একটি পুরোনো গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৬/২০১০ - ৯:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোটবেলাটা খুব আবছাভাবে মনে পড়ে, বিশাল ফ্ল্যাটে নিজেকে খুব একা মনে হতো, সাজিয়ে রাখা একটা পুতুলের মতো । বাবা মা যখন নিজেদের কেরিয়ার গড়ার উন্মত্ত প্রতিযোগীতায় বাইরে কাটিয়ে দিতেন সারাটা দিন তখন আমি কংক্রীট এর কুঠুরিতে আটকা পড়ে ঠান্ডা মেঝেতে বসে অর্থহীন খেলা খেলে যেতাম একের পর এক। একমাত্র বড় আপু তখন সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তার বাসায় ফেরার মুহুর্তটা ছিল আমার ছোট্ট জগতের সবচেয়ে আনন্দময় মুহুর্ত। তারপরও সেইদিনগুলিই হয়তো আমার জীবনের সবচাইতে রঙ্গীন দিন ছিল। তারপরের গল্প তো শুধু একদিকে ওপরে ওঠার অন্যদিকে তলিয়ে যাওয়ার। মনে পড়ে, আমরা যেদিন গুলশানের নতুন বাড়িতে উঠে এলাম, রঙ্গিন ফার্নিচারের প্রাচুর্য্যতায় আমার একটা নিজের রুম হলো। আমার বয়স তখন পাঁচ। সুন্দর পেইন্টিং করা দেয়ালে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি কি সেদিন আরও একটু একা হয়ে গিয়েছিলাম? আপুর গা ঘেষে ঘুমাতাম মনে আছে, শেষ কবে মায়ের বুকের কাছে ঘুমিয়েছি তা অবশ্য এখন আর মনে করতে পারিনা, কিন্তু সেদিন থেকে আমার নরম বিছানায় ছোট্ট আমি সম্পূর্ণ একা। এভাবেই আমার পৃথিবী বিস্তৃত হচ্ছিল আর হয়তো একটু ফাঁকাও। আমারি এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে হলভর্তি অতিথির সামনে সেদিন আমি অদ্ভুতভাবে বিপন্ন ও শঙ্কিত বোধ করছিলাম, বাবা-মা দুজনে দুদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। ভদ্রতার মেকি মুখোশের আড়ালে একদঙ্গল অতিথির সামনে রাগে ফেটে পরা থেকে হয়তো তারা নিজেদের অনেক কষ্টে সংবরণ করেছিলেন। ঠিক কি নিয়ে সেদিন তাদের মনোমালিণ্য হয়েছিলো জানিনা, তবে ওনাদের মাঝে নিরন্তর ব্যক্তিত্বের সংঘাত চলতো, সেটা আমি পরে বুঝেছিলাম। একদিন সত্যিই সেই সংঘাত চরমে উঠলো। মনে পড়ে সেই বিকেলের কথা, বড়আপু ছিলো কোচিং এ, আর আমি বাবা মায়ের ঔচ্চস্বরের বাক্যালাপ শুনতে শুনতে শংকিত হয়ে উঠছিলাম। বাবা কি মাকে মেরেছিলেন? জানিনা। তবে বাবা একপর্যায়ে মাকে বলেছিলেন চলে যেতে, তাকে আর ওনার প্রয়োজন নেই। মাও আর একমূহুর্ত দেরি করেনি। হয়তো দুজনের কাছেই দুজনের প্রয়োজন ফুরিয়েছিল।

