৩
যুক্তি ভ্যান রিটেনের পক্ষে এবং গতিপথও তার সুনির্দিষ্ট। এশাম শ্রদ্ধাভরে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বসেই রইলো, যেন ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চা বসে আছে হেডমাস্টারের সামনে। ভ্যান রিটেন উপসংহার টানলো।
“নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পিগমিদের খুঁজে বেড়াচ্ছি, পিগমিদের পেছনেই থাকবো আমি।”
“তাহলে হয়তো জিনিসগুলো আপনাকে টানবে,” খুব শান্ত গলায় বলে এশাম।
তার জ্যাকেটের পাশ-পকেট থেকে দুটো জিনিস বার করলো সে, তুলে দিলো ভ্যান রিটেনের হাতে। জিনিসগুলো গোল, সবচে’ বড় কুলের চাইতেও বড়, ছোট সবচে’ ছোট পিচফলটার চেয়ে, গড়পরতা হাতের ভেতর রেখে মুঠোবন্ধ করা যাবে অনায়াসে। ওগুলো কালো, আর প্রথমে দেখে ঠিক বুঝতে পারি নি জিনিসগুলো আসলে কী।
“পিগমি!” লাফিয়ে উঠলো ভ্যান রিটেন। “নির্ঘাৎ পিগমি! দু’ফুটের চাইতে উঁচু হতেই পারে না। তুমি বলতে চাও এগুলো পূর্ণবয়স্কদের মাথা?”
“আমি কিছুই বলতে চাই না,” নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলে এশাম। “নিজেই দেখে নিন।”
একটা মাথা ভ্যান রিটেন বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। সূর্য প্রায় অস্তাচলে, তাই খুব কাছ থেকে ভালো করে লক্ষ্য করতে হয়। মাথাটা শুকানো, বেশ যত্নের সাথে সংরক্ষণ-করা, আর মাংসটা আর্জেন্টিনার নুনে-জারানো গরুর মাংসের মতো শক্ত। যেখানে উবে-যাওয়া ঘাড়ের পেশীগুলো কুঁচকে আছে ঠিক সেখানটায় কাঁটার মতো বেরুনো একটা কশেরুকা। একচিলতে চিবুকটা একটা ঠেলে-ওঠা চোয়ালের ডগায়, খুদে দাঁতগুলো সাদা আর সরে-যাওয়া ঠোঁটের নিচে সমান সারিতে বসানো, পুঁচকে নাকটা চ্যাপ্টা, একরত্তি কপালটা পিছিয়ে গেছে, বালখিল্য খুলিটাতে এখানে সেখানে গোছা গোছা কোঁকড়ানো পশম। মাথাটা দেখলে শিশুসুলভ, বালকোচিত কিংবা এমনকি যৌবনপ্রাপ্তও মনে হয় না, প্রাপ্তবয়স্ক হতে হতে ওটা পৌঁছে গেছে শেষ সীমায়।
“এগুলো এলো কোত্থেকে?” সন্ধানী ভ্যান রিটেন।
“সেটা বলতে পারি না,” যথাযথ জবাব এশামের। “যখন সাহেবের জিনিসগুলোতে পাগলের মতো ওষুধ খুঁজছিলাম যাতে উনাকে সাহায্য করার মতো কিছু পাই, তখন ওখানেই এগুলো পাই। কোত্থেকে উনি এই চিজ যোগাড় করেছেন তার হদিস আমার কাছে নেই। তবে কসম কেটে বলতে পারবো এই এলাকায় পা দেওয়ার আগে উনার কাছে এগুলো ছিলো না।”
“ঠিক জানো?” তদন্ত ভ্যান রিটেনের, তার চোখ বড় বড় এবং এশামের ওপর স্থির।
“এক্কেবারে ঠিক।” আধো আধো স্বরে এশাম।
“কিন্তু তুমি না জানলে এগুলো এলোই বা কোন রাস্তায়?” ভ্যান রিটেনের সন্দেহ।
“মাঝখানে একদিন শিকার করতে গিয়ে প্রায় দশদিন উনার কাছ থেকে আলাদা ছিলাম।” এশাম বলে। “সাহেব তো এমনিতেই চুপচাপ। কী করছেন এ ক’দিন তার কোনো হিসেব নেই, আর হামেদ বার্ঘাশ বেশ কম কথা বলে আর অন্যদের ওপর ওর ভালো দাপট।”
