অনলাইনে সাবধান!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ৩১/০৫/২০১০ - ৯:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ফোনট্যাপিংফোনট্যাপিং

[লেখাটি মাসদেড়েক আগে লিখে ড্রাফট করে রাখা। এখন খুব যুতসই সময় মনে হল সবার সাথে শেয়ার করার জন্য]

এই মনে করেন আপনি অনলাইনে কাজকর্মে মাঝারি থেকে বেশীরভাগ অংশই সারেন। আপনার আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধবের সামাজিকতার একটা বড় অংশও ফেসবুকের কল্যাণে তেমন সমস্যার না। আর কাউকে চটজলদি পেতে হলে তো মোবাইল আছেই এক রিং দিলেই পৃথিবী হাতের মুঠোয়। আপনার মত প্রযুক্তিমনস্ক মানুষকে নিয়ে আপনার পরিচিতরাও খুশী আর আপনারো আপত্তি নেই। যাদের বেশ কয়েক বছর ধরে অনলাইনে পদচারণা তাদের জীবনের এক বড় অংশ দেখা যাচ্ছে অনলেইনে সংরক্ষিত হয়ে থাকছে। এই অনলাইন সংগ্রহশালার মধ্যে এমন বহু তথ্য বা ছবি বা স্মৃতি থাকে যা আপনার নিতান্তই ব্যাক্তিগত। আর সেগুলো প্রকাশ হয়ে গেলে আপনার ব্যাবসায়িক বিড়ম্বনা, বা ব্যাক্তিগত সমস্যার মুখোমুখি হবেন অথবা অন্যান্য কারণে সমস্যা হতে পারে। তাই অনলাইনে আপনার ব্যাক্তিগত তথ্যাদি যেন ব্যাক্তিগত থাকে তার জন্য কম্পিউটার নিরাপত্তা বিশারদরা দিনরাত কাজ করে যান আর ব্যাবহারকারীদেরও নিরাপদে থাকার জন্য উপদেশ দিয়ে থাকেন।

এখন আপনার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে প্রধানত দুভাবে। প্রথমত আপনার একাউন্ট যদি কেউ হ্যাক করে। এটি একটি অতি প্রচলিত ইস্যু আর এই ঝুঁকি থেকে মোটামুটিভাবে বাঁচা তেমন কঠিন কিছু না। যেই কম্পিউটার আপনি ব্যাবহার করবেন সেটি মোটামুটি ভাইরাস, স্পাইওয়ার ইত্যাদি পোকামাকড় থেকে মুক্ত রাখলে আর আন্দাজ করা মুশকিল এমন জটিল পাসওয়ার্ড ব্যাবহার করলে গড়পড়তা হ্যাকিং থেকে বাঁচা সম্ভব। ব্যাক্তিগত তথ্য বিঘ্নিত হবার দ্বিতীয় ঝুঁকি হল সরকার যদি আপনার সম্পর্কিত তথ্য আপনি যেই ওয়েবসাইট ব্যাবহার করেন তাদের থেকে চায় তাহলে। আমার জানামতে খুব কম ব্যাবহারকারীই এই বিষয়ে কখনো চিন্তা করেন বা ভেবে দেখেন কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের কাছে আমাদের ব্যাক্তিনিরাপত্তা মোটামুটি অর্থহীন।

আমেরিকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে একটি পরিচ্ছেদ যোগ করা হয় যার অর্থ মোটামুটি এই যে – একজন নাগরিক তার বাড়িতে, কার্যক্ষেত্রে, দলিলাদিতে অন্যায্য সরকারী জেরা ও যব্দের হাত থেকে নিরাপদ থাকবে যদি না আইন/বিচারবিভাগ প্রয়োজনীয় সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করে।

