পরদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে মীরা খালা আমায় গোল্ডফিশের আঁকা শেষ ছবিটা দেখালেন আর প্রায় পুরো সময়টাই আমরা ছবিগুলো নিয়ে কথায় মেতে রইলাম। তাঁর ছবির বিষয়বস্তুগুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে আমার ঘেন্না হচ্ছিলো, কিন্তু মনোভাবটা চেপে রাখলাম প্রায় পুরোটা সময়।
শেষদিকে তিনি বললেন, “রাতুল, একটা কথা ভাবছিলাম। তোর কি মনে হয় আমার ছবির পরবর্তী বিষয় হিসেবে টেডি ভালো হবে?”
তাকালাম খালার কোলে টেডির দিকে, সম্মতি জানালাম, কিন্তু সে কি অতক্ষণ চুপচাপ একজায়গায় বসে থাকবে?
খালাকে বেশ চিন্তামগ্ন লাগছিলো।
“ঠিক জানি না,” তিনি বললেন। “অন্য কোনো উপায় ভাবতে হবে। ওকে ধর সকালের ব্রেকফাস্টের ঠিক পরে ডিনারটা দিয়ে দিলাম। কিংবা...।” গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি আর আমি তাঁকে না ঘাঁটিয়ে কিছুক্ষণ পরে নাজিমের বোন তিন্নির সাথে দেখা করার জন্যে কেটে পড়লাম।
দু’জনে দু’জনার হাত ধরে বসে রইলাম বারান্দায়, বাতাসে হাস্নাহেনার মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসতে লাগলো আমাদের দিকে। মধুর, বিষণ্ন, আবেগী সে-সন্ধ্যা।
পরদিন বৃহস্পতিবার। ব্রেকফাস্টের পর খালা বললেন টেডি-কে নিয়ে একটু বাইরে বেড়িয়ে আনার জন্যে যাতে ফেরার পরে সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফিরে এলে তিনি তাকে পেটপুরে খাওয়াবেন আর তাঁর আশা যে খাওয়া প্লাস এই ব্যায়ামের ফলে মডেল হিসেবে তাকে আঁকতে আর বিশেষ বেগ পেতে হবে না।
বাধ্যগত আমরা পথচলা আরম্ভ করলাম। টেডি আর আমি শহরের প্রতিটা লাইটপোস্ট অন্তত দুবার করে ঘুরে তল্লাশ করলাম, আর যখন ফিরলাম ততক্ষণে সে যদি ক্লান্ত হয়ে না-ও পড়ে, অন্তত আমি তো পড়েছি। কলারটা ধরে খালা তাঁকে টেনে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে যেখানে অপেক্ষা করছে তার খাবারে উঁচু আর ভর্তি থালা।
বাচ্চা শুয়োরের মতো পেট ভরে খেলো টেডি। খাওয়া শেষ করে সে তৃপ্তির সাথে পড়ে রইলো রান্নাঘরের মেঝেতে। খালাকেই ওকে কোলে করে নিয়ে যেতে হলো ডাইনিংরুমে, ইজেলের কাছে একটা রোদভরা জায়গায় শুইয়ে দিলেন ওকে। যখন ঘর ছাড়ছি তখন সে গভীর ঘুমে নাক ডাকাচ্ছে।
দুপুরের খাওয়া সেদিন হলো দেরিতে, প্রায় আড়াইটায়, যাতে মীরা খালা টেডির ক্লান্তির পুরো সুযোগ নিতে পারেন। আমার পেটে খিদে আর আম্বিয়া খাওয়াটাও বানিয়েছে দারুণ, চিকেন ভুনা আর দেশি কাতলার ঝোল। তাতে করে ফ্রুট কাস্টার্ডটা শেষ না করে খালার দিকে নজর দেওয়ার অবকাশ আমার ছিলোই না। তারপরেই খেয়াল করলাম তিনি বড্ড অন্যমনস্ক আর মনমরা।
“মীরা খালা, সকালের ছবি আঁকাটা ভালো হয় নি?” জিজ্ঞেস করি।
জোরে মাথা নাড়েন খালা আর তাঁর কানের দুলগুলো প্রবলভাবে নেচে ওঠে।
“না রে রাতুল, হয় নি। টেডি...” থেমে যান তিনি, মন খারাপ তাঁর।
“ব্যাপার কী? ও কি ঘুমায় নি?”