এরপরের গল্পটা খুবি গতানুগতিক একটা নাটকের মতো। আইনি লড়াই শুরু হয়েছিল আমাদের দুবোনকে নিয়ে, সম্পত্তির মতো। যখন বোঝা গেল কোনো একজনকে দুজনেরি দায়ীত্ব নিতে দেয়া হবেনা, তখন দুজনই যেন প্রচ্ছন্নভাবে চাচ্ছিলেন বড়আপুকে নিজের কাছে রাখতে, যদিও মুখে তা ব্যক্ত করেনি । কে জানে, হয়তো যে মেয়েটি তাদের কিছুদিনের জন্য হলেও পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের মতো মানবীয় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন রেখেছিল, সেই অনুভূতির স্মৃতির ছোঁয়া পেতেই আপুকে তাদের প্রয়োজন ছিল। কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী এরপর আপু মায়ের কাছে আর আমি বাবার কাছে ছিলাম। আপু মাঝে মাঝে আসতো বাবার সাথে দেখা করতে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতো স্রেফ বাবা এবং মেয়ের দেখা করার আনুষ্ঠানিকতা, কিন্তু যেদিন দেখা হতো সেদিন বাবা আর আপু দুজনের মধ্যেই একটা চাপা উচ্ছ্বাস কাজ করতো। আর কেউ বুঝতে পারতোনা কিন্তু আমি পারতাম। আর আমি? হ্যাঁ, মায়ের সাথে আমার দেখা করাটা যেন ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। নাহ্‌, মায়ের দোষ নয়, আমিই পারতামনা সহজ হতে। ছোটোবেলা থেকেই বাবা মায়ের সাথে আমার যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তাকে আর আমি অতিক্রম করতে পারিনি। এর দু তিন বছর পর মা আর আপু ইমিগ্রেশন নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলো, আমি আর বাবা রইলাম দেশে। বাবা সেই আগের মতই টাকা উপার্জন করার দুর্মর নেশায় মত্ত। আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম বিলাসিতার প্রাসাদে আর একাকিত্বের অন্ধকারে। সব পাওয়ার জগতে একরাশ বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়েও আমি ছিলাম একেবারে একা, অদ্ভুত একটা ফাঁকা অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো সবসময়। কে জানে হয়তো আমি বাস্তববাদী ছিলামনা, হয়তো কিছুটা ভোতাও ছিলাম। খুব কষ্ট করে এ-লেভেল দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম অখ্যাত এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। মাঝে মাঝে আমরা মা আর আপুর খোঁজখবরপেতাম। তাও পাওয়া যেতো ক্রমশ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে থাকা আপুর বদৌলতে। হ্যাঁ, সেই চৌকশ মেয়েটি তার শিক্ষাজীবনের একের পর এক ধাপ অতিক্রম করছিল অসামান্য প্রতিভায়। দেশের পত্রিকায় বিশেষ খবর আসতো- 'বাংলাদেশী মেয়ের অভূতপূর্ব সাফল্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গ্রেডপয়েন্ট প্রাপ্তি। ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে তার প্রকাশিত পেপার নিয়ে গবেষক মহলে হইচই। শুধুমাত্র এই খবরগুলো
পাওয়ার সময়ই বাবার ঈস্পাতকঠিন মুখে কিছুটা হাসির রেখা দেখা যেতো।

