এর পরে ব্যাপারটা নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছি অনেক বছর ধরে। যেন কোনো কিছু আপনার হাঁটু বেয়ে উঠছে, আর আপনি প্রচণ্ড জোরে ওটা ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন, প্রতিবারই ব্যর্থ চেষ্টা ওটার হাত থেকে বাঁচার, আর প্রতিবারই ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর এতো যে খারাপ লাগতে থাকে। কোনোদিনই অবশ্য ঠিক করতে পারি নি দুঃস্বপ্ন দেখাটা যুক্তিযুক্ত হচ্ছে কি না।
ঘটনার শুরু ১৯---সালে যখন মীরা খালার বাসায় থাকতে যাই। যখন আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠিটা তাঁর কাছ থেকে আসে তখন ছ’মাস ধরে আমার কোনো কাজ নেই, আর দু’সপ্তা ধরে পেট ভরে খেতেই পাচ্ছি না।
শুরু থেকেই শুরু করি। মীরা খালা আমার ঠিক আপন খালা নন। মায়ের দিকের দূর সম্পর্কের বোন হন উনি, আর যখন পুঁতি-চোখো ছোট জামা-পরা বাচ্চা ছিলাম তখনই তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা।
আমন্ত্রণটা আমায় অবাক করে দিতেও পারতো। যদিও তাঁর চিঠিতে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে তিনি একজন বুড়ো মহিলা, একা হয়ে পড়েছেন, আর দয়ালু কাউকে কাছাকাছি চাইছেন, কিন্তু খিদে পেটে অতশত ভাবা যায় না।
চিঠির সাথেই একটা মানি-অর্ডার, আর চট্টগ্রামে আসার একটা বাসের টিকেট, ওখান থেকে কিছু দূরে মফস্বলে উনি থাকেন। মানি-অর্ডারটা দিয়ে ঘরের বকেয়া ভাড়া আর পেট ভরে ডবল প্লেট বিরানি খাওয়ার পরও হাতে রইলো ছয়শ’ সতেরো টাকা। রাতেই চট্টগ্রামের বাস ধরলাম আর পরদিন দুপুরের একটু আগে পৌঁছালাম মীরা খালার দরজার সামনে।
খালা নিজেই দাঁড়িয়েছিলেন দরজায়। আমায় দেখে বড্ড খুশি হলেন তিনি। অভ্যর্থনা জানিয়ে হাসিতে মুখ কুঁচকে ফেললেন।
“তুই আসাতে কী ভালো যে লাগছে, রাতুল!” তিনি বলেন। “তোকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাবো! খুব ভালো করেছিস রে!” জায়গায় জায়গায় তিনি বেশ জোর দিয়ে কথা বলছিলেন।
বুড়ি খুকিকে সাহস দেওয়া শুরু করলাম। পনেরো বছর আগে যেমনটা দেখেছিলাম, তার চাইতে বয়েস তাঁর বেশি বেড়েছে বলে মনে হলো না। তখনো গলায় কলার আর হাতে লাঠি দিয়ে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো, এখনো তাই। তাঁর বয়েস নিয়ে সবচাইতে তোষামুদে কথাগুলো বলা শুরু করলাম।
“ওঃ, রাতুল,” কিচিরমিচির করে ওঠেন তিনি, “তেল দিচ্ছিস আমাকে!”
