইতস্তত করে, “কার্বাঙ্কলের মতো ওগুলো এতো গভীরে যন্ত্রণা সৃষ্টি করে না, আর অতোটা কষ্টও দেয় না, আর অতোটা জ্বরও হয় না। কিন্তু রোগটার একটা বড় দিক হচ্ছে তাঁর মনের ওপর খুব খারাপ প্রভাব পড়েছে। প্রথম প্রথম ক্ষতগুলোতে পট্টি লাগাতে আমার সাহায্য নিতেন তিনি, কিন্তু পরে দেখলাম আমার আর অন্য সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছেন। যখন ওগুলো ফুলে ওঠে তখন নিজের তাঁবুতেই থাকেন, আর পট্টি পাল্টানো বা তাঁর সাথে থাকার কোনো সুযোগই আমায় দেন না।”

“তোমাদের পট্টি কি অনেকগুলো ছিলো?” ভ্যান রিটেনের প্রশ্ন।

“অল্প কিছু ছিলো,” এশাম অনিশ্চিতভাবে বললো, “কিন্তু উনি ওগুলো ছুঁতেনও না, নিজেই পট্টিগুলো ধুয়ে বারবার লাগাতেন।”

“ওই ফোলাগুলোর চিকিৎসা কিভাবে করতো সে?” ভ্যান রিটেন জানতে চায়।

“একেবারে ওই জায়গার মাংসটাসহ নিজের ক্ষুর দিয়ে কেটে ফেলতেন।”

“কী?” চেঁচিয়ে উঠেছে ভ্যান রিটেন।

কোনো উত্তর দিলো না এশাম, তাকিয়ে আছে সোজা তার চোখের দিকে।

“সরি,” দ্রুত গলায় ভ্যান রিটেন সামলে নেয়, “চমকে দিয়েছিলে একেবারে। ওগুলো কার্বাঙ্কল হতেই পারে না। সেরকম হলে অনেক আগেই সে মারা যেতো।”

“মনে হয় কথাটা আপনাকে আগেই বলেছিলাম।” আধো আধো স্বরে এশামের কথা।

“কিন্তু লোকটার মাথা তো এক্কেবারে গেছে!” বিস্ময় ভ্যান রিটেনের।

“ঠিক তাই,” এশামের বক্তব্য। “উনি আমার উপদেশ বা নিয়ন্ত্রণের একেবারে বাইরে।”

“এভাবে ক’টার ওপর চালিয়েছে?” ভ্যান রিটেন জানার দাবি করে।

“আমার জানামতে দু’টো,” এশামের চটজলদি জবাব।

“দু’টো?” প্রশ্নবোধক ভ্যান রিটেন।

আবারো লজ্জা পেলো এশাম।

“আমি ওঁকে,” ওর স্বীকারোক্তি, “কুঁড়ের ফাঁক দিয়ে দেখেছি। ওঁর ওপর নজর রাখতে বাধ্য হচ্ছিলাম. যেহেতু নিজের কোনো খেয়াল উনি রাখছেন না।”

“তাই তো মনে হচ্ছে,” একমত হলো ভ্যান রিটেন। “আর তুমি দুবার ওকে কাজটা করতে দেখেছো?”

“আমার তো মনে হয়,” এশাম বলে, “বাকিগুলো নিয়েও উনি একই কাণ্ড করেছেন।”

“ক’টা আছে বললে?” ভ্যান রিটেনের প্রশ্ন।

“প্রায় ডজনখানেক,” আবারো আধো গলায় উত্তর।

“খাওয়া-দাওয়া আছে তো?” অনুসন্ধিৎসা ভ্যান রিটেনের।

“নেকড়ের মতো খান,” এশাম জানায়, “যেকোনো দুজন কুলির চাইতে বেশি।”

