১.
“তোমার হঠাৎ হঠাৎ কি যে হয়।”
ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে যায়।
নীরব ফোনটা টেবিলে রেখে ডান পকেটে হাত বাড়ায়। লাইটারটা একই পকেটে ছিল। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে নিঃশব্দে ধরায়।
অহনা জানে নীরব এখন আর সিগারেট খায় না। ওদের সম্পর্ক হবার পর ছেড়ে দিয়েছে। আসলেই ছেড়ে দিয়েছিল নীরব। সপ্তাহখানেক হল আবার ধরেছে।
দুপুর হলেও চারপাশ অন্ধকার হয়ে আছে। মেঘলা দিন। বাতাসে সোঁদা এক গন্ধ।
জানালার দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে নীরব। পা তুলে দেয় টেবিলে।
পা রাখতেই খেয়াল করে টেবিলটা কাঁপছে। ফোনের স্পন্দনে। ফোনে শুধু ভাইব্রেশন দেওয়া।
ফোনের তোয়াক্কানা করে নীরব চেয়ারে আরো গা এলিয়ে দিল। ফোনটা আরো কিছুক্ষণ কাপে। তারপর ঘরময় এক নিস্তব্ধতা।
বাইরে প্রচন্ড বাতাস, বাতাসের তোড়ে সামনের আমগাছের পাতাগুলো এসে বারবার জানালায় কড়া নাড়ছে।
আজকাল নীরবের একা থাকতে প্রচন্ড ভালো লাগে। নিজের সাথে কথা বলতে ভাল লাগে। স্মৃতির পাতায় হাতড়ে বেড়াতে ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে দু’চোখ বুজে স্বর্ণাকে নিয়ে কল্পনার জাল বুনতে।
পিঠটা ধরে এলে নীরব একটু নড়েচড়ে বসে। ছোটবেলায় গাছ থেকে পড়ে পিঠে সেই যে ব্যথা হয়েছে আজও মাঝেমাঝে তা জ্বালায়।
চেয়ার ছেড়ে খাটে যায় নীরব। বালিশের ওপর থুতনি দিয়ে জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে।
ইদানীং খুব হাঁটতে ইচ্ছা করে নীরবের। একা একা অথবা স্বর্নার সাথে। কিন্তু পেরে উঠে না। আলস্যের কাছে ইচ্ছা হার মানে।
নীরব ভাবতে থাকে স্বর্ণাকে নিয়ে। এ যেন এক বাঁধ না মানা আবেদন, যাকে কিছুতেই থামাতে পারে না নীরব। ভাবনার এক পর্যায়ে নীরবের দ্বিতীয় সত্তাটা জেগে ওঠে। নীরব বোঝে এটা তার বিবেকের দংশন, অহনাকে বঞ্চিত না করবার আহ্বান। কিছু সময়ের জন্য এক ধরনের অপরাধবোধে ভোগে নীরব।
কিন্তু স্বর্ণা যে ওর সত্তায় মিশে গেছে, ইদানীং যেন আরো বেশি। বিবেকের দংশন তাই প্রতিনিয়ত হার মানে আবেদনের কাছে।
অহনার সাথে কথা হলেই কেন জানি নীরবের স্বর্ণার কথা মনে পড়ে যায়। এ নিয়ে নীরব প্রথম প্রথম খুবই বিব্রত বোধ করতো। এমন নয় যে অহনা স্বর্ণার কথা জানে না। সবই জানে অহনা। শেষের কটা দিনের কথা ছাড়া। তবু কেন যে মন স্বর্ণার সাথে অহনার তুলনা করে! একদিন তো মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিল অহনাকে, “তোমার জায়গায় স্বর্ণা থাকলে এমন হত না।”
অনেক পার্থক্য দুজনের মধ্যে। নীরবের মনে হয় ও যেন এক গ্রহ থেকে এসে অন্য গ্রহে বাস করা শুরু করেছে। ভাবেনি এত ব্যবধান হবে দু’জনের। স্বর্ণা প্রচন্ড ঠান্ডা একটি মানুষ যার ভালবাসার প্রকাশ খুবই কম। হয়তো এই কারণেই স্বর্ণার প্রতি আকর্ষণ অনেক বেশী। অন্যদিকে অহনা চঞ্চল, আবেগী এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশে চরমভাবে সার্থক এক মেয়ে।