আরেকটা হাসি আমায় উপহার দিয়ে তিনি এগিয়ে যান ড্রয়িংরুমের দিকে।
তাঁকে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে আমার জন্যে রাখা তিনতলার সামনের ঘরটাতে উঠে আসি। ঘরটার ছাদগুলো খুব উঁচু আর ওখানে একটা বিরাট খাট রাখা। উনি চলে যাওয়ার পরে রেক্সিনের স্যুটকেসটা বিরাট ওয়ার্ড্রোবে তুলে রাখি আর পরিষ্কার হয়ে নিতে ঢুকে যাই পাশের দরজা দিয়ে বাথরুমে।
নিচে যখন নামলাম, দুপুরের খাবার খেতে দেওয়া হলো আর একজন কাজের মেয়ে, বয়েসে মীরা খালার চাইতে বেশ বড় মনে হলো, খাবারের পাত্রগুলো নিয়ে বারেবারে আসা যাওয়া করছিলো। খালার উৎসাহে সারা বিকেল ভাতঘুম দেওয়ার মতো ঠেসে খেলাম, তারপর সিগ্রেট জ্বালিয়ে বসলাম খালার কথা শুনতে।
শুরু করলেন নিজের বুড়োবয়েসের আর একলা-থাকার বিষয়ে একগাদা কথা দিয়ে, আর তারপরে একরাশ শুভেচ্ছা জানালেন নিজেকে কারণ এখন থেকে জোয়ান একজন আত্মীয় থাকছে তাঁর পাশাপাশিই।
যেমন ভেবেছিলাম, ছোট ছোট কাজের কথা দিয়ে শুরু হলো, টেডি নামের বিরক্তিকর কুকুরটাকে নিয়ে বেড়াতে-যাওয়া, ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে-আসা। আমার জন্যে কোনো সমস্যাই না, তাঁকে কথাটা বললামও।
কথায় এবার একটা ছোট্ট বিরতি। তারপর, খাওয়ার সময় টেডি যেখানে ছিলো মেঝের সেখান থেকে তুলে নিয়ে তিনি ওকে রাখলেন নিজের কোলে আর তাঁর ভাষায় তাঁর শখের বিবরণ দেওয়া শুরু করলেন। গত বছর বা এমনি কোনো এক সময়ে তিনি ছবি আঁকায় মন দিয়েছেন আর ওটা এখন, তাঁর কথায়, পরিণত হয়েছে খ্যাপামি-তে।
একহাতের নিচে টোডি-কে ধরে তিনি উঠে দাঁড়ান আর পাশের কড়ইকাঠের দরজা দিয়ে ঢুকে যান আর আমাকে দেখানোর জন্যে একগাদা ছবি নিয়ে বেরিয়ে আসেন।
“ডাইনিংরুমে বসেই বেশিরভাগ ছবি আঁকি,” তিনি বলেন, “ওই জায়গার আলোটা খুবই ভালো। এবার বল তো, এগুলো নিয়ে তোর মতামত কী?” হাতে তুলে দিয়েছেন পঞ্চাশ কি ষাটটা ছোট ছোট ড্রয়িং কাগজ।
ডাইনিংরুমের টেবিলে ছড়িয়ে রাখি ছবিগুলো, এঁটো ডিশগুলোর ভেতরেই, আর দেখতে থাকি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সব আঁকা পেন্সিলে, দু’একটায় দু’একপোঁচ জলরঙের ছাপ, আর সেগুলো সব একই জিনিস, একটা ছোট চিনামাটির বাটিতে চারটে আপেল।
বেশ কষ্ট করেই ছবিগুলো আঁকা; মীরা খালা বারবার মুছে-ঘষে কাগজগুলোর বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। ওগুলোর ব্যাপারে ভালো কিছু বলার জন্যে মাথার ভেতরে হাতড়াচ্ছিলাম।
“তুমি...উমম...আপেলগুলোর যে-একটা আত্মা আছে, একটা একেবারে ভেতরকার ব্যাপার আছে, সেটা দারুণ ধরেছো,” কিছুক্ষণ পর বলি নিজের ওপর জোর খাটিয়ে। “বিশ্বাস না করে পারাই যায় না।”
মীরা খালা হাসলেন। “তোর পছন্দ হয়েছে এটাই আমার খুব ভালো লেগেছে,” জবাব দেন তিনি। “আম্বিয়া-ওই কাজের মেয়েটা-বলছিলো ওগুলো নিয়ে এতো মাথা ঘামানো নাকি পাগলামি, কিন্তু, বুঝলি, যতক্ষণ না ওগুলো এক্কেবারে নিখুঁত হয়েছে আমি থামতে পারি নি, থামা সইতেই পারছিলাম না।” তিনি চুপ করেন, তারপর যোগ করেন, “জানিস রাতুল, আমি না দারুণ ঝামেলায় পড়েছিলাম!”