এভাবেই চলছিল। এরপর এলো একদিন সেই চিঠি। এইতো দুসপ্তাহ আগের কথা, চিঠির ভাষা খুব সোজাসাপ্টা, তারপরও যেন বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। আপু দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। পৃথিবীর কোনো ডাক্তার পারেনি কোনো সমাধান দিতে। বরং একেকজন ডাক্তার একেকটা সময় বেধে দিচ্ছে। শেষমূহুর্তে এসে মেয়েটি তার বাবা আর বোনকে দেখতে চাচ্ছে। চিঠিটা আমার মায়ের লেখা, মেয়ের শেষ ইচ্ছা পুরণ করতেই হয়তো তিনি অহ্‌মিকা ভেঙ্গে বাবাকে অনুরোধ জানালেন সেখানে যেতে। 'মায়ের চিঠি'...বহুদিন পর মা যেনো জেগে উঠলেন আমার স্মৃতিতে। যে মমতার স্পর্শ আমি কোনোদিনও পাইনি, যার স্বাদও আমি জানিনা সেই স্পর্শের জন্যই একটা অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করে ফেলল। আশ্চর্য্য!! আপুর কথা কি কোনো রেখাপাতই করলনা আমার মনে?? চিঠিটা পেয়ে বাবাকে উদ্‌ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছিল। পাগলের মতো আমাদের ভিসার জন্য ছোটাছুটি করছিলেন। পাঁচদিনের মাথায় উড়াল দিলাম। সত্যি, অদ্ভুত সে বিদেশযাত্রা, কাউকে পৃথিবী থেকে বিদায় জানাতে আমাদের সে বিদেশযাত্রা।বহুদিন পর মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের সঙ্গে বাবার মিলনমূহুর্তটা কি খুব বেশী আবেগভরাক্রান্ত হয়েছিলো? তাদের ভেতরে কি হচ্ছিল বুঝতে পারিনি,
তবে বাবাকে আপুর হাত ধরে কাঁদতে দেখেছি। হ্যাঁ, নিখাদ কান্না। ভেতরের জমাট বাঁধা কষ্ট যেন চোখের পানি হয়ে ঝরছিলো। সত্যি, বহুদিন আমি এমন বিষ্মিত হইনি। বাবা-মা একবারও সামনাসামনি হলেননা। তারা আলাদা আলাদা সময়ে আপুর কাছে আসতেন। আর আমাকে একদিন মা আলাদা ডাকিয়ে নিয়ে দেখা করেছেন। মায়ের সাথে দেখা হলো ১২ বছর পর। সেই মা যিনি আমাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন, অথচ উনি যখন আমার পিঠে হাত রাখলেন, আমি সংকুচিত হয়ে গেলাম। এই কি সেই স্পর্শ যার জন্য আমার এত আকুলতা?? মাকেও সেদিন দেখেছি, আপুর পাশে বসে কাঁদতে। আপু বিরক্ত মুখে বারবার মাকে বলছিলো চুপ করতে। আর আমি? আমার অনুভূতি কিছুটা ভোতা জানতাম, তাই বলে এতটা ভোতা? আমি কেন যেন কাঁদতে পারতামনা। তবে কি আমি আপুর এই পরিণতিতে দুখি নই? আমি কি আমার ছোটোবেলার আপুকে ভালবাসতে পারিনি? আমার শুধু আশেপাশের পৃথিবীটাকে আরও ভীষনরকমের ফাঁকা মনে হতে থাকল। আমি কেবল আপুর বেডের পাশে বসে থাকি আর জানালা দিয়ে অর্কিডফুলের গাছের দিকে তাকিয়ে থাকি। এমনি এক নির্জন দুপুরে আপু আমার হাত ধরে বলল ,'বুবলি( ছোটবেলায় আপু আমাকে এই নামে ডাকতো) তোর সেই ফেরীওয়ালাটার কথা মনে আছে? আমি যথারীতি অন্যমনষ্ক ছিলাম, চমকে আপুর দিকে তাকালাম-
'কোন ফেরিওয়ালাটা?'
'সেইযে আমাদের বাসার সামনে দিয়ে প্রতিদিন দুতিনবার করে ফেরি নিয়ে ডেকে যেতো, আর আমাদের দেখলে মিষ্টি করে হাসতো।'
'হ্যাঁ, মনে আছে।'(কিন্তু আপু হঠাৎ করে তার কথা বলছে কেন??)
'তোর মনে আছে? যেদিন সে তার ফেরি একেবারেই বিক্রী করতে পারতনা সেদিন সে কেমন অদ্ভুত মনখারাপ করা ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকতো ক্রেতার আশায়। সেদিন কিন্তু তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাতোনা, তার দিকেও না, তার ফেরির দিকেও না।'
আপু আপনমনে বলে যেতে লাগলো...
'অথচ সেসব দিনেও যদি সে আমাদের দেখতে পেতো একটা স্নেহের হাসি হাসতই। তার সেই হাসির নিঃসঙ্গতা তখন আমাকে ছুয়েঁ যেত। একদিন ফেরি বিক্রী না হলে তার ঘরে খাওয়া জুটবেনা, এই ভয়ঙ্কর চিন্তা মাথায় নিয়েও সে যখন হাসতো তখন সেই হাসিতে কতটুকু নিঃসঙ্গতা থাকতে পারে, তা কি তুই ভাবতে পারিস?
আমি আপুর দিকে তাকিয়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। সে কেন আজ আমাকে এসব বলছে? সৃষ্টিকর্তা কি তাকে অসম্ভব মেধা দেয়ার সাথে সাথে থট্‌রিডিং এর ক্ষমতাও দিয়েছেন? সে কি আজ আমার একাকিত্বকেও স্পর্শ করতে চাইছে? নাকি শুধু স্পর্শই নয়, এই অর্থহীন একাকিত্বের অন্তঃসারশূন্যতা দেখিয়ে একে ঝেরে ফেলে দিতে বলছে...?? না, মুখে সে আর কিছুই বলেনি, তার উষ্ণ হাত আমাকে স্পর্শ করে ছিল, আমার ভেতরটা কাঁপছিল, বহুদিন পর যেন কোনো জীবনের ছোঁয়া পেলাম। এই মেয়টিই আর অল্পদিনের ব্যবধানে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চলেছে, আমার কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায়না। আপুর জন্য প্রতিদিন একটি শেতাঙ্গ ছেলে ফুল নিয়ে আসে। কিন্তু