প্রথম প্রথম যখন অহনার সাথে প্রেম হয় তখন অবশ্য এমন হত না। খুবই সুখে ছিল প্রথম ক’দিন। এ যেন আবার নতুন করে জেগে ওঠা। শীতের পাতা ঝরা শেষে বসন্তের নতুন পাতার মত অহনার আগমন নীরব নামক বৃক্ষের জীবনে। কত যে কথা হত। নীরবের মনে পড়ে অধিকাংশ কথা হত স্বর্ণাকে নিয়ে। স্বর্ণা এই করেছে, স্বর্ণা সেই করেছে। অহনা মনোযোগী ছাত্রীর মত সব শুনে যেত। আমি এক মনে বলে যেতাম।
হঠাৎ একদিন অহনা জড়িয়ে ধরে নীরবকে। নীরব পুরোপুরি সাড়া না দিলেও ছাড়ে না। তারপর মনের অজান্তেই বলে ওঠে, “স্বর্ণাও ঠিক এরকম করেই ধরতো।”
সেদিনই প্রথম টের পায় কিরকম রাগী আর অভিমানী অহনা। বুঝতে পারে কেন সবাই বলে রাবণের চিতার চেয়েও বড় ভয়ানক মেয়েদের হিংসার আগুন। পরদিন থেকে নীরব গুটিয়ে যায় নিজের ভেতর।
তাও ভাল ছিল। ঝগড়ার দিনগুলো ছাড়া। আগে খুঁনসুটি হত। ইদানীং খুনসুটি অত্যন্ত বাজে সব ঝগড়ায় শেষ হয়। প্রতিদিন নীরব অহনাকে ছেড়ে চলে যেতে বলে। আর অহনা ‘চলে যাব’ বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
নীরবের মাথাটা ধরে আসে। ইদানীং অহনার সব কথাতেই খুঁত ধরে নীরব। স্বর্ণার সাথে মিলিয়ে দেখবার চেষ্টা করে অহনাকে। অহনার জায়গায় স্বর্ণা থাকলে কি করতো তাই ভাবে। ভেবে যখন কিনারা পায় না তখন অহনার সাথে ঝগড়া করে।
অহনা মেয়েটা যে খারাপ তা নয়। নীরব জানে অহনার মত মেয়ে এই যুগের আদর্শ, ওর জায়গায় যে কেউ থাকলে এতদিনে বিয়ে করে ফেলতো। নীরব বললে হয়তো করেও ফেলবে।
কিন্তু নীরবের কাছে স্বর্ণা যে সাক্ষাৎ দেবী।
ভাবনায় ছেদ পড়ে জানালার কবাটের শব্দে। বাইরে ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তুমুল বৃষ্টি। নীরব তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে জানালা লাগায়।
ফোনটা নিয়ে খুলে দেখে, ৬টা মিস কল। সবগুলো অহনার।
নীরবের মায়া হয়। ও জানে অহনা এখন কাঁদছে। প্রতিবার ঝগড়ার সময় অহনার জল গড়াবেই।
নীরব তাড়াতাড়ি কল করে। ওপাশে রিং বাজার শব্দ হয়। দুবার বাজার পর ওপাশে কোন শব্দ হয় না। অহনা ফোন ধরেছে। কিন্তু কথা বলবে না। সে চায় না নীরব বুঝুক সে কাঁদছে।
নীরব চুপ করে থাকে। ভেবে পায় না কি বলবে।
এমন বৃষ্টির দিনে চুটিয়ে কথা বলতো স্বর্ণার সাথে। সে যে কত কথা। বৃষ্টিতে ভেজার গল্প, ফুটবল খেলার গল্প, পাশের বাড়িতে আম চুরি করতে গিয়ে আছাড় খাওয়ার গল্প আরও কত কি। এযেন শেষই হতে চায় না।
এখন আর কোন গল্পই মুখে আসে না নীরবের।
-হ্যালো
ওপাশ থেকে অহনা কথা বলে ওঠে।
-হ্যালো।
-তোমার কি হয়েছে আমাকে একটু বলবে? আগে তো তুমি এমন করতে না। আমাকে কষ্ট দিয়ে, আমাকে খোঁটা দিয়ে কথা বলতে না।
নীরব চুপ করে থাকে। অহনা বুঝতে পারে মানুষটাকে জিজ্ঞেস করেও লাভ হবে না।
-কিহল উত্তর দাও। নাকি আমাকে বলা যাবে না?