“মাথাগুলো ভালো করে দেখেছিলে?” প্রশ্নকর্তা ভ্যান রিটেন।
“খুব নিখুঁতভাবে,” এশাম বলে।
নোটবুক বের করে ভ্যান রিটেন। বেশ গোছালো লোক সে। একটা পাতা ছিঁড়ে নেয়, ভাঁজ করে এবং সমান তিনটে টুকরো করে ছেঁড়ে। একটা দেয় আমায় আর অন্যটা বাড়ায় এশামের দিকে।
“আমার ধারণাটা একটু পরীক্ষা করে দেখি,” সে বলে। “আমি চাই এই মাথাগুলো আমাদের যা মনে করিয়ে দিচ্ছে আমরা সবাই কাগজে ঠিক সেই জিনিসটা লিখবো। তারপর মিলিয়ে দেখবো লেখাগুলো।”
এশামের দিকে একটা পেন্সিল বাড়িয়ে দেই আর সে লেখে। তারপর পেন্সিলটা বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে, এবার লেখার পালা আমার।
“তিনটাই পড়ো,” ভ্যান রিটেন বলে, ওর টুকরোটা বাড়িয়ে দিয়েছে আমার দিকে।
ভ্যান রিটেন লিখেছে, “একটা বুড়ো বালুন্দা ওঝা।”
এশামের লেখাটা, “একটা বুড়ো মাং-বাট্টু প্রেতসিদ্ধ।”
আমার মতামত, “এক বুড়ো কাটুঙ্গা জাদুকর।”
“এই যে পেয়েছি!” উচ্ছ্বাস ভ্যান রিটেনের। “দ্যাখো এবার! ওই মাথাগুলোতে ওয়াগাবি কিংবা বাটওয়া অথবা ওয়ামবুটু বা ওয়াবুটু-র কোনো ছাপ নেই। এবং এগুলো পিগমিও না।”
“আমিও তাই ভেবেছিলাম,” এশাম বলে।
“এবং তুমি বলছো যে এগুলো তার কাছে আগে ছিলো না?”
“একদম নিশ্চিত হয়ে বলছি,” এশাম জোর দেয়।
“ব্যাপারটা দেখা উচিত,” ভ্যান রিটেনের সিদ্ধান্ত। “তোমার সাথে আমি যাচ্ছি। তবে সবার আগে স্টোনকে বাঁচাতে যা দরকার সব করবো।”
হাত বাড়িয়ে দেয় সে এবং নিঃশব্দে তা আঁকড়ে ধরে নেয় এশাম। তার সারা শরীর জুড়ে কৃতজ্ঞতা।
৪
এই রাস্তা পেরুতে এশামের উদ্বেগের তাড়াতেই আসলে সময় লেগেছে পাঁচ দিন। পথ জেনে আর আমাদের দলের সাহায্য নিয়েও তার এবার লাগলো আট দিন। সাত দিনেও আমাদের পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব হতো না, একটা উদ্বেগের চাপা আতঙ্ক থেকে আমাদের তাড়া দিয়ে নিয়ে চললো এশাম, নেতার প্রতি তার দায়িত্ব পালনের আকুল আবেগ থেকে নয়, বরং ভক্তির এক প্রকৃত আগ্রহ থেকে, স্টোনের প্রতি তার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার আলো থেকে, যা তার রসশূন্য স্বভাবসুলভ বহিরঙ্গ ভেদ করেও প্রকাশিত এবং দৃশ্য হয়।
পৌঁছে দেখা গেলো স্টোনের যত্ন বেশ ভালোভাবেই নেয়া হচ্ছে। তাঁবুর চারপাশে এশামের নির্দেশে তৈরি বেশ মজবুত, উঁচু কাঁটা-ওয়ালা জারিবা, কুঁড়েগুলো মজবুতভাবে তৈরি আর ছাওয়া আর তাদের সামর্থ্যে যতটুকু কুলায় স্টোনকে তারা ততটুকু ভালো রেখেছে। হামেদ বার্ঘাশের নাম দু’জন সৈয়দের নামে এমনি এমনি রাখা হয় নি। সুলতানের চরিত্র তার মধ্যে একদম স্পষ্ট। সে মাং-বাট্টুদের একত্রে রেখেছে, একজনও ছিটকে যায় নি, আর শৃঙ্খলাটাও সে ভালোই ধরে রেখেছে। সে দক্ষ নার্স আর বিশ্বস্ত সেবকও বটে।
