মিস ফেল্পস গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই মাটিল্ডাকে দেখছিলেন, পরম বিস্ময়ে! সেদিন ওকে এদিক ওদিক ঘুরতে দেখে তিনিও উঠে গেলেন। ওর কাছে গিয়ে বললেন, “মাটিল্ডা, তুমি কি কিছু খুঁজছো? আমাকে বলো, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।“
“ওইদিকে বাচ্চাদের সব বইগুলো আমার পড়া হয়ে গেছে। এরপর আর কি পড়া যায় তাই খুঁজে দেখছিলাম।“
“মানে তুমি বলতে চাও যে বইয়ের সবগুলো ছবি দেখা শেষ তোমার, তাই তো?”
“হ্যাঁ, তা শেষ। তবে বইগুলো আমি পড়েও শেষ করেছি।“
মিস ফেল্পস সোজা হয়ে তাকালেন ওর দিকে। পিঁচকি মেয়েটাকে এত্তোটুকুন লাগছিলো দেখতে। আর এই এত্তোটুকুন মেয়েটাও সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো, বলতে লাগলো, “সবগুলো বই আমার কাছে তেমন ভালো লাগেনি। কয়েকটা অনেক বিরক্তিকর ছিলো। তবে বাকিগুলো বেশ ভালো। সবচেয়ে ভালো লেগেছে সিক্রেট গার্ডেন। বন্ধ দরজার ওপাশের ঘরটার রহস্য আর সেই বড় দেয়ালটার পেছনে লুকানো বাগানের রহস্য নিয়ে পড়তে অনেক মজা লেগেছে।“
মিস ফেল্পসের মুখটা দেখলে তখন যে কারো মনে হতেই পারে যে তিনি ভীষণ চেহারার এক ভূত দেখে ফেলেছেন হয়তো। তিনি খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, “মাটিল্ডা, তোমার বয়স ঠিক কতো, বলতে পারো মামনি?”
“চার বছর তিন মাস।“
মিস ফেল্পস যেন এবার আর কোন ভূত না, বরং একটা ব্রহ্মদত্যি দেখলেন! তবে তিনি বিচক্ষণ একজন মানুষ এবং সেই হিসাবেই তিনি তার বিস্ময়ের ব্যাপারটা মাটিল্ডাকে মোটেও বুঝতে দিলেন না। বরং সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা মাটিল্ডা, তুমি এবার বলো কি রকম বই পড়তে চাও তুমি।“
মাটিল্ডা গম্ভীর হয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করে জবাব দিলো, “আমাকে বড়দের বইগুলোর মধ্যে খুব ভালো কোন বই দাও। নামকরা কোন বই দেবে। আমি তো কোন নাম জানি না। তুমিই একটু খুঁজে দাও।“
মিস ফেল্পস কতোক্ষণ অন্ধের মতো এই তাক ওই তাক খুঁজে বেড়ালেন। তিনি আসলে বই দেখার চেয়ে নিজেই ভাবছিলেন যে কি দেবেন ওকে। এমন কোন্ নামকরা বড়দের বই আছে যেটা একটা চার বছরের পিচ্চি মেয়েকে পড়ার জন্য দেয়া যায়! প্রথমে ভাবলেন পনের-ষোল বছরের মেয়েদের জন্য লেখা কিশোরীদের প্রেমের যেসব বই আছে এমন একটা কিছু ওকে ধরিয়ে দেবেন। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক তিনি কিছুতেই ওইরকম একটা বই এই মেয়েটার হাতে তুলে দিতে পারলেন না। বরং সাবধানে এড়িয়ে গেলেন সেই তাকগুলো। অবশেষে মনের মধ্যে একটু দ্বিধা নিয়েই একটা বই নিয়ে মাটিল্ডার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি,
“এই বইটা পড়ে দেখো। বেশ নামকরা আর খুব ভালো একটা বই। তবে তোমার যদি মনে হয় কাহিনীটা একটু বেশিই বড় তাহলে আমাকে বলবে। আমি সহজ দেখে অন্য আরেকটা বই খুঁজে দেবো।“
