গ্রেডশীট টা হাতে নিয়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঢুকলাম বন্ধুর রূমে। তিনের সামান্য উপরের গ্রেডটা দেখিয়ে বললাম, দোস্ত এই দেশ আমার মুল্য বুঝলনা। এমনিতে আমাদের মতের হয়ত বিস্তর ফারাক থাকে, কিন্তু রেজাল্টের দিন আমরা ভীষণ রকম সহমত হয়ে যাই। বন্যার সময় যেমন এক বাধ্যতামূলক সাম্য বিরাজ করে, আমাদের অবস্থা ও দাঁড়ায় সেরকম। সে পূর্ণ সমঝদারির সাথে বলল, "আম্রিকা যাগা"। আমিও আম্রিকাতো চাইলে এখুনি যাইতে পারি এইরকম একটা ভাব নিয়া বললাম চল আপাতত স্টারে ঘুরে আসি।
সেটা ছিল সেকেন্ড ইয়ারের কথা, তখনো মনে কিছুটা আশা ছিল একদিন হয়তো স্কুলের কারিশমা ফিরে আসবে। পরীক্ষার খাতায় পেজ ভরে লিখে দিয়ে আসা ছাড়া জীবনের আর প্রায় কোন ক্ষেত্রেই কোন সাফল্য ছিলনা বিধায় ভালো ছাত্র সুনামটাই ছিল একমাত্র ভরসা। স্কুল-কলেজ লাইফটা খারাপ কাটেনি, পরীক্ষার আগের রাত জেগে একটু বই-খাতা ঘাটলেই হয়ে যেত। তারপর বুকে বিল গেটস হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে একদিন ঢুকলাম ভার্সিটিতে। এবং পদার্পণ বাস্তবতার কনক্রীটে। ক্লাসে যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা সেরে হলে ফিরতে ফিরতে শরীরে যতটা তাগদ থাকত, তা দিয়ে বড়জোর আড্ডাবাজিটাই করা যেত। তারপর ঘুম, ঘুম থেকে উঠে রাতের কাপড়েই দৌড় ক্লাসে। ক্লাসে পৌছাতাম প্রায় সবার পরে, আর ক্লাসটেস্টের খাতা জমা দিতাম সবার আগে। বের হওয়ার সময় থাকত মৃদু উত্তেজনা, আমার জমা দেয়া খাতা স্যার পুরোটা পড়ে ফেলার আগেই বেরোতে হবে দরজা দিয়ে। খাতায় উত্তরের পরিমাণ আর বেঞ্ছ থেকে দরজা পর্যন্ত দূরত্ব ব্যাস্তানুপাতে থাকত বলে এই বাড়তি বিড়ম্বনা। কী দরকার আমার সম্পর্কে স্যারের শুণ্যের কোঠায় থাকা ধারণায় ভিত্তি যোগান দেয়ার?
থার্ড ইয়ারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক পোড় খাওয়া হয়ে গেলাম। টুকটাক ২/১ টা সংগঠন, মাঝে মাঝে গাগরমের আন্দোলন, হলের মাঠে বাদামের খোসা ফেলা উচিত কি উচিতনা সে বিষয়ে অমীমাংসিত তর্ক আর স্টারে খেতে যাওয়া এইছিল হাতেগোণা অর্থপূর্ণ কিছু কাজ। আর হ্যাঁ, টিউশনী। অন্যদের মত বলার মত কোন কাহিণী ঘটেনি, তবে পকেট টা সবসময়ই স্বাস্থ্যবান থাকত। একদিন দোস্তের সাথে হলের ছাদের বন্ধ করে দেয়া অংশ দিয়ে ছাত্রকল্যাণে কর্তৃপক্ষের কী কী ব্যাবস্থা নেয়া উচিত, সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করছিলাম। সবকয়টা প্রস্তাবনা আবার প্রকাশ্যে বলা সম্ভবনা, তাতে ভালোছেলে হিসাবে আমাদের না চাইতেই পাওয়া সুনাম নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। তো এরি মাঝে উপলব্ধি আসল, করতেছিটা কী, বয়স কত হইল। যখন দুইহাতে গুণে ও বয়স শেষ করতে পারলামনা, তখন নিজেরে বললাম, "মন চল নীলক্ষেতে"। না, ওভারব্রীজের নীচেনা, ভালো বইয়ের দোকানে গিয়ে লেটেস্ট ভার্সনের ব্যারন'স জি.আর.ই কিনে হলে ফিরলাম। আমার টেবিলের তাকে টার্মের শুরুতে কেনা, কেনার পর থেকেই অমনুষ্যস্পর্শা অন্যান্য একাডেমিক বইয়ের সাথে, জি আর ই বইটাও শোভা পেতে থাকল। বন্ধুরা রুমে এসে যখন তীর্যক চাউনি হানতো, আমি তখন নেপালের রাজদরবার থেকে প্রাচীন পুঁথিসংগ্রাহকের গৌরবের অংশীদার হয়ে, মুখে একটা মৃদু বিনয়ের হাসি ফুটিয়ে তুলতাম।