বাকি দু’জন জাঞ্জিবারিও ভালোই শিকার যোগাড় করেছে। খিদে আছে বটে, কিন্তু উপোস থেকে তাদের ক্যাম্প এখনো ঢের দূরে।
একটা ক্যানভাসের খাটিয়ায় শোয়ানো স্টোন আর পাশে একটা কলাপসিবল ক্যাম্প-টুল-টেবিল, অনেকটা তুর্কি টুলের মতো। ওখানটায় একটা জলের বোতল আর কয়েকটা ভায়াল রাখা, স্টোনের ঘড়ি আর ক্ষুরটাও ওখানেই।
স্টোন ধোপদুরস্ত আর খুব শুকিয়েও যায় নি সে, কিন্তু জীবন ফেলে অনেক দূরের পথে, অচেতন নয়, ঘোরের মধ্যে সে এখন। কাউকে হুকুম করার কি বাধা দেওয়ার অনেক ওপারে। মনে হলো না আমাদের ঢুকতে দেখেছে কিংবা বুঝতে পেরেছে আমরা সেখানে আছি। ওকে যে-কোনো জায়গায় দেখলেই চিনতে পারতাম। ওর ছেলেবেলার সাহস আর সৌন্দর্য অবশ্য উবে গেছে অনেকটাই। কিন্তু মাথাটা তার সিংহের মতোই; একরাশ চুল তার মাথায়, হলদে আর ঢেউ-খেলানো; রোগশয্যায় গজানো ঘন, কোঁকড়ানো সোনালি দাড়িও তাকে বিশেষ পাল্টে দেয় নি। এখনো সে বিশালদেহী, সুপ্রশস্ত তার বক্ষদেশ। চোখগুলো ঘোলাটে আর বিড়বিড় করে সে আওড়াচ্ছে শব্দ নয়, অক্ষর।
স্টোনের কাপড় সরিয়ে তাকে পুরোপুরি দেখানোর কাজে ভ্যান রিটেনকে সাহায্য করলো এশাম। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পরও পেশীগুলো তার তুলনামূলকভাবে বেশ পোক্ত। হাঁটু, কাঁধ আর বুক ছাড়া কোথাও আঁচড়টি নেই। প্রতি হাঁটুতে এবং তার ঠিক ওপরে একজোড়া গোলাকৃতি শুকনো ক্ষতের ছাপ, প্রতি কাঁধে এমনি ডজনখানেক কি আরো বেশি, আর সবই সামনের দিকে। দুতিনটে ক্ষতের মুখ খোলা আর চার-পাঁচটা প্রায় ভরে এসেছে। ওর বুকের দুপাশেই একটা করে মোট দুটো বাদে নতুন কোনো ফোলা নেই, বাঁদিকেরটা অন্যদিকেরটার চাইতে উঁচু আর বড়। ফোঁড়া বা কার্বাঙ্কলজাতীয় কিছু মনে হচ্ছে না ওগুলো দেখে, বরং মনে হচ্ছে যেন দিব্যি সুস্থ মাংসের ভেতর থেকে ভোঁতা আর শক্ত কিছু ঠেলে বের হতে চাইছে, জ্বালাপোড়া হচ্ছে বলেও মনে হলো না।
“ আমি হলে ওগুলোতে ছুরি চালাতাম না,” জানায় ভ্যান রিটেন, সম্মতি দেয় এশাম।
সাধ্যমত স্টোনকে তারা দুজন মিলে আরামে রাখার চেষ্টা করে, আর সূর্যাস্তের ঠিক আগেই ওকে আমরা আবার দেখতে যাই। সে চিৎ হয়ে শোওয়া, বুক তার এখনো বিশাল আর প্রশস্ত দেখায়, কিন্তু সে যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য। এশামকে ওর কাছে রেখে আমরা গেলাম পাশের কুঁড়েটাতেই, যেটা এশাম আমাদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে। গত কয়েক মাসের রাতের জঙ্গলে যেসব শব্দ শুনে আসছি, এখানেও তা-ই এবং দ্রুত আমি ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি।
৫