খালা অন্যধরনের মহিলা হলে বোধহয় একটা ব্যঙ্গের হাসি দিতেন। কিন্তু তিনি দিলেন একটা ছোট্ট, মৃদু নাকঝাড়া।
“হুঁ, ঘুমিয়েছে সে,” তিনি বলেন। “হ্যাঁ, সে ঘুমিয়েছে বটে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে সারাক্ষণ এদিক সেদিক চুলকাচ্ছে, লাফাচ্ছে, নড়াচড়া করছে। না রে, রাতুল, ছবি আঁকা একদম অসম্ভব ছিলো। যেন ঝড়ের মধ্যে গাছের ছবি আঁকছি!”
“তাহলে তো বড্ড খারাপ হলো। এখন তো মনে হয় তোমার অন্য কোনো বিষয় খুঁজতে হবে।”
কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বললেন না আমার খালা। তাকিয়ে মনে হলো, চোখে যেন তাঁর জলকণা চিকচিক করছে।
“হ্যাঁ,” আস্তে আস্তে তিনি বলেন, “মনে হয় আমি...ভাবছি, বিকেলে শহরে যাবো, কয়েকটা জিনিস কিনবো টেডির জন্যে।”
একমুহূর্তের জন্যে মনে হলো আমার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা কিছু একটা যেন উঠছে আর নামছে। তারপর চলে গেলো অনুভূতিটা, আর ভাবতে লাগলাম বুড়ি খুকিটা কী ভালো, ছবি আঁকাকে কী গুরুত্বই দিচ্ছেন, আচ্ছা কুকুরটাকে একজায়গায় বসিয়ে রাখার জন্যে তিনি কী নিয়ে আসতে পারেন...
রাতের খাওয়ার ঠিক আগেই খালা আমার কামরায় এলেন, দেখালেন কী কিনেছেন টেডির জন্যে। একটা ছোট ঘন্টা লাগানো লাল বেল্ট, একটা বড়সড় হাড়, আর বেশকিছু ভালো কুকুরদের বিস্কুট।
দেখতে লাগলাম বেল্টটা পড়ালেন টেডির গলায়, তারপর দুটো বিস্কুট খেতে দিলেন ওকে, ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিলো বেশ মজাই পাচ্ছে সে...
শুক্রবার সকালে উঠে বসলাম, হাড়গুলোকে একটু নাড়াচাড়া করলাম যতক্ষণ না ঘড়ি জানান দিলো যে আজ গোটাদিন মেয়েদের সাথে আমার আর নাজিমের বাইরে থাকার যে প্রোগ্রাম করেছি, দেরি করতে না চাইলে এখনই বেরুনোর সময়।
সবাই মিলে গ্রামের দিকে গেলাম। ভালোই কাটলো সময়টা। নাজিম পা পিছলে পড়ে গেলো একটা বিষকাটালির ঝোপে আর হাসতে হাসতে তিন্নি একটা শুঁয়োপোকা আমার কাঁধে ছেড়ে দিলো।
বাড়িতে যখন ফিরলাম তখন বেশ অন্ধকার। ভেতরে ঢোকার আগেই খেয়াল করেছি বাতিগুলো সব নেভানো আর কেমন যেন সন্দেহজনক আবহাওয়া।
দরজা যখন খুললাম দেখি মীরা খালা ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে, প্রায় ফিট হওয়ার মতো অবস্থা। আম্বিয়া তাঁর নাকের সামনে একটা স্মেলিং সল্টের শিশি ধরে আছে।
“আমার টেডি! ” খালা আমাকে দেখেই ফুঁপিয়ে উঠলেন। “রাতুল রে, ও তো...”
তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে জড়িয়ে রাখলাম, খালা এবার ভেঙে পড়লেন কান্নায়। চোখের জল তাঁর পাউডার-মাখা গালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে ঝরে পড়ছিলো তাঁর শাড়ির জমিনে।
“টেডি,” তিনি হাহাকার করে উঠলেন। “ও রাতুল, ও তো চলে গেলো রে!”
অবচেতনে প্রত্যাশা করছিলাম এটাই, তবুও লাফিয়ে উঠলাম।
“কী হয়েছিলো?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“ঘন্টা তিনেক আগে ওকে উঠোনে অল্পক্ষণ দৌড়ানোর জন্যে ছেড়ে দিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ পরও যখন সে আসছে না, শেষে আমি নিজেই দেখতে গেলাম। ওকে ডাকছি তো ডাকছিই, শেষপর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেলো একটা অপরাজিতার ঝাড়ের নিচে। খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারপর আমি ডাক্তার ডাকলাম, কিন্তু উনি আসতে আসতেই বেচারা ছোট্ট টেডি চলে...চলে গেলো। নিশ্চয় কেউ ওকে বিষ খাইয়েছিলো।” আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
খালার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে সান্ত্বনার কথা শোনাতে লাগলাম, কিন্তু আমার মন ব্যস্ত অন্যদিকে। প্রতিবেশীরা কেউ নাকি? টেডি চুপচাপ ছোট্ট জানোয়ার বটে, কিন্তু মাঝেসাঝে সে ডাকতো, আর অনেকেই কুকুর প্রাণীটাকে সহ্য করতে পারে না।
“ডাঃ আনোয়ার খুবই ভালো মানুষ, আমার দুঃখটা বুঝলেন। বেচারা ছোট্ট টেডি-কে একটা ব্যাগে ভর্তি করে নিয়ে গেছেন উনি। ওকে উনি একটা লোকের কাছে নিয়ে যাবেন, সে ওকে স্টাফড করে দেবে।”
স্টাফড? পিঠের ডানায় আর হাতের নিচে ঠান্ডা ঘাম বেরিয়ে এলো। যন্ত্রের মতো রুমালটা পেছন-পকেট থেকে বের করে খালার হাতে তুলে দিলাম।
রুমালটা নিয়ে খালা চোখ মুছলেন। “এটুকু ভেবেই ভালো লাগছে যে,” নাক ঝাড়লেন তিনি, “তার জীবনের...শেষ...সময়টা...অন্তত ভালো কেটেছে।”
তাঁকে নিজের কামরায় নিয়ে গিয়ে একটা ঘুমের ওষুধ খেতে দিলাম। ওষুধটা না খাওয়া পর্যন্ত তাঁর পাশেই থাকলাম, শান্ত করতে চেষ্টা করলাম আর হাত চাপড়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে তাঁকে ভালোমত শান্ত করে ফিরলাম নিজের ঘরে।
বিছানায় শুয়ে রইলাম আর তাকিয়ে থাকলাম ছাদের দাগগুলোর দিকে। বুক ধুকধুক করছে আমার জোরে জোরে আর খুব তাড়াতাড়ি। দ্রুত পকেটে হাত দিলাম সিগ্রেটের জন্যে আর শুরু করলাম সিগ্রেট-টানা।
ওখানে শুয়ে শুয়েই শেষ করে ফেললাম পুরো প্যাকেটটা, তাকিয়ে আছি ছাদের দিকে, কিছুই ভাবছি না, মন রেখেছি নিষ্ক্রিয়, শুধু একটা প্রায়-অচেতন চেষ্টা, কোনো একটা জায়গা থেকে যেখান থেকে চাইছি না কিছু বেরিয়ে আসুক। প্রায় বারোটায় বেড়াতে যাওয়ার জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় লম্বা হলাম।