তারপর বছর গড়ায়, জি.আর.ই বইটা ধুলা আর বাতাসের আর্দ্রতা শোষে নিজের স্বাস্থ্য বাড়িয়ে চলে। আমি একের পর ডাউনলোড করা টিভি সিরিয়াল প্রোগ্রাসে গিলতে থাকি। এরিমাঝে আসে ফোর্থ ইয়ার, ফার্স্ট টার্ম। সে এক সুবর্ণ সময়। চারধারে জিপিএর মচ্ছব লেগে যায়, আমার জিপিএ ও চার ছুঁই ছুঁই করতে থাকল। তাতে অবশ্য আমার সিজিপিএর থোড়াই এসে গেল। লাভের মাঝে হল, নিজের মাঝে মুই কী হনুরে একটা ভাব চলে আসল। কিন্তু লোকজনরে বোঝাই কেমনে! চিন্তার একপর্যায়ে মাথায় ১০০ ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠল। মাথার মাঝে দৈববাণী হলে, যাও আম্রিকা, দুই/একটা পিএইচডি হাকাও। বুদ্ধিতো ভাল, কিন্তু এই রেজাল্ট নিয়ে কেম্নে কই যাই। তখন আগের জ্বলে উঠা বাতির আলোতে আমার চোখে পড়ল ধূলিধূসরিত ব্যারন'স। তারপর? না, এইযাত্রাতে ও হলনা, মাঝে মাঝে কাল থেকে নিশ্চয়, এই আপ্তবাক্য নিয়ে বইটার সামনে দাঁড়ানো ই সার।
হাজার বাজে প্রিপারেশন নিয়েও আমি কেন জানি কখনো ফেল করতামনা, তাই সবার সাথেই মানসম্মান বাঁচিয়ে একটা ডিগ্রী বগলদাবা করে বের ও হয়ে গেলাম। এবং তিনদিনের মাথায় পেয়ে গেলাম একটা চাকরী ও। সে এক মজার চাকরী, সবাই শুধু স্বপ্নেই এমন চাকরী পায়। আমার কাজ ছিল এগারটার একটু পরে অফিসে যাওয়া, মাঝে মাঝে কিছু বই পড়া, আর বাকীটা দিন কাজের খোঁজে কাটিয়ে দেয়া। আর হ্যাঁ, ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাস নিয়মিত আপডেট করার কাজটা ও করা লাগত। এই চাকরীর সময়ই বুঝতে পারলাম আমি কোনকিছুই ঠিকমত করতে পারছিনা, কত তুচ্ছ আমার জীবনের অর্জনগুলো(আদৌ যদি কিছু থেকে থাকে)। সারাজীবনের না পাওয়াগুলো, ভুলগুলো, যত মনখারাপ লাগা মূহুর্তের সাথে মিশে আমাকে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দিত। সবসময় মনে হত, পালাই পালাই। কখনো পালানোর তাগিদ, কখন একটা নতুন শুরুর কুড়ে খাওয়া ইচ্ছা আমার মাঝে একটা জিদের মত অভূতপূর্ব বস্তু এনে দেয়।
এবার আর কিছু ভুল হয়না। আশৈশব স্বপ্ন দেখা "সারমেয়-লড়াই" এ অবশেষে সামিল হই আমি। জি.আর.ই তে একটা দশগায়ে বলার মত স্কোর করি। টোফেল ও দুইবার দেয়ার পর একটা সম্মান জনক স্কোর আসে। এবার ভার্সিটিতে এপ্লাই করার কাজটাই শুধু বাকি। পরিবারের ছোটছেলে, তেমন একটা দ্বায়িত্ব এসে চাপেনি কাধে। তাই বেতনের টাকার বড় একটা অংশ ঢেলে দিয়ে এপ্লাই করে যাই একের পর এক ভার্সিটিতে। ডজন খানেক ভার্সিটি হওয়ার পর সম্বিত ফেরে, তারপর ক্ষান্ত দেই। দুইমাসের অপেক্ষা, তারপর অফার আসতে থাকে একের পর এক, আর বুঝতে পারি ঠিকমত বেঁচতে পারলে আমারে ও লোকজন মেধাবী হিসেবেই মেনে নিবে।
এখন প্রায় সবই ঠিকঠাক, ভিসাটা হয়ে গেলেই টিকেট কেটে ফেলি। পালানো বা নতুন শুরূ, তার আয়োজন সম্পূর্ণ। সবাই উত্তরটা ধরে নিয়ে প্রশ্ন করে, "ফিরে আসবি তো?"। সবার অবিশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার গলায় আত্মবিশ্বাস নামতে থাকে, তবুও উত্তরটা থাকে একই, "হ্যাঁ, ফিরেতো আসবই"।
সত্যিই, ফিরে আসা হবেতো?
