আগের পর্বেই কহিয়াছি নটরডেমের সবথেকে মেদামারা পুলাপানদের জায়গা হইত গ্রুপ ৩ এ। এই অধম ও গ্রুপ ৩ এর ছাত্র ছিল। এক সপ্তাহ মুখতার স্যার এর ক্লাস করিবার পর বাংলা ক্লাস অসহ্যবোধ হইতে লাগিল। বিদু্যৎ স্যার গণিত ভাল পড়াইতেন এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই । তবে কয়েকদিন পরে উনার জায়াগায় আওকাত আলী নামে একজন আসিয়া যান। একঘেঁয়ে কন্ঠে টানা কথা বলিয়া যাইবার পরে আমাদের বিরস মুখের দিকে তাকাইয়া স্যারের বোধহয় দয়া হইত। তিনি আমাদের বিনোদিত করিবার নিমিত্তে জোকস কহিয়া আমদের হাঁসাইবার চেষ্টা করিতেন। আমরা অবশ্য তাঁহার জোকে হাঁসিবার জায়গা না পাহিয়া জোক শেষ হইবার পরপরই বিকট শব্দে ঠ্যাঁ ঠ্যাঁ করিয়া হাঁসিয়া উঠিতাম। আমাদের হাঁসি দেখিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া স্যার আমাদের দিকে তাঁকাইয়া থাকিতেন। পরবর্তীকালে আমাদের মাঝে জোকসের এক নুতন ধরণের শ্রেণীবিভাগ চালু হয়। যেসব জোকসেআমরা হাঁসির কিছু পাইতাম না উহাদিগকে আমরা “আওকাত প্রডাকশন” বলা শুরু করি।
এইরূপে বিনোদনহীনভাবে ক্লাস করিতে করিতে আমি হাওয়া বদল করিবার সিদ্ধান্ত লই। আমার গ্রূপ ৮ এর এক দোস্তের সাথে আমার গ্রুপ ৩ এর জায়গা অদল বদল করিবার সিদ্ধান্ত লই। ঠিক হয় আমি তাহাদের গ্রুপে জে.কে. স্যারের ক্লাস করিব। আর সে আমাদের গ্রুপে আওকাত স্যারের ক্লাস করিবে। যথা সময়ে আমি গ্রুপ ৮ এ যাইয়া হাজির হইলাম। আমি আমার জায়াগায় বসিয়া স্যারের জন্য প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। গ্রুপ ৮ এর পুলাপানেরা আমাকে সাদরে তাহাদের মাঝে গ্রহণ করিল। তাহারা আমাকে জে.কে. স্যার সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য দিতে লাগিল। তাহারা স্যারকে লাল স্যার নামে ডাকে। স্যার নাকি সর্বদা লাল রঙের একটি টীশার্ট পড়িয়া ক্লাস লইতে আসেন। উনার গাড়ির রঙ ও নাকি লাল। আমার পাশে বসা একজন ঈশ্বরের নামে শপথ করিয়া কহিল সে নাকি স্যারকে একদিন কটকটা লাল রঙের একটি প্যান্ট পড়িয়া আসিতে দেখিয়াছে।
