ঈশম তরমুজ ক্ষেতে টোঙ ঘরে শুয়ে থাকে। আর রাত জেগে জেগে পাহারা দেয়। ধনকর্তার ছেলে হয়েছে। এই খবর নিয়ে রওনা হয়েছে ধনকর্তার কাছে। বড়বৌ বারান্দায় ভাত বেড়ে দিয়েছে। তৃপ্তি সহকারে খেয়ে রওনা হয়েছে বিশ ক্রোশ পথে সন্ধ্যার অন্ধকারে। গোপাট থেকে আড়াআড়ি মাঠে নেমেছে ঈশম। আর খুঁজছে বড়কর্তাকে। বড়কর্তা কোন খেয়ালে থাকেন। মাঝে মাঝে বেরিয়ে যান। কোন এক পলিনকে খোঁজেন। আর নিজের মনে কথা বলেন। তার প্রকাশ হল-- গাৎচোরেৎশালা। এই বড়কর্তাকে এলাকার হিন্দু মুসলমান সবাই সমীহ করেন। কেউ মনে করেন--তিনি ঐশীস্বভাবযুক্ত। তার জন্য সকলের মায়া রয়ে যায়।
শুরু হয়েছে ঈশমকে দিয়ে নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসটি। তিনটি পর্ব। প্রতিটি পর্বে আবার অনেকগুলো খণ্ড। দ্বিতীয় পর্বের নাম--অলৌকিক জলযান, শেষ পর্ব--ঈশ্বরের বাগান।
অতীন লিখেছেন রাইনদি গ্রামের ঈশ্বরোপম মানুষের আর মানুষের মাঝে বেড়ে ওঠা গাছপালা, পশুপাখি আর প্রকৃতির কথা। এর মধ্যে দিয়ে মানুষ যে রূপের জগতে যেতে চায়--সে জগতের পরতে পরতে যে অরূপের আনন্দ, বেদনা আর অপার বিস্ময় খেলা করে তা গ্রন্থপাঠে অর্জিত হয়।
শুরু হয়েছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে। একটি খণ্ড শেষ হল সাতচল্লিশে--একটি অর্জুন গাছের বাকলের উৎকীর্ণ কষ্ট গাথা দিয়ে। সোনা তার পাগল জ্যাঠা মশাইকে খুজে পাচ্ছে না। অথচ তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অন্য সময় হলে--সবাই নানাভাবে জ্যাঠা মশাইকে খুজতে বের হত। বের হত কাকা শচীকর্তা, ঈশম, আবেদালী, জব্বর, সামু, জোটন, জালালী...ঝড়জলের মধ্যে দিয়ে এই নীলকণ্ঠ পাখিটিকে খুঁজতে বের হওয়া ছাড়া কারো অন্য কোন স্বভাব থাকে না-- কারণ পাগলা বড়কর্তা তো কেবল কংগ্রেসের শচীকর্তার দাদা নন, তিনি মুসলিমলীগের সামুরও নিকটজন। তাকে খুজতে লড়কে লেঙে পাকিস্তান কিম্বা বন্দেমাতরম ফিকে হয়ে যায়। তিনি সকলের অন্বিষ্ট।
কিন্তু দেশভাগ এমন একটা সময়--যখন জ্যাঠা মশাইকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। তার জন্য অপেক্ষা করার উপায় নেই। সে স্বভাবটি তখন আর নেই। একমাত্র সোনা মহাবৃক্ষ অর্জুন গাছের বাকলে লিখে গেল,, "জ্যাঠা মশাই আমরা হিন্দুস্তানে চলিয়া গিয়াছি। ইতি-সোনা।" কোন মানুষকে বলে গেল না। মহাবৃক্ষটি অনন্ত মানুষের এই বেদনাটি নিয়ে বুড়ো হতে থাকল। কেউ না কেউ একদিন দেখে জেগে উঠবে। বুঝবে, এই বিভেদ আসলে অসভ্যতা। মানুষ মূলত মিলনে অভ্যস্ত।
অতীন লিখছেন, সোনা দেখল এক সকালে কিছু মানুষজন এসে ঘরগুলির ওপর উঠে টিনের স্ক্র খুলে নিচ্ছে। আর টিনগুলো রাখছে আলাদা করে। ওর বাবার মনে হচ্ছে জ্যাঠা মশাই তার মত পাল্টাবে। কিন্তু সব যখন খোলা হচ্ছে--তখন সোনা একা হয়ে যাচ্ছে। তখন অর্জুন গাছটা তাকে বার বার হাত ছানি দিচ্ছে। ঘর ভাঙা হচ্ছে বলেই গরীব মানুষজন ভীড় করে আসছে। টুকটাক জিনিসপত্র কুড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ঈশম আবার সেসব ফিরিয়ে আনছে।