এই আইনের আওতায় যেকোন নাগরিকের ব্যাক্তিগত জীবনে হাত দিতে গেলেই সরকারকে প্রয়োজনীয় ওয়ারেন্ট ইস্যু করা লাগে ও তার বিপরীতে একজন সন্দেহভাজন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয় ও তার ব্যাক্তিগত তথ্যাদি তদন্ত করা হয়। প্রচলিত পরিস্থিতিতে এই আইন কার্যকর হলেও অন্তর্জালীন যোগাযোগের যুগে এই আইনের হালনাগদ করার দরকার হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৮৬ সালে আমেরিকায় আরেকটি নতুন আইনের প্রবর্তন হয় যেটি ইলেক্ট্রনিক কমিউনিকেশনস প্রাইভেসী এক্ট। এই আইনের আওতায় সরকার চাইলে কোন ব্যাবহারকারীর ইমেইল তাকে না জানিয়েই এবং কোন সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু না করেই পড়তে পারবে (তবে তার জন্য মেইলের বয়স ১৮০ দিনের বেশী হওয়া লাগবে, মেইলটি গ্রাহকের আগে থেকে পড়া লাগবে আর মেইলটি সার্ভারে সংরক্ষিত হওয়া লাগবে ইত্যাদি)। আর এই আইন নিয়ে এখন আমেরিকায় প্রচুর বাদানুবাদ হচ্ছে আইএসপি, টেকনলজী প্রোভাইডার আর সরকারের মধ্যে ভাল যুদ্ধ চলছে। সরকার চায় হল সে চাইলেই যেকোন নাগরিকের যেকোন তথ্য নিতে পারে। আর টেকনলজী কোম্পানী নীতিগতভাবে চায় যে সে তার কাস্টোমারের গোপনীয়তা ও ব্যাক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করবে।

তাই কিছুদিন ধরে আমেরিকার প্রধান প্রযুক্তি কোম্পানীগুলো একত্রে একটি ফোরাম করে সরকারের কাছে আবেদন করছে যেন আমেরিকান সরকার বর্তমান সময়ের তুলনায় পিছিয়ে পড়া এই আইনটি হালনাগাদ করে। অর্থাৎ বর্তমানে একজন মানুষের অনলাইন পরিচয় তার রক্তমাংসের পরিচয়ের মতই অনেকটি বাস্তব আর সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর বিস্তারের ফলে অনেক ব্যাবহারকারীরই প্রচুর তথ্য অনলাইনে সংরক্ষণ করা হয়। একই ভাবে নিতান্ত পারিবারিক যোগাযোগ রক্ষা করা বা হালকা দাফতরিক চালাচালির বদলে বর্তমানে ইমেইলই হয়ে গেছে বহু যায়গায় যোগাযোগের একমাত্র এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম। তাই ইমেইলের গোপনীয়তার নিশ্চয়তার গুরুত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ। কয়েক বছর আগে চীনে এক ব্যাবহারকারীর ইমেইলের তথ্য চীনা সরকারের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয় ইয়াহু আর সেই তথ্যের ভিত্তিতে সেই মানবাধিকার কর্মীকে জেলে যাওয়া লাগে। সেই ঘটনার পরে অনলাইনে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়, কিন্তু আমেরিকার নিজের মাটিতেই অনলাইন নিরাপত্তার বেড়াটি তেমন শক্ত না।

মাইক্রোসফট, ইয়াহু, এওএল, গুগল সহ প্রধান সেবাদানকারীদের এই আন্দোলনের ফলে যদিও আমেরিকান আইন হালনাগাদ করা হয় তবুও মনে হয় আইনের মাঝে যথেষ্ট পরিমাণে ফাঁক রাখা হবে যেন এই আইন শুধু আমেরিকান ব্যাবহারকারীদের ওপরেই বলবৎ হয়। অর্থাৎ আমেরিকান সরকার যদি বাংলাদেশী বা ব্রাজিলিয়ান কোন নাগরিকের তথ্য ফেসবুক বা গুগলের কাছে চায় তবে দিব্যি তারা দিয়ে দেবে। যাদের জীবন মরণ অনলাইনে তারা নিজেদের অবস্থা আরেকবার চিন্তা করে দেখেন।