কিছুক্ষণ পরে স্যার আসিয়া হাজির হইলেন। তাঁহার আগমনের সাথে সাথে একটি অভূতপূর্ব ব্যাপার ঘটিয়া গেল। ক্লাসের সব পুলাপান সমস্বরে জে.কে. বলিয়া চিকার করা শরু করিল। আমার পাশের জন তো পারিলে বেঞ্চ তুলিয়া আছাড় মারে। আমি সবথেকে বেশী অবাক হইলাম স্যারকে একটু ও অপ্রস্তুত না হইতে দেখিয়া। বরং তিনি জননন্দিত নেতার ন্যায় দুইহাত উঁচু করিয়া পুলাপানদেরকে শান্ত হইতে কহিলেন। হাস্যমুখী স্যারকে আমার বড়ই মনে ধরিল। উনি পড়ানো শরু করিলেন। কিছু সময় অতিবাহিত হইবার পরপরেই আমাদের পাশের রো তে বসা একজন আমাদের নিঁচুস্বরে ডাকিল। আমার পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম আকৃ্তিতে ছোটখাট এইজনকে সবাই ভাতিজা বলিয়া ডাকে। অনেক চিন্তা করিয়াও সে তাহার আসল নামখানি মনে করিতে পারিল না। বদমায়শীতে সে নাকি অদ্বীতিয়। সে আমাদেরকে কহিল,”শোন আমি শুরু করমু। আর তোরা সবাই কোরাস গাবি।”
স্যার তখন বোর্ডে লেখায় মগ্ন। এরই মাঝে পুরা ক্লাস সংগঠিত হইয়াছে। ভাতিজা নীঁচু স্বরে গলায় যথাযথ আবেগ ঢালিয়া গাঁহিয়া উঠিল,
“বন্ধু যখন বঊ লইয়া রংগ কইরা হাইট্যা যায়”
পুরা ক্লাস বিকট স্বরে,
“ফাইট্যা যায় বুকটা ফাইট্যা যায়।”
আমাদের গাঁওয়া শেষ হইবার পরপরই স্যার তাঁহার এক পায়ের উপর ভর দিয়া সাঁই করিয়া বোর্ড হইতে আমাদের দিকে ঘুরিয়া গেলেন। মেট্রিক্স স্টাইলে ডান হাত দিয়া তিনি ক্লাসের সবথেকে ভদ্র ছেলেটিকে দাড়ইবার আদেশ দিলেন। পুরা ক্লাসে এই একজনই ক্লাস লেকচার তুলিতেছিল। হায়! এই ধরাধামে ভাল মানুষের কোন দাম নাই। তিনি তাহাকে বলিলেন, “You tell me who were singing?”
-স্যার আমি দেখি নাই।
পুরাটা সময় সে মনোযোগের সহিত ক্লাসনোট তুলিতেছিল। সে আসলেও দেখে নাই। কিন্তু স্যার তাহা বুঝিতে রাজী হইলেন না। তাহাকে ক্লাস হইতে বাহির করিয়া দিলেন। তারপর স্যার আমদের দিকে ঘুরিয়া কহিলেন, ”এরপর যদি আমি কোন গান বাজনা শুনি তাহলে তোমাদের খবর আছে।” পিছন থেকে কেউ বলিয়া উঠিল ,”স্যার কয়টার খবর?” স্যার চিৎকার করিয়া উঠিলেন,”কে কে?” কোন সাড়া শব্দ না পাইয়া তিনি আবার বোর্ডের দিকে ঘুরিয়া Fill in the blanks লিখিতে লাগিলেন। আবার ভাতিজা পুরা ক্লাসকে সংগঠিত করিল। সে নীঁচু স্বরে গাঁহিয়া উঠিল,
“আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল গো”
পুরা ক্লাস বিকট স্বরে,
“মড়ার কোকিলে।”
স্যার আবারো ঠিক পূর্বের ন্যায় আমাদের দিকে ঘুরিয়া দাড়াইলেন। এইবার তিনি ভাতিজাকে দাড় করাইলেন।
-You tell me who were singing.