“তাই?”
“আপেলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিলো! কী বাজে ব্যাপার। কাজ শেষ করার পরপরই ওগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখতাম, তারপরও দু’তিন সপ্তা পরেই ওগুলো খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। তারপর আম্বিয়ার মাথাতেই বুদ্ধিটা এলো, মোম গলিয়ে ওখানে আপেলগুলো চুবিয়ে রাখা শুরু করলাম।”
“আইডিয়া তো ভালোই।”
“ভালো না? কিন্তু, কী হলো জানিস রাতুল, ইদানিং আপেল দেখলেই বিরক্তি লাগে। অন্য কিছু আঁকার চেষ্টা করছি...ধর, ভাবছি উঠোনের ওই ছোট্ট গাছটা আঁকলে কেমন হয়?”
জানালার কাছে উঠে গেলেন তিনি আমাকে গাছটা আমাকে দেখাবেন বলে। তাঁর পিছু নিলাম আমিও। একটা চারাগাছ, পাতাগুলো বেরুচ্ছে মাত্র। খালা বললেন ওটা নাকি কামরাঙা গাছ।
“ভালো লাগছে না রাতুল? তুই আজ বিকেলে টেডি-কে নিয়ে বেড়াতে গেলে আমি একবার ওটা নিয়ে বসবো।”
আম্বিয়া খালাকে কয়েকপ্রস্থ গরম কাপড় আর শাল-টাল দিয়ে মুড়ে দিলো আর আমি বাগানে তাঁর জন্যে বসার টুল, ইজেল, পেন্সিলের বাক্স আর কাগজের গাদাগুলো বয়ে আনলাম।
কোথায় বসবেন না বসবেন এই নিয়ে অনেকক্ষণ খুঁতখুঁত করলেন এবং শেষমেষ তাঁর পছন্দের একটা জায়গা খুঁজে পেলাম। তারপর, যদিও ওপরতলায় একটা মোক্ষম ভাতঘুম দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু অগত্যা টেডির বদখদ কলারটার পেছনে মফস্বল শহরটা দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।
শিগগিরই বুঝলাম যে শহরটার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে ওটার বাজারের ওষুধের দোকানটা, তারপরও প্রায় দুঘন্টা কাটালাম টেডির পেছন পেছন তার পেয়ারের লাইটপোস্টগুলোর কাছে।
ভাবলাম এসে দেখবো খালা তখনো ছবিগুলোর ওপর মুখ থুবড়ে আছেন, কিন্তু দেখি তিনি নেই, টুল, ইজেল-টিজেলগুলোও উধাও। তাকালাম আশে-পাশে, কিন্তু কোথাও তাঁর দর্শন পাওয়া গেলো না। কাজেকাজেই টেডিকে ছেড়ে এলাম ডাইনিংরুমে তার বাক্সে আর সোজা ওপরে উঠে গেলাম মিস-করা ঘুমটার ক্ষতিপূরণ করতে।
কিন্তু, ঘুম এলো না। বরং অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে আসতে থাকলো এতো কষ্ট করে আঁকা বাটির আপেলগুলোর কথা, অগত্যা বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেয়ালের ফোঁটাগুলো গুনে গুনে সময়টা কাটালাম।
রাতের খাবারটাও ভালো আর পরিমাণেও প্রচুর। কিন্তু খালার মেজাজ দেখলাম খারাপ। আম্বিয়া থালাবাসনগুলো সরিয়ে নেওয়ার পর খালা যখন টেডিকে কোলের অভ্যস্ত আসনে বসালেন, তখন জানলাম আসল ঘটনাটা...