সজল
০৮/০৬/২০১০
মন্তব্য
খুবই চমৎকার লাগলো আপনার লেখা। তবে জিপিএ চার ছুঁই ছুঁই কিভাবে খ্রাপ রেজাল্ট হয় বুঝান।
সেকেন্ড ইয়ারে আমিও একটা ব্যরনস কিনছিলাম। ফোর্থ ইয়ারে আইইউটি ছাড়ার আগে, কেনার পরে বইটা তাকে যেভাবে বইটা কিনে রেখেছিলাম সেভাবেই রেখে এসেছি। তাকাইওও নাই
আবারও বলি, লেখাটা দারুন হয়েছে।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
বেশিরভাগ ব্যারন'স এর কপালে মনে হয় এটাই ঘটে, তবু হাতের কাছে বইটা আছে, চাইলেই পড়া শুরু করে দিতে পারি এটা ভেবে হয়তো সবাই কিনে রাখে।
আর চার ছুঁই ছুঁই রেজাল্টের দেখা একবারই পেয়েছিলাম, এটারে খারাপ বলার সাহস আমি কেম্নে পাই।
লেখা ভাল লাগছে। আশা করি আম্রিকা গিয়ে লেখা লেখিটা ভুলবেন না
আপনার লেখা পড়ে ইউনীতে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রচলিত একটা কথা আছে সেটা মনে পরল, শুধু মাত্র ভাল ছাত্ররাই নিজেদের খারাপ ছাত্র প্রমাণ করার চেষ্টা করে
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
লেখা ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগছে। প্রথম লেখা, একটু ভয়ে ছিলাম।
ছাত্র তো আমি ভালই, রেজাল্টটা একটু ইয়ে আরকি
আর আমার ইউনিতে ভাল ছাত্রদের ভাব হচ্ছে, আমি তো কিছুই পড়লামনা, তাও যে সব কেমনে পারি।
বিনয় না অভিনয় ঠিক বুঝলাম না। যাই হোক দোয়া করছি ভিসাটা হয়ে যাক।
আচ্ছা আপনার ভার্সিটি কোনটা
বেশি লঘুচালে লিখাতে হয়ত বিনয় আর অভিনয় মনে হচ্ছে
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
লেখার হাত ভালো আপনার। হাত-পা খুলে লিখতে থাকেন। সচলায়তনে স্বাগতম।
উৎসাহের জন্য অনেক ধন্যবাদ। দরকার হলে অন্যের হাতপা ধার করে হলেও লিখে যাব
সজল
ভালো লাগলো।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ভালো লাগাতে ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ।
সজল
অনেক কিছুই দেখি মিলে গেলো!
শুধু ৪/১ এর কাহিনী ছাড়া
লেখা ভালো লাগল ।
_________________________________________
ৎ
_________________________________________
ওরে! কত কথা বলে রে!
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
মিলে যাওয়ার কথায় মনে হচ্ছে, আপনার লাইফটা পাইরেটেড ভার্সন। দুর্বল অনুকরণের জন্য পুরাটা মিলে নাই।
সজল
দাদা , লেখাটা ভাল হইছে | চার তলার বারান্দা দিয়ে হাটাচলা করার সময় প্রায় আপনার রুমে চোখ যেত | দেখতাম আপনি হয় মুভি না হয় টিভি সিরিয়াল দেখছেন | আর আপনার র্যাকে সাজানো পাইথনের বইটা অনেক চোখে পড়ত |আমার ভাসিটি লাইফ ২-২ পযন্ত আপনার চেয়েও খারাপ তবে ভাসিটি নিয়ে অনুভূতিগুলো একেবারে মিলে গেছে |
দাদা , আমেরিকায় গিয়ে ভাল থাকবেন আশা করি | এবং আরও বেশি করে লিখতে থাকুন
রিদওয়ান, হলের চারতলাটাকে অনেক মিস করি। আর কিছুটা আফসোস হয়, তোমাদের সাথে আরো ভাল করে মিশা হয়নি বলে। পাইথন শেখার অনেক শখ ছিল, দেখি পরে কোন একদিন। ভালো থেকো, আর যতটা পার, ভার্সিটি লাইফ টা কে এনজয় কর।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
চমৎকার লেখা । ......হুম্ম, ফিরে আসাটা কিন্তু আসলেই কঠিন।
শুভকামনা রইল।
- আসাদ-বাবু
ধন্যবাদ। আর কঠিন কাজটাই করতে চাই।
চমৎকার লাগলো
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
ধন্যবাদ।
লেখা খুব প্রানবন্ত হয়েছে... গুড লাক...
ধন্যবাদ পড়ার জন্য
সজল
নতুন মন্তব্য করুন