ভাতিজার মুখে ফুটিয়া উঠা হাঁসিখানি স্যারের নজর এড়াইয়া গেলেও আমাদের নজর এড়াইল না। উল্লেখ্য ভাতিজাসহ গ্রুপ ৮ এর কয়েকজন গুহ স্যারের নিকট রসায়ন পড়িত। তাহাদের গুহ স্যারের বাসায় ঢুকিবার প্রাক্কালে স্যারের নিকট অধ্যয়নরত ললনাদের বাহির হইবার সময় হইত। কে স্যারের বাসার দরজার সামনে সবার সামনে দাড়াইবে এইটা লইয়া ভাতিজার সাথে অন্যদের বিষম গোল বাঁধিয়া যায়। এই ঘটনার প্রতিশোধ লইবার সূবর্ণ সু্যোগ ভাতিজা হাতছাড়া করিল না। সে একে একে তাহার সাথে যাদের দুশমনী ছিল তাহাদের সবাইকে ধরাইয়া দিল। তাহাদের একটি কথাও না শুনিয়া স্যার তাহাদিগকে ক্লাস হইতে বাহির করিয়া দিলেন। বাহির হইবার প্রাক্কালে উহারা সবাই ভাতিজার দিকে তাকাইয়া অনেকটা “তুই শ্যাষ” ধরণের দৃষ্টি প্রদান করিল। তাবে উহাদের এইরূপ চাহুনী ভাতিজাকে কিছুমাত্র বিচলিত করিল না। স্যার তাহাকে বসিতে বলিলেন। স্যার আবার বোর্ডের দিকে ফিরিবা মাত্র ভাতিজা শুরু করিল,
“চল চল ……” সে তাহার গানখানি শেষ করিতে পারিল না। স্যার যথাসময়ে পিছনদিকে ঘুরিয়া তাহাকে ধরিতে সক্ষম হইলেন। এইবার স্যারের বুঝিতে অসুবিধা হইল না যে মূল কালপ্রিট কে ছিল। স্যার উহাকে ক্লাস হইতে বাহির হইবার আদেশ দিলেন। সে মাথা নীচু করিয়া যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় ক্লাস হইতে বাহির হইয়া গেল। দরজার বাহিরে স্যারের দৃষ্টির আড়াল হইবার সাথে সাথে সে তাহার দুই পা দুইদিকে রকস্টারদের ন্যায় প্রসারিত করিয়া(আমাদের ভাষায় চ্যাগাইয়া) কহিয়া উঠিল ,”ও ইয়া”। স্যার ততক্ষণে আমাদের দিকে ঘুরিয়া পাঠদান করা শুরু করিয়াছেন। আমরা স্যারের পড়ার থেকে দরজার বাহিরে ভাতিজার বিচিত্র কাজ মনো্যোগ দিয়া দেখিতে লাগিলাম। হঠাৎ স্যারের চৈতন্যদয় হইলে চিনি আমাদের মাঝে একজনকে দরজা লাগাইতে কহিলেন। দরজা লাগাইবার পরে স্যার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া ক্লাস নিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে কেউ ধাম ধাম ধাম করিয়া দরজায় আঘাত করিল। স্যার হতভম্ব হইয়া আমাদের দিকে তাকাইয়া থাকিলেন। তারপর আমাদের মাঝে একজনকে তিনি দরজা খুলিবার জন্য কহিলেন। দরজা খুলিয়া আমরা কাউকে পাহিলাম না। কারোরই বুঝিতে বাকী থাকিল না এই কাজ কাহার। স্যার আবার দরজা লাগাইয়া পাঠদান করা শুরু করিলেন। কিছুক্ষণ পরে আবার দরজায় আঘাত পড়িল। স্যার এইবার আর কাউকে দরজা খুলিতে কহিলেন না। এমন ভাব করিতে লাগিলেন যেন কিছুই হয় নাই। তবে প্রত্যেকবার দরজায় আঘাত পড়িবা মাত্র আমরা সকলে হো হো করিয়া হাঁসিয়া উঠিতে লাগিলাম। এইভাবেই ক্লাস চলিতে লাগিল। স্যারের অবস্থা দেখিয়া আমাদের মায়া হইতে লাগিল। কিছুক্ষণ পর একটানা অবিশ্রান্ত কেউ দরজায় আঘাত করিতে লাগিল। এইবার স্যারের ভিতরে থাকা পৌ্রষ জাগিয়া উঠিল। স্যার তাহার হাতে থেকে মাইক্রোফোন সবেগে একপাশে ছুড়িয়া দরজার দিকে অগ্রসর হইয়া দরাজা খুলিলেন। দরজা খুলিয়া তিনি ভূত দেখার মত পিছাইয়া আসিলেন। স্বয়ং প্রিন্সিপাল সেখানে দন্ডায়মান। তিনি ধীরে ধীরে কহিলেন ,”এইখানে আসলে হচ্ছেটা কি?”
মন্তব্য
মজা পেলাম খুব। সাত/আট বছর আগে দেখা জ়ে কে এর চেহারা যেন ভেসে উঠল। চেহারা তো আর মনে নাই, লাল্মতন কিজানি দেখলাম একটা।![হো হো হো হো হো হো](http://www.sachalayatan.com/files/smileys/21.gif)
ভাতিজার মত পুলাপান নটরডেমের জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ। বালিকা বিরহে কাতর নাদান ছেলেগুলার কিছু বিনোদন তো পাইতে হবে নাকি!
