জহিরুল ইসলাম নাদিম
জায়গাটা সুখপ্রদ বা দৃষ্টিনন্দন কোনোটাই না।
সারফেস ড্রেনগুলো থেকে ময়লা ওঠাবার ক্ষেত্রে কর্পোরেশনের কর্মীরা কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর রাখলেও সেগুলো সরাবার বেলায় তাদের অনীহা হতাশাব্যঞ্জক। মাঝে মাঝে ময়লা ‘তোলা’ এবং ‘ফেলা’ কাজ দুটির মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান দিনকে পর্যন্ত ছুঁয়ে দেয়। ছোট্ট এই গলিটার দুপ্রান্তে তখন দাঁড়িয়ে থাকে গড়পড়তা কালো রঙের মিনি গম্বুজগুলো। বেরসিক দু বা তিন চাকার যানবাহনগুলো কখনো এদের একটিকে মাড়িয়ে দিলে পরবর্তীটার সাথে একটি সরু সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দৃশ্যটা তখন হয় দেখার মতো। দুপ্রান্তে দুটি ময়লার মালা গলায় সজ্জিত গলিপথ! বিলাসী বাতাসেরা কখনো পথ ভুলে এদিকটায় এসে পড়লে বাঁধে আরেক বিপত্তি। তখন যে বিশেষ গন্ধটির সাথে তার সংযুক্তি ঘটে তাতে গা রি রি করে ওঠারই সম্ভাবনা।
মজার কথা হলো সীমিত পছন্দের বৃত্তে এই স্থানটিই ওর ভাল লাগার কেন্দ্রবিন্দু। ড্রেনটাকে নিচে রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয় ও। কখনো পা ঝিম ধরে এলে এক পা বাঁকিয়ে দেয়ালে চেপে রাখে। মাঝে মধ্যে পা বদলে নেয়। তবু দাঁড়িয়েই থাকে এবং এতে খুব একটা ক্লান্ত হয় না সে। সিগারেটের তৃষ্ণা প্রবল হলে অবশ্য হার মানতে হয়। কিছুটা হেঁটে মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনে ওখান থেকেই ধরিয়ে আনে। নিজের কাছে প্যাকেট এবং লাইটার রাখার অভ্যেসে এখনো অভ্যস্থ হওয়া হয়নি। সম্ভবত ও দুটির আপেক্ষিক গুরুত্ব বয়সের তুলনায় এখনো বেশি। তারপর আবার দাঁড়িয়ে থাকা। এবং আবারো দাঁড়িয়ে থাকা।
সপ্তাহে কমপক্ষে একবার এদিকটায় আসার চেষ্টা করে ও। পারলে এগারোটার দিকে আসে। থাকে আশা অপূর্ণ থাকা পর্যন্ত। অবশ্যি এর ব্যত্যয় যে ঘটে না তা নয়। ও যে দেয়ালে হেলান দেয় তার বিপরীতেও একটি দেয়াল। এক মানুষ সমান উঁচু। পলস্তরা বিহীন, লোনায় আক্রান্ত। তার পেছনে সম্ভবত দশ গজ মতো দূরে পুরনো একটি দোতলা বাড়ি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, জুবুথুবু। সেই বাড়ির পেছন দিকটা গলি থেকে দেখা যায়। চোখে পড়ে দোতলার দুটি জানালাকে। ও দুটির একটি ওকে জাদুমন্ত্রের বাঁধনে বেঁধে রাখে। জানালার ছোট্ট আয়তন জুড়ে আশা আর আনন্দের কী বিরাট বিরাট সব জগৎ চমৎকার ভাবে ঝুলে থাকে! যতক্ষণ থাকে ততক্ষণতো বটেই অন্যান্য মুহূর্তগুলোতেও মায়াবী সেই ঘোর ওর চোখ থেকে চোখে বিম্বিত হতে থাকে। এ সব কিছুরই সূত্রপাত এক মায়াবী বিকেলে। স্বভাবসুলভ অনুসন্ধিৎসু পর্যবেক্ষণে পথ চলতে চলতে একবার চোখ পড়ে এই জানালায়। জানালার শিক অাঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধতার একটি পেলব পরশ চোখে হয়তো লাগে কিন্তু ও আরো এগিয়ে যায় যেমনটি সবাই যায়। কিন্তু এর পর পরই মনে হয় জানালার মেয়েটি তো শুধু একটি মেয়ে নয়! অন্য কিছু। অন্য কেউ। পরিচিত কারোর সাথে মেয়েটির যেন মিল। কার? কার? ওকে ফিরতে হয়। গভীর ভাবে দেখে এবার। দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে যায়। এতো সাদৃশ্য! এতো মিল! হৃদয়ের গুপ্তঘরে যার ছবি সে নিয়ে নিয়ে ফেরে, শত মাইলের দূরত্বও যার স্মৃতিকে সামান্য মলিন করতে পারে না তার এই অভাবিত শহুরে সংস্করণ ওকে মাতিয়ে তোলে। মেয়েটার চোখে মুখে এক স্বপ্নের রাস্তা পায় সে। যা ওকে নিয়ে যায় ওর হৃদয়েশ্বরীর কাছে-কাছাকাছি। এও এক খেলা। খেলা, তবে ঘোরের।
দুটি সিগারেট শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকায় ও। বিরক্তি এসে মনকে দখল করে ফেলে। জানালাটা খুলবার কোনো নামই নেই!
