মুক্ত বিহঙ্গ
৬ষ্ঠ পর্বঃ
ঘটনাগুলো আমার মা এবং প্রয়াত নানী-র কাছ থেকে শোনা। আমার জন্ম বগুড়া জেলার মিশন হাসপাতালে। সময়টা ছিল রাতের শেষে এবং সূর্যোদয়ের আগ-মুহুর্তে। [আমার দেখা অধিকাংশ শিশুর জন্ম হয়েছে রাতে অথবা খুব ভোরে। শিশুরা ঠিক এই সময় কেন পৃথিবীতে আসে -এই কারণটা আজো আমার কাছে বড় অদ্ভুত লাগে!] অস্বাভাবিক কম ওজন নিয়ে আমি জন্মেছিলাম। চার পাউন্ড চার আউন্স। জন্মের সাথে-সাথেই অনেক কমপ্লিকেশন দেখা দেয়। নানীর কথা অনুযায়ী, পোড়া বেগুনের চামড়া যেভাবে সহজে উঠে যায়, আমার শরীরে হাত দিলে ঠিক সেভাবেই চামড়া উঠে যাচ্ছিলো। বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়েছিলো কয়েকদিন। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে আমার বাঁচবার কোন আশা ছিলোনা [আমার মা ছাড়া বাকি সবাইকে সেই কথা জানানো হয়েছিলো] কিন্তু সৃষ্টিকর্তার বিশেষ দয়ায় সেই যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলাম; এবং কোন রোগ-ব্যধি ছাড়া আশ্চর্যজনকভাবে আজ-ও বেঁচে আছি!
জন্মের কিছুদিন পর হাসপাতাল থেকে আমার মাকে রিলিজ করা হলো। কিন্তু আমাকে আরো কিছুদিন রেখে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন ডাক্তাররা। কিন্তু আমাকে ছেড়ে আমার মা বাসায় যাবেননা। অবশেষে কিভাবে হয়েছিলো জানিনা, তবে আমার মা আমাকে নিয়েই বাসায় ফিরেছিলেন। আর একটা মজার কথা মা-র কাছে শুনেছিলাম। প্রতি রবিবার হাসপাতালের বাচ্চাদের নতুন পোষাক দেয়া হত। আমার মা আমাকে কখনোই সেই পোষাক পড়াননি। কারণটা আমার কাছে পরিস্কার না। আরেকটা মজার কথা শুনেছি মায়ের কাছে। আমাকে খুব ছোটবেলায় মেয়েদের জামা পড়ানোর চেষ্টা করা হত মাঝে-মাঝে। কিন্তু কোন বিচিত্র কারণে সেই জামা আমি পড়তে চাইতাম না; অথবা কোন রকমে পড়ানো হলেও সাথে সাথে সেটা খুলে ফেলার চেষ্টা করতাম। [আমার যতদুর মনে হয়, সেই বয়সের কোন শিশুর নারী-পুরুষের ভেদাভেদ বুঝতে পারবার কথা না। তাই এই ঘটনা শুনে বড়ই অবাক হয়েছি!]
যতদুর শুনেছি, আমি ছোট্ট বেলায় মাকে অনেক জ্বালিয়েছি। সারা রাত তাঁকে ঘুমাতে দিতাম না। [আমি যতদুর জানি সব বাচ্চাই কম-বেশি এমন করে। তবে আমার জ্বালাতন টা স্বাভাবিকের চাইতে বেশি ছিলো] আমার পা দুইটা নাকি রাতের বেলা ঘুমের মধ্যেও খুব বেশি চলতো। একে তো মা আমার জ্বালায় রাতে ঘুমাতে পারতেন না, তার উপর আবার একটু ঘুমিয়ে পড়লেই আমার দুই পায়ের লাথিতে তাঁর ঘুম ভেঙে যেতো। যখন আমার বয়স পাঁচ-ছয় বছর, তখন বেশির ভাগ সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের মুখে বিনিদ্র রাতের ছাপ দেখেছি।
