ঘটনার সময়কাল একাত্তরের কিছু পরে। দূরের কোন এক গ্রাম। অনেক দূরের। এখানকার লোকেরা এখনও গঞ্জের গল্প শোনে। তবে প্রায়ই হাটে লোকজন আসে এখানে গঞ্জ থেকে। এমনকি এ গ্রামেরও বেশ কয়েকজন যুদ্ধের পর বসত গেড়েছে গঞ্জে। হাটবারে তাদেরও দেখা মেলে হামেশাই। হাটের দুটি অংশ। একাংশে কেবল ধান-চাউল আর সারের আড়ত...আরেক পাশে গ্রামের লোকেরা প্রায় আদি সমাজের বিনিময় প্রথায় ছয়টা বেগুনের দামে আধপোয়া সয়াবিন কিনে ঘরে ফিরে। গঞ্জের মানুষেরা কেবল ওই চাউলের আড়তের দিকেই ঘোরাফেরা করে। আট নয় বছরের ছেলে গফুর ঠিক বুঝতে না পেরে বাবাকে জিজ্ঞেস করে...“বাবা গঞ্জের মাইষ্যেরা কি খালি চাউলই খায় ?” ওর বাবা পেশায় নাপিত। নাম শরফুৎদ্দি। মুসলমান হয়ে হিন্দুয়ানী নাপিতের কাজ করে বলে শরফুৎদ্দির ছেলেকে সবাই গদাই বলে ডাকে। আবার এদিকে খবর রটেছে শরফুৎদ্দিরা যুদ্ধের আগে যে গ্রামে থাকতো সেখানে ওরা আসলে হিন্দু ছিলো। যুদ্ধের সময় শরফুৎদ্দির মোছলমানি করানো হয়। শরফুৎদ্দির বউকে অর্মিরা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলো।তারপর থেকে বউটা পাগল হয়ে গেছে। শরফুৎদ্দি প্রায়ই গঞ্জে যায় তার বউ কমলাকে দেখতে। এ সব কোন উড়ো খবর নয়। গঞ্জ থেকে এসে এই হাটে নতুন আড়ত দিয়েছে জয়নব হোসেন। সে নিজে এই সমস- ঘটনার সাক্ষি। যেনতেন কথার মানুষ নয় এই জয়নব হোসেন। শহরেও তার অনেক ব্যাবসা আছে। থানার টি. এন. ও, --ওসি সাহেবের সঙ্গে ওঠা বসা।জয়নব যুদ্ধের পর এখনও অস্ত্র জমা দেননি। একজন পেয়াদা তার বন্দুকটা এখনও সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। কোমরেও নাকি একটা বন্দুক থাকে। এটা নাকি যুদ্ধের সময় এক পাক সাহেবকে নিজের হাতে খুন করে তবেই এটা নিজের করেছেন। তিনি বলেছেন বেটা শরফুৎদ্দির কথা । ধর্মত্যাগ করায় পাড়ার হিন্দুরা দূর করে দিয়েছে বলেইতো শরফুৎদ্দি এখন এই গ্রমে ডেরা বেধেছে। এমনকি এই গ্রামের জোয়ান ছেলে মমিনও গেল বছর রমজানে শরফুৎদ্দিকে দেখেছে হিন্দুদের মতন রোজার মইদ্যে পানি খাইতে। সে নিজের চোখে দেখেছে এইসব। এটা কোন উড়ো খবর নয়। শরফুদ্দির দোকান হাটের পাশেই ইস্কুল ঘরের সামনে। ইস্কুলের সামনে বিরাট একটা খেলার মাঠ। মাঠের পাশেই শরফুদ্দির দোকান। এরপর একটা কালভার্ট পার হয়েই বাজার। ইদানিং খবর এসেছে শরফুৎদ্দি পুবপাড়ার হারেস আলীর মাইয়াটারে নিকা করবে। এই বিষয় নিয়া সে মাওলানার সঙ্গে কথাও বলছে। হারিস আলীর মাইয়াটাও কপাল পোড়া। কমবয়সে মা মইরা গেছে। বাপটা অনেক চেষ্টা কইরাও বাঁচাইতে পারলোনা মাইয়টারে। ক্যাপ্টেন সাহেব গ্রামে আইয়্যা হিন্দু পাড়ার খোঁজ করে। এই গ্রামে কোন হিন্দু পাড়া নাই