সোনাদের নৌকা যখন চলতে শুরু করেছে,, ঈশম তার প্রাপ্য পেয়েও নৌকার সাথে সাথে হাটতে শুরু করেছে। ভূপেন্দ্রনাথ তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। ঈশম হাত তুলে যেন বলল, সময় হলেই ফিরে যাবে। ভূপেন্দ্রনাথ বুঝলেন, ঈশম যতক্ষণ পারে ততক্ষণ ওদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটবে। এবং ঠিক দামোদরদির মাঠ পার হলে সে আর এগুতে পারবে না। সামনে বড় বাওড় পড়বে। সে জল ভেঙে ওপারে যেতে পারবে না। ওকে থেকে ফিরে যেতেই হবে।
কিন্তু ঈশম জানে সেই বিন্দু বিন্দু নৌকা থেকে এখনও কেউ একজন দেখছে। যতক্ষণ দেখা যায় দেখছে। সেতো লিখে গেছে তার প্রাণের হাহাকার অর্জুন গাছের কাণ্ডে। যেন আবার তাদের ডাক দিলে ফিরে আসবে। নীলকণ্ঠ পাখির মত এইসব মানুষের কথা অতীন লিখেছেন। নির্মোহভাবে। প্রবলভাবে। আমাদের প্রবলভাবে ঝাঁকি দেওয়ার জন্য। আমাদের বোধকে উস্কে দেওয়ার জন্য।
নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজের মধ্যে এই ঈশমই প্রকৃত মানবের প্রকৃতি। আমরা এই প্রকৃতির এই মহৎ পাঠটি আমাদের মত করে আর কেউ কি লিখেছেন?
--কুলদা রায়
মন্তব্য
রিভিউ ভালো লাগলো, খুব! একসময়ের অতি প্রিয় এই ট্রিলজি নিয়ে লেখা বলেও হয়তো।
আচ্ছা, গৌরকিশোর ঘোষেরও একটা ট্রিলজি আছে না? প্রেম নেই, প্রতিবেশী, জল পড়ে পাতা নড়ে - যদিও ট্রিলজি বলা যাবে কিনা নিশ্চিত নই, তবে সম্পর্কিত বোধহয়।
আরও রিভিউ লিখুন। আপনার নিজের বইটা নিয়ে যেটা লিখেছিলেন সেটাও খুব ভালো ছিলো, যদিও তখন বলা হয় নি
'আমাদের মত' বলতে আমি 'মহাপ্রাণ বাঙালিদের' বুঝিয়েছি। কারণ এই মহাকাব্যিক উপন্যাসটি বাঙালি জীবনের রূপকথার মানবিক দলিল। বহুবার পড়েছি। আবারও নতুন করে পড়ছি। অথচ উপন্যাসটি স্বল্প আলোচিত। আমাদের মত করে আমাদের জীবন-সাহিত্য রচনার জন্য নীলকণ্ঠ আলোকবাতির মত।
গৌরকিশোর ঘোষের 'প্রেম নেই' উপন্যাসটিও অসাধারণ। এটি নিয়েও এক পর্বে আলোচনা করা যাবে। আগে ঈশম পর্ব চলুক।
আমার লেখাটি নিয়ে আমাকে বলতে হয়েছে--এটা ঠিক হয় নি। আর আমার প্রকাশক যেভাবে প্রকাশ করেছেন--তাতে গল্পগুলোর পাঠ বিপর্যয় ঘটেছে। কী আর করা যাবে? লেখককে প্রেসম্যানও হতে হয়! আমার তো সে সময় বা রুচি নেই। এই দুঃখে আমি গল্প লেখাই ছেড়ে দিয়েছি আপাতত। আর বই প্রকাশের মধ্যেও আমি নেই।
ধন্যবাদ।
-কুলদা রায়
পড়া হয় নাই বইগুলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসাধারণ ডকুমেন্টারী আছে--'ঈশ্বরের বাগানে'। এই মানের লেখা অন্যত্র পাইনি। ১৯৪৭ এর পর থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়কে অতীন এই ট্রিলজিতে তুলে ধরেছেন তার মন্ময় কলমে।
