ছেলেবেলায় পাঠ্যবইয়ে "দারুচিনি দ্বীপের দেশে" পড়ার সময় কখনো কি ভেবেছিলাম আমার দারুচিনি দ্বীপের দেশে যাওয়া হবে? গিয়েছি ঠিকই কিন্তু দারুচিনি গাছ না দেখেই ফিরে এসেছি। সুমাত্রা-জাভা-বালির নাম শুনলেই কেমন একটা রোমান্টিক ভাব চলে আসে। কিন্তু বালি দ্বীপ দেখার পর সে রোমান্টিকতার অনুভূতি আমার হয় নি। তার কারণ বিবিধ। হয়তো বয়সটা পেরিয়ে এসেছি। তপন কুমার রায় চৌধুরী বাঙালনামায় পড়েছিলাম," শৈশবে মানুষের যে সব কিছুই মধুর হয়ে উঠে তার কারণ রঙের উজ্জ্বলতা ।" বয়স পেরিয়ে এলে সে রঙ অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। শিশুদের লক্ষ্যই হচ্ছে আনন্দ। সে জন্যেই তারা আনন্দের নাগাল পায়। আর বড়রা প্রাপ্তির মাঝে আনন্দ খোঁজে ফেরে । আনন্দের খোঁজে ওরা মদ খায়, জুয়া খেলে , বেশ্যা গমন করে । কিন্তু পরদিন সকাল বেলা সেই একই নিরানন্দময় তটভূমিতে শুয়ে থাকে। সত্যিকার আনন্দের যেমন কোন উপলক্ষ্য লাগে না, সত্যিকার বিষন্নতারও তেমন কোন কারণ থাকে না। বালি দ্বীপ ঘুরে এসে জীবনের এই সত্যটি উপলব্ধি করেছিলাম। রোমান্টিক ভাব অনুভব না করার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, বালি দ্বীপ রঙবেরঙ মানুষের ভীড়ে যেন ক্লান্ত। বায়ুবদলের বায়ুগ্রস্তদের নজর একবার যে দ্বীপে পড়েছে, সে দ্বীপের শুঁড়িখানা হয়ে উঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে রোমান্টিকতা অনুভব না করলেও, বালি দ্বীপে আমার অভিজ্ঞতা বেশ মজার ।
আঠার -বিশ-অথবা বাইশ সিটের একটা মিনিবাস আমাদের বিশ-একুশ জনের দলটিকে নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ছুটে চলছে হোটেলের দিকে। মাইক্রোফোনে আমাদের গাইড মাদি আরি নিজের পরিচয় দিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে সকল বালিনিজদের পক্ষ থেকে স্বাগত জানাল, ইন্দোনেশিয়ার পক্ষ থেকে নয়। তখনই আমার মনে হলো বালি দ্বীপ ভৌগলিক ভাবে ইন্দোনেশিয়ার অংশ হলেও কেমন যেন বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। যেমন বিচ্ছিন্নতা পরিলক্ষিত হয় আমাদের দেশের আদিবাসীদের মাঝে। শুরুতেই নিয়ম মাফিক, খানিকটা ভূগোল আর ডেমোগ্রাফী। আরি আমাদের জানালো,প্রায় দুই হাজার বর্গ কিলোমিটারের এই বালি দ্বীপের জনসংখ্যা ৩৫ লাখ । শতকরা পঁচান্নবই জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ( আমার অবাক হবার পালা। আমি যত দূর জানি ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম দেশ। খানিকটা নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস জানার জন্য মনটা আঁকু-পাঁকু করে উঠল।) কিন্তু গাইড সে দিকে না গিয়ে,
রাস্তার দু'পাশের স্থাপনা সমূহ চিনিয়ে দিতে লাগল। পরিচ্ছন্ন মসৃণ রাস্তার দু'পাশের লালটালির ছাদওয়ালা বাড়ীগুলো দেখে মনে হল, এদেশের গৃহস্তরা বেশ সম্পন্ন। রাস্তার দু'পাশে পৃথিবীর বিখ্যাত রিটেইলাদের দোকান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। রিবক, নাইকে, পলো, কেয়ারি ফোর,ম্যাগডোনাল্ডস । আর প্রচুর শ্বেতাঙ্গের ভীড়।
একটা জায়গা দেখিয়ে , আরি জানাল এটা সেই কুখ্যাত স্থান যেখানে ২০০০ সালে বোমা হামলায় প্রায় দু'শত লোক মারা গিয়েছিল।
আমাদের এক সহযাত্রীর এই তথ্যটি জানা ছিল না। একটু ভয় পেয়ে আরিকে জিজ্ঞেস করল, এখন সে ভয় নেই তো।
ভীষণভাবে মাথা ঝাঁকালো মাদি আরি। " নো------। এভরিথিং আন্ডার কন্ট্রোল।"
এমন ভাবে বললো , আমার কাছে মনে হলো মাদি আরি যেন এখানকার পুলিশের চিফ।
আগেই বলেছি, আরির ইংরেজী ভাঙা ভাঙা । আর বেশী ভাগ বাক্যই শুরু করে অফ দিয়ে। এ ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম , ইংরেজী শিখেছ কোথা থেকে?