বইলা হারেস আলীর আপন ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে মমিন ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে নিয়া যায় জোৎস্নারে। অহন গাঁওয়ের ভেতরেই পাড়ায় পাড়ায় ঘুইরা রঙিন কাচের চুড়ি বেচেঁ জোৎস্না। সপ্তাহে দুইদিন-তিনদিন গঞ্জেও গিয়া বেইচ্যা আসে কাচের চুড়ি। কোন একদিন শরফুৎদ্দি আর জোৎস্না গঞ্জ থাইক্যা ফিরছিলো গ্রামে এক লগেই। আগে পিছে হাঁটতে ছিলো ওরা। জোৎস্নারে দেখতে লাগছিলো রাঙ্গা বউডার মতন। একদিন একদিন করে অনেকগুলা দিন চলে যায়। বাজারে শরফুৎদ্দির দোকানেরপাশেই একটা চালা তুলে চুড়ি, বাচ্চাদের খেলনা , আচারের একটা দোকান মত দিয়েছে জোৎস্না। একদিন কি মনে করে শরফুৎদ্দির দোকানে ঢুকেছে জয়নব হোসেন।
নিঃশব্দে দোকানে ঢুকলো সে। শরফুৎদ্দি তখন তার ক্ষুরটাকে দেয়ালে ঝোলানো একতাল শুকনো চামড়ায় শানিয়ে নিচ্ছিলো। যেই মুহুর্তে জয়নব হোসেন দোকানে প্রবেশ করে শরফুৎদ্দি হঠাৎ তার ক্ষুর শানানো ক্ষাণিকের জন্য থামিয়ে দেয়।অমনি অবার ক্ষুর শানানো শুরু করলো শরফুৎদ্দি। জয়নব হোসেন আয়নার সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসলেন। একটু বাঁকা হয়ে কোমরে গোঁজা রিভালবারটা বের করে সামনে রাখলেন। জয়নব খুব গম্ভীর স্বরে ডাকে শরফুৎদ্দিকে। শরপুৎদ্দি শুনেও না শোনার ভান করে। হঠাৎ জয়নব বেশ জোরে ডেকে ওঠে...‘শরফুৎদ্দি!!!’। জয়নবের ডাক শুনে শরফুৎদ্দি প্রায় বছর পাচেঁক আগে যুদ্ধের দিনে ফিরে যায়। শরফুৎদ্দি সেখানে অন্য একটা সেলুনে মাটিতে বসে ক্ষুরে শাণ দিচ্ছে। চেয়ারে বসা আছে আর্মির ক্যাপ্টেন। পাশে দাড়িয়ে আছে জয়নব। সেখানেও হঠাৎ করেই জয়নব শরফুৎদ্দিকে ডেকে ওঠে। শরফুদ্দি চমকে উঠে তাকায় জয়নবের দিকে। শরফুৎদ্দি বাস-বে ফিরে আসে। সেখানে সামনে বসে আছে জয়নব হোসেন নামের নব্য প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী। শরফুৎদ্দি জয়নবের দিকে ধারালো ক্ষুর নিয়ে এগিয়ে যায়। জয়নবের গালে মুখে পানি দিয়ে কাঁচা পাকা দাড়ি গুলোকে ধুয়ে দেয়। এরপর সেখানে সাবান লাগাতে থাকে।
জয়নব হঠাৎ বলে ওঠে : ‘শরফুৎদ্দি... তুই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যা।’
শরফুৎদ্দি কোন জবাব দেয় না। জয়নবের গালে ভালো করে সাবান ঘসতে থাকে। সাবান ঘসতে ঘসতে শরফুৎদ্দি আবার বছর পাচেঁক আগে চলে যায়। সেখানে চেয়ারে বসে আছে ক্যাপ্টেন সাহেব আর পাশে দাড়িয়ে জয়নব বলছে...‘বুঝলিতো ; আল্লার মেহেরবানীতে তিনি তোকে পছন্দ করেছেন। তোর আওরাতকে ক্রাপ্টেন সাহেবের পছন্দ হয়েছে। (আওরাত শব্দটি কানে যেতেই ক্যাপ্টেন সাহেব চোখ তুলে তাকায়)।’ জয়নব আবার বলতে থাকে ‘সারা জীবনতো করলি হিন্দু মালাউনগো কাজ। নাপিনের কাম নি করে কুনো মুসলমান...? তোরে শরফুৎদ্দিন না ডেকে সবাউ ডাকে গদাইয়ের বাপ। মালাউনগো নামে ডাকে তোর পোলারে। তুইতো মালাউন হয়ে যাইতাছস। এখন আল্লার নামে কিছু কাম কাজ কর। তুই শান্তি পার্টিতে যোগ দে। আর তাইলে নাপিতের ব্যাবসাও করতে হইবো না। আর তোর বিরি কথা ভাবতাছস.. এমুন বিবি কত পাইবি।’ (বার কয়েক বিবি শব্দটি বলায় ক্যাপ্টেন সাহের জয়নবের দিকে তাকায়। শরফুৎদ্দি তখনও সাবান মেখে যাচ্ছিলো।) জয়নব ক্যাপ্টেন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে ‘আওরাত .. আউরাত.. ইসকি আউরাত!!’ জয়নব বলতে থাকে..‘তুই এই গ্রামটা ছাইড়া চইলা যা.. ’ জয়নব বলতে না বলতেই শরফুৎদ্দি ক্ষুর দিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেবের গালের অমসৃণ লোম গুলোকে চেছেঁ ফেলতে থাকে। ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কাটার কর্কষ শব্দে শরফুৎদ্দি ঘোরে পড়ে যায়। সে কল্পনা করতে থাকে তার চারপাশে শত শত মুক্তিযোদ্ধা...সে প্রকাশ্য একটা মাঠের মধ্যখানে একটা নাপিতের চেযারে বসে থাকা ক্যাপ্টেনের গলায় ক্ষুর চেপে বসে আছে। চারপাশ থেকে হাজার হাজার আহত মুক্তিযোদ্ধা শরফুৎদ্দিকে বলছে ‘কেটে ফেল! ওই শালা পাকিস্তানী হারামজাদার গলাডা ফাকঁ কইরে দে শরফুৎদ্দি! দে শালার গলাডা দুই ভাগ কইরে !’ এই শুনতে শুনতে শরফুৎদ্দি ঘোরের মাঝেই আবার ঘোরে পড়ে। শরফুৎদ্দি তখন নিজেকে আবিষ্কার করে ক্যাপ্টেনের পায়ের তলায় দলিত মথিত অবস্থায়। জয়নব এবং আরও কয়েকজন মিলে শরফুৎদিকে মাটিতে ফেলে মারতে থাকে। ক্যাপ্টেনের গাল কেটে গেছে। সেখান থেকৈ টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। শরফুৎদ্দির চোখে রক্তগুলো মাটিতে পড়তে না পড়তেই কালো ঘন নোংরা কোন জলীয় অবস্থার তৈরী করে। শরফুৎদ্দি আবার জ্ঞান হারায়। একটু পর সে নিজেকে আবিষ্কার করে টর্চার সেল’এ। সেখানে সে খুব কষ্ট করে এক পর্যায়ে উঠে দাড়ায়। টর্চার সেল’এর এক কোণ থেকে আরেক কোণায় হুড়মুড় করে দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় সে আলুথালু হয়ে বসে থাকা তার স্ত্রীর সামনে এসে দাঁড়ায়। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরতে চায়। এমন সময আরও কিছু লোক এসে শরফুৎদ্দিকে সরিয দেয় এবং শরফুৎদ্দির স্ত্রীর উপর হামলে পড়ে। শরফুৎদ্দি আবার ঘেরে হারিয়ে যেতে থাকে। হটাৎ জযনব শরফুৎদ্দির মুখের ওপর এসে বলে ‘বুঝলি মানুষ মারাডা এতো সোজা না...শালা’ বরেই শরফুৎদ্দিকে একটা ঘুসি মারে। শরফুৎদ্দির ঘোর কেট যায়। সে নিজেকে আবিষ্কার করে নতুন একটা সেলুনে। সেখানে তার ক্ষুরের তলায় বসে আছে জয়নব হোসেন। শরফুৎদ্দিন ক্ষরটা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। এদিকে জয়নব বলতে থাকে...