পিচকালো আঁধারে কোনো একটা সময় আবিষ্কার করি আমি জেগে আছি আর শুনছি কান পেতে। দুটো গলা শুনতে পাচ্ছি, একটা স্টোনের, অন্যটা হিসহিসানি আর টানা শ্বাসের মতো। শেষবার শুনেছি স্টোনের গলা বেশ দেরি হলো, তা-ও অনায়াসে চিনতে পারি। অন্যটার মতো জীবনে কখনো কিছু শুনেছি বলে মনে পড়ে না। নবজাতকের কান্না থেকে এর আওয়াজটা কম, কিন্তু একটানা স্বরটা বয়েই চলেছে পোকামাকড়ের আওয়াজের মতো। কান খাড়া করে শুনলাম আমার পাশেই অন্ধকারে ভ্যান রিটেনের শ্বাস পড়ছে, তারপরে সে শুনলো আর বুঝলো যে আমিও শুনছি। এশামের মতো আমারও বালুন্দা-র জ্ঞান বেশ সীমিত, কিন্তু দু’টো একটা শব্দ আমিও বুঝছিলাম। নৈঃশব্দের মাঝখানে গলা দুটো একাদিক্রমে পালা বদল করছে।
তারপর হঠাৎই দু’টো গলা একসাথে আর দ্রুতলয়ে। স্টোনের মন্দ্রগম্ভীর গলা, সুস্থ অবস্থায় যেমন ছিলো আর ঐ অবিশ্বাস্য ক্যানকেনে কণ্ঠ, দুটোই যেন একসাথে ঝগড়া করছে আর চাইছে গলার জোরে অন্যটাকে দাবিয়ে দিতে।
“আর তো সহ্য হয় না,” ভ্যান রিটেন বলে। “চলো তো ওকে দেখে আসি।”
ওর কাছে সিলিন্ডারের মতো দেখতে ইলেক্ট্রিক রাত-বাতি ছিলো। অন্ধকারে সে ওটার জন্যে হাতড়ায় কিছুক্ষণ, খুঁজে পায় অবশেষে বাটনটা আর আমাকে ডাকে ওর সাথে যেতে।
কুঁড়ের বাইরে সে আমায় দাঁড়িয়ে থাকার সঙ্কেত দিয়ে চট করে আলোটা নিভিয়ে দেয়, ভাবটা এমন যেন দেখা গেলে শোনা মুস্কিল হয়ে যাবে।
কুলিদের আগুনের নিভু নিভু আধো আলো ছাড়া আমরা পুরো অন্ধকারে, গাছের ফাঁক দিয়ে তারার অল্প আলো বেশ কষ্ট করছে ঢোকার জন্যে, শোনা যাচ্ছে নদীর মৃদু কুলুকুল। দুটো গলাই এখন একত্রে শোনা যাচ্ছে আর তারপর হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ গলাটা পাল্টে গেলো ক্ষুরধার ফালিফালি শিসে, অবর্ণনীয়ভাবে যেন কেটে কেটে যাচ্ছে, যাচ্ছে স্টোনের রাগী গোঙানোর মাঝ দিয়েই।
“হায় ঈশ্বর!” ভ্যান রিটেনের গলা।
হঠাৎ করেই সে জ্বেলে দিলো আলোটা।
দেখি এশাম গভীরভাবে ঘুমন্ত, গোটা দিনের হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্তশ্রান্ত আর নিশ্চিতও বটে, কারণ বোঝাটা সে এখন চাপিয়েছে ভ্যান রিটেনের কাঁধে। মুখের ওপর আলো পড়ার পরও তার ঘুম ভাঙলো না।
থেমে গেছে শিসটা এবং দুটো গলা এখন একসাথেই শব্দ করছে। দুটোই আসছে স্টোনের খাটিয়া থেকে। জমাট আলোতে দেখছি যেরকম তাকে রেখে গেছি সেরকমই সে আছে এখনো, শুধু হাতগুলো তোলা মাথার ওপর আর বুক থেকে ছিঁড়ে ফেলেছে গায়ের কাপড় আর পট্টিগুলো।