প্রশ্ন শুনে একটু গম্ভীর হয়ে জানাল, বালির এক নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে এম এ করেছে। তার পর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে যোগ করল, "আন্ডার সাইন্স ফ্যাকাল্টি।"
আমার এক সহযাত্রী হাসি চেপে টিপ্পনী কাটল।" তোমার উচ্চারণে সে ছাপ স্পষ্ট। ভালো ইংরেজী শিখতে হলে সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে শেখাই শ্রেয়।"
টিপ্পনীটা বুঝল বলে মনে হলো না। গদ গদ ভাব আসলো চেহারায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা বইয়ে একটা গল্প পড়েছিলাম। বড়রা সবাই মিলে এক খুকীর রূপের প্রশংসা করছিল। বাচ্চা মেয়টি চুপ করে শুনছিল। তারপর সবাই যখন প্রশংসা করে থামল , তখন গম্ভীর ভাবে জানাল, তাও তো সে আজ তেলই মাখে নি। মাদি আরি এমনি ভঙ্গিমায় জানাল, আগে উচ্চারণ আরো ভালো ছিল। এখন গলায় কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে।
অত:পর মাদি আরি আমাদের জানালো, তাকে যেন আমরা সবাই আরি বলে ডাকি। কারণ বালি দ্বীপে , কম করে হলেও লাখ খানেক পুরুষ আছে যাদের নাম মাদি। কেননা বালিনিজরা পরিবারের দ্বিতীয় ছেলেকে মাদি বলে ডাকে। এরকম প্রথম , দ্বিতীয় , তৃতীয় , সবারই ভিন্ন ডিনোটেশান আছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যদি উদাহরণ দেয়া যায় তবে, কোকো জিয়ার নাম হতো মাদি জিয়া। আর জাফর ইকবালের নাম হতো মাদি আহমেদ।
আধা ঘন্টার মাঝেই আমরা হোটেলে পৌঁছুলাম। আমাদের হোটেলটার অবস্থান একে বারে 'কুতা বীচে'র কাছেই। আমরা মজা করে বলতাম 'কুত্তা বীচ'। কুত্তা বীচের গা ঘেঁষে সারি সারি নাইট ক্লাব আর হোটেল। আমাদের হোটেল থেকে বীচ দেখা যায় না। তাই হতাশ লাগল একটু। তবু এই ভেবে ভালো লাগলো যে, একটু জিরানোর ফুসরত মিলল অবশেষে।
কৃষ্ণ কানহাইয়া
মন্তব্য
'দারুচিনি দ্বীপের দেশে' পড়ে এবং তারপর মহাভারতের গরুড়ের উপাখ্যান পড়ে ইন্দোনেশিয়া দেখার শখ মাথার মধ্যে এখনও চেপে আছে। সেদিন এক কলিগ ইন্দোনেশিয়া থেকে আসলো। ওর মুখ থেকে অনেক কাহিনী, ঘটনা শুনলাম। কবে যে যাব সেখানে!
পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য বসে রইলাম।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
বাঙ্গালনামা পেয়ে পেয়েও কিভাবে যেন ফস্কে গেছে ,পড়ে ফেলতে হবে শীঘ্রই।
ও হ্যাঁ ,প্রমোদ দ্বীপের কাহিনী চলুক।
অদ্রোহ।
[/শৈশবে মানুষের যে সব কিছুই মধুর হয়ে উঠে তার কারণ রঙের উজ্জ্বলতা ।" বয়স পেরিয়ে এলে সে রঙ অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। শিশুদের লক্ষ্যই হচ্ছে আনন্দ। সে জন্যেই তারা আনন্দের নাগাল পায়। আর বড়রা প্রাপ্তির মাঝে আনন্দ খোঁজে ফেরে ।quote]
খুব ভাল লাগলো আপনার লেখা পড়ে। পরের কিস্তির অপেক্ষায় থাকলাম।
জয়_
অপেক্ষায় রইলাম।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
"দারুচিনি দ্বীপের দেশে" প্রবন্ধ/গল্প-টি কে লিখেছিলেন এবং কোন গল্পগ্রন্থে এটি পাওয়া যাবে কেউ বলতে পারবেন?
লেখক সানাউল্লাহ্ নূরী। মূল বইটির নামও 'দারুচিনি দ্বীপের দেশে'।
নতুন মন্তব্য করুন