“একেবারে জঘন্য হয়েছে আঁকাআঁকি,” অভিযোগ করলেন তিনি। “আঁকবো কি, বাতাস পাতাগুলো এতো নাড়াচ্ছিলো কিছুই আঁকতে পারি নি।”
“খুব বেশি বাতাস তো দেখলাম না খালা,” বেকুবের মতো বলে ফেলি।
“তোর চোখে তো কিছুই পড়ে না!” রেগে ওঠেন তিনি। “পাতাগুলো একটা মিনিটও যদি স্থির থাকতো।”
তাড়াতাড়ি ভুল শোধরানোর চেষ্টা করি।
“তোমার মতো দক্ষ শিল্পীর জন্যে অবশ্য মনোযোগ দিতে না পারাটাই স্বাভাবিক,” খালাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা চালাই। “সরি। হয়েছে কি, শিল্পীদের সাথে তো বেশি থাকি নি।”
খালাকে শিল্পী সম্বোধন করায় তাঁর রাগ কিছুটা পড়ে।
“না রে, আমি তো জানি তুই আমাকে আঘাত দিতে চাস নি,” তিনি বলেন।
“আসলে কোনোকিছু একেবারে স্থির না হলে আমি ওটা নিয়ে কাজ করতে পারি না। গাছটা আঁকতে ভালোই লাগছিলো। ভাবছিলাম...” একদম চুপ মেরে যান তিনি, দু’কাপ কফি খাওয়া ছাড়া মুখ খোলেন না এসময়ের মধ্যে।
“রাতুল,” শেষমেষ কথা ফোটে, “ভাবলাম। কালই তুই গাছটা আমার জন্যে কেটে ঘরে নিয়ে আসবি। দু’লিটারের একটা সেভেন-আপের বোতলের মাথা কেটে ওটাকে ওখানে ঢুকিয়ে রাখবো। তাহলে বাতাসের ঝামেলাটা থাকছে না, আর আমিও শান্তিতে ছবিটা আঁকতে পারবো।”
“কিন্তু এতো সুন্দর একটা চারাগাছ,” আমি প্রতিবাদ জানাই। “আর তাছাড়া কেটে ফেললে তো ওটা বেশিদিন টিকবেও না।”
“ওহো, ওটা তো স্রেফ একটা গাছ,” তাঁর জবাব। “নার্সারি থেকে আরেকটা আনিয়ে নিলাম না হয়। আর শুকিয়ে যাবে বলছিস? এদিকে আম্বিয়ার হাত খুব ভালো। পানিতে অ্যাস্পিরিন আর চিনি দিয়ে ফুলটুলগুলো এমন করে রাখে একেবারে দিনের পর দিন চলে যায়। তবে হ্যাঁ, আমাকেও তাড়াতাড়ি হাত চালাতে হবে। যদি ধর সকালে দু’তিনঘন্টা আর দুপুরে খাওয়ার পরে এই চার-পাঁচ ঘন্টা করে দিই তাহলে কিছু একটা দাঁড় করাতে পারবোই।”
তাঁর মতামতই শেষ সিদ্ধান্ত।
পরদিন সকালে নাস্তার ঠিক পরপরই, মীরা খালা আমায় বাড়ির পেছনের বাগান-ঘরে নিয়ে সেখান থেকে একটা জং-ধরা করাত আমার হাতে গছিয়ে দেন। করাতটায় যখন ধার দিচ্ছিলাম তখন উনি হিংস্র আগ্রহ নিয়ে ব্যাপারটা দেখছিলেন। এরপর নিয়ে গেলেন আমায় অকুস্থলে। কয়েকবার করাত চালিয়ে চারাটা গুঁড়ি থেকে যখন কেটে ফেলছিলাম, নিজেকে মনে হচ্ছিলো খুনী, এরপর ওটাকে ঘরে ঢোকালাম।
দিনের বাকি সময়টা আর এর পরে তিন-চার দিন ধরে বাগানেই কাজ করলাম। বাগান করতে আমার খুব ভালো লাগে, আর ওখানে কিছু কিছু ভালো গাছপালা আছে যেগুলো এতদিন ধরে খুব অবহেলায় পড়ে ছিলো। কিছু মৌসুমি গাছ লাগালাম আর চারদিকের মাটি কুপিয়ে সেখানে হাড়ের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিলাম। বাগানের শেডে কে যেন রেড অ্যারো আর নিকোটিন সালফেট এনে রেখেছিলো, অ্যাফিড আর গুবরেদের ওপর সেগুলো ছিটিয়ে বেশ মজার সময় কাটালাম।