“হাঁটতে পারে?” জানতে চায় ভ্যান রিটেন।

“একটু একটু হামাগুড়ি দেওয়ার মতো, গোঙাতে থাকেন,” সহজভাবে বলে এশাম।

“অল্প জ্বর হয়, তুমি বলেছিলে,” স্মৃতি টেনে আনে ভ্যান রিটেন।

“যথেষ্ট এবং বেশি,” এশাম ঘোষণা দেয়।

“বিকারের ঘোরে কিছু বলে?” আবার প্রশ্ন ভ্যান রিটেনের।

“শুধু দু’বার,” এশামের উত্তর, “একবার যখন প্রথম ফোলাটা ফেটে যায়, আর একবার পরে। সেসময় উনি কাউকে কাছে ঘেঁষতেই দেন নি। কিন্তু আমরা শুনছিলাম উনি কথা বলছেন, বলেই যাচ্ছেন ক্রমাগত, আর দেহাতি কুলিরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।”

“ও কি বিকারের ঘোরে ওদের ভাষায় কথা বলছিলো?” জিজ্ঞাসু ভ্যান রিটেন।

“না,” এশাম বলে, “কিন্তু উনি প্রায়ই একইরকম ভাষায় কথা বলছিলেন। হামেদ বার্ঘাশ বলছিলো উনি নাকি বালুন্দা ভাষায় কথা বলছিলেন। আমি বালুন্দা খুব কমই জানি। ভাষা শেখার কাজে আমার দক্ষতা বেশি না। আমি এক বছরে যতটুকু মাং-বাট্টুদের ভাষা শিখতে পারতাম সাহেব এক সপ্তাতেই তার চাইতে বেশি শিখে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমারও মনে হয়েছে যেন মাং-বাট্টুদের ভাষা শুনছি। আর এদিকে মাং-বাট্টু কুলিরা তো ভয়েই কাবু।”

“ভয়ে?” ভ্যান রিটেন পুনরাবৃত্তি করলো প্রশ্নের সুরে।

“জাঞ্জিবারের কুলিগুলোও ভয় পেয়েছিলো, এমনকি হামেদ বার্ঘাশ, আর আমিও পেয়েছিলাম,” এশাম বললো, “অবশ্য কারণটা আলাদা। উনি দুটো গলায় কথা বলছিলেন।”

“দুটো গলায়,” ভাবছে ভ্যান রিটেন।

“হ্যাঁ,” এতক্ষণ যে-গলায় কথা বলছিলো এশাম, এবার তার চাইতে অনেক বেশি সে উত্তেজিত। “দুটো গলায়, কথাবার্তা বলার সময় যেমন শোনা যায়। একটা উনার, আরেকটা ছোট, হালকা, রিনরিনে গলা, ওরকম কণ্ঠ কোনোদিন শুনি নি। বোঝার চেষ্টা করলাম, ভারি গলাটার করা দুএকটা মাং-বাট্টু শব্দ জানি, যেমন ‘নেড্রু’, ‘মেটাবারা’ আর ‘নেডু’, ওদের ভাষায় এর অর্থ ‘মাথা’, ‘ঘাড়’, উরু’ আর মনে হয় ‘কুদরা’-ও শুনেছি আর ‘নেকেরে’ (‘কথা-বলা’ আর ‘শিস্-দেওয়া’); আর সরু গলাটার করা শব্দের মধ্যে ‘মাটোমিপা’, ‘আনগুঞ্জি’ আর ‘কামোমামি’ (‘হত্যা’, ‘মৃত্যু’ আর ‘ঘৃণা’)। হামেদ বার্ঘাশ বলছিলো সেও নাকি একই শব্দ শুনেছে। আমার চাইতে সে অনেক ভালো মাং-বাট্টু জানে।”

“আর কুলিগুলো কী বললো?” ভ্যান রিটেন জানতে চায়।

“ওরা বলছিলো, ‘লুকুন্ডু’, ‘লুকুন্ডু’!” উত্তর দেয় এশাম। “শব্দটা আমার জানা ছিলো না; হামেদ বার্ঘাশ বললো মাং-বাট্টুতে ওটা নাকি ‘নেকড়ে’।”