খুব আল্পদিনই তাকে আমি আপুর সাথে কথা বলতে দেখেছি। আপুকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, এই শেতাঙ্গ আপুর সাথেই রিসার্চ করছিলো। এখন আর করছেনা, হঠাৎ করেই ছেড়ে দিয়েছে। কেন ছেড়ে দিয়েছে এই ব্যপারে কোনো উপুযুক্ত কারন সে দর্শাতে পারেনি। ওরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করতো, যদিও মুখ ফুটে সেটা কখনো বলা হয়ে ওঠেনি। ছেলেটি অধিকাংশ দিনই সে সময়ই আসে যখন আপু ঘুমিয়ে থাকে। স্বচ্ছ কাঁচের পার্টিশানের ওপাশ থেকে অপলক দৃষ্টিতে ঘুমন্ত আপুর দিকে তাকিয়ে থাকে। একদিন আমি তার চোখের দৃষ্টি খেয়াল করেছিলাম। দৃষ্টিতে অসীম শূন্যতা। বেশিক্ষণ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা অসম্ভব। হঠাৎ করেই আমার মৃত্যুপথযাত্রী আপুকে সেদিন হিংসে হয়েছিল। তার অসামান্য মেধার জন্য নয়, বাবা মার ভালবাসা বেশী পেয়েছে সেজন্যে নয়, হিংসে হয়েছিল সেই অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টিটার জন্য। যে শেতাঙ্গদের দেশে সত্যিকারের ভালবাসা শুধুমাত্র বইয়ের পাতার বিষয়, যেখানে প্রতিমুহূর্তে অবিশ্বাস আর স্বার্থের সংকীর্ণতায় হাজার হাজার সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, সেই দেশেরই একজন মানুষ আপুকে কি অদ্ভুত সত্যতায় ভালবেসেছে। আপুকে হারাতে বসে সে যেন পৃথিবীর সব হারিয়ে ফেলেছে।
আর আজ, আমার শূন্য পৃথিবীতে ঝড়ো বাতাসের টানা শো শো শব্দ আমার ভেতরটাকে শীতল থেকে শীতলতর করে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ বাবা-মা সামনাসামনি হয়ে গেলেন।মা ঢুকছিলেন আর বাবা বেরোচ্ছিলেন দুজনে একমূহুর্তের জন্য থমকে দাড়ালেন, আর সামনে এসে দাড়ালো একযুগের ব্যবধান আর হয়তো কিছু টুকরো স্মৃতি। হঠাৎ যেন বাস্তবে ফিরে এলেন, পাশের কেবিনই শুয়ে আছে মৃত্যুপথযাত্রী প্রথম সন্তান, নির্মম বাস্তব।
বাবাই প্রথমে বললেন, কেমন আছ?
'যেমন থাকার কথা' মায়ের উত্তর। কিছুক্ষণ নীরবতা...এরপর মা পাল্টা প্রশ্ন করেছেন।
বাবার উত্তর সোজা 'ভালো নয়'।
দুজনে ঢুকলেন আপুর কেবিনে। আমি পিলারের আড়াল হতে বের হয়ে সম্মোহিতের মতো কেবিনের নিরেট দরজার আড়ালে এসে দাড়ালাম। দুজনকে একসঙ্গে দেখে আপুর অভিব্যক্তি কেমন হয়েছিল? দেখতে পাইনি। হয়তো অদ্ভুত একটা হাসি হেসেছিল। পাঁচ মিনিট নীরবতা, নাকি পনের মিনিট? জানিনা, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো অনন্তকাল দাঁড়িয়ে আছি। কি হচ্ছে ওপাশে? দরজার ফাঁক দিয়ে তাকালাম। আপু শিশুর মতো সরলতায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আপুর উষ্ণ দুহাত দুপাশে থাকা বাবা মায়ের হাতে বন্দী। নিজের পরিপূর্ণ শেকড়কে একসাথে পেয়ে আপুর মুখের সারল্যে আজ অদ্ভূত প্রশান্তি।আর বাবা মা? কতদিন পর তারা তাদের বরফ শীতল সম্পর্কের মাঝে তাদের প্রথম উত্তরসূরীর উষ্ণ ছোঁয়া পেলেন। তাদের প্রথম সন্তানের হাতে হাত রেখে তারা কি তাদের সেইসব দিনের স্মৃতি খুঁজে পাচ্ছিলেন যখন তারা কিছুদিনের জন্যে হলেও একজন আরেকজনকে সত্যিকার অর্থেই ভালবেসেছিলেন? সেই সন্তানের স্পর্শ, যে তাদের প্রথম মাতৃত্ব আর পিতৃত্বের স্বাদ দিয়েছিল। সত্যি, এর চেয়ে ভালো যোগসূত্র আর কি হতে পারতো?
আপু চোখ মেলে তাকালো, তারপর শান্ত স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল,'মা, বাবা, আমার আর একা হবার ভয় নেই, ঘুমানোর জন্য একা হওয়াই ভাল, কিন্তু যারা জেগে থাকে, তারা কি পারে একা থাকতে? কিছুক্ষণ নীরবতা, বাবা মা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে...'বুবলিটা খুব একা, তোমরা দুজনে ওকে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দাও, ওর মাঝেই তোমরা আমাকে খুঁজে নিও।' আপুর কথা শেষ হয়েছে, সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। পুরো পৃথিবীটা যেন থমকে গেছে, এই বন্ধ কেবিনটার ভেতর। আমি আস্তে আস্তে পা ফেলে চলে এসেছি ব্যলকনিতে। সামনে ছবির মতো বাগানের চেনা দৃশ্য। অর্কিড ফুলের গাঢ় নীল রঙ যেন আমার চোখের ভেতর ঢুকে রক্তে মিশে যাচ্ছে। কতদিন পর আজ আমার কান্না পাচ্ছে সে হিসেব কসতে বসবোনা। আজ তো আমার নিজের জন্য নয়, কান্না পাচ্ছে সেই মেয়েটির জন্য, যে আমার ভেতরের একাকীত্ব আর কষ্টের জমাট বাষ্পটাকে গলিয়ে দিতে পেরেছে। আমিতো আজ থেকে অন্তত কাঁদতে পারবো। সেই মেয়েটি যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চলেছে... হ্যাঁ আজ আমি কাঁদব...অনেক কাঁদব...