আর আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাজেটে কালো অপারেশনের জন্য যেই পরিমানে টাকা বরাদ্দ করা হয় তাতে মনে হয় দু-পাঁচটা বাংলাদেশ দিব্যি চরে খেতে পারবে তাই বিশ্বব্যাপী মানবতার মোড়লদের নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই।

একই সাথে একটু অস্বস্তিকর একটি খবর দেখলাম কিছুদিন আগে। প্রথম আলো রিপোর্ট করছে জননিরপত্তার স্বার্থে গোয়েন্দা বিভাগের হাত থেকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশের ফোনে আড়িপাতার দায়িত্ব। পত্রিকার ভাষ্যমতে “সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা মন্ত্রী ও সরকারদলীয় কয়েকজন নেতার মুঠোফোনে আড়ি পাতে এবং এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতনদের কাছে পাঠায়। এ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে হইচই পড়ে যায়।“ সমস্যার কথা হল, ভিআইপিদের ওপরেই যদি যখন তখন আড়িপাতা হয় (যদিও রাঘব বোয়ালরাই বড়মাপের ‘সুকর্ম’ গুলো করে থাকে) তবে সাধারণ জনগণ যাবে কই। বাস্তব প্রমাণিত সত্য যদিও এই যে মোবাইল নেটওয়ার্কের নজরদারীর কারণে গত কয়েকবছরে বেশকিছু বড়মাপের অপরাধী ধরা পড়েছে, তবুও বাংলাদেশের পুলিশ/ গোয়েন্দাদের ওপরে খুব বেশী ভরসা করতে সাহস হয়না। একই সাথে কোন নির্দিষ্ট ব্যাবহারকারীর তথ্য ‘নির্দিষ্ট ফী’ এর বিনিময়ে যে তার প্রতিপক্ষের কাছে পাচার হবেনা তারই বা নিশ্চয়তা কি, যেখানে যেকারো ওপরে নজরদারী শুরু করতে আইন বা বিচার বিভাগের কোন অনুমতির প্রয়োজন হয়না?

দুনিয়া বড়ই জটিল… একটু সাবধানে থাকবেন

ফরিদ
বইমেলা


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- হে হে হে
আমার কোনো মোবাইল নাই। মানে বাংলাদেশি কোনো মোবাইল আমি ব্যবহার করি না। বড় বাঁচা বাঁইচা গেছি মনে হয়!

অবশ্য, এইখানেও আমার মোবাইলে কখনো আড়ি পাতা হলে কতোগুলা গান শুনতে পারবে লোকে (দেখি, ভালো ভালো কিছু গান ঢুকিয়ে রাখতে হবে)। আর যদি কথা শুনতে চায়, তাইলে আধুনিক কালের সর্বসাম্প্রতিক গালির ডিকশনারি (by- ধুগো) হাতের কাছে থাকা লাগবে। হাসি
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতিথি লেখক এর ছবি

মানলাম, বুঝলাম বাংলাদেশী মুবাইল ফুন নাই, কিন্তুক তাই বলে কি ইমেইল নাই অন্য সাইটে একাউন্ট নাই?

ধরা যাক শ্যামকাকা হটাৎ করে আগ্রহী হইলেন, ধুগো তার মূল্যবান সময় খরচ করে অনলাইনে কোন কোন বালিকার লগে ধুনফুন করে, যা বুঝা যাচ্ছে তিনি চাইলেই সব তথ্য পেতে পারেন।

ডানবামের ফরিশতার লাহান আজকাল সবই রেকর্ড থাকে। সব তথ্য একত্র করলে যেই কাউরে খাড়ার ওপরে গ্রেফতার করা যায়।

নৈষাদ এর ছবি

লেখা ভাল লাগল।

আমাদের ধুসর গোধূলির ‘বাংলাদেশের মোবাইল ফোন নেই’ বলে আনন্দ প্রকাশ করার খুব একটা সুযোগ নেই বোধহয়। প্রথম আলোর রিপোর্টাতে দেশে একসাথে মাত্র পাচঁ হাজার ফোন টেপিং এর কথা বলা হয়েছিল।