শুক্রবার সকালে নাস্তার টেবিলে দেখি আমার সামনের টিস্যু কাগজটায় মোড়ানো একটা পাঁচশো টাকার নোট। ভুরু তুললাম। মাথা নাড়লেন মীরা খালা, হ্যাঁ, ওটা আমার জন্যেই, তাঁর ফুলোফুলো গালে খেলে গেলো একটা হাল্কা লাল আভা।
ওটা সযত্নে ভাঁজ করে আমার পকেটে রাখলাম। বুড়ি খুকির জন্যে একটা উষ্ণ কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নিলো বুকের ভেতর। আমায় সিগ্রেটের পয়সা জোগানোর বুদ্ধিটা তাঁর চমৎকার। ভাবলাম বিকেলে ওঁর জন্যে কিছু একটা উপহার কিনে আনবো।
শিগগিরই আবিষ্কার করলাম যে সেধরনের জিনিস এই শহরে বিশেষ নেই। একটা চিনেমাটির শো-পিস আর একটা বৌলে ভর্তি পাখা-ল্যাজা গোল্ডফিশের মধ্যে তুলনা করে মনে হলো মাছগুলোই বেশ প্রাণবন্ত হবে। কথাপ্রসঙ্গে দেখা গেলো আমায় মাছটা যে বিক্রি করেছে সেই নাজিম আসলে অনেকদিন ঢাকায় ছিলো আর আমরা কিছুটা পরিচিতও। পরদিন রাতে ওর সাথে আড্ডা মারার জন্যে সময় নিয়ে রাখলাম।
মীরা খালা মাছটা পেয়ে সত্যিই খুশি হলেন। মাছগুলোর লেজ-বাঁকানো আর লেজের স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক আহাউহু করে বৌলটা রাখলেন তাঁর ইজেলের পাশে।
জীবনটা ছকে বাঁধা পড়ে গেছে। সকালে আর বিকেলের শুরুর দিকে মীরা খালা আঁকতে বসবেন ডাইনিং-রুমে আর আমি বাগানে সময় দেবো। দিনের বাকি সময়টা জুড়ে চিঠি ডাকে দিতাম, টেডিকে নিয়ে বেড়াতে যেতাম, আর ঘরের টুকিটাকি মেরামতির কাজগুলো সারতাম।
এখানে থাকতে আসার দ্বিতীয় সপ্তার মাঝ বরাবর কামরাঙার চারাটা একেবাবে শুকিয়ে গেলো। রাতে খাবার টেবিলে আসন্ন দুর্যোগ ঘোষণা করার গলায় তিনি জানালেন যে ওটা তিনি বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছেন। দুর্যোগটির আগে করা তাঁর বত্রিশটা ছবির সবগুলোই আমরা দেখলাম ভালো করে খুঁটিয়ে।
ওগুলোর মধ্যে একটা নিয়ে আমি ঘোষণা করি যে অন্যগুলোর চাইতে ওটার মূল্যমান বেশি। খালা জানান যে ওটা তাঁরও বেশ পছন্দের, আর সবকিছুই ঠিকঠাক। অবশ্য দেখলাম যে পরে কী আঁকবেন, তা নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছেন তিনি।
পরদিন পুরো বাড়িতে পাগলের মতো আঁকার কিছু খুঁজে বেড়ালেন তিনি। নেমে এলেন উঠোনে যেখানে আমি ঝুমকোলতার চারা লাগাচ্ছি, জানতে চাইলেন এটা কিংবা ওটা তাঁর পেন্সিলের জন্যে যুৎসই হবে কি না। দুপুরের খাবার খেতে যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম গোল্ডফিশের বৌলটার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছেন তিনি, কিন্তু তখন কিছুই বুঝতে পারি নি।