---------------------------------------------------------------------------------
চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে বুকটা ধপাস করে ওঠে মেয়েটির। তার হাতে কাঁপন লাগে। এক অজানা আশংকার খাঁচায় বন্দী মনে হয় নিজেকে। মুচড়ে রাখা কাগজটিকে খুলে নিশ্চিত হতে চায় লেখাটা হারায়নি! জড়তা কাটিয়ে এবার উঠতে পারে। তারপর ভীরু পায়ে এগোয়। এতটাই সলাজে যে নিজেকেই অপরিচিত লাগে ওর। লজ্জা ওর মুখের অবস্থাকে প্রায় রক্তারক্তি অবস্থায় নিয়ে যায়। নিঃশব্দে জানালার কপাট উন্মোচিত করে। করেই শ্বাস নেয় বুক ভরে। আছে! সাধারণত এই সময়েই ছেলেটি আসে। আজও এসেছে। সময়ানুবর্তিতায় ছেলেটির কৃতিত্ব বিস্ময়কর ঠেকে ওর কাছে। কবে থেকে ও আসে ঠিক জানে না তবে যেদিন থেকে জানে তাতেই এই ধারণা বদ্ধমূল হবার কারণ ঘটেছে। প্রথম যেদিন চোখাচোখি হয়ে গেল ঝটিতে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল ছেলেটি। তারপর যোগ দিয়েছিল পথচারীর দলে। সপ্তাহখানেক পরে আবার চার চোখের মিলন হলো। ওর ভাবনাকে দোলা দিয়ে গেল ব্যাপারটি। আয়ত কালো চোখের পটভূমিতে সুউচ্চ নাক আর বিশিষ্ট চুলের ছেলেটিকে অন্যরকম মনে হলো। একটু নয়--অনেকটুকু। পরবর্তী পর্বগুলোতে নিশ্চিত হলো তার সততা সম্পর্কে। ছেলেটির চোখ অসম্ভব দৃঢ়তার কথা জানান দিয়ে গেল। অমন চোখ যার সে খারাপ হয় কী করে? ছেলেটির ভাব-ভঙ্গিও অদ্ভুত রকমের। আর দশটি ছেলের মতো শিস দিয়ে ওঠে না- চোখ টেপে না। বরং চোখাচোখি হলে দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলে। এত ভদ্র! এত বিনয়ী! কিন্তু ছেলেটি এখানে কেন আসে?
একদিন দুপুরের দিকে হঠাৎই বৃষ্টি নেমে পড়ল। বৃষ্টির ছাঁট ঘরে ঢুকে পড়ছে দেখে ও এগোলো জানালার দিকে। বন্ধ করবে। তখন অবাক হয়ে দেখে ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়েছে। সম্ভবত চলে যাচ্ছিল। ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টিটা ছিল এমন একটু ভিজলেই পুরো ভিজে যেতে হবে। কিন্তু ওকে বিস্মিত করে দিয়ে ছেলেটি নড়ল না। যেন জমে গেল। ওর সমস্ত শরীরকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে বৃষ্টি নামতে লাগল। কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই! ছেলেটি করছেটা কী? তার অদ্ভুত আচরণ দেখতে সে জানালায়ই দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকল কেন? নাকি ওকে দেখতেই ছেলেটি অমন দাঁড়িয়ে থাকল! এর মানে কী...?