ল’ফুল ইন্টারসেপশন’ প্রায় সব দেশেই আছে, এবং আমি নিশ্চিত উন্নত দেশে এল আই এর মানও উন্নত। বাংলাদেশ থাকলে হয়ত আপনি এর আওতায় আসতেন না, কিন্তু ইউরোপে এর আওতায় থাকার প্রবল সম্ভাবনা আছে… (ইদানিং ব্লক টক করে সম্ভাবনা আরও বেড়েছে…:D

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- এটা ঠিক নৈষাদ'দা। কিন্তু এখানে এল আই'এর আওতায় পড়লেও আমি এতোটা নিশ্চয়তা অন্তত পাবো যে আমার তথ্যগুলো কোনো আন-অথারাইজড কারো কাছে পাচার হবে না। এবং সেই তথ্য নিয়ে কেউ আমাকে কোনোভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করবে না।

আমার নিজের দেশে কি আমি এই সুবিধাটুকু পাবো? (যদি ধরে নিই, পাঁচ হাজার নাম্বারের মধ্যে আমার নাম্বারও কোনো চিপাচাপা দিয়ে ঢুকে গেছে)

ফেসবুক ব্যান নিয়ে হিমু একটা দারুণ কথা বলেছে। বান্দরের হাতে খুন্তি থাকলে সেটা আসলেই ভালো কোনো অভিজ্ঞতা বয়ে আনবে কি না, এ ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

নৈষাদ এর ছবি

হ্যাঁ, তথ্যের ব্যবহার নিয়ে আপনার মন্তব্যের সাথে পূর্ণ সহমত প্রকাশ করছি।

কল্পনা আক্তার এর ছবি

ফোনে আড়িপাতার যন্ত্রনায় আমি অস্থির। মাঝে মাঝে মনে হয় ফোন(গুলো)ছুড়ে ফেলে দেই কিন্তু পারিনা, প্রযুক্তির বেড়াজালে নিজেকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছি এখন আর নিজেকে এর থেকে আলাদা করতে পারছিনা মন খারাপ
........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা


........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

অতিথি লেখক এর ছবি

বিশাল সব বিপদ থেকে গা বাঁচিয়ে থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে, আজকাল আর কিছুই খুব একটা গায়ে লাগে না। তবে আমি অনেককেই দেখি অনলাইনে ভুয়া আইডি দিয়ে খোমাখাতা, ইয়াহু, মেসেঞ্জারে ক্রমাগত প্রতারনার চেষ্টা করে যেতে -- এইসব ভুয়ামি থেকেও দূরে থাকা উচিত।
--শফকত মোর্শেদ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এই দেশে সাবধানে থাকা না থাকার সঙ্গে বিপদ আসার সম্ভাবনা শূণ্য। বিপদের আসার ইচ্ছা হইলে আপনা আপনিই আসে। তাই কিছুই চিন্তা করি না। নিশ্চিন্ত মনে চলি।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

হাসিব এর ছবি

কথা সেইটাই । এভিডেন্স না পাইলে এভিডেন্স বানায় নেয়া হৈবে । দরকার হলে প্রেসে রিলিজে বলা হবে আমার জার্মান বাসায় খাটের নিচ থেকে জেহাদি বই, বাথরুমের শেলফে কনডম পাওয়া গেছে ।

অতিথি লেখক এর ছবি

নজরুল ইসলাম লিখেছেন:
এই দেশে সাবধানে থাকা না থাকার সঙ্গে বিপদ আসার সম্ভাবনা শূণ্য। বিপদের আসার ইচ্ছা হইলে আপনা আপনিই আসে। তাই কিছুই চিন্তা করি না। নিশ্চিন্ত মনে চলি।

নজরুল ভাই, ভাল বলছেন... আমিও নিশ্চিন্ত মনেই চলি ...হা হা
--শফকত মোর্শেদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।