বইটা হাতে নিয়ে ওপরের নামটা জোরে জোরে পড়লো মাটিল্ডা, “গ্রেট এক্সপেক্টেশনস্। লেখক চার্লস ডিকেনস। হুমম্, পড়তে খুব মজা হবে মনে হচ্ছে।“
ওইদিকে বইটা ওকে দেবার পর থেকেই মিস ফেল্পস মনে মনে ভাবছেন, ‘আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো! এই বাচ্চাটাকে আমি এই বই দিলাম!’ কিন্তু মাটিল্ডাকে সেসব কিছু না বলে তিনি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলেন ওর কথায়, বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি পড়ে দ্যাখো। ভালো লাগতেও পারে।“
মিস ফেল্পসের পরের কয়েকটা দুপুর কাটলো মাটিল্ডার দিকে তাকিয়ে থেকে। নিজের চোখ ওর ওপর থেকে সরাতেই পারছিলেন না তিনি। লাইব্রেরী ঘরের একদম ওইপাশের এক কোণায় গদি আঁটা ইয়া বড় এক চেয়ারে বসা এইটুকুন সাইজের মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। তার কোলের ওপর এতো মোটা একটা বই। বইটা এতোই মোটা আর ভারী যে মাটিল্ডা দুই হাত দিয়েও তুলে ধরে রাখতে পারে না, তাই কোলের ওপর রেখে সামনে ঝুঁকে পড়া ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। সবকিছু মিলিয়ে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দাঁড়াতো। মেঝে থেকে কয়েক হাত ওপরে পা ঝুলিয়ে কালো চুলের পুঁচকে এক মানুষ বিশাল এক চেয়ারে প্রায় ডুবে গিয়ে বই পড়ছে। তবে চেয়ারে ডুবে যাবার চেয়ে বইয়ে ডুবে যাবার ব্যাপারটাই হয়তো চোখে পড়তো বেশি। মিস হ্যাভিশাম নামের সেই বুড়ির মাকড়শার জালে ঘেরা বাড়ি আর পিপের রোমাঞ্চকর সব কাহিনী নিয়ে ডিকেনসের শব্দ-বুনটের মায়াজালে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটাকে দেখলে যে কেউই হতবাক হয়ে সারাদিন হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে! এমনই হারিয়ে যেতো পিচ্চিটা যে নড়াচড়া করতেও যেন ভুলে যেতো। মাঝে মধ্যে একেকটা পৃষ্ঠা উল্টানোর তাড়া না থাকলে হয়তো মূর্তি বলেই মনে হতে পারতো মাটিল্ডাকে।
প্রতিদিন মাটিল্ডার যাবার সময় হয়ে এলেই মিস ফেল্পসের মনটা খারাপ হওয়া শুরু করতো। তবে তিনি ঠিক ঠিক ওর কাছে গিয়ে মনে করিয়ে দিতেন, “পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি আছে, মাটিল্ডা।“
মাটিল্ডা যখন প্রথম আসা শুরু করলো সেই সময় তিনি একবার ওকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
“তোমার মা কি প্রতিদিন তোমাকে এখানে আনা-নেওয়া করেন?”
মাটিল্ডা খুব সহজ সুরে জবাব দিয়েছিলো, “আমার মা প্রতিদিন কার্ড খেলতে আইল্সবারিতে যান। তিনি জানেনই না যে আমি এখানে আসি।“
“কিন্তু এটা তো ঠিক না। তোমার উচিত মাকে জিজ্ঞেস করে লাইব্রেরীতে আসা।“
“মাকে না বলাই বরং আমার জন্য ভালো। আমার বই পড়ার ব্যাপারটা বাবা-মা কেউই পছন্দ করেন না।“
“তাহলে তারা তোমাকে এই সারাটা দুপুর একা একা বাসায় বসে কি করতে বলেন?”