সে-রাতে নাজিমের বাসা থেকে আড্ডা-টাড্ডা মেরে যখন বাসায় ফিরেছি তখন দরজাতেই আমাকে পাকড়াও করলেন খালা আর রহস্যময় বিজয়ী ভঙ্গিতে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
“ব্যাপারটা নিয়ে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম প্রথমে,” তিনি বলে চলেন, ফ্রিজের দরজায় হাত রাখা তাঁর, “কিন্তু যা দারুণ হয়েছে জিনিসটা!” ফ্রিজটা খোলেন তিনি, ওর ভেতরে হাতড়ান কিছুক্ষণ, আর বের করে আনেন গোল্ডফিশের বৌলটা। ওর ওপরে এরই মধ্যে জলকণা জমছে। হাঁদারামের মতো ওটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
“জানতাম, মাছটা কোনোদিন একজায়গায় থাকবে না, কিন্তু ওর ছবিটা আঁকার জন্যে মরে যাচ্ছিলাম,” তিনি বলে চলেন। “তাই ভাবলাম আর ভাবলাম। আর হঠাৎই মাথায় বুদ্ধিটা এলো, আমার নিজের হলেও বলি দারুণ বুদ্ধি! ঠান্ডার মিটারটা আরো নিচে নামিয়ে দিলাম, বৌলটা রাখলাম, আর ঘন্টাখানেক পর ফিরে এসে দেখি জমে একেবারে বরফ!
“ভয় পেয়েছিলাম ঠান্ডা হওয়ার পর জমে বৌলটা ভেঙে যায় কি না, কিন্তু ভাঙে নি। দ্যাখ, বরফটা কী দারুণ পরিষ্কার।” একটা ডিশ-মোছার তোয়ালে নিয়ে ওটার ওপরটা মুছে জমা-জলটা সাফ করে নেন তিনি যাতে বরফে জমে-যাওয়া দুটো গোল্ডফিশকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। “এখন কোনো ঝামেলা ছাড়াই ছবিটা আঁকা যাবে। কী অসাধারণ, না রে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলাম, হ্যাঁ, অসাধারণ, আর নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে ওঠা শুরু করলাম ওপরে। ঘটনাটা আমার মুখের ভেতর যেন একটা বাজে স্বাদ রেখে গেছে। এমন না যে গোল্ডফিশগুলোর অমরত্ব নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিলো, কিন্তু ...
ওগুলোর সাঁতার-কাটা দেখতে উনি এতো পছন্দ করতেন, আর তাঁকে ওগুলো উপহার দিলাম আমি আর... ওঃ, গোল্লায় যাক!
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে কিছুটা মন খারাপ আমার, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কেনো। যখন মনে পড়লো, ঠিক করলাম বেশ হাসিখুশিই থাকবো। দু’টো গোল-চোখো মাছের মৃত্যুর জন্যে মন খারাপ করা গাধামির চূড়ান্ত। শিস দিতে দিতে নামলাম সকালের নাস্তা করতে।
খাওয়া শেষ হলে পরে, মীরা খালা বৌলটা বের করে নিলেন রেফ্রিজারেটর থেকে আর কাজে লেগে গেলেন। আমি শেডে গিয়ে রঙের স্প্রে-গানটা নিয়ে কতক্ষণ খেলা করলাম।
বাড়িটার নোংরা রঙ-চটা দেয়ালগুলো দেখে মাথায় একটা আইডিয়া এলো। ওগুলো রঙ করে ফেলি না কেন? কথাটা খালাকে জানালাম আর অনুমতিও পেয়ে গেলাম। কিছু হিসেব-নিকেশ করে, স্টোর থেকে এক বালতি রঙ নিয়ে লাগানো শুরু করলাম।