‘তুই এই গ্রাম ছাইড়া চইলা যা। তোরে আমার দেখলে ভাল লাগে না।’ ...এই সব বলতে বলতে জয়নব হঠাৎ খেয়াল করে সে শরফুৎদ্দির ক্ষুরের তলায় বসে আছে। হঠাৎ জয়নব হেসে ওঠে এবং সামনে রাখা তার পিস্তলটায় হাত নেয়। জয়নব হাসতে থাকে। হাসি থেমে যায়।
স্ক্রীনে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
লাতিন আমেরিকার নির্বাচিত গল্পের "শুধু সাবানের ফেনা" থেকে কেবল নাপিতের ক্যারেক্টার নিছি। কেবল একজন নাপিতের ক্ষুরের তলা এবং যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ। এটুকু আমার চুরি।
অভদ্র মানুষ
মন্তব্য
প্রকাশ করবার জন্য ধন্যবাদ
ভালো লাগলো।
-------------------------------------------------------------------------------------------------
তারাপ কোয়াস
ধন্যবাদ ।
অভদ্র মানুষ
লেখার জন্য কৃতজ্ঞতা -
কৃতজ্ঞতা চালাচালি করে নিলাম। তবে আমি দিলাম একটু বেশি।
লেখাটা পড়ার জন্য সেই বেশিটুকু।....
লেখাটা পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা।
অভদ্র মানুষ
মূল গল্পটা পড়েছি। কলম্বিয়ান লেখক হার্নানদো তেলেজ এর লেখা। অসাধারণ একটা গল্প সেটা।
ওই গল্পটা অসাধারণ ছিলো না...? ঠিক বলেছেন....। লাতিন আমেরিকার নির্বাচিত গল্প সমগ্র বইটাই আমার বেশ পছন্দের একটা বই।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
অভদ্র মানুষ।
ভালো লাগলো।
তবে মাঝে মাঝে আরেকটু স্পেস দিলে পড়তে আরাম লাগে।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
পড়ার আরামটা না দিতে পারায় অনেক বেশি দুঃখ দুঃখ লাগছে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
অভদ্র মানুষ
চুরি স্বীকার করে কি অভদ্র মানুষ ভদ্র হতে চাচ্ছে?
যাই হোক, লিখাটা কিন্ত ভালো লাগছে......///.......
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
"অভদ্র মানুষ" জাতির সঙ্গে অভদ্রতা করার কোন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেনি। সে বলতে চেয়েছে খানিকটা অভদ্র হলেও শেষ পর্যন্ত সে মানুষ। কিন্তু অনেকেই আছেন ভদ্র অমানুষ। (স্থান বিশেষে কিছু মহা-মানুষ 'ও আছেন--- বেশ পেইন ফুল)
অভদ্র স্বীকার করে সে মানুষ। চুরি স্বীকারের বিষয়টি আপনার ভাল লেগেছে বলে খুশি হলাম। আশা করি আপনি বাংলাদেশ সরকারের মতন না...(আদালতে দোষ স্বীকার করলে শাস্তি হয়.... না করলে বিবেচনাধীন কিঙবা কেস্ ঝুলন্ত থাকে) ........... চুরির ব্যাপারটা "ওমের্তা " অনুযায়ী মেনে নিবেন।
অভদ্র মানুষ।
নতুন মন্তব্য করুন