তার বুকের ওপরের ডান দিকের ফোলাটা ভেঙ্গে গেছে। ভ্যান রিটেন আলোর মাঝদিকটা তাক করে ওটার দিকে, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওটা এখন। ওর মাংসের ভেতর থেকে একটা মাথা বেরিয়ে এসেছে যার শুকনো নমুনা এশাম আমাদের দেখিয়েছে, বালুন্দা ওঝাদের মাথার একটা খুদে সংস্করণ যেন ওটা। কালো রং মাথাটার, কৃষ্ণতম আফ্রিকি ত্বকের মতোই চকচকে কালো; ঘোরাচ্ছে তার শয়তানি, খুদে চোখের সাদাটা আর এতো ছোট্ট মাথাতেও নিগ্রো লাল ঠোঁটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে আণুবীক্ষণিক দাঁত। পিচ্চি খুলিটাতে কোঁকড়ানো, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পশম। অশুভ ভঙ্গিতে ঘুরছে ওটা এদিক-সেদিক আর সেই অবোধ্য তারস্বরে অনবরত চেঁচিয়েই যাচ্ছে। তার বকবকানির মাঝে মাঝে টুকরো টুকরোভাবে স্টোন বিড়বিড় করে যাচ্ছে।
স্টোনের দিক থেকে ফিরে ভ্যান রিটেন এশামকে জাগালো, একটু কষ্টই হলো। এশাম জেগে যখন দেখলো সবটা, চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো তার, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুলো না।
“ওকে দুটো ফোলা কেটে ফেলতে দেখেছিলে?” ভ্যান রিটেন জানতে চায়।
মাথা নাড়ে এশাম, দম আটকে গেছে তার।
“বেশি রক্ত পড়েছিলো?” আবারো ভ্যান রিটেনের প্রশ্ন।
“এ’দম অল্প,” এশামের উত্তর।
“ওর হাতগুলো ধরো,” এশামকে নির্দেশ দেয় ভ্যান রিটেন।
স্টোনের ক্ষুরটা হাতে নেয় সে আর আমায় দেয় আলোটা। আলো চোখে-পড়ার কিংবা আমরা যে ওখানে আছি, তা বোঝার কোনো লক্ষণই স্টোন দেখায় নি। কিন্তু পুঁচকে মাথাটা আমাদের দিকে তাকিয়ে সরু গলায় গোঙ্গাতে আর চ্যাঁচাতে থাকে।
হাত কাঁপছে না ভ্যান রিটেনের। ক্ষুরের আঘাতটা জায়গামত আর নিখুঁত। অবিশ্বাস্য কম রক্ত পড়লো স্টোনের গা থেকে আর ওটা যেন কালশিরে কি আঁচড় এমনিভাবে ক্ষতটা ড্রেসিং করে দেয় ভ্যান রিটেন।
কুৎসিত মাথাটা কাটার মুহূর্ত থেকেই স্টোন কথা বলা থামিয়ে দিয়েছিলো। স্টোনের জন্যে যথাসাধ্য করলো ভ্যান রিটেন আর তারপর শক্তহাতে আমার হাত থেকে নিয়ে নিলো আলোটা। একটা বন্দুক হাতে নিয়ে খাটিয়ার চারপাশের জমি তল্লাশি করলো সে আর হিংস্রভাবে বন্দুকের কুঁদোটা নামিয়ে আনলো একবার আর দু’বার।
ফিরে এলাম তাঁবুতে কিন্তু ঘুমিয়েছি বলে মনে হয় না।
৬
পরদিন প্রায় দুপুরে ঝকঝকে সূর্যের আলোয়, স্টোনের কুঁড়ে থেকে শুনতে পেলাম দুটো গলা। গিয়ে দেখি এশাম তার পাশে গভীর ঘুমে মগ্ন। বাঁদিকের ফোলাটাও ভেঙ্গে গেছে, ঠিক তেমনি আরেকটা মাথা সেখানে সরু গলায় চেঁচামেচি করছে। এশাম জেগে গেলো আর আমরা তিনজনেই সেখানে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ওই অশুভ গলার রিঙটিঙে বকুনির মাঝখানে স্টোন ছুঁড়ে দিচ্ছিলো কর্কশ শব্দ।
সামনে এগুলো ভ্যান রিটেন, হাতে তুলে নিলো স্টোনের ক্ষুরটা আর হাঁটু গেড়ে বসলো খাটিয়ার সামনে। একরত্তি মাথাটা তার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠলো।
আর তারপর হঠাৎ ইংরেজি বলে উঠলো স্টোন, “আমার ক্ষুর নিয়ে আপনি কী করছেন?”