গ্রুপ ৩ এর পুলাপান মেদামারা।![গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি](http://www.sachalayatan.com/files/smileys/24.gif)
হইলেও হইতে পারে। ভাল লিখেছেন। :-bd
-----------------------------------------
ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর ...
-----------------------------------------
এই গল্প ভরা রাতে, কিছু স্বপ্ন মাখা নীল নীল হাতে
বেপরোয়া কিছু উচ্ছাস নিয়ে, তোমার অপেক্ষায় ...
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
তার্কিক
সাবাশ রামিন, বুঝতে পারছি এটা তোর লেখা, কারণ নাম দিতে ভুলে যাওয়ার মত বেকুব আমাদের ব্যাচে একমাত্র তুই-ই ছিলি...
ভাইরে, জেকে একটা পিস ছিলো। অমানুষ পুরা। ...
এইভাবে একেকজনরে ধরে ধরে একেকটা পর্ব দে। ভালো লাগতেসে পড়তে।
... আর লেখায় কিছু টাইপো আছে। (নিয়মিত লিখ, নাইলে ঐগুলা কাটবো না। )
_________________________________________
সেরিওজা
ঠিকাসে চেষ্টা করব।
তার্কিক
আমার নামটা দিতে ভুলে গেছি।
তার্কিক
Hey you...you are in trouble
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
হাহাপগে...হাহাপগে
=)) ![গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি](http://www.sachalayatan.com/files/smileys/24.gif)
------------------------------------
সময় এসেছে চল ধরি মোরা হাল,
শক্ত কৃপাণে তুলি বরাহের ছাল।
------------------------------------
সময় এসেছে চল ধরি মোরা হাল,
শক্ত কৃপাণে তুলি বরাহের ছাল।
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য। আপনার ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগল।
তার্কিক
আওকাত! একটা ব্যাক্কেল এর অধম ছিল! কি যে ঘোড়ার ডিম পড়াইতো ও নিজে বুঝতো কিনা সন্দেহ আছে।
.........
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
হুম ঠিকই বলেছেন। তার ক্লাসে রীতিমত দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে হত। তবে স্যারকে আমরা বেশ নাকানীচুবানী খাইয়ে ছিলাম এইটা মনে আছে।
তার্কিক
কিন্তু জাইঙ্গা কবির? লালে লাল! তার ক্লাসে সারাক্ষণই হাসতাম, এখন আবার হাসি আসতেছে। আজব চিড়িয়া!
==========================
আবার তোরা মানুষ হ!
হা হা হা... কলেজ এ দুই একটা ভাতিজার মতো পিস থাকে সবসময়ই। অনেকদিন পর কলেজ এর স্মৃতি মনে পড়ে গেল। চালিয়ে যান, পরবর্তি পোস্ট এর অপেক্ষায় রইলাম।
অনেক ধন্যবাদ সাথে থাকবার জন্য।
তার্কিক
মজা পেলাম।গড়াগড়ি দিয়া হাসি তার্কিক ভাই কি অতনুদের সাথের? অনেক স্মৃতি কলেজ নিয়ে। অধিকাংশই মজার। সুহানের জানার কথা। ভাল লাগল লেখাটা পড়ে।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। অতনু নামটা ঠিক চিনতে পারলাম না। আমি সুহানের সাথে এক ব্যাচে।
তার্কিক
- হে হে হে
চরম!
নটরডেমের পোলাপাইন হলো অনেকটা '৯৬ উত্তর শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দলের মতো। নতুন কোনো টিচারই বোলিং করে সুবিধা করতে পারেন না। একেবারে ক্লাশের প্রথম দিন থেকে শুরু করলেও ক্যামনে ক্যামনে পুলাপান স্যারের 'দৌঁড়' বুঝে যায়।
আমার মতে, হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া নটরডেমে শান্তিমতোন ক্লাস করতে পারেন, এমন শিক্ষক নেই। আমাদের সময়ে ফাদার বকুল পর্যন্ত শান্তিমতো ক্লাশ শেষ করতে পারেন নি!![হাসি হাসি](http://www.sachalayatan.com/files/smileys/1.gif)
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নতুন মন্তব্য করুন