শংখ


মন্তব্য

মর্ম এর ছবি

কী বলব বুঝতে পারছিনা!

অনবদ্য লেখনী আপনার, বুবলীর কষ্টে সত্যি ঢোঁক গিললাম।
আগের কয়েকটা লেখা পড়ে মন এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে, এখন রীতিমত গলাব্যথা করছে।

জানিনা আগে লিখেছেন কিনা, প্রথম লেখা যদি হয়ে থাকে তাহলে আন্তরিক অভিনন্দন জানবেন।

সচলে স্বাগতম।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

শংখ [অতিথি] এর ছবি

ঠিকি ধরেছেন, নতুন লিখছি... কিছু জায়গায় স্পেস বেশী হয়ে গেল কিভাবে বুঝলামনা...পরেরবার থেকে সতর্ক থাকবো। আর অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে উৎসাহিত করার জন্যে।

চড়ুই [অতিথি] এর ছবি

খুব ভালো লেগেছে

মেকা এর ছবি

গল্প টা দারুন হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

শংখ, লেখাটা পড়লাম অনেক কষ্ট লাগছে, সত্যি কি জানো, মাঝে মাঝে আমার চোখটাও সিক্ত হয়েছে। কেন হয়েছে আমি জানি না। তবে এইটুকু বলবো, তোমার আপু জন্য দোয়া থাকলো। দোয়া করি তোমার আপুর শেষ ইচ্ছেটা যেন তোমার বাবা-মা রক্ষা করেন। তোমার বিশাল একাকীত্বের মাঝে যেন ওনারা উচ্ছ্বাস নিয়ে আসেন। বাকী দিন গুলি যেন তোমার সুখ আর আনন্দে কাটে।

ভালো থেকো।

কামরুজ্জামান স্বাধীন।


০৫-০৬-২০১০
সময়ঃ রাত ১:৫১মিনিট(বাংলাদেশ)

