নাজমুস নূপুর আপুর ব্লগটা একটু আগে পড়লাম। পড়ে কেন জানি মাকে নিয়ে ভাবতে বসলাম।
কয়েকদিন আগে মা দিবস চলে গেল। ভেবেছিলাম মাকে কিছু একটা দেব।
দেওয়া আর হয়ে ওঠেনি।
মনের মধ্যে হঠাৎ করে যেন এক ঝড় বইছে। ভাবনাগুলো খাপছাড়া।
সময় যে কিভাবে চলে যায়, মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই। মনে হয় এইতো সেদিন মা চাকরিতে ঢুকল। আমার সেদিন যে কি কান্না, মা আর সারাদিন আমার সাথে থাকবে না।
অবশ্য কয়েকদিনেই কান্না ভুলে টিভি নিয়ে পড়ে ছিলাম।
খাওয়া নেই দাওয়া নেই সারাদিন টিভিতে কার্টুন দেখা।
মা চাকরিটা না করলে আজ আমি এতদূর আসতে পারতাম না। মা যদি শক্ত হাতে সংসারটা না ধরতো তাহলে হয়তো আমি এই আমি হতাম না।
যখন ক্লাশ ফাইভে পড়ি তখন বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আগে থেকেই তার হাঁপানির সমস্যা ছিল। তবে সেবার যে বিছানায় পড়লেন আর উঠতে পারলেন না।
সেই সেদিন থেকে মার কাঁধে সবকিছু।
মা বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। মা প্রতিদিন এসে বাবাকে সারাদিনের ঘটনা বলতো। বাবাও মনোযোগ দিয়ে শুনতো।
মা আমাদের মানুষ করতে গিয়ে প্রতি পদে পদে পেয়েছে বাঁধা। আমার দাদার পরিবার, আমার মামার পরিবার কেউ তাকে এতটুকু সহায়তা করেনি।
দু-তিনটে ঘটনা প্রায়ই আমার মনে পড়ে।
বাবা তখন প্রচন্ড অসুস্থ। মা সারাদিন অফিস করে আসেন, আর সারা রাত জেগে থাকেন। বোনের স্কুলে যাওয়া তখন বন্ধ। বাসায় কোন কাজের লোক ছিল না।সাত-সকালে মা রান্না করে রেখে যেন। জুঁই (আমার বোন) তখন তেমন কিছু বোঝে না।
সে সকালে উঠে নিজের মত নিজে টিভি দেখত। মা ভাত বেড়ে রেখে যেত। ও প্লেটটা নিয়ে নিজের মত সেখান থেকে একবেলা কি দুবেলা খেত।
আমি সকালে স্কুলে চলে যেতাম। মা সকালে বাবাকে খাইয়ে অফিসে যেত। আমি দুপুরে এসে বাবাকে গোসল করিয়ে খাওয়াতাম। মা এসে বিকালের নাস্তা করে আমাদের সবাইকে খেতে দিত। জুঁই সারাদিন শেষে মাকে দেখে কি সুন্দর করে যে হাসি দিত।
আমাদের কোন ভালো পারিবারিক ছবি নেই। ক্যামেরা ছিল না।
বাবা অসুস্থ অবস্থায় বেঁচে ছিলেন ১০ বছর। আমার মা একলা হাতে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
বাবা শেষের দিকে একটু সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। হাঁটা চলা করতেন। জুঁইকে স্কুল থেকে আনতে যেতেন।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার ৫ মাস পর বাবা মারা যান।
মা প্রায়ই কাঁদে। এই বলে যে, সে মানুষটাকে কেন বাঁচিয়ে রাখতে পারলো না। এই ভেবে যে সুখের সময় মানুষটা চলে গেল।
একবার ঠাকুরদা-ঠাকুরমা ঢাকায় আসেন আমাদের সবাইকে নিয়ে যাবার জন্য।
কিন্তু মা যাবেন না। কারণ তিনি বুঝতেন, গ্রাম দেশে ঢাকার মত চাইলেই বাবাকে হাসপাতালে নেওয়া যাবে না। চাইলেই সাথে সাথে বাবাকে ভালো ডাক্তার দেখানো যাবে না। তাছাড়া আমরা ভালো স্কুলে পড়তাম। ঢাকা ছেড়ে গেলে আমাদের সমস্যা হত। নতুন পরিবেশে আমরা মিশতে পারতাম না। মা চাননি আমাদের কোনরকম কষ্ট করতে দিতে। তিনি চাননি আমরা অন্য কারো গলগ্রহ হয়ে থাকি।