“ মাং-বাট্টুতে ওটা ‘ডাকিনীবিদ্যা’ বোঝায়,” ভ্যান রিটেন জানায়।

“মনে হয় ওরাও তাই ভেবেছিলো,” এশাম বলে। “ওইরকম দুটো গলা শুনলে যে কেউ তুকতাকে বিশ্বাস করবে।”

“একটা গলা অন্যটার জবাব দিচ্ছিলো?” যন্ত্রের মতো ভ্যান রিটেন প্রশ্ন করে।

পোড়া চামড়ার নিচে এশামের মুখ ছাইরঙের হয়ে ওঠে।

“কখনো কখনো দু’টোই একসাথে শোনা যাচ্ছিলো,” খসখসে গলায় সে বলে।

“একসাথে দু’টোই!” ভ্যান রিটেনের মুখ থেকে ছিটকে আসে।

“সবাই শুনেছে,” এশাম জানায়। “এখানেই শেষ না।”

থেমে যায় সে আর আমাদের দিকে এক লহমার জন্যে তাকিয়ে থাকে অসহায়ের ভঙ্গিতে।

“একটা লোক কি একই সাথে কথা বলতে আর শিস দিতে পারে?” সে প্রশ্ন করে।

“মানে, কী বলতে চাইছো?” অনুসন্ধান ভ্যান রিটেনের।

“আমরা শুনলাম সাহেব কথা বলছেন তাঁর দরাজ বুক থেকে উঠে-আসা গমগমে গলায়, আর তার সাথেই শোনা যাচ্ছে একটা উঁচু, তীব্র, তীক্ষ্ণ শিস, একটা অসম্ভব অদ্ভুত, শ্বাস-টানার মতো আওয়াজ। আপনি দেখবেন একজন বয়স্ক লোক যতই তীক্ষ্ণ গলায় শিস দিক, সেটার সুরটা একটা ছেলে কিংবা মহিলা বা একটা ছোট্ট ছেলের চাইতে আলাদা হবেই। ওগুলো আরো অনেক তীক্ষ্ণ হয়। কল্পনা করুন একটা ছোট্ট মেয়ে অনবরত একটানা সুরে শিস দিচ্ছে, ওটা অনেকটা সেরকমই, শুধু আরো বেশি কান-ফাটানো, আর ওটা শোনা যাচ্ছিলো তাঁর ভারি গলার সাথে সাথেই।”

“আর তোমরা ওকে দেখতে গেলে না?” চিৎকার করে উঠেছে ভ্যান রিটেন।

“উনি সাধারণত হুমকি দেন না,” এশাম ঘাড় নাড়ে। “কিন্তু উনি হুমকি দিয়েছিলেন, তাড়াহুড়ো করেও না, অসুস্থ লোকের মতোও না, একদম ধীরে সুস্থে কঠিন গলায়, যদি কেউ (আমাকেও ওদের মধ্যে ধরে) তাঁর ঝামেলার সময় কাছে আসি, তার মরণ নিশ্চিত। আর বলাটা না, তাঁর আচরণটা ছিলো দেখার মতো। যেন মৃত্যুশয্যায় কোনো সম্রাট নিরিবিলি একাকী পরিবেশ চাইছেন। ওই জায়গায় ঘাড় ত্যারা করবে কে?”

“হুম,” সংক্ষিপ্ত জবাব ভ্যান রিটেনের।

“উনি বড্ড অসুস্থ,” এশাম আবারো অসহায়ভাবে বলে। “মনে হয়...”