ছেলেটির ইচ্ছের একাগ্রতা সম্পর্কেও নিশ্চিত হলো ও। ওর সতের বছরের জীবনে এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটল। নিজেকে প্রয়োজনীয় আবিষ্কার করে ও অনাবিল আনন্দে ডুবে গেল। এরপর ডুবতেই থাকল। একদিন এক অলস মুহূর্তে ছেলেটির কথাই কেন জানি মনে পড়ে গেল। পড়তে লাগল। ওকে দেখবার জন্য এতটা আগ্রহ অনুভব করে নিজেরই বিস্ময়ের সীমা রইল না। ছেলেটির জন্য ওর মনের কপাট কখন যে খুলে গেছে তা টেরই পায়নি ও।
আশপাশটা ভীত চোখে দেখে নিয়ে জানালা গলিয়ে হাতটা বের করে আনল মেয়েটি। তারপর জোরের সাথে বাতাসে ভাসিয়ে দিল মোচড়ানো কাগজটিকে। দম বন্ধ হয়ে এলো ওর আপনাআপনি। আল্লাহ্ যেন ওটা ঠিকঠাক পৌঁছায়! মাত্র কটা মুহূর্ত। কিন্তু মনে হলো কযুগ। পৌঁছেছে! ছেলেটি তুলে নিচ্ছে কাগজটিকে। আর দাঁড়িয়ে থাকা চলে না। ও ত্রস্ত হাতে কপাট লাগিয়ে সরে গেল ওখান থেকে। এ ছাড়া ওর আর গত্যন্তর ছিল না। ছেলেটির নিস্পৃহতা ওকে এমন বিদ্রোহী করে দিয়েছে। ছেলেটি ওকে ভালবাসে? সম্ভবতঃ। নইলে এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কী? নাকি নিজের ভালবাসার কথা প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত? হতে পারে। কিন্তু ও ছেলেটিকে ভালবাসে। এতটাই যে ওকেই প্রথমে এগোতে হয়েছে। প্রেমে পড়লে ছেলেরা নাকি বোকা হয়ে যায়! মেয়েরা সাহসী? ওতো মেয়েই! মেয়ের মতো কাজই ও করেছে।
---------------------------------------------------------------------------------
কাগজটিকে পকেটে ফেলে হনহন করে অনেকটা এগোয় ছেলেটি। তারপর যখন মনে হয় কেউ তাকে দেখছে না তখন বের করে আনে সেটিকে। দু আঙ্গুলের কসরতে কাগজটিকে মেলে ধরেই একটা প্রচন্ড ধাক্কা খায় ও। চার অক্ষরের ইংরেজী শব্দটি ওকে বিমূঢ় করে দেয়। ছিঃ ছিঃ একি করেছে ও! ব্যাপারটি একবারও ভেবে দেখেনি। কাউকে দেখার আশায় ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার যে সহজ মানেটা করা যায় তা কখনোই মাথায় আসেনি ওর। নিষ্পাপ একটি মেয়ের কাছে প্রতারক চিহ্নিত হয়ে যেতে হবে এই চিন্তা ওকে বিদ্ধ করে বার বার। নিজেকে ধিক্কারে জর্জরিত করে সিদ্ধান্ত নেয় আর যাবে না। ওই রাস্তা আর মাড়াবে না ভুলেও। কখ্খনো না।
এরপর থেকে জানালা খুলে মেয়েটি অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু ছেলেটিকে আর চোখে পড়ে না তার। চোখ জ্বালা ধরে আসা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সপ্তাহ ঘুরে মাস আসে এবং সেটিও ফুরায়। কিন্তু ছেলের দেখা মেলে না। সমস্ত আশা যখন হতাশার জালে আটকা পড়তে বসেছে ঠিক সেই সময় একদিন তার ক্লান্ত দৃষ্টিসীমায় আয়ত কালো চোখের পটভূমিকায় খাড়া নাক ভেসে ওঠে। সে ভীষণ চমকে ওঠে। সত্যি তো? সত্যিই। এক অলৌকিক দুর্বার আকর্ষণ ছেলেটিকে এই খানে নিয়ে আসে। তাকে আসতেই হয়। মন ও মানসীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এতদিন হেরেছে মন। এবার মানসীর হারবার পালা!
মন্তব্য
ছোট গল্পের ক্ষেত্রে এত বিস্তারিত বর্ণনা কি সাজে?
লেখার হাত ভাল।
----------------------------------
জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।
জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছ পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবি হও।
সুন্দর তো!
আরো লিখুন।
নতুন মন্তব্য করুন