চ্যাম্পিয়ন্স লীগ এবং কবিতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২২/০৪/২০১০ - ২:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাগল মন

১.
মঙ্গলবার দিনটা আমার খুব খারাপ কাটে, মেজাজও খুব খারাপ থাকে কারণ আর কিছুই না এদিন অনেক সকালে আমার ঘুম থেকে উঠতে হয় যেখানে আমি বেলা ১০টার আগে উঠিই না। প্রতি মঙ্গলবারে আমার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে একটা অফিসে যাইতে হয় আর সুপারভাইজারের সামনে কম্পু নিয়া সারাদিন কাজ করতে হয় (আসলে বেশিরভাগ সময় কাজের ভান করি)। তো গতকালকেও গেছি অফিসে সাতসকালে উইঠ্যা, গিয়াতো দেখি অনেক কাজ আজকে। মেজাজটা গেল খিঁচ্যা। রেগে টং তার উপরে অফিসে যায় না ফেসবুকে ঢুকা। তাও বাঁচোয়া যে প্রথম আলো, সামু আর সচলে ঢোকা যায়, নাইলে তো আমি দম বন্ধ হইয়া মইরা যাইতাম। সারাদিন পরে অফিস থেইকা আইস্যা প্রথ্থমেই ফেসবুকে লগিন করলাম। কইরা দেখি, এক বন্ধু স্ট্যাটাস দিসে, ওরে নাকি ইন্টারমিলান শান্তি দিসে। আমি তাড়াতাড়ি বিবিসি ওপেন করলাম, দেইখ্যাতো প্রাণটা জুড়ায়ে গেলঃ বার্সেলোনা ১-ইন্টারমিলান ৩. সারাদিনের কষ্টটা সাথেসাথেই দূর হয়ে গেল দেঁতো হাসি ।দিলাম একখান স্ট্যাটাসঃ Go Messi Go (to hell)। আর ঠিক করলাম যদি ইন্টারমিলান ফাইনালে উঠে এবং কাপটা জিতাই ফেলে, তাইলে আমি আজীবনের জন্য মরিনহোর ভক্ত হইয়া যামু। কয়দিন ধইরা মেসি মেসি শুনতে শুনতে কানটা ঝালাপালা হ্ইয়া গেছিল, ফাইনালে না উঠলে যদি কিছু কমে। অবশ্য সামনে বিশ্বকাপ তখন এমনি কইম্যা যাইবো… চোখ টিপি
২.
রাতে পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হল একটা গান শুনিঃ “ ওলো সুজন আমার ঘরে কেন আইলো না”, দিলাম ইউটিউবে সার্চ কিন্তু পাইলাম না। কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে পাইলা গেলাম কিছু কবিতা। আমি ছোটবেলা থেকেই কবিতা বুঝিনা, তাই গদ্যই পড়ি আরও নিদির্ষ্ট করে বললে গোয়েন্দা গল্প। শুরু করছিলাম তিন গোয়েন্দা দিয়ে, তারপর কুয়াশা, রাজু গোয়েন্দা শেষে মাসুদ রানায় এসে থিতু হই। ইন্টার পর্যন্ত মাসুদ রানাই বেশি পড়তাম, পরে অন্য লেখকদের বই পড়া শুরু করি। স্কুল আর কলেজ লাইফে যে কয়টা কবিতা ভাল লেগেছিল তার মধ্যে “কাজলা দিদি”, “সোনার তরী”, “কবর” এই কয়টার কথাই এখন মনে আছে। আজকে জীবনানন্দর একটা কবিতা শুনলাম, ভালোই লাগলো। এরপরে পেলাম নজরুলের “বিদ্রোহী” কবিতাটা। শুনেতো পুরা শরীর গরম হইয়া গেলো, এতো তেজী আর বলিষ্ঠ লেখনী, আবৃত্তিটাও সব্যস্যাচীর। এর আগে আমি এই কবিতাটা পুরা শুনিনি, শুধু শেষের কয়েকটা লাইন শুনেছিলাম, আজকে পুরাটা শুনে মাথা পুরা আউলা হইয়া গেছে। তাই কবিতাটা দেয়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না।
( সতর্কীকরণঃ কারও পড়তে ইচ্ছা না করলে স্কিপ করে শেষে চলে যান, কবিতাটা একটু বড়)

বিদ্রোহী- কাজী নজরুল ইসলাম
বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর -
বল মহা বিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর-
আমি চির উন্নত শির।
আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধুর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!
...
আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি
আমি পথসম্মুখে যাহা পাই,যাই চূর্ণি
আমি নৃত্যপাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই
আমি মুক্ত জীবনানন্দ
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল
আমি চল চঞ্চল ঠমকে ছমকে পথে যেতে যেতে চকিতে চমকে
ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!
চপলা চপলে হিন্দোল,
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর
আমি শাস্ন, ত্রাসন, সংহার, আমি উষ্ণ চির অধীর
বল বীর-
চির-উন্নত শির!
আমি চির দুরন্ত, দুর্ম্মদ
আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্ ভরপুর মদ
আমি হোমশিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান
আমি অবসান, নিশাবসান
আমি ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য।
আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, - আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!

আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দণ শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের!
আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখণ,
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা, তা'র কাঁকন চুড়ির কন্ কন্।
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেনু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি,
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি।
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন!
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,
তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আণি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প!
ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', -
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'!
আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
...
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্,
ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
মম বাঁশরীর তানে পাশরি
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠে’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল-ধ্বংস-ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমন্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজয়, অম্র, অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি স্বর্গ পাতাল-মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার, খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!-
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে,
মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত,
আমি সেইদিন সব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দণ-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন;
আমি স্রষ্টা-সুদন; শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
আমি চির-বিদ্রোহী-বীর-
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!


যারা এত বড় কবিতাটা পড়ার ধৈর্য/সময় করতে পারবেন না তাদের জন্য এটা আবৃত্তির একটা লিংক দিলাম।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।