তখন সে মেডিক্যাল চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। ফরেনসিক মেডিসিন মিড টার্ম পরীক্ষার ঠিক আগের দিনের কথা, পড়া শেষ করে ঘুমের প্রস্তুতি নেবার সময় অজানা একটা ব্যাথা টের পায় তলপেটে। প্রথমে পাত্তা না দিয়ে শুয়ে পড়ে, কিন্তু ব্যাথাটার সাথে সে যেন কোন ভাবেই পেরে উঠেনা। পাশের বেডের মিষ্টি কে জানালে সে ব্যাথা কমানোর একটি ট্যাবলেট এনে দেয় আর সেই সাথে হটব্যাগ, যেন কিছুটা আরাম হয়। নীলা প্রথম দিকে ভেবেছিল এটা স্বাভাবিক মেয়েলী ব্যাথা কিন্তু রাতের গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যাথাটাও বেড়ে চলে। ভোরের দিকে ব্যাথাটা তীব্র আকার ধারন করলে ওর বন্ধু জলি, মিলা ও মিষ্টি আর দেরি না করে ওকে হাসপাতলে নিয়ে যায়। এর মধ্যে সব ডাক্তার, প্রফেসররা মেয়েটির কথা জেনে গেছে।খুব অল্প সময়ে সব প্রয়োজনীয় টেষ্ট সারার পর নীলাকে একসময় অপরেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।বাবা মা এসে গেছে অনেকক্ষন আগেই, তারা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেননা, দু’দিন আগেও মেয়েকে সুস্থ দেখে গেছেন। বাবা ঝাপসা চোখে অনুমতি পত্রে স্বাক্ষর করেন আর মা নীলার হাত ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। নীলার অস্পস্ট ভাবে এসব মনে আছে কিন্তু এর পর কি হয়েছে তার কিছুই মনে নেই। তিন চার ঘণ্টা পড় ওর জ্ঞান ফিরে আসে, তখন চারদিকে সাদা পর্দা দেয়া একটা বেডে সে নিজেকে আবিষ্কার করে। ওর কাছের বন্ধুরা, মা, বাবা যেন এই মূহুর্তটির অপেক্ষাতেই ছিল। নীলা ওদেরকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল ওর আসলে কি অপারেশন হয়েছে, কিন্তু ওরা কেন জানি বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে মিলা জানায় জলি সারাক্ষণ অপরেশন থিয়েটারেই ছিল, পরীক্ষাও দেয়নি। নীলা আবারো ওর অপারেশনের কথা জিজ্ঞেস করলে ওরা জানায় সেটা এপেন্ডিসাইডের ছিল। কথাটি শুনে নীলার মনে কিছুটা সংশয় জাগে কারন ওর ব্যাথার তীব্রতা ও ধরণ কিছুটা ভিন্ন ছিল এবং অন্যান্য উপসর্গ গুলোও যেন মেলেনা।
পরদিন সকালে জলিকে দেখে নীলা আবার ওর অপারেশনের কথা জিজ্ঞেস করে। এ পর্যায়ে জলি তার প্রিয় বান্ধবীর কাছে এত বড় কঠিন সত্য লুকাতে পারেনা, সবকিছু খুলে বলে।আসলে নীলার ব্যাথা হয়েছিল মূলত ওর ডিম্বাশয়ের সিস্ট ও এপেন্ডিসাইড ফেটে যাবার কারনে , সাথে মিকেলস ডাইভারটিকুলাম। এর ফলে ওর ডান দিকের ডিম্বনালী কেটে ফেলা হয়েছে এবং সাথে অন্য গুলোও। একটি মেয়ের পক্ষে এই বিষয়টি মেনে নেয়া কঠিন কারন এর ফলে ভবিষ্যতে সন্তান ধারনের ক্ষমতা অর্থেক কমে যায় আবার অনেক সময় তা একেবারেই হারিয়ে ফেলতে পারে। সবকিছু শুনে নীলা খুব বিমর্ষ হয়ে যায়, প্রত্যেক মেয়েই চায় তার কোল জুড়ে একদিন ফুটফুটে একটি সন্তান আসবে যাকে ঘিরে তার সব সুখ দুঃখ আবর্তিত হবে।
