নীচ থেকে হোস্টেল ইনচার্জের গলা শোনা যায়।এত সকালে ডাক শুনে কিছুটা বিরক্ত নিয়েই মিনাক্ষী এগিয়ে যায় বারান্দায়, নীচে তাকাতে ইনচার্জ জানায় তিন দিন ধরে তিনি তাকে খুঁজছেন, তার একটা চিঠি এসেছে। দৌড়ে গিয়ে চিঠিটা নিয়ে আসে সে। চিঠির উপরে জীবনের নাম দেখাতে মিনাক্ষীর মন আনন্দে নেচে উঠে। রুমে ফিরতেই উর্মি তাড়া দেয় ক্লাসে যাবার জন্য। মনটা যতটা খুশি হয়েছিল, ঠিক বিরক্ত লাগে মেডিসিন ক্লাসের উপর। কেন আজ ক্লাস হবে, হঠাৎ কোন কিছু হয়ে ক্লাসটা না হলে মন্দ হতো না। উর্মিকে এ কথা বলতেই সে ঘড়ির দিকে তাকাতে বলে। অগত্যা রাতে পড়বে ভেবে চিঠিটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে মিনাক্ষী ক্লাসের দিকে পা বাড়ায়।
ক্লাসে স্যার যা বলছে কিছুই কানে ঢুকছে না, মনটা পড়ে আছে কখন চিঠিটা পড়বে তার জন্য। দিন রাতের বৈষম্যের জন্য অনলাইনের সুবিধাও ঠিক নিতে পারেনা সে। জীবন যখন বাসায় ফিরে বাংলাদেশে তখন দিন, সুতরাং তখন মিনাক্ষীকে থাকতে হয় ক্লাসে না হয় ওয়ার্ডে, নতুবা লাইব্রেরীতে। জীবন ওর ভাইয়ের সাথে আমেরিকা গেছে বছর দুয়েক হলো। এর মধ্যে এটা তার প্রথম চিঠি। আগে প্রায়ই ফোন করতো, কিন্তু কিছুদিন হলো যোগাযোগ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। মিনাক্ষী এদিক থেকে ফোন করলেও নানা অজুহাতে কথা বলতে চায় না। সে সব অবলীলায় মেনে নেয়, এসব নিয়ে বেশী মাথা ঘামায় না, ভাবে কাজের ব্যাস্ততায় হয়ত তেমন সময় পায়না। জীবনকে সে তার থেকেও বেশি বিশ্বাস করে। সে দিন গুনে, আর মাত্র ছ’মাস, তার পরই তারা চলে যাবে জীবনের কাছে।তারা মানে সে আর তাদের একমাত্র মেয়ে নুপুর।
জীবন যেন ওর সবকিছু, একদিন এই জীবনের জন্য ত্যাগ করেছিল ধর্ম, বাবা-মা আর ছোট ভাই টিকেও। বাবা মা’র এত স্নেহ ভালবাসাকে তুচ্ছ করে কিভাবে এই কাজ করেছিল একথা ভাবতেই মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় মিনাক্ষীর। বেশ কাকতালীয় ভাবেই পরিচয় হয়েছিল তাদের, সে কথা মনে হলে এখনো হাসি পায়।এক অনিবার্য আকর্ষণ অনুভব করেছিল জীবনকে একান্ত করে পাবার জন্য। মিনাক্ষী গুনে গুনে ব্যয় করেছে জ়ীবনের প্রতিটি মুহুর্ত।পড়ালেখা, সংস্কৃতিচর্চা, রাজনীতি সব করেছে সমান তালে। কিন্তু সারাজীবন আবেগকে দুরে ঠেলে রাখলেও জ়ীবনের কাছে পরাজিত হয়েছিল আবেগকে সম্বল কলেই। জীবনের না ছিল বিদ্যা, না ছিল অর্থ, কিন্তু মিনাক্ষী দেখেছিল ওর মনের বিশালতা, কিছু না থাকলেও হাজার বছর পার যেন করে দেয়া যায ওর সাথে।
উর্মির ডাকে বাস্তবে ফিরে আসে সে,
‘এই উঠ আর ভাবতে হবেনা, আগে আমাদের খাওয়া।’
‘কেন!’, মিনাক্ষী অবাক হয়।
‘আশ্চর্য, এতদিন পরে জীবন ভাইয়ের চিঠি এলো আর তা সেলিব্রেট করবিনা’, মুক্তা যোগ করে।
‘আমার কাছে আজ টাকা নেইরে, পরে খাওয়াব।’
‘আরে না না, বাকীর নাম ফাঁকি, আমার কাছ থেকে ধার নে’, উর্মি সমাধান দিয়ে দেয়।
মিনাক্ষীর আর না করার সুযোগ থাকেনা, সব ক্লাস শেষ করে ওরা চাইনিজে খেতে যায়। সেখান থেকে আবার ওয়ার্ডে ডিউটি সেরে রাত দশটায় রুমে ফিরে মিনাক্ষী। কাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে এসেই চিঠিটা নিয়ে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে সে। চিঠিটা খুলতেই মিনাক্ষী টের পায় অতি প্রিয় সেই পরিচিত সেই গন্ধ। কিন্তু একি!