তার স্বাভাবিক অনাবেগী খোলসের ভেতর থেকে ফুটে বেরুচ্ছিলো স্টোনের জন্যে তার অসম্ভব টান, তার আন্তরিক ভালোবাসা। স্টোনের আরাধনাই তার প্রিয়তম অনুভূতি।

অনেক যোগ্য লোকের মতোই, ভ্যান রিটেনের ভেতর একটা দারুণ স্বার্থপর অংশ ছিলো। এবার সেটা স্বরূপে দেখা দিলো। সে জানালো যে দিনের পর দিন আমরা স্টোনের দলের মতোই জানটা হাতে নিয়ে পথ চলেছি; সে মোটেও ভুলে যায় নি দু’জন অভিযাত্রীর ভেতর রক্তের টান আর বিপদে সাড়া দেওয়ার সম্পর্ক, কিন্তু হয়তো সব সাহায্যের ঊর্ধ্বে চলে গেছে এমন একজনের জন্যে প্রচুর ঝামেলা করে একটা দলকে বিপদে ফেলা অর্থহীন; বললো একটা দলের জন্যে শিকার যোগাড় করাটাই যথেষ্ট ঝামেলার; বললো দুটো দল যদি এক হয়, খাবার যোগাড় করাটা হবে দ্বিগুণের চাইতেও বেশি ঝামেলার; অনাহারে থাকার ঝুঁকিটা প্রচণ্ডরকমভাবে যাবে বেড়ে। পুরো সাতদিনের একটা উল্টো পথে যাত্রা (এশামকে সে এখানে তার হাঁটার ক্ষমতার জন্যে প্রশংসা জানালো) হয়তো পুরোপুরিই ভেস্তে দিতে পারে আমাদের অভিযান।

(ক্রমশ)

---মহাস্থবির জাতক---


মন্তব্য

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

এইবারো সেমসাইড দেঁতো হাসি

এই গল্পটাও আমি পড়েছি, নামটা আনকমন দেখে মনে ছিলো। আপনার গল্পের প্রিভিউ দেখে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, তবে কার্বাঙ্কলের কথাটা আসতেই পুরো মনে পর্লো... তাই আর পড়লাম না।

আপনি কি থ্রিলার ফ্যান নাকি ?? তাইলে নিজেই একটা ভূত নামায়ে ফ্যালেন না ??

আর হুমায়ুন আহমেদের কুটু মিয়া পড়েছেন ?? আমার কেনো জানি পড়বার সময় মনে হয়েছিলো ঐ বইটা এই গল্পের ছায়া থেকে লেখা...
_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

থ্রিলার, ভয়, আতঙ্ক, রোমখাড়ক ইত্যাদি সবই পছন্দের....

নিজে লেখার খেমতা নাই...

একটা গল্প দিয়েছিলাম, সচল ছাপে নি...(মা-বাবাকে স্মরণ করিয়া ক্রন্দন)

কুটু মিয়াটা অন্যরকম, গুলিয়ে ফেললেন নাকি?

গল্পটা কোথায় পড়েছিলেন, নাকি অনুবাদ?

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

নাহ, এটা গুলাই নাই। কুটু মিয়া অবশ্যি অন্যরকম, কিন্তু আমার ধারণা হয়েছে বইটা পড়ে যে থীমটা এই গল্পের মত কিছুটা।... গল্পটা কোথায় পড়েছিলাম মনে নাই, তবে ঐ বইতে চমৎকার কিছু হরর গল্প ছিলো। 'দ্যা রেড রুম', 'দ্যা রোডসাইড হোটেল'- এই দুইটা গল্পের নাম মনে পর্তেসে এখন...

_________________________________________

সেরিওজা

সংসপ্তক এর ছবি

শেষ করলেন না গল্পটা? আরো বাকি আছে তো......
.........
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

অতিথি লেখক এর ছবি

আগামী সংখ্যায় সমাপ্য...

---মহাস্থবির---

খেকশিয়াল এর ছবি

গল্পটা অনেক আগে থেকেই পড়বো পড়বো করে পড়া হয়নি, এখন হচ্ছে আপনার কল্যাণে। দারুণ অনুবাদ। পরের পর্ব ছাড়ুন শিজ্ঞির!

------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

হিমু এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।