পরদিন মনটা বেশ ভার ভার লাগছিলো। ঘুমালাম অনেকক্ষণ, কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। মীরা খালা খাওয়ার টেবিলে এলেন পরে, ততক্ষণে আমি আমার খাওয়া ফেলে রেখেছি এক পাশে। চোখ তাঁর লাল। তাঁকে সুপ্রভাত জানিয়ে চলে গেলাম বাগানে।
দিনটাও স্যাঁতসেঁতে আর মেঘলা। কিছু করার কোনো ইচ্ছেই জাগছে না মনে। কতক্ষণ দোপাটিগুলোর কলি ছিঁড়লাম আনমনে, শুকনো ফল থেকে বিচি বের করলাম; তারপর ঠিক করলাম কাঁটা মেহেদির ঝোপগুলো কাঁচি দিয়ে ভালো একটা ছাঁট দেবো। অনেক আগেই কাজটা করা উচিত ছিলো। কাজটা শেষ করে চলে গেলাম বাগান-ঘরে, গাছগুলোর ক্ষতে লাগানোর জন্যে তিসির তেল আর স্পিরিট মিশিয়ে একটা আরক বানাবো।
স্পিরিটের বোতলটা হাতে নিতে গিয়ে কোনার দিকে একটা অপরিচিত জেল্লা চোখে পড়লো। লেড আর্সেনেটের একটা বোতল। বোতলের গায়ের কাগজে যথারীতি খুলি আর আড়াআড়ি জোড়া হাড়। বোতলটা খুললাম। বিষের প্রায় সিকি ইঞ্চি গায়েব।
বোতলটা আগে থাকতেই পারে ঘরটায়; ওটা যে ছিলো না সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না। ওই কথাটাই মাথায় রাখলাম: আমি নিশ্চিত না।
বাকি দিনটা কী যে করেছি, নিজেই ঠিক জানি না। বোধহয় বাগানের ভেতর ঘুরপাক খেয়ে বেরিয়েছি সারাক্ষণ, চেয়েছি সব ভাবাভাবি দূরে ঠেলে রাখতে, রাতের খাবার পর্যন্ত এইভাবে চললো। মীরা খালা জানালার কাছে একবার এলেন, জানতে চাইলেন দুপুরের খাওয়াটা খাবো কি না, জানালাম খিদে লাগে নি।
উনি বোধহয় সারা সময়টা ড্রয়িং-রুমে টেডির বাক্সোটার দিকে তাকিয়েই কাটিয়েছেন।
যাই হোক, কাটিয়ে উঠলাম। দু’তিনদিন পরে, যখন টেডি খড়-ঠাসা হয়ে ফিরলো, ততদিনে আমি ব্যাপারটা মনের এতো গভীরে ঠেলে দিয়েছি যে আমার প্রতিক্রিয়া হলো কিঞ্চিৎ মজা-করার আর কিছুটা ব্যাখ্যার অতীত।
এমনকি যখন মীরা খালা হাতে তুলে নিয়েছেন পেন্সিল আর শুরু করেছেন ছোট্ট খড়-ঠাসা প্রাণীটার অন্তহীন স্কেচের পালা, তখনও আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যদি কেউ জানতে চাইতো, বলতাম যে পোষা প্রাণীটা এতো ভালো উনি বেসেছিলেন, তাকে আঁকার চেষ্টা করাটাই তো স্বাভাবিক।
টেডিকে যখন খালা আঁকছেন বারবার, তখন আমি ঘরটার চাল ঠিক করতে লেগেছি। কাজটা ঝামেলার কারণ পুরনো আমলের গম্বুজ আর ভাঙা মিনারে ছাদটা ভর্তি, আর যখন আসবে বলে ভেবেছিলাম, তার ঢের আগেই চলে এসেছে গ্রীষ্মকাল।
মীরা খালা অনুরোধ করলেন আমায় থামার জন্যে, কিন্তু চুপচাপ বসে থাকাটা আমার জন্যে অসম্ভব।