আমার ঠাকুরমা ছিলেন নিরক্ষর। তিনি আমার মাকে মোটেও পছন্দ করতেন না। কারণ বউ শিক্ষিত এবং তার কথা অনুযায়ী কাজ করেনা।
এই ঘটনার পর তিনি জোর পূর্বক বাবাকে নিয়ে দেশের বাড়ী চলে যান। গ্রামের আলো বাতাসে তাকে সুস্থ করে তুলবেন এই পণ করে।
সপ্তাহদুয়েকের মধ্যে খবর আসে বাবার অবস্থা, শোচনীয়। খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আর অনিয়মে শরীরে পানি জমেছে।
মা সব কিছু ছেড়ে চলে যাইয় দেশের বাড়িতে বাবাকে আনতে। এরপর একদিনও মা বাবাকে কাছছাড়া করেনি।
আমার মার সাথে মাঝে মাঝে ঠাকুরমাকে মেলানোর চেষ্টা করি।
আমার মা আমাদের ছেড়ে থাকতে পারেনা, আর আমার ঠাকুরমা আমার বাবার জীবনের শেষ সাতটা বছরে একবারও ছেলেকে দেখতে আসেননি, ফোন করে একবারও বলেননি কেমন আছিস বাবা।
একবার বাবকে নিয়ে আমরা চারজন গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ায়, বাবার চিকিৎসা করাতে। বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম আমরা। মা ভেবেছিল ২০ দিনে সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। ঐভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাবার চিকিৎসা করাতে ২০ দিনের বেশি লেগে যায়। অর্থ সংকটে পড়ে মা। হাসপাতালে বাকী পড়ে ২৫০০ রুপী। মা ফণ করে আমার কাকাকে, যে সেখানেই থাকতো। মা ধার চায় তার কাছে।
কাকা টাকা ধার দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।
সেদিন প্রথম আমি বাবা-মা দুজনকে একসাথে কাঁদতে দেখেছিলাম। বাবা বিশ্বাস করতে পারেননি যে, যে ভাইকে তিনি নিজের হাতে মানুষ করেছেন সে এরকম করবে।
কাকা একদিক থেকে ভালোই করেছিলেন। মা পরে আমাকে বলেছিল যে আমরা যে পুরোপুরি একা সে সেদিন তা বুঝতে পেরেছিল।
পরে দেশে ফোন করে মা আমার এক বন্ধুর মার কাছ থেকে টাকাটা ধার নেন।
এমন আরও অনেক ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে মা আমাদের এই পর্যায়ে এনেছেন।
আমার মা টিভি দেখে না, পেপার পড়ে না। কোথাও বেড়াতে যায় না। কোন ভালো রেস্তোরার নাম সে জানে না। কোন দামী ব্রান্ডের কোনকিছুই সে চেনে না। গত ১০ বছরে মা শাড়ী কিনেছে মাত্র দুটি। তেমন কোন প্রসাধনী সে ব্যবহার করেনা। অপচয় হবে ভেবে। যা আয় করে তা ব্যয় করে আমার আর আমার বোনের লেখাপড়ার পেছনে।
আমাদের কষ্ট করতে দেন না, আজও ফাঁক পেলে আমাদের খাইয়ে দেন, কাপড়গুলো ধুঁইয়ে দেন, ঘর গুছিয়ে দেন।
নিজের কোন বিশ্রাম নেই তার, নেই কোন চাওয়া।
মাঝে মাঝে ভাবি আমি তার জায়গায় থাকলে কি পারতাম? পারতাম না। আরতাম না। নিজেকে সব সুখ থেকে দূরে রেখে বাকী সবার মুখে হাসি ফোটাতে।
মাঝে মাঝে পেপারে দেখি রত্নগর্ভা নারীদের সম্মাননা দেওয়া হয়। আমার মা রত্নগর্ভা নন। কিন্তু তিনি আমার কাছে একজন অতিমানব, মহীয়সীদের একজন।
মাকে প্রায়ই বলতে ইচ্ছা করে ,"মা আজ থেকে আমি সব করবো, তুমি এবার অবসর নেও।"