আমার বাবার প্রিয় বই নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে। বারে বারে বইটার কথা বলতেন। আমি বুঝতে পারিনি কেন এমন টান। এর সঙ্গে যে দেশ মাটি নদী মাঠ সাদা বালির চর চখাচখী আম্র-পনস-জম্বীর গাছেরা অলৌকিক জ্যোৎস্নায় জড়িয়ে থাকতে পারে তা তখন বুঝতে পারিনি, তখন আমি নিতান্ত স্কুলের মেয়ে, সিক্স সেভেনে পড়ি।
তখন অতীন বন্দ্যো আনন্দমেলায় লেখেন, আমরা পড়ি "বিন্নির খই লাল বাতাসা।" তখন আমাদের কত ব্যস্ততা কত সব ছবি কাটো খাতায় সাঁটো, স্টার ওয়ার্সের কমিকসে দিতো। ভয়েজার থেকে তোলা ছবিগুলো দেখে আমাদের মন উচাটন। ওদিকে খুদে তার মেজকার সঙ্গে কত কী করছে, ডগা দৌড়ে পালাচ্ছে, কাকাবাবু আর সন্তু জানি এবার কোন রহস্যের পিছনে ধাওয়া করেছে, এইসবের মধ্যে আবার কেশব নাগ ডিপিসি জানা সাঁতরা উর্ধশ্বাস কোচিং--আমাদের তখন জোৎস্নাজলের ইতিহাস খোঁজার সময় কই?
কিছু পরে হাতে এলো বইটা, নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে। ভালো লাগলো কিন্তু বাবা যেভাবে আবিষ্ট সেরকম না। আসলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না, বাবার জীবনের সুতোর সঙ্গে ও গল্পের সুতো জড়িয়ে ছিলো, আমি বুঝতে পারি নি। আমি সম্ভবত কোনোদিন বুঝতেও পারবো না, ও গল্পের নীলকন্ঠ পাখি খোঁজা জ্যাঠামশাই যে আসলে একটা অখন্ড ভালোবাসার স্বপ্ন, একটা এমন দেশ যা টুকরো টুকরো হয়ে যায় না, এমন এক মধু-মিলনোদ্যান যেখানে বিরহ নাই।
বইটা আবার পড়তে হবে, আবার আবার। আসলে হয়তো সেখানে সেই উনিশ কুড়ি বছরের ছেলেটাকেও খুঁজে পাবো, যাকে সব শিকড়গুলো এক এক করে মাটি থেকে তুলে নিয়ে পাড়ি দিতে হয় অজানায়, সাদামাঠা ভালোমানুষ বোকাসোকা বলে যাকে জানে সবাই, যার মনের কথা কোনোদিনই জানা যাবে না সে গুছিয়ে কথা কইতে পারে না বলে, তার চারিপাশের "প্র্যাকটিকাল" মানুষেরা তাকে নানাভাবে সামলেসুমলে রাখে যেন সে বোকা মেষশাবক হারিয়ে গেলে মুশকিল। কিন্তু এই বইটা হয়তো সোনার চাবি হয়ে খুলে দেবে দরজা, বোঝা যাবে আসলে সে কেমন।
আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করবো না, আরো লিখুন।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এই ট্রিলজির প্রথম পর্বটাই পড়া হয় নি। আর এদের মধ্যে প্রথম পড়ে ছিলাম অলৌকিক জলযান, এর পরে কিছুদিন ঘোরের মাঝে ছিলাম। জ্যাক, ছোটবাবু, ক্যাপ্টেন স্যালি হিঙ্গিস, অভিশপ্ত জাহাজ এস,এস,সিউল ব্যাঙ্ক আর তার যাত্রীরা। এই উপন্যাস টা নিয়ে আমরা কয়েক বন্ধু অনেক রাত হলের অন্ধকার রুমে তুমুল আড্ডা দিয়েছি। আর মজার ব্যাপার হল আজকে আমরা কলেজের কয়েক বন্ধু এক জায়গায় আড্ডা দেওয়ার সময় আবার এই উপন্যাসের গল্প এসেছিল
আশা করি নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে পড়ার পর ট্রিলজির পুরাতন মুগ্ধতা বজায় থাকবে
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
পড়তে হবে।
অদ্ভুত কাকতালীয়! এখনই বইটা পড়ছি। স্বপ্নিল গতিময় সমালোচনার জন্যে লেখককে ধন্যবাদ।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
নতুন মন্তব্য করুন