“তেমন কিছু না। এমনিই সময় কাটাতে অথবা টিভি দেখতে।“
“হুমম্, আচ্ছা।“
তারপর মাটিল্ডা মনটা খারাপ করে আবার যোগ করেছিলো, “আসলে আমি যা কিছুই করি না কেন তাদের তেমন কিছুই যায় আসে না।“
বাচ্চা মেয়েটা একা একা বাসা থেকে এতোটা দূর হেঁটে আসে, আবার মাঝপথে একটা বেশ ব্যস্ত রাস্তাও পার হতে হয় – এসব চিন্তা করে মাটিল্ডার নিরাপত্তা নিয়ে মিস ফেল্পসের বেশ ভাবনাই হচ্ছিলো। কিন্তু অন্যদের ব্যাপারে নাক না গলানোই উচিত হবে বলে মনে করলেন তিনি। তখন হয়তো হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে।
যাইহোক, পরের এক সপ্তাহের মধ্যেই মাটিল্ডা চারশ’ এগারো পৃষ্ঠার গ্রেট এক্সপেক্টেশনস পড়া শেষ করে ফেললো। তারপর মিস ফেল্পসের কাছে গেলো আবারো,
“ইশশ্, এত্তো ভালো লাগলো এই বইটা পড়তে! ডিকেন্স সাহেব কি আরো কোন বই লিখেছেন?”
বিস্মিত মিস ফেল্পস শুধু বলতে পারলেন, “হ্যাঁ মা, আরো অনেক বই লিখেছেন। আমি তোমাকে আরেকটা খুঁজে দেবো?”
পরের ছয়মাসে মিস ফেল্পসের সহায়তায় মাটিল্ডা যে যে বইগুলো পড়লো সেগুলো এমনি বলা যাবে না। তালিকা দেয়া লাগবে। সেই তালিকাই নীচে দেয়া হলো:
নিকোলাস নিকলবি – চার্লস ডিকেন্স
অলিভার টুইস্ট – চার্লস ডিকেন্স
জেন আয়ার – শার্লট ব্রনটে
প্রাইড এ্যান্ড প্রেজুডিস – জেন অস্টেন
গন টু আর্থ – ম্যারী ওয়েব
কিম – রুডিয়ার্ড কিপলিং
ইনভিজিবল ম্যান – এইচ জি ওয়েলস
ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দ্য সী – আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
সাউন্ড এ্যান্ড দ্য ফিউরী – উইলিয়াম ফকনার
গ্রেপস অফ র্যা থ – জন স্টাইনবেক
গুড কম্প্যানিয়নস – জে বি প্রিস্টলি
ব্রাইটন রক – গ্রাহাম গ্রীন
এ্যানিম্যাল ফার্ম – জর্জ অরওয়েল
এবং থমাস হার্ডির লেখা আরেকটা বই যেটার উচ্চারণ লিখতে গিয়ে আমার নিজের দাঁতই কয়েকটা ভেঙে পড়ে গেছে।
চলবে ...
-নৃ
মন্তব্য
ishumia@gmail.com
প্রতিটা পর্ব আরেকটু বড় হয়তো করা যায়। তবে বেশি বড় করলে সাধারণত কেউ পড়তে চায় না। তাই ১০০০ শব্দের নীচেই রাখার চেষ্টা করি। প্রতিদিন দেয়াটা অবশ্য একটা সমস্যা। প্রথম পাতা থেকে আগের পর্ব সরে না গেলে পরের পর্ব পোস্ট করা হয় না মনে হয়। আমি চেষ্টা করবো ধারাটা একদিন পর পরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
বর্ণনা এবং সংলাপের চমৎকার সাবলীল ভংগিমা মুগ্ধ করল,
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম...
______________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো লাগাতে কৃতজ্ঞতা থাকলো
খুব সাবলীল অনুবাদ, হৃদয়ের খুব কাছাকাছি ভাষা।
"হ্যাঁ মা, আরো অনেক বই লিখেছেন। আমি তোমাকে আরেকটা খুঁজে দেবো?" লাইনটা পড়ে কেমন একটা টান পড়ে বুকের ভিতরে।
পড়তে বড় ভালো লাগছে। ধন্যবাদ লেখক।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার আন্তরিক মন্তব্যটাতে আসলে একটু লজ্জাই পেয়ে গেলাম।
অনেক ধন্যবাদ উৎসাহের জন্য
নতুন মন্তব্য করুন