মাত্র তিনটা লাইন অথচ তা পড়তেই তার চোখ প্রচণ্ড জ্বালা করে, প্রতিটি শব্দ তার কাছে দূর্ভেদ্য লাগে, মনে হতে থাকে যেন কোন অতল সমুদ্রে সে তলিয়ে যাচ্ছে, তার সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে যায়। সে হাত বাড়িয়ে বারান্দার রেলিংটা শক্ত করে ধরার চেষ্টা করে কিন্ত পারেনা, পৃথিবীটা হঠাৎ তার কাছে শুন্য মনে হয়। উর্মি দৌড়ে এসে মিনাক্ষীকে সামলে নেবার চেষ্টা করে, ওর হাত থেকে পড়ে যাওয়া চিঠিটা চোখে পড়ে তার। সাধাসিধে ভাবে লেখা কয়েকটা কথা,আর একটা প্যাকেট।বিবাহ বিচ্ছেদের কারন মিনাক্ষীকে নাকি তার আর ভাল লাগেনা। কি বিচিত্র মানুষের মন!
গভীর রাতে বিছানায় শুয়ে মিনাক্ষী ভাবে, কি ভাবে জীবন বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজ পাঠিয়ে দিল, একটিবারের জন্যও কি তার মেয়েটির কথা মনে হয়নি। সে নিজের দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যার্থ হয়। কি করেনি মিনাক্ষী, জীবন কে সে যখন বিয়ে করে তখন সে ৩য় বর্ষের ছাত্রী, জীবনকে খুশি করার জন্য বিয়ের অল্প কয়েক দিনের মধ্যে নামাজ পড়া, কোরান শরীফ পড়া শিখেছে। জীবনের পরিবারের নাচ গান বিশেষ পছন্দ নয় বলে এত সাধের সেগুলোও জলাঞ্জলি দিয়েছে, নিজের মত করে জীবনের পরিবারের সবাইকে আপন করে নিয়েছে। জীবনকে যখন ওর ভাই আমেরিকা নিয়ে যায় তখনও এতে ওর অনিচ্ছা প্রকাশ করেনি বরং নিজের মনকে শক্ত করেছে ওদের ভবিষ্যৎ সুন্দর সময়ের জন্য। কিন্তু কেন এমন হলো? নিজের মনের কাছে হাজার প্রশ্ন করেও যেন এর কোন উত্তর পায়না সে। একদিন যার জন্য সব ছেড়ে ছিল আজ সেই তাকে ছেড়ে দিল। এতবড় পৃথিবীতে তার আর নুপুরের যাবার জায়গা নেই ভাবতেই সে খুব অসহায় বোধ করে।বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন আর অর্থহীন মনে হয় তার। রাতের গভীরতার সাথে মিনাক্ষীর দীর্ঘশ্বাস আরো দীর্ঘায়িত হয়।
===============
মিতু
রিফাত জাহান মিতু
==============
সচলায়তনে প্রকাশিত আগের লেখাগুলিঃ
অস্থিরতা ও অজানা আশঙ্কা
জীবনের খুব কাছ থেকে দেখা -১
জীবনের খুব কাছ থেকে দেখা -২
মন্তব্য
অনেক সুন্দর হয়েছে.........
ধন্যবাদ প্রভা প্রহেলিকা।
দেখেন গল্প নিয়ে সমঝদারর অনেক কথা বলে থাকেন। কেউ বলেন নতুন কিছু বলো। কেউ বলেন নতুন করে নতুন ভাবে বলো। পুরনো গল্পও শুনতে ভালো লাগবে। আবার কেউ বলেন, এতো সরাসরি বলে ফেল না। একটু আড়াল করে বলো। পাঠককে ভাবতে দাও। কিন্তু এ্ই গল্পটা, এতো সরলমনে বলা, যে সমঝদারির সাথে পড়তেই মন চায় না। এধরণের গল্প আমার তো ভালো লাগে। এই গল্পটাও লেগেছে। আরো লিখুন। সম্ভবত এতে নিজের ভাষা আরো জোরালোভাবে খুঁজে পাবেন। ধন্যবাদ।
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
কঠিন বা গুরুগম্ভীর ভাষায় গল্প লেখার বিপক্ষে আমি।ধন্যবাদ।
মিতু
রিফাত জাহান মিতু
মীনাক্ষী মানে তো মীন বা মাছের মতো অক্ষি বা চোখ যার। সেভাবে দেখলে নামের এই বানানটা ভুল।
গল্প ভালো লাগলো, আরো লিখুন।
আব্দুর রহমান
হুম,আপনার ব্যাখ্যা ঠিক আছে।কিন্তু যার কথা লিখেছি,সে তার নামটা এই বানানে লিখতো।।ধন্যবাদ।
মিতু
ভালো হয়েছে। আরো গল্প লিখুন জীবনের এই ঘটনাগুলি নিয়ে। ভালোবাসার জন্য ধর্ম, পরিবার, নিজ সমাজ ত্যাগ করে আসা একজনকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। এত অসীম কষ্টের পরেও যদি এমন পরিণাম হয়, মেনে নেয়া যায় না।
গল্পটা পরে মন খারাপ লাগছে খুব।
সত্যি যদি কখনও এমন না হত.......।।
মিতু,
অণুগল্পের সরল বর্ণনা ভালো লেগেছে
একটা বিষয় বেমানান লেগেছে। চিঠিটা কি মীনাক্ষী সাথে নিয়ে যেতে পারতো না ক্লাস অথবা কাজের ফাঁকে পড়বার জন্য? যে চিঠি পড়বার জন্য মন আকুল হয়, সেটা না পড়ে রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা কী সম্ভব!
মীনাক্ষী আর নুপুর-এর জন্য মন খারাপ হলো
- মুক্ত বিহঙ্গ
নতুন মন্তব্য করুন