শংখ [অতিথি] এর ছবি

ভাই, এটা আমার জীবনের গল্প নয়, আমার জীবনে ঘটলে মারাই যেতাম। তবে আমার লেখা আপনাকে নাড়া দিয়েছে জেনে খুশি হলাম।

শাফি এর ছবি

দু:খ লাগল পড়ে। কারও জীবনে এমনটি যেন না ঘটে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল।
ছেড়া পাতা
ishumia@gmail.com

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার গল্প লেখার হাত ভাল.. শুভকামনা

বর্ণ অনুচ্ছেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

শংখ,

প্রচন্ড মন খারাপ করা লেখা। এমন যেন কারো জীবনে না ঘটে মন খারাপ

গল্পটির বর্ণনা অসাধারণ সুন্দর চলুক চলুক চলুক

ভবিষ্যতে আপনার আরো লেখা আশা করছি।

- মুক্ত বিহঙ্গ

শংখ [অতিথি] এর ছবি

বাঙ্গালি চিরকালই দুঃখবাদী, দুঃখভরাক্রান্ত জিনিষগুলোই কেন যেন ভালো লেগে যায়। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য।

শংখ [অতিথি] এর ছবি

দুঃখভারাক্রান্ত*
-শংখ

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

লেখাটা অদ্ভুত মায়াভরা। খুবই স্পর্শ করে গেল। চলুক
সচলায়তনে স্বাগতম। আরো লিখুন।

রিম সাবরিনা এর ছবি

সচলের পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলছি,
আজকে লেখিকার বাসায় স্টিমড চিকেন সহযোগে কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়ার পরম সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আর খাদ্যপর্ব শেষে পুডিংটার কথা না হয় বাদই দিলাম। লেখিকার লেখনী যেমন ভাল...তেমনি ভাল তার হাতের পুডিং।

--রিম

অতিথি লেখক এর ছবি

আজকের আড্ডায় অবগত হলাম আমার এই লেখিকা বন্ধু 'পিজার' রন্ধনপ্রণালী (নাকি বেকপ্রণালী) র ব্যাপারে খুব ভালো ধারণা রাখে... যদিও কখনও চেখে দেখার সুযোগ হয়নি... চোখ টিপি

রিম সাবরিনা এর ছবি

নীলিম এইটা কি তুমি? ধইরা একটা মাইর দিব। চল নেকস্ট উইকে আজকের গ্যাংসহ শর্মা হাউসে যাই। পিজা পার্টি হয়ে যাক। চৈতী রাজী। বাকিদের জানাও...

অতিথি লেখক এর ছবি

খিক খিক... সত্যি? সিরিয়াস? যাকগে, সে নিয়ে আর এখানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সচলায়তন টিম এর একাংশ লেগে যাওয়ার আশংকা আছে...খাইছে

কনীনিকা এর ছবি

নিলিম আবার শঙ্খ হলি কবে থেকে। গল্পটা খুবই ভাল লিখছিস। চলুক
আর আমিও সাক্ষী, লেখিকা এবং লেখিকার মাতা উভয়েরই রান্না সার্থক ছোটগল্পের মতন সুস্বাদু!
------------------------------------------------------------------
It is impossible to be a mathematician without being a poet in soul.

------------------------------------------------------------------
It is impossible to be a mathematician without being a poet in soul.

অতিথি লেখক এর ছবি

" আমিতো আজ থেকে অন্তত কাঁদতে পারবো। "
_______________________________________________

ভীষণ ভাল লেখেন আপনি, চুম্বকের মতন আটকে রাখার ক্ষমতা আছে আপনার বাক্যগুলোর, এক নিঃশ্বাসে পড়তে বাধ্য হলাম, ভাল থাকুন ।

______________________________
বর্ণ অনু্চ্ছেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, আরও পরিপক্ক ও শুদ্ধ লেখনী চর্চার ইচ্ছা রয়েছে।
-শংখ

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অসাধারণ লাগলো!

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

দময়ন্তী এর ছবি

ভারী চমত্কার
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

গল্প নয়, মনে হলো যেন কারো জীবনের ঘটা ঘটনার বিবরণী শুনছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সকলকে।
-শংখ

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

মনটা বড় খারাপ হয়ে গেলো। আরেকটু পরিপক্ক লেখা হলে আরো ভালো হতো, তবে, চালিয়ে যান।

আপনার হবে। শুভেচ্ছা।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

শংখ [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।