বলতে পারিনা। ঈশ্বর যে এখনও সে শক্তি আমায় দেয়নি।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
মন্তব্য
অনেক ভাল লাগলো আপনার মায়ের কথা জেনে।মাকে সালাম।
যতদূর মনে পড়ে লেখাটা বুধবার রাতে লিখেছিলাম। পরের দিন প্রকাশ না হওয়ায় ভেবেছিলাম, এটা আর প্রকাশ হবে না। আজ হঠাৎ হলে গিয়ে দেখি আমার এক বন্ধু লেখাটা পড়ছে।
আপনার লেখাটা পড়েই আমি আমার লেখাটা শুরু করেছিলাম। আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপু।ভালো থাকবেন।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
আপনার মাকে সালাম। তিনি 'রত্নগর্ভা' কিনা জানি না, তবে 'রত্ন' তো বটেই!
ঠিকই বলেছে তানভীর ভাইয়া। আসলেই তিনি রত্ন।
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
মন ছুঁয়ে গেলো।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। জবাব দিতে দেরী হওয়ায় দুঃখিত।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
চাচিকে স্যালুট দোস্তো...
ভালো থাকিস।
_________________________________________
সেরিওজা
ধন্যবাদ দোস্ত তোর মন্তব্যের জন্য। ক্লাস তো খুলে গেল রে। কেমন জানি লাগে এখন ক্লাস করতে।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
ভালো লাগল
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ধন্যবাদ।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
আপনার কথাগুলো হৃদয় ছুয়েঁ গেল..................... আপনার মাকে আমার শ্রদ্ধা জানাবেন।
নবীন পাঠক
shahriarsajib@gmail.com
সজীব ভাই ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
খুব আবেগাপ্লুত হলাম।
সচলে স্বাগতম।
ধন্যবাদ বাউলিয়ানা ভাই, ভালো থাকবেন।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
মা'কে নিয়ে ভালো থাকুন...
লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো...
---------------------------
জানতে হলে পথেই এসো,
গৃহী হয়ে কে কবে কী পেয়েছে বলো....
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি
লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে অত্যন্ত খুশি হলাম। ভালো থাকবেন আপু।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
পৃথিবীর সমস্ত মায়েরা বুঝি এমন-ই। লেখাটি মন ছুঁয়ে গেল ।
ভালো থাকুন মাকে নিয়ে ।
সাবরিনা সুলতানা
"অকুতোভয় যোদ্ধা" মাকে জানাই শ্রদ্ধা।
খালাম্মা'কে আমার সালাম পৌঁছে দিয়েন।
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
কান্না কি একটা ভাষা ? কিছুই বলার নেই... কেনো যেনো সব কিছু ঝাপসা দেখছি... ...
''চৈত্রী''
সবাই সবার মায়ের ভালবাসা উপলব্ধি করুক, এই কামনা করি। মা'রা সন্তানের কাছ থেকে কিছুই চান না। কিন্তু একটু ভালবাসা আমরা তাদেরকে মনে হয় দিতে পারি, শুধুই তাদের ভালবাসাকে মনে রেখে।
পোস্টে
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
মন ছুঁয়ে গেল লেখাটা।
নতুন মন্তব্য করুন