তিন ভাই এক বোনের মধ্যে আমি-ই সবার ছোট। আমাদের বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় এমন সন্তানকে বলা হয় ‘প্যাট মোছা ছোল’ [যে বাচ্চা সবার শেষে মায়ের পেট মুছে বের হয়]। সবার ছোট হবার কারণে মায়ের আদর সবচেয়ে বেশি পেয়েছি [এবং এখনো পেয়ে যাচ্ছি]। আর এ কারণেই অনেক বড় হবার পরেও মায়ের সাথেই ঘুমাতাম। এমন ছেলেদের-ই হয়তো ‘মায়ের আঁচল ঘেষা ছেলে’ বলা হয়।
আমার জন্মের সময়ে বাবার সম্পর্কে কোন ঘটনা আমার জানা নেই। শৈশবের বেশিরভাগ স্মৃতি জুড়েই আমার মা। বাবার সাথে আমার দূরত্ব ছিলোনা, কিন্তু মায়ের মত অন্তরঙ্গতা-ও ছিলোনা। তাই বোধ-হয় শৈশবের কথা বলতে গেলে শুধু মা-র কথাই চলে আসে। আমার বোন তার শৈশব নিয়ে লিখতে গেলে নিশ্চয় বাবা-র বিষয়ে বলবে। শুনেছি, ছেলেরা নাকি মা-প্রিয় হয় আর মেয়েরা হয় বাবা-প্রিয়। শুধু আমাদের সংসারেই না, অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা দেখেছি। তবে বাবা-র বিষয়ে ছোটবেলার একটা কথা খুব মনে পড়ে । প্রতিদিন সন্ধ্যার পর যখন পড়তে বসে মায়ের বকা খেতাম [অথবা মাঝে-মাঝে মায়ের হাতে মার খেতাম] তখন ত্রাণকর্তা হিসেবে বাবা-ই এগিয়ে আসতেন আমার পাশে। কোনদিন বাবা আমার গায়ে হাত তোলেননি। বকা হয়তো দিয়েছেন দুই-একবার, কিন্তু সেটাও তেমন কিছু না। শাসন বলতে যা বোঝায়, তার পুরোটা মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি।
আমার শৈশবের মধুর স্মৃতির একটা বিরাট অংশ স্কুল জীবন এবং স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানীর বাড়ি আর খালার বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। এই বিষয়টা নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে।
আগেই বলেছি, তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। সবার ছোট হবার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, সবার কাছ থেকে আদর পাওয়া যায় এবং অন্যান্য ভাই-বোনদের চাইতে অনেক বেশি-ই পাওয়া যায়। আর সবচাইতে বড় অসুবিধা হলো, সবার শাসনটাও ভোগ করতে হয়। কারো কোন বিষয়ে রাগ থাকলে সেটা ঝেড়ে ফেলার উত্তম উপায় হলো, বাসার সবচাইতে ছোট যে আছে, তাকে ইচ্ছেমতো গালমন্দ করা। সে যা-ই হোক; আমি বাসায় সবার ছোট হয়ে সবচাইতে বেশি সুবিধা ভোগ করেছি [এবং এখনো করে যাচ্ছি]। বাসার কোন কাজ কখনো আমাকে করতে হয়নি। কোনদিন বাজারে যেতে হয়নি। বাসার যেকোন কোন সমস্যা আমার বাবা-মা আর বড় ভাই-বোন দের উপর দিয়ে গেছে; কখনো সেইসব অনুভব করিনি। বাসার বড় কোন কাজের দায়িত্ব কখনো নিতে হয়নি, এবং আজ-ও নিতে হয়না। তবে এখন যেটা অনুভব করি সেটা হলো, বাসার ছোট ছেলেকে সারাজীবন ছোট-ই থাকতে হয়। সে পূর্ণ যৌবনে পদার্পণ করলেও, বাসার সবার কাছে সে সেই ছোট্ট-ই থেকে যায়!