ছাদের কাজ শেষ করে, ঘরের পেছনে চারাগুলোর জন্যে বেড়া দিয়ে একটা নার্সারি-মতো বানানো শুরু করলাম। প্রতি রাতেই দেখা করতে যাই তিন্নির সাথে, নিজেকে বলি খুব ভালো আছি আমি। টের পাই একটু একটু ওজন কমছে নিয়মিত, কিন্তু ভান করি যেন সিগ্রেট বেশি খাওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে।
অগস্টের শেষ দিকের একটা গরম রাতে, খালা টেডির যেসব ছবি এঁকেছেন সেগুলো নিয়ে এলেন আর আমি ওগুলো নিয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করলাম।
“মনে হয় আরো কয়েকটা আঁকা আমার উচিত ছিলো,” বললেন খালা, আমি তখন সরিয়ে রাখছি শেষ ছবিটা। “আর তারপর...হুঁ, অন্য কিছু ধরতেই হবে।” তাঁকে দুঃখী দেখায়।
“হ্যাঁ,” আমি বলি যান্ত্রিকভাবে। বিষয়টা কেমন যেন অস্বস্তিতে ফেলতো আমায়। কিন্তু খুব যত্ন করে চেপে রাখতাম আমার উদ্বেগ, জানি না কেন।
“রাতুল,” মিনিটখানেক পরে বলেন তিনি। অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে তাঁর চেহারা আরো খারাপ। “একটা বুড়িকে খুশি করার জন্যে তুই অনেক করেছিস রে। ওই তিন্নি মেয়েটার সাথে যে এতো ঘুরে বেড়াচ্ছিস, ওকে কি তোর সত্যিই ভালো লাগে?”
“মানে, ইয়ে...হ্যাঁ। হ্যাঁ, লাগে।”
“হুঁ, ভাবছি। রাতুল, যদি এই শহরে ছোটো একটা নার্সারি করার মতো টাকা তোকে যদি অগ্রিম দেই, তাহলে তোর কেমন লাগবে? ওসব ব্যাপারে তোর দারুণ একটা প্রতিভা আছে। নিশ্চয় তোকে মিস করবো খুব, কিন্তু তুই চাইলে...আমি ঠিক জানি তিন্নির সাথে তোর খুব সুখেই দিন কাটবে, আর...।” গলা ধরে এলো তাঁর, এবং আর কিছুই তিনি বলতে পারলেন না।
ওরে বুড়ি সোনা! টেবিলের পাশ দিয়ে ঘুরে তাঁর কাছে গেলাম আর জড়িয়ে ধরে তাঁকে দিলাম চুমু। আমি যে কত খুশি হবো আর যেটা তিনি চাইছেন সেটা যে আমি কি পরিমাণে চাইছি সেটা বলতে অনেক কষ্ট হলো। নিজের একটা ব্যবসা, আর তিন্নি হবে আমার বউ! আলাদিনের জিনের চাইতেও মহান আমার খালা!
পরে বসে দু’জনে নার্সারি নিয়ে বিশদ আলোচনায় মাতলাম, কোথায় হবে, কোত্থেকে যোগাড় করা হবে, বিজ্ঞাপন, নিয়মনীতি, যেসব নিয়ে আমার আগ্রহ, আর মীরা খালা বেশ মজা পাচ্ছিলেন আমার কথা শুনতে।
যখন ওপরে নিজের ঘরে গেলাম, তখন এতো খুশি লাগছিলো যে বিছানায় শোয়ার কথা ভাবতেই পারছি না। কাপড় বদলাতে বদলাতে শিস দিচ্ছিলাম। আর, না ভাবার পরেও বিছানায় শুয়েই চোখ বুজে এলো ঘুমে।
ভোর তিনটের দিকে ঘুম ভেঙে গেলো, আমার মন একটা পরিবর্তনের অতীত দৃঢ়তায় স্থির। যে সন্দেহ ছিলো আমার মনের গভীরে, যা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে, তা-ই যেন আমার ঘুমের মধ্যে জেগে উঠেছে, আর পরিণত হয়েছে এক অটল নিশ্চয়তায়।