সকালের রাউন্ডে ওদের গাইনীর অধ্যাপক ফারজানা ম্যাডাম ওকে দেখতে আসে। এখন কেমন আছে তার থেকেও নীলার বেশি চিন্তা ছিল তার সন্তান হবার সম্ভাবনা নিয়ে। তাই ম্যাডামকে দেখেই ও এই বিষয়টা জানতে চায়। সে তাকে বলে, ‘তুমি যে বেঁচে আছ আগে সেটাই বড় কথা, এগুলো নিয়ে পরে চিন্তা করো।’ একে একে ওর বাবা মা, অন্যান্য ডাক্তাররা সবাই ওকে দেখতে আসে কিন্তু সবকিছু ছাপিয়েও নীলার মনে পড়ছিল শাহেদকে ও কি বলবে, শাহেদের সাথে ওর বিয়ে আগামী মাসে। বাবা মাও যেন নির্বাক হয়ে যান। সুস্থ হবার পর নীলা হলে ফিরে এসে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।হাসাপাতালে ছিল মাত্র দুই দিন, এর মাঝেও ও শাহেদের সাথে কথা বলেছে কিন্তু কেন জানি ওর অপারেশনের কথা ওকে বলতে যেয়েও শেষ পর্যন্ত আর বলতে পারেনি।খুব ভালোবাসতো তাই হয়তো হারানোর ভয়টাও বেশী ছিল। বাবা মা কেও বলেছিল, শাহেদের সাথে বিয়ে না হলে সারা জীবন একাই থাকবে। বাবা মা ও যেন নিরুপায়…।
এর পরের সময় খুব দ্রুত চলে যায়, নীলা আর শাহেদের বিয়ে হয়ে যায় নির্দিষ্ট দিনেই। বিয়ের পরের সুন্দর দিনগুলির মধ্যেও একটা অজানা আশঙ্কা নীলাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়াত, কি জানি একটা অপরাধবোধ ওকে সবসময় আনমনা করে রাখত। এক সময় মনে হতো বিয়ে না করাটাই বোধহয় ভাল ছিল। তবে বিধাতা হয়তো কাউকে বেশীদিন কষ্টে রাখেননা, কিংবা যতটুকু নেন তার চেয়েও বেশী উপহার দেন। তাই তো একদিন নীলার শরীর জানান দেয় আরেক জনের অস্তিত্ত্ব। সেই দিনটি ছিল নীলা আর শাহেদের জীবনে স্মরণীয় একটি দিন যার কোন তুলনাই হয়না। তার আগেই অবশ্য নীলার আশঙ্কার কথা জেনে গিয়েছিল শাহেদ, কিন্তু কোন দিন একটি মূহুর্তের জন্যও এই ব্যপারটা নিয়ে ওকে কোন কষ্ট দেয়নি। এরপর দুজনের প্রতীক্ষার পালা, অবশেষে একদিন অনেক ঝড় ঝপটা পাড়ি দিয়ে মা বাবার কোল জুড়ে আসে অরণ্য। আর আজ সেই অরন্যকে নিয়েই নীলা আর শাহেদের পৃথিবী। ফারজানা ম্যাডামের হাতেই অরণ্যর জন্ম হয়, যে অরণ্যকে বলেছিল, ‘মিরাকল বেবী।’
হঠাৎ ফোনের শব্দে নীলা স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে জলি জানায়, ‘মিলা অনেক দিন পর দেশে এসেছে, আজ রাতে মিষ্টির বাসায় এক জমজমাট আড্ডা হবে চলে আয়’। অনেক দিন পর আগের সবার সাথে দেখা হবে ভেবেই মনটা আনন্দে নেচে উঠে নীলার।
বিঃদ্রঃ প্রিয় পাঠক নীলার জীবনে যা ঘটেছিল তা গল্পাকারে লিখলেও একটি চরম বাস্তব ঘটনা যা আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে একটি আনন্দময় ঘটনা। নীলার মত যদি কেউ থেকে থাকেন অজানা আশঙ্কায়, আমি শুধু এইটুকুই বলব কখনো নিরাশ হবেননা কারন আশার যেখানে মৃত্যু জীবনের সেখানে সমাপ্তি।
এই সিরিজের আগের লেখাঃ ( প্রত্যেকটি পর্ব অবশ্য আলাদা আলাদা)
====================
মিতু
রিফাত জাহান মিতু
মন্তব্য
লেখাটা বেশ ভালো লেগেছে। আপনার বর্ণনার ভঙ্গীটাও চমৎকার। বাস্তব ঘটনা হলেও গল্পাকারে লিখুন। গল্প তো জীবনকেই ধারণ করে।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
ভাইয়া একটু অপ্রাসঙ্গিক কথা জিজ্ঞেস করছি, দুঃখিত, কিন্তু রেটিং করতে চাইছিলাম, পারছি না। তারার কাছে 'ইঁদুর' নিয়ে গেলেই কি হবার কথা নয়?!
