তবে মাঝে মধ্যে পুরাই উল্টা কিসিমের অভিভাবকও দেখা যায়। তারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের দিকে কোন নজরই দেন না। আর বলাই বাহুল্য, এইরকম অভিভাবকরা ওইসব গর্বিত বাবা-মায়েদের থেকে অনেক বেশি বিরক্তিকর। মি. ওয়ার্মউড আর তার বউ ছিলেন এইরকম দুই বাবা-মা। তাদের এক ছেলে, মাইকেল আর এক মেয়ে, মাটিল্ডা।
মাটিল্ডাকে তারা মনে করতেন এমন একটা কিছু যার সংগে স্রেফ মরা চামড়ার তূলনা করা চলে। আমরা যেমন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি কখন মরা চামড়াটা তুলে ফেলার সময় আসবে আর আমরা সেটাকে টেনে তুলে ফুঁ দিয়ে ফেলে দিতে পারবো, ঠিক সেইরকম আর কি! মি. ওয়ার্মউড আর তার বউও ওইভাবেই অপেক্ষাতে ছিলেন কবে তাদের পিচ্চি মেয়েটাকে টেনে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবেন, দূরে কোথাও। এক্কেবারে আরেকটা দেশ কিংবা অন্য একটা মহাদেশে নিয়ে ফেলতে পারলে আরো খুশি হবেন।
যখন বাবা-মায়েরা যখন তাদের “সাধারণ” বাচ্চার সংগে এইরকম মরা চামড়া বা পাঁচড়া টাইপের ব্যবহার করেন সেটা দেখতেই অসম্ভব খারাপ লাগে। কিন্তু যদি সেই বাচ্চাটা হয় “অসাধারণ”, মানে অসম্ভব বুদ্ধিমান আর সংবেদনশীল কেউ তাহলে বাবা-মায়ের অমন ব্যবহার একদমই অসহনীয় হয়ে যায়। মাটিল্ডা তেমনই এক অসাধারণ মেয়ে, বুদ্ধিতে প্রখর। ওর মাথা এতো ভালো ছিলো আর এমন চট করে সবকিছু শিখে ফেলতো যে একেবারে গোমূর্খও সংগে সংগে বুঝে যাবে এই মেয়েটার কত্তো বুদ্ধি! কিন্তু আমাদের ওয়ার্মউড বাবা-মা এমনই বোকার হদ্দ আর নিজেদের অর্থহীন জীবন নিয়েই এতো ব্যস্ত যে তারা তাদের মেয়ের মধ্যে অসাধারণ কোনকিছু খেয়ালই করলেন না। আর সত্যি বলতে কি, পিচ্চি মেয়েটা যদি বাইরে গিয়ে হাত-পা ভেঙেও ঘরে আসলেও মনে হয়না তারা কখনো সেটাও খেয়াল করতেন!
মাটিল্ডার বড় ভাই মাইকেল একেবারেই সাধারণ আর স্বাভাবিক একটা ছেলে। কিন্তু বোনটার কান্ডকারখানা দেখলে যে কারো চোখ কপালে উঠে যেতে বাধ্য। দেড় বছর বয়সের মাথায় সেই মেয়ে ফটাফট কথা বলা শিখে গেলো আর একদম বড়দের মতো করেই কথা বলতে পারতো। ওর বাবা-মা অবশ্য ওকে উৎসাহ দেবার ধারে-কাছে দিয়েও গেলো না। বরং ওকে অহেতুক বকর বকর করা বাদই দিতে বললো। ছোট্ট মেয়েদের গলা নাকি কখনো শোনা যেতে নেই, তাদের শুধু সুন্দর সেজেগুজে চুপচাপ বসে থাকতে হয়।
তিন বছর বয়সে সেই মেয়ে বাসায় যেসব পত্রিকা আর ম্যাগাজিন এখানে ওখানে পড়ে থাকে সেগুলো দেখে দেখে নিজে নিজে পড়তে শিখে ফেললো। চার বছরের মাথায় সে রীতিমতো বড়দের মতোই পড়তে পারতো আর তার কৌতুহল তখন বাড়তে থাকলো বইয়ের দিকে, স্বাভাবিকভাবেই। তবে তাদের পুরো বাসাটায় ওর মায়ের “সহজে রান্না” নামের বইটা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেলো না। অগত্যা সেই বইয়ের এইদিক থেকে ওইদিক পর্যন্ত সমস্ত শব্দ, বাক্য মুখস্থ হয়ে যাবার পর মাটিল্ডা চাইলো অন্য কিছু পড়তে। ভালো কোন বই।
সেইমতোই ইচ্ছা নিয়ে সে একদিন তার বাবার কাছে গিয়ে বললো, “বাবা, তুমি আমাকে একটা বই কিনে দিতে পারবে?”
“বই!? এইসব আজাইরা বই-টই দিয়ে তুমি করবা কি?”