ভ্যান রিটেন পিছিয়ে আসে আর উঠে দাঁড়ায়।
স্টোনের চোখগুলো এখন স্পষ্ট আর উজ্জ্বল, ঘুরে বেড়াচ্ছে কুঁড়ের চারদিকে।
“শেষ সময়,” সে বলে; “বুঝতে পারছি আমার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। এশামকে দেখছি যেন জীবন্ত। কিন্তু সিঙ্গলটন! আঃ, সিঙ্গলটন! ছোটোবেলার ভূতগুলো আমার মরণ দেখতে এসেছে! আর তুমি, কালো দাড়ি আর আমার ক্ষুর হাতে অদ্ভুত ভূত! এই কী সবাই!”
“আমি ভূত না স্টোন,” কষ্টে স্বর ফোটাই। “আমি বেঁচে আছি। এশাম আর ভ্যান রিটেনও তাই। আমরা এখানে এসেছি তোমাকে সাহায্য করতে।”
“ভ্যান রিটেন!” উত্তেজনা তার গলায়। “আমার কাজ সেরা লোকের হাতেই পড়েছে। সৌভাগ্য তোমার সঙ্গী হোক, ভ্যান রিটেন।”
ভ্যান রিটেন তার কাছে এগিয়ে আসে।
“এক মিনিট, ওল্ড ম্যান,” সে সান্ত্বনার গলায় বলে। “একটু শুধু ব্যথা লাগবে।”
“ওরকম কতটা ব্যথার জন্যে যে অপেক্ষা করেছি,” বেশ স্পষ্ট গলায় জবাব দেয় স্টোন। “ছেড়ে দাও, নিজের মতো করে মরতে দাও। হাইড্রাও এর কাছে কিছু না। দশটা, একশোটা, হাজারটা মাথা কাটো, কিন্তু অভিশাপটা তুমি কাটাতেও পারবে না, মুক্তও হতে পারবে না। হাড়ের ভেতর যেটা ঢুকে গেছে মাংস থেকে তো আর সেটা বের করা যাবে না। ওখানেই জন্ম, ওখানেই থাকবে। আমায় আর কাটাকুটি করো না। কথা দাও!”
কম বয়েসের সেই পুরনো হুকুমের সুর এখনো তার গলায় আর অন্য সবাইকে যেভাবে নাড়া দিতো, সেভাবে নাড়া দিলো ভ্যান রিটেনকেও।
“দিলাম,” জানালো ভ্যান রিটেন।
কথাটা বলতে না বলতেই আবারো ঘোলাটে হয়ে এলো স্টোনের চোখজোড়া।
তারপর তিনজন বসলাম স্টোনের কাছাকাছি আর দেখতে লাগলাম সেই গা-ঘিনঘিনে, বকুনে খুদে মানুষটা স্টোনের মাংস ঠেলে উঠছে, উঠছেই যতক্ষণ না জড়ানো কালো হাতদুটো শেষমেষ নিজেদের মুক্ত করলো।
সূক্ষ্ণ নখগুলোর গোড়ায় নজরে প্রায় না-পড়া আধখানা চাঁদটাও নিখুঁত, হাতের তালুর গোলাপি দাগ ভয়ঙ্করভাবে বাস্তব-ঘেঁষা। হাতগুলো নড়ে উঠেছে আর ডান হাতটা তাক করেছে স্টোনের সোনালি দাড়ির দিকে।
“আর সহ্য হচ্ছে না,” ভ্যান রিটেন বলে উঠলো আর ক্ষুরটা আবার তুলে নিলো হাতে।
তক্ষুনি খুলে গেলো স্টোনের চোখ, কঠিন, জ্বলছে।
“ভ্যান রিটেন কথা ভাঙবে?” আস্তে আস্তে সে বললো। “কখনো না!”