যাযাবর ব্যাকপ্যাকার
______________________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
আমরা যারা অতিথি লেখক তারা রেটিং করতে পারি না। ধন্যবাদ।
আহ্! তাই তো বলি...
ধন্যবাদ!
যাযাবর ব্যাকপ্যাকার
_________________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ধন্যবাদ মাহবুব।
প্রথম লেখাটা গিয়ে পড়ে আসলাম... ধন্যবাদ মন খারাপ করে দেয়া লেখার পরে মন ভাল করা লেখা উপহার দেবার জন্যে। নিজের মিতু নামের ছেলেবেলার বন্ধুকে মনে পড়ছে, সলিমুল্লাহ্র দিনগুলি থেকেই হারিয়ে গেছে যেন, ফেসবুকে হঠাৎ হঠাৎ জানতে পারি তার গভীর ব্যস্ততার কথা। সুখ একটাই, তার সেই ব্যস্ততা মানুষের জন্যেই...
যাযাবর ব্যাকপ্যাকার
___________________________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
প্রথম লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি,আপনি কি ডাক্তার? মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
না ভাই আমি ডাক্তার নই, পদার্থবিজ্ঞানী বলতে পারেন বড়জোর! বন্ধুদের দু'একজন ডাক্তার অবশ্য, যাদের দেখা মেলা বেশ কঠিন ইদানিং। আপনার এত ব্যস্ততার মাঝেও লেখালেখি করছেন দেখতে ভাল লাগছে।
হৃদয় ছুঁয়ে গেল লেখাটা!
আপনার লেখাগুলো পড়ে মনে হয়, ডাক্তার হলেই বোধহয় ভালো করতাম!! অনেক কিছু জানতে পারতাম!!
"আশার যেখানে মৃত্যু জীবনের সেখানে সমাপ্তি" -সেলুট!!
- মুক্ত বিহঙ্গ
ধন্যবাদ ।
শাহেদ আর অরণ্যকে নিয়ে নীলার জীবন অনাবিল আনন্দে কেটে যাক যেই কামনা করি।
বাস্তব ঘটনার গল্পাকারে লিখন চমৎকার লেগেছে। সিরিজ ভাল হচ্ছে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো পর্ব আসুক।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
ধন্যবাদ সচল জাহিদ।
এক্কেবারে খাঁটি কথা... আশাহীন জীবন আসলে থেকেও নেই...
লেখা চমৎকার হয়েছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
পাগম মন
ধন্যবাদ পাগল মন।
ভালো লেগেছে। পাঠক মনে হয় হ্যাপি এন্ডিং চায় এবার সেটা পেয়েছে।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
সবাই যদি সুখের গল্প শুনতে চায়,তবে কষ্টের গল্প বলবো কাকে?
জীবনটা তো আর বাংলা সিনেমা না ,যে শেষে সবাই শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।আমি ঘটনা গুলো যেমন দেখেছি,তেমনি লেখার চেষ্টা করেছি। ধন্যবাদ ।
মিতু
গল্পটা বেশ ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ
মিতু
নতুন মন্তব্য করুন