“পড়বো, বাবা।“
“পড়বা মানে! টিভি দেখতে এমন কি সমস্যা? এত্তো সুন্দর বারো ইঞ্চি টিভি আছে আমাদের আর তুমি আসছো কিসব বই-ফইয়ের কথা বলতে! লাই পেয়ে তো মাথায় উঠে গেছো দেখা যাচ্ছে!” ওর বাবা তার স্বভাবসুলভ উত্তর দিয়ে দিলেন মেয়েকে।
প্রায় প্রতিদিন দুপুরটাই বাসায় একা একা কাটাতো মাটিল্ডা। মাইকেল ওর চেয়ে পাঁচ বছরের বড় আর সে প্রতিদিন স্কুলে থাকতো এই সময়। বাবা যেতেন কাজে। আর মা আট মাইল দূরের এক বাসায় যেতেন কার্ড খেলতে। সপ্তাহে পাঁচটা দুপুর কার্ড খেলতে যেতেন মা, তার নেশা ছিলো বলা চলে। তো, যেদিন বাবা বই কিনতে সাফ মানা করে দিলেন সেদিন দুপুরবেলা মা চলে যাবার পর মাটিল্ডা একাই রওনা দিলো তাদের মহল্লার পাবলিক লাইব্রেরীটার দিকে। সেখানে পৌঁছে মিস ফেল্পসের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলো ও। মিস ফেল্পস সেখানেই কাজ করেন। এইরকম বাচ্চা একটা মেয়েকে একা একা কোন অভিভাবক ছাড়াই লাইব্রেরীতে আসতে দেখে তিনি প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও আবার সামলে নিলেন। হাসিমুখে কথা বলতে লাগলেন তার সংগে।
মাটিল্ডা খুবই ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলো, “বাচ্চাদের বইগুলো কোনদিকে আমাকে দয়া করে দেখিয়ে দেবেন?”
মিস ফেল্পস দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “ওইদিকের নীচের তাকগুলোতে বাচ্চাদের বই আছে। আমি কি তোমার সংগে যাবো? অনেক ছবি আছে এইরকম একটা বই তোমার জন্য খুঁজে দিতে পারি।“
“না, না, লাগবে না। আমি নিজেই খুঁজে নিতে পারবো। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।“
সেই থেকে প্রতিদিন দুপুরে মা কার্ড খেলতে বের হলে গুটি গুটি ছোট্ট পায়ে বেরিয়ে যেতো মাটিল্ডাও। চলে যেতো লাইব্রেরীতে। মাত্র দশ মিনিট লাগতো বাসা থেকে হেঁটে যেতে। আর তারপর পুরো দুই ঘন্টা শুধু বই আর বই! লাইব্রেরীর এক কোণায় আরামে বসে চুপচাপ একটার পর একটা বই শেষ করতো মাটিল্ডা। এইভাবে পড়তে থাকলে বাচ্চাদের বই শেষ করতে আর কয়দিন লাগে! তো, কিছুদিনের মধ্যে মাটিল্ডাও সমস্ত বাচ্চাদের বই পড়া শেষ করে ফেললো। তারপর ঘুরঘুর করতে লাগলো লাইব্রেরীর এদিক সেদিক আরো বইয়ের খোঁজে।
চলবে..
- নৃ
মন্তব্য
মাটিল্ডার কপাল খারাপ! কী বাবা-মা.......বই পড়তে গেলে বিরক্ত হয়..
অনুবাদ ভালো লেগেছে।
বাবা-মা সম্পর্কে আরো ইনসাইট আসবে পরের পর্বগুলোতে ..
ভালো লাগায় কৃতজ্ঞ
.................................................................
মাটিল্ডার জন্য শুভকামনা।
আমার মেয়ে কেবল বইয়ের পাতা ছোড়ে। মাটিল্ডার মতো পড়লে দুনিয়ার সব বই কিনে দিতাম। কিন্তু আশা এখনও আছে। জুলাইয়ে দেড় বছর হবে।
বুঝতেই পারছেন কতো আগ্রহ নিয়ে আপনার মাটিল্ডার কথ্ পড়ছি। অনুবাদের ভাষাটা খুব প্রমিত না হওয়ায় গল্পটা বেশী বিস্বাশযোগ্য লাগছে আমার কাছে।
এর পর মাটিল্ডা কি পড়বে এবং করবে?
হাহা.. মাত্র দেড় বছরেই মাটিল্ডার মতো হওয়া একটু কঠিনই বটে! তবে আপনার মেয়েটিও নিশ্চই ঠিক তার নিজের মতো করেই অসাধারণ একজন হবে
বাচ্চাদের গল্প বলেই আমি ভাষাটা সহজ, ঘরোয়া রাখবার চেষ্টা করছি যেন পড়তে গিয়ে তাদের একেকটা ডিকশনারীর দরকার না পড়ে। আপনার ভালো লাগায় কৃতজ্ঞতা জানাই।
আপনার পিচ্চিটার জন্য অনেক আদর থাকলো
যেমন গল্প তেমন অনুবাদ। দুটোই ঝরঝরে। চলুক মাটিল্ডার বই যাত্রা!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নীড়দা.. সমস্ত প্রশংসাই মূল লেখকের প্রাপ্য। আমি ভাষা বদলানোর নিমিত্ত মাত্র!
নতুন মন্তব্য করুন