বিছানার কোনায় বসেই রইলাম পায়জামা পরে, কাঁপছি।
মীরা খালা আমায় খুন করতে চান।
ভালোবেসে, দুঃখের সাথে, তিনি আমার খাবারে বা পানীয়তে মেশাবেন বিষ। ভালোবেসে, দুঃখের সাথে, আমার কষ্ট দেখবেন তিনি আর বালিশটা রাখবেন টানটান করে।
চোখে জল নিয়ে, তিনি ডাক্তারকে ডাকতে সময় নেবেন যাতে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তিনি বড় মনোকষ্টে ভুগবেন। আর আমার মরার পরে তিনি ঢাকার সবচে’ ভালো রসায়নবিদকে ডেকে আমার দেহটা চমৎকার সংরক্ষণ করবেন।
সপ্তাখানেক পরে, দিনে আঠারো ঘন্টা করে আমার ছবি আঁকার পর, তিনি আমায় পাঠাবেন মাটির ভেতরে, বড় কষ্ট মনে নিয়ে, কিন্তু এটুকু সুখ তাঁর হৃদয়ে জাগ্রত থাকবে যে আমার মৃত্যুর আগের শেষ সময়টা বড় ভালো কেটেছিলো। বুঝতেই পারছেন টেডির বেলায় যেটা লাল কলার আর বড় হাড়, আমার বেলায় সেটা নার্সারি ব্যবসা আর তিন্নির সাথে বিয়ে।
চটজলদি একবার নজর বুলিয়ে নিলাম আমার যুক্তিশৃঙ্খলের ওপর। কোনো খুঁত নেই। কিন্তু আরো একটা ব্যাপার আছে। নিজের চোখে-দেখা প্রমাণ চাই।
লুঙ্গিটা পরে পা টিপে-টিপে বারান্দা ধরে নিচতলায় নেমে এলাম। বাগান-ঘরে এসে ম্যাচ জ্বালিয়ে স্পিরিটের শিশির পেছনে তাকের সেই জায়গাটা খুঁজলাম যেখানে লেড আর্সেনেটের বোতলটা থাকার কথা। ওটা সেখানে নেই।
নিজের ঘরে ফিরে এলাম, জামা পরে নিলাম, স্যুটকেসে ঝটপট ভরে নিলাম দরকারি দু’চারটে জিনিস আর চিরাচরিত নিয়মে পালালাম। মানে, বিছানার চাদর পাকিয়ে দড়ি বানালাম, বাঁধলাম বিছানার সাথে, আর ওপরতলা থেকে ওটা ফেলে দিলাম মাটিতে। চট্টগ্রামে পৌঁছানোর সবচাইতে আগের বাসটা ধরলাম।
মীরা খালার কাছ থেকে আর কোনো খবর পাই নি। ঢাকায় গিয়ে তিন্নিকে ক’টা কার্ড পাঠিয়েছিলাম, ঠিকানা দিই নি, শুধু জানাতে চেয়েছিলাম আমি তাকে ভুলি নি। কিছুদিন পরে একটা প্রাইভেট ফার্মে ঢুকি আর চমৎকার এক মেয়ের সাথে আলাপ হয়। ঘটনা একটা থেকে অন্যটায় গড়ায়, আর আমরা বিয়ে করে ফেলি।
কিন্তু একটা ব্যাপার জানার দারুণ আগ্রহ রয়ে গেছে আমার। মীরা খালা এরপর কী এঁকেছিলেন?
---মহাস্থবির জাতক---
মন্তব্য
দারুণ! চমৎকার অনুবাদ।
ওয়াও, দারুণ, সত্যি চমৎকার।
মহাস্থবির জাতক,
আপনাকে অভিনন্দন। অনেক অনেক আনন্দ পেলাম আপনার অনুবাদ পড়ে। সুন্দর একটি গল্পের খুব সুন্দর অনুবাদ করেছেন। মূল গল্পকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইল ।
-- আরিফ বুলবুল,
সবাইকে অনাবিল শুভেচ্ছা।
গল্প: দ্য পার্ফেকশনিস্ট
মূল লেখক: মার্গারেট সেন্ট ক্লেয়ার
রবিজয়ন্তীর শুভেচ্ছা
---মহাস্থবির---
নতুন মন্তব্য করুন