নীরব বুঝতে পারে আর একটা ঝগড়া অবশ্যম্ভাবী।
-কিছু হয় নাই। এমনি আজ একটু শরীরটা ভালো না। তুমি দুপুরে খেয়েছো?
-এখন কি তোমার কাছে খাওয়াটাই বড় মনে হচ্ছে? যদী তাই হয় তবে তুমি খেতে যাও, আমি রাখি।
নীরব বাঁধা দেয়। ওপাশে তখন পুনরায় কান্না শুরু হয়ে যায়।
আধঘন্টা পর নীরব-অহনা দু’জনই চুপ। ২০ মিনিট আগে তাদের আজকের ঝগড়ার মৃত্যু ঘটেছে।
-এই শোন, কাল কিন্তু আমি শাড়ি পড়বো।
ওপার থেকে নীরবের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।
-তুমি প্লিজ কাল একটু পাঞ্জাবি পড়ো। ভালো লাগবে দু’জনকে একসাথে।
এই এক জায়গায় দু’জনের অদ্ভূত মিল। দুজনই শাড়ি পড়তে চায় আর চায় নীরব পাঞ্জাবি পড়ুক।
কাল ওদের সম্পর্কের এক বছর পূর্তি। অহনা চায় একসাথে সময় কাটাতে।
আগে একসাথে অনেক সময় কাটাতো তারা। ইনাদীং নীরব সময় করে উঠতে পারে। তারচেয়ে বরং বলা ভালো সময় করে উঠতে চায় না। দেখা হলেই শুধু স্বর্ণার কথা মনে পড়ে।
মাঝেমাঝে নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হয় নীরবের। কেন তার এমন হবে? স্বর্ণারও কি একই রকম হয়? স্বর্ণা কি ওকে এভাবে মনে করে?
গতমাসে একবার সে ফোন দিয়েছিল স্বর্ণাকে। গলাটা শুনেই ফোন ঘ্যাট করে কেটে দিয়েছে। তারপর থেকে প্রায়ই ফোন দেয়। গলা শুনে ফোন কেটে দেয়।
মাঝখানে এক ছেলের সাথে দেখেছিল স্বর্ণাকে। ধানমন্ডি কেএফসি’র সামনে। কে জানি সহ্য হচ্ছিল না ওর। ইচ্ছা করছিল ছেলেটাকে ধরে...
নীরবের দ্বিতীয় সত্তাকে আবার ওকে জ্বালানো শুরু করে।
নীরব মনোযোগী হয় অহনার সাথে কথা বলায়। তবু তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে স্বর্ণার ছবি। এ চক্র যেন কোনভাবেই শেষ হবার নয়। নেশার মত প্রতিদিন যেন আরো বেশি করে ঢুকে যাচ্ছে সে চক্রে।
(চলবে)
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
মন্তব্য
কেনো যে আমরা বোকার মতো শুধু কমপেয়ার করতে যাই।
এর এটা ভালো, তাহলে ওর সেটা ভালো নয় কেনো? ভুলে যাই, দোষগুন মিলিয়ে প্রত্যেকটা মানুষই আলাদা।
শেষটা জানতে ইচ্ছে করছে।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
শিমুল আপু,তুলনা কিসে হয় না বলুন?
আজ ভোর পাঁচটায় উঠে লেখা। ভার্সিটিতে যাবার আগে এতটুকু লিখে গিয়েছিলাম। বাসায় এসে বিকালে পোস্ট করি।
আগামী সপ্তাহে আশা করি শেষটুকু পোস্ট করতে পারব।
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
"অহনা মনযোগী ছাত্রীর মত সব শুনে যেত। আমি এক মনে বলে যেতাম।" এখানে বো্ধহয় "নীরব এক মনে বলে যেত" হবে।
নীল অপরাজিতা
নতুন মন্তব্য করুন