এডমন্টন সিটি, কানাডা
মে ২৫, ২০১০
এক প্রবাসী বাংলাদেশীর দিনলিপি [১ম পর্ব]
এক প্রবাসী বাংলাদেশীর দিনলিপি [২য় পর্ব]
এক প্রবাসী বাংলাদেশীর দিনলিপি [৩য় পর্ব]
মন্তব্য
ভাইয়া,
অনেক মজা পেয়েছি আপনার লেখাটা পড়ে, কারণ "ছোট" হবার ব্যপারে যে সত্যতা তা আসলেই বাস্তবে প্রমাণিত।
আমার ছোট ভাইটাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম হস্পিটালে, সেদিন আমার মনে প্রশ্নের অভাব ছিলো না, যেমন, "ও মা! ওর হাত দু'টা এত্তো ছোট!", "আল্লাহ্! কি পিচ্চি একটা মানুষ!!!!" ইত্যাদি।
এখন ভাবলেও অবাক লাগে যে সেই পিচ্চিটা এখন না কি ক্লাস এইটে পড়ে, সে আবার ক' বছর পর মেট্রিক পরীক্ষা দেবে :-o। অথচ ও যেন আমার কাছে এখনো সেই "পিচ্চি"টাই রয়ে গেছে। হয়তো সময় ঠিকই চলে যায়, অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না, আবার কিছু সময় আমরা বুঝেও বুঝতে চাই না।
আশা করি সব ছোটরাই যেন সারা জীবন তাদের আপন মানুষগুলোর কাছে সেই ছোট্টটিই থাকে; যত ঝড়-ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন, সেগুলো যেন কখনোই তাদের স্পর্শ করতে না পারে। তাদের জীবনে যৌবন-বার্ধক্য যে সময়টাই আসুক না কেন, তারা যেন সবসময় সে-ই "পিচ্চি"টাই থেকে যায়।
আশা করি ভাল থাকবেন এবং সারা জীবন সেই ছোট্টটি থেকে যাবেন আপনার কাছের মানুষদের কাছে।
ভাইয়া,
অনেক মজা পেয়েছি আপনার লেখাটা পড়ে, কারণ "ছোট" হবার ব্যপারে যে সত্যতা তা আসলেই বাস্তবে প্রমাণিত।
আমার ছোট ভাইটাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম হস্পিটালে, সেদিন আমার মনে প্রশ্নের অভাব ছিলো না, যেমন, "ও মা! ওর হাত দু'টা এত্তো ছোট!", "আল্লাহ্! কি পিচ্চি একটা মানুষ!!!!" ইত্যাদি।
এখন ভাবলেও অবাক লাগে যে সেই পিচ্চিটা এখন না কি ক্লাস এইটে পড়ে, সে আবার ক' বছর পর মেট্রিক পরীক্ষা দেবে :-o। অথচ ও যেন আমার কাছে এখনো সেই "পিচ্চি"টাই রয়ে গেছে। হয়তো সময় ঠিকই চলে যায়, অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না, আবার কিছু সময় আমরা বুঝেও বুঝতে চাই না।
আশা করি সব ছোটরাই যেন সারা জীবন তাদের আপন মানুষগুলোর কাছে সেই ছোট্টটিই থাকে; যত ঝড়-ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন, সেগুলো যেন কখনোই তাদের স্পর্শ করতে না পারে। তাদের জীবনে যৌবন-বার্ধক্য যে সময়টাই আসুক না কেন, তারা যেন সবসময় সে-ই "পিচ্চি"টাই থেকে যায়।
আশা করি ভাল থাকবেন এবং সারা বীবন সেই ছোট্টটি থেকে যাবেন আপনার কাছের মানুষদের কাছে।
ভাইয়া,
অনেক মজা পেয়েছি আপনার লেখাটা পড়ে, কারণ "ছোট" হবার ব্যপারে যে সত্যতা তা আসলেই বাস্তবে প্রমাণিত।
আমার ছোট ভাইটাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম হস্পিটালে, সেদিন আমার মনে প্রশ্নের অভাব ছিলো না, যেমন, "ও মা! ওর হাত দু'টা এত্তো ছোট!", "আল্লাহ্! কি পিচ্চি একটা মানুষ!!!!" ইত্যাদি।
এখন ভাবলেও অবাক লাগে যে সেই পিচ্চিটা এখন না কি ক্লাস এইটে পড়ে, সে আবার ক' বছর পর মেট্রিক পরীক্ষা দেবে :-o। অথচ ও যেন আমার কাছে এখনো সেই "পিচ্চি"টাই রয়ে গেছে। হয়তো সময় ঠিকই চলে যায়, অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না, আবার কিছু সময় আমরা বুঝেও বুঝতে চাই না।
আশা করি সব ছোটরাই যেন সারা জীবন তাদের আপন মানুষগুলোর কাছে সেই ছোট্টটিই থাকে; যত ঝড়-ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন, সেগুলো যেন কখনোই তাদের স্পর্শ করতে না পারে। তাদের জীবনে যৌবন-বার্ধক্য যে সময়টাই আসুক না কেন, তারা যেন সবসময় সে-ই "পিচ্চি"টাই থেকে যায়।
আশা করি ভাল থাকবেন এবং সারা বীবন সেই ছোট্টটি থেকে যাবেন আপনার কাছের মানুষদের কাছে।
চেনা পথিক,
আবারো অনেক-অনেক ধন্যবাদ আপনার সুন্দর এবং গোছানো মন্তব্যের জন্য। আপনার নিজের অভিজ্ঞতার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো।
সারা জীবন-ই ছোট্ট থাকতে বলছেন! হায় হায়!!
- মুক্ত বিহঙ্গ
নতুন মন্তব্য করুন