কাজ এগোয় ধীরগতিতে। দিন চলে যায় আর আমি রঙের দোকানে পরিচিত খদ্দের হয়ে উঠি। বিশাল বাড়িটায় রঙের প্রথম পোঁচটা লাগাতে লাগাতে মীরা খালা জমাট গোল্ডফিশগুলোর একাশিটা ছবি আঁকা শেষ করে ফেলেন, আর রঙ-লাগানোটা এতো বাজে হয়েছে যে কমপক্ষে আরো দু’বার লাগাতে হবে।
বসন্তটা হঠাৎ করে আগেভাগে গরমে বদলে যায়, আর আমি তখনো বাড়ি রঙ করে চলি আর মীরা খালা এঁকে চলেন গোল্ডফিশের ছবি। দু’জনেই নিজের নিজের কাজে ভীষণ মগ্ন।
সময়টা খুব ভালো কাটছিলো আমার। নাজিম আমায় তার বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, শ্যামলা মেয়েটার মধ্যে মধু আর কাঁটা দুটোই আছে, এরকম মেয়েই আমার পছন্দের, আর তার নিজেরও ছিলো একজন। প্রতি সপ্তাহেই দু’একবার বাইরে রাত কাটাতাম আমরা। ঢাকায় আমার ভাড়া না-দেওয়া ঘর, চাকরির জন্যে লক্ষ্যহীন ঘোরাঘুরি, আর পেটভর্তি খিদে, মনে হয় সে যেন অনেক দূরের দেশের কথা।
মীরা খালার গোল্ডফিশ-পর্বের সমাপ্তি ঘোষণার ঠিক আগের দিনই বাড়িটা রঙ-করা শেষ করে ফেলি। ইচ্ছে হলো বিজয়োৎসব করি। সাবানের ফেনা আর নিকোটিন সালফেট মেশালাম, দু’এক ফোঁটা রেড অ্যারো ঢাললাম আর বাতিল গাছপালাগুলোতে ইচ্ছেমত ছিটিয়ে দিল খুশ করলাম।
(ক্রমশ)
---মহাস্থবির জাতক---
মন্তব্য
পুরাটাই পড়লাম......
পড়ার জন্যে শুকরগুজার। কিন্তু, পড়ে কেমন লাগলো বললেন না?
---মহাস্থবির---
ভারি সুন্দর হয়েছে!
মহাস্থবির জাতক, আপনাকে অভিনন্দন জানাই।
--আরিফ বুলবুল,
ধন্যবাদ হে গীতিকার, সুরকার, আর কি কি জানা নেই...
---মহাস্থবির---
ভালো লাগলো, পরের পর্ব চাই তাড়াতাড়ি।
আমার অতলান্ত সৌভাগ্য।
প্রথম পাতা থেকে না সরিলে তো পরের পর্ব দিতে পারি না, ভ্রাত।
শুভেচ্ছা...
---মহাস্থবির---
লিখে তৈরি করে রাখুন, লেখা নীড়পাতার মায়া কাটালেই ঝপাং করে পাতে ফেলে দেবেন!
খাসা স্বাদ বলে পাত পাতাই আছে, কেবল ঝপাং করে পড়ার দেরি...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
দারুন হয়েছে।
++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আপনার মন্তব্য আমার অনুপ্রেরণা।
ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা আপনার ও আপনার সুখী পরিবারের জন্যে।
---মহাস্থবির---
অনেক ভালো তো।
মুল গল্পের লিঙ্ক দিতে পারবেন প্লিজ?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
দুঃখিত। আমি আসলে এই বইটা থেকেই অনুবাদ করেছি।
ধন্যবাদ।
---মহাস্থবির---
আগে কখনো কি লেখাটা অন্যকোথাও ছাপা হয়েছে? প্রথম থেকেই আমার মনে হচ্ছে আমি আগে পড়েছি... কিন্তু মনেও করতে পারছি না। কোন পত্রিকায় কি এটা দিয়েছিলেন?
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আমি অন্য কোথাও পড়ি নি। অনুবাদ এই প্রথম লোকচক্ষুগোচর করলাম।
ধন্যবাদ।
---মহাস্থবির---
ভালো লেগেছে অনেক, পরের টুকুর প্রতিক্ষায়!
নতুন মন্তব্য করুন