“কিন্তু তোমায় সাহায্য করতে তো হবেই,” ভ্যান রিটেন ঢোক গেলে।
“সব সাহায্য আর সংঘাতের উপরে চলে গেছি,” স্টোন বলে। “আমার সময় ফুরিয়ে এলো। এই অভিশাপ আমার ওপরে ছুঁড়ে ফেলা হয় নি; আমার ভেতর থেকেই এর জন্ম, যেমন এই বিভীষিকাটা জন্মেছে। যাই তাহলে।”
ওর চোখগুলো আবার বন্ধ হয়ে গেলো আর অসহায় আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। আটকানো কালো শরীরটা তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়েই চলেছে।
এক মুহূর্ত পরে স্টোন আবার কথা বলে উঠলো।
“সব ভাষায় কথা বলতে পারো?” চট করে জিজ্ঞেস করলো সে। আর উঠে-আসা মানবকটি চটজলদি ইংরেজিতে জবাব দিলো, “হ্যাঁ, অবশ্যই, যেসব ভাষা তুমি জানো,” কথা বলতে বলতে সে বের করছে আণুবীক্ষণিক জিভ, মোচড়াচ্ছে ঠোঁট, আর মাথা ঘোরাচ্ছে এপাশ-ওপাশ। যখন ওটা নিশ্বাস নিলো ছোট্ট বুকের দুপাশের সুতোর মতো পাঁজরগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা।
“সে কি ক্ষমা করেছে আমায়?” দম-আটকানো চাপা গলায় বলে ওঠে স্টোন।
“সাইপ্রেস গাছ থেকে যতদিন শ্যাওলা ঝুলবে ততদিন তিনি ক্ষমা করবেন না,” কিচকিচ করে ওঠে মাথাটা। “যতদিন তারা ঝলমলাবে পোন্টচারট্রেন হ্রদের ওপর ততদিন সে নারীর ক্ষমা পাবে না তুমি।”
আর তারপর স্টোন এক হঠাৎ গতিতে নিজেকে উলটে ফেললো একপাশে। পরমুহূর্তেই তার দেহ ছেড়ে গেলো শেষ শ্বাস।
সিঙ্গলটনের গলা যখন থেমে গেলো, ঘরটা তখন এক মুহূর্তের জন্যে চুপ। সবাই শুনতে পাচ্ছি সবার শ্বাসের শব্দ। মাথামোটা টোম্বলিই নীরবতা ভাঙলো।
“আমার ধারণা,” সে বলে, “ঐ ছোট্ট মানুষটাকে কেটে এ্যালকোহলে চুবিয়ে তোমরা দেশে নিয়ে এসেছিলে।”
সিঙ্গলটন তার দিকে কঠিন একটা চাউনি হানলো।
“আমরা স্টোনকে মরার পরে,” সে বলে, “কাটাছেঁড়া না করেই কবর দিয়েছি।”
“কিন্তু,” বিবেচনাহীন টোম্বলি বলে ওঠে, “পুরো ব্যাপারটাই তো অবিশ্বাস্য।”
“আশাও করি নি যে তোমরা বিশ্বাস করবে,” সে বলে; “কথাটা তো শুরুতেই বলেছিলাম যে যদিও ঘটনাটা দেখেছি আর শুনেছি, পেছন ফিরে যখন তাকাই তখন নিজেকেই আমি বিশ্বাস করতে পারি না।”
[এডওয়ার্ড লুকাস হোয়াইট-এর লুকুন্ডু অবলম্বনে]
মন্তব্য
চমৎকার !
ভাল লাগল।
অনুবাদ করতে থাকুন। ভাল অনুবাদকের খুব অভাব।
প্রথম পর্বের কিছুটা পড়েছিলাম। কিন্তু পুরোটা পড়তে পারলাম না। সময়ের বড্ড টানাটানি যাচ্ছে। জমিয়ে রাখলাম। কদিন পর পড়বো। অনুবাদটার জন্য অনেক ধন্